বাল্যবিবাহ-প্রয়োজন আইনি সংস্কার by এমএম কবীর মামুন

আমাদের সমাজে হাজার হাজার বছর ধরে চলছে শিশুকালে কন্যাসন্তানের বিবাহ দেওয়ার রীতি। এ সমাজে কন্যাসন্তানকে মনে করা হয় বোঝা। পিতা-মাতার গলার কাঁটা। তাই একে ঠেলে ফেলে দিতে পারলে বা সরিয়ে দিতে পারলে পিতামাতা এক ধরনের স্বস্তিবোধ করেন।


যদিও বিয়ের সময় যতটা স্বস্তিবোধ করেন, বিয়ের দু'চার বছর পর থেকে সেই সাময়িক স্বস্তি চরম অস্বস্তি হয়ে ফিরে আসে বেশিরভাগ সময়। আর এ অবস্থা একজন নারীর জন্য বয়ে নিয়ে আসে চরম অন্ধকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতি কোনোভাবেই নারীর পক্ষে যায় না। আর শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এর ভয়াবহতা অনেক বেশি। আর্থিকভাবে তুলনামূলক সক্ষম ব্যক্তিরা শহরে বাস করার ফলে শহরাঞ্চলে এর ভয়াবহতা গ্রামাঞ্চলের মতো অতটা প্রকট নয়। বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের সংখ্যা তো খুব বেশি নয়। তাই অধিকাংশ মেয়েই শিকার হচ্ছে এই বাল্যবিবাহ নামক সামাজিক ব্যাধির।
বাল্যবিবাহের ওপর বিশ্বব্যাপী পরিচালিত কিছু গবেষণার দিকে দৃষ্টি দিলেই আমরা দেখতে পাই এর ভয়াবহতা বাংলাদেশে কতটুকু। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় (প্রতিবেদন, ইউনিসেফের বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০১১)। এ প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, চীন ছাড়া উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রতি তিনজন মেয়ের মধ্যে একজনের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। তবে বাংলাদেশে এই সংখ্যা তিন ভাগের দুই ভাগ। ইউনিসেফের আরও একটি গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮ বছর বয়সের আগেই যেসব মেয়ের বিয়ে হয় তাদের শতকরা হার ৬৫ ভাগেরও ওপর। অথচ একই বয়সের ছেলেদের বিবাহের শতকরা হার মাত্র ৫ ভাগ। আর সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত অন্য একটি গবেষণায় বাল্যবিবাহের হার দেখা যায়, শতকরা প্রায় ৭০ ভাগের কাছাকাছি। এসব পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ভয়াবহ রূপ।
বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করছে এমন কিছু বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক রীতিনীতি-সংস্কার, কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, সামাজিক চাপ, শিশুকন্যার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, সচেতনতার অভাব প্রভৃতি কারণে এই বাল্যবিবাহের ঘটনাগুলো ঘটছে। এ ছাড়া দেখা যায় খুন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌন নিপীড়ন, যৌন হয়রানি প্রভৃতি কৌশলে নারীর প্রতি যেসব সহিংসতা সমাজে অনবরত ঘটে চলেছে তাতে অভিভাবকরা শঙ্কিত এবং ভোগের চরম নিরাপত্তাহীনতায়। কারণ বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতিতে নারী কোনো অন্যায়-অনাচার-নিপীড়নের শিকার হলে তার জন্য ওই নারীকেই দায়ী করা হয়। তাই কন্যাসন্তানের অভিভাবকদের এই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা অত্যন্ত স্বাভাবিক। অন্যদিকে গ্রামীণ সমাজে কোনো মেয়ের বয়স ১৮-২০ পার হলে তুলনামূলক অধিক যৌতুক ছাড়া তার বিয়ে হবে না। এ ছাড়া বখাটেদের উৎপাত, আকাশ সংস্কৃতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতেও অভিভাবকরা কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এরপর রয়েছে সামাজিক চাপ। মেয়ের বয়স ১৩-১৪ হলেই প্রতিবেশী ও সমাজের মাথাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। চারদিক থেকে চাপ আসতে থাকে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য। যেন এ সমাজে কন্যাসন্তানের পিতা-মাতা হওয়াটা এক ধরনের অভিশাপ। তাই এই শাপ মোচনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে তৈরি হওয়ার আগেই শিশু অথবা কিশোরী অবস্থায় তারা পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হচ্ছে। যার ঘানি টানতে হচ্ছে ওই মেয়েকে একা।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করছে এরকম এনজিওর সংখ্যা বাংলাদেশে খুব কম নয়। বাংলাদেশ সরকারও কাজ করছে এ বিষয়ে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে যারা কাজ করছে তারা প্রায় প্রত্যেকেই বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে থাকে। কিন্তু তবুও কমছে না এ প্রবণতা। সমাজটাকে বাল্যবিবাহের মতো অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে আন্দোলন শুরু হলেও ২০১২ সালে অর্থাৎ একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও আমরা এ সমাজ থেকে এই ব্যাধি দূর করতে পারিনি। কিন্তু কেন? এর কারণ হাতড়িয়ে যেসব বিষয় পাওয়া যায় তার মধ্যে প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯-এর দুর্বলতা। এরপর আরও কিছু কারণকে চিহ্নিত করা যায়। সেগুলো হলো_ বাল্যবিবাহ বিষয়টি একটি সামাজিক সমস্যা, এটা কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নয়। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে থাকলেও তা এতই ক্ষুদ্র যে হিসাবে ধরা যায় না। একই কারণে বাল্যবিবাহ দেওয়ার সময় মেয়ের অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যরা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সহানুভূতি লাভ করে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভোট হারানোর ভয়ে এই ব্যাধি মোকাবেলায় কাজ করতে সাহস করেন না। বরং যেটুকু করতে পারেন সেটি হলো জন্ম-তারিখ পাল্টে দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে আয়োজিত বাল্যবিবাহ আয়োজনে সহায়তা করেন। অনেক ইমাম ও কাজি আইনের প্রতি সম্মান না জানিয়ে বাল্যবিবাহে সহায়তা করে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ শাসনামলের বহু পুরনো এ আইনের বহু দুর্বলতা থাকার ফলেই এগুলো সম্ভব হচ্ছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯-এ শাস্তি অংশে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় বা নিজ ইচ্ছায় ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো শিশু বা নাবালিকা কন্যাকে বিবাহ করে তাহলে সে ব্যক্তি আইনগতভাবে শাস্তি পাবে। শাস্তির পরিমাণ এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড। গুরুতর অপরাধে লঘুদণ্ড সত্যিই হাসির উদ্রেক ঘটায়। ১৯২৯ সালে ধার্য করা এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড এ সময়ে কত টাকা হতে পারে সেটা চিন্তা করলেই এ আইনের সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়। এ আইনে বাল্যবিবাহকে নিষেধ করা হয়েছে কিন্তু অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি। তবে এ আইনের অধীনে বাল্যবিবাহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আইনে যদি বাল্যবিবাহকে অবৈধ ঘোষণা না করা হয় তবে স্বামী কেন শাস্তি পাবে? এরকম নানা প্রশ্ন রয়েছে এ আইনটিকে ঘিরে। আর স্বামী যদি শাস্তি পায়, তবে ভবিষ্যতে এ বিয়ে টিকে থাকবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। বর্তমান সময়ে এসে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ করার সরকারি উদ্যোগ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সমর্থ হলেও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে তা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। সাময়িক প্রতিষেধক দিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন সময়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সঠিক ও যুগোপযোগী আইন।
বাল্যবিবাহ রোধে আজ অনেকেই সচেতন। এটি যে একটি মারাত্মক ব্যাধি এবং তা রোধ করা উচিত তা নিয়ে অনেকে বলিষ্ঠ কণ্ঠ এবং কাজও করে যাচ্ছেন। সরকার, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং সচেতন মহল এই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে। মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। এ সময় দরকার ব্রিটিশ আমলে (১৯২৯ সালে) তৈরি করা বর্তমান আইনের সংশোধনী এনে একটি যুগোপযোগী আইন তৈরি করা। যে আইন বাল্যবিবাহের মতো অপরাধকে শুধু আইনের বলেই রুখে দিতে পারবে। সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং আইন প্রণেতারা এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন এটা এখন সময়ের দাবি।

এমএম কবীর মামুন : উন্নয়নকর্মী
krmamun334@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.