ভারতের নীতিতে পরিবর্তনের সূচনা by হুমায়ুন কবীর
আমাদের বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার ভারত সফর নিয়ে গণমাধ্যম অনেকটা উচ্চকিত, দেশের মানুষও উচ্ছ্বসিত। মানুষের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে যে আমাদের বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক নেই বা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ নেই।
এ ধারণার কারণেই খালেদা জিয়ার ভারত সফর আমাদের কাছে যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি আনন্দের ও সম্ভাবনার। তা ছাড়া তাঁর সফরের সংবাদটা একেবারে হঠাৎ করেই যে ঘটে গেছে, তা কিন্তু নয়।
বর্তমান সফরের একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে আসছিল দেড়-দুই বছর থেকে।
ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন। অবশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও গত বছর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, ভারত সফরের জন্য বলে গেছেন। এ ছাড়া ভারতের রাজনীতির ভেতরে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে বলে আমি মনে করি। তারাও তাদের পূর্ববর্তী অনেক ধারণা বদলানোর চেষ্টা করছে। আমাদের সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে ধারাবাহিকভাবে। এ ধারাবাহিকতার ফল হলো আজকের বিরোধী দলের নেতার ভারত সফর।
দুই-তিন বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, ভারতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে। বাংলাদেশের গুরুত্ব তাদের কাছে বেড়েছে। দেরিতে হলেও ভারতের মানসিকতার এই পরিবর্তন আশাব্যঞ্জক, দুই দেশের জনগণের জন্যই। দুটি দেশ প্রতিবেশী এবং ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও কাছাকাছি। তাই দুটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে পরস্পরের সহযোগিতা অবশ্যই দরকার। এ জন্য ভারতের সঙ্গে বর্তমান সময়ের সুসম্পর্ককে রাজনৈতিকভাবে টেকসই করে তোলাই এ সময়ের দায়িত্ব। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক যেমন ভালো করতে হবে, তেমনি নিরাপত্তার স্বার্থেও কাজে লাগাতে হবে। আসল কথা, আমাদের মধ্যে যেমন ভারত সম্পর্কে ধারণার কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে, ঠিক তাদেরও বাংলাদেশ সম্পর্কে রয়েছে কিছু ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা।
আশা করা যায়, এ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনের পথচলা হবে আস্থাপূর্ণ। আস্থা বৃদ্ধি পেলেই অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। সুসম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ভারতের আন্তরিকতা সত্যিই লক্ষণীয়। তারা আমাদের বিরোধীদলীয় নেতার সফরকে যথার্থ মূল্যায়ন করছে। যেমন গত সোমবারের মধ্যাহ্নভোজে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা আদভানিও। এই যে দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একসঙ্গে বসে কথা বলার পরিবেশ, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বের যেকোনো সংকট-সমস্যা সমাধানের জন্য এই 'ডায়ালগ'-এর কোনো বিকল্প নেই। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা না চলা দুই পক্ষই প্রায় অন্ধকারে থাকার মতো। আর দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক টেকসই স্তরে উন্নীত করতে হলে অবশ্যই সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নও জরুরি।
দেশের স্বার্থে উন্নয়ন ও সহযোগিতা দুই পক্ষেরই প্রত্যাশা। তাই ডায়ালগের মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আশা করব, উভয় পক্ষই দুই দেশের জনগণের স্বার্থে সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে।
নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকতেই হবে, তা ঠিক। কিন্তু মাঝেমধ্যে যে দ্বিমত বা অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি হবে না, তা নয়। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হওয়া মানেই শত্রু হওয়া নয়, এমন একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে হবে। এই ইতিবাচক ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানসিক চর্চার প্রয়োজন। এখন যে নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হতে চলেছে, এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় রাজনীতির মেজাজকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে হলে অবশ্যই দুই দেশের নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, দুই দেশের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক উদ্যোগ সফল হয় না, বাস্তবায়ন হতে হতে বিভিন্ন সমস্যাও আসে। এসব অবশ্যই বিবেচনা করেই কাজ করতে হবে। আর ভারতের কাছে আমরা যে বিষয়টি সব সময় প্রত্যাশা করি তা হলো, বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে চলা। ভারত বড় দেশ বলে কোনো প্রতিবেশী দেশকে অবজ্ঞার অবকাশ যে নেই, দুটি জাতি, দুটি দেশ_এ ক্ষেত্রে বড় ভাইসুলভ আচরণ বাঞ্ছনীয় নয়। আশা করি, ভারতের এ উপলব্ধি হচ্ছে। উভয় দেশ পাশাপাশি বন্ধু দেশ হিসেবে অবস্থান করতে পারে তখনই যখন যে যার মর্যাদা নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারে। আর এটাই ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।
অনুলিখন
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত
বর্তমান সফরের একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে আসছিল দেড়-দুই বছর থেকে।
ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন। অবশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও গত বছর তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, ভারত সফরের জন্য বলে গেছেন। এ ছাড়া ভারতের রাজনীতির ভেতরে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে বলে আমি মনে করি। তারাও তাদের পূর্ববর্তী অনেক ধারণা বদলানোর চেষ্টা করছে। আমাদের সরকারের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গেও সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে ধারাবাহিকভাবে। এ ধারাবাহিকতার ফল হলো আজকের বিরোধী দলের নেতার ভারত সফর।
দুই-তিন বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, ভারতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিবেশী বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে। বাংলাদেশের গুরুত্ব তাদের কাছে বেড়েছে। দেরিতে হলেও ভারতের মানসিকতার এই পরিবর্তন আশাব্যঞ্জক, দুই দেশের জনগণের জন্যই। দুটি দেশ প্রতিবেশী এবং ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও কাছাকাছি। তাই দুটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে পরস্পরের সহযোগিতা অবশ্যই দরকার। এ জন্য ভারতের সঙ্গে বর্তমান সময়ের সুসম্পর্ককে রাজনৈতিকভাবে টেকসই করে তোলাই এ সময়ের দায়িত্ব। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক যেমন ভালো করতে হবে, তেমনি নিরাপত্তার স্বার্থেও কাজে লাগাতে হবে। আসল কথা, আমাদের মধ্যে যেমন ভারত সম্পর্কে ধারণার কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে, ঠিক তাদেরও বাংলাদেশ সম্পর্কে রয়েছে কিছু ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা।
আশা করা যায়, এ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আগামী দিনের পথচলা হবে আস্থাপূর্ণ। আস্থা বৃদ্ধি পেলেই অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। সুসম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ভারতের আন্তরিকতা সত্যিই লক্ষণীয়। তারা আমাদের বিরোধীদলীয় নেতার সফরকে যথার্থ মূল্যায়ন করছে। যেমন গত সোমবারের মধ্যাহ্নভোজে উপস্থিত ছিলেন বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা আদভানিও। এই যে দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একসঙ্গে বসে কথা বলার পরিবেশ, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিশ্বের যেকোনো সংকট-সমস্যা সমাধানের জন্য এই 'ডায়ালগ'-এর কোনো বিকল্প নেই। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা না চলা দুই পক্ষই প্রায় অন্ধকারে থাকার মতো। আর দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক টেকসই স্তরে উন্নীত করতে হলে অবশ্যই সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নও জরুরি।
দেশের স্বার্থে উন্নয়ন ও সহযোগিতা দুই পক্ষেরই প্রত্যাশা। তাই ডায়ালগের মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আশা করব, উভয় পক্ষই দুই দেশের জনগণের স্বার্থে সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে।
নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকতেই হবে, তা ঠিক। কিন্তু মাঝেমধ্যে যে দ্বিমত বা অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি হবে না, তা নয়। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হওয়া মানেই শত্রু হওয়া নয়, এমন একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে হবে। এই ইতিবাচক ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মানসিক চর্চার প্রয়োজন। এখন যে নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি হতে চলেছে, এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় রাজনীতির মেজাজকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে হলে অবশ্যই দুই দেশের নেতাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, দুই দেশের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক উদ্যোগ সফল হয় না, বাস্তবায়ন হতে হতে বিভিন্ন সমস্যাও আসে। এসব অবশ্যই বিবেচনা করেই কাজ করতে হবে। আর ভারতের কাছে আমরা যে বিষয়টি সব সময় প্রত্যাশা করি তা হলো, বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে চলা। ভারত বড় দেশ বলে কোনো প্রতিবেশী দেশকে অবজ্ঞার অবকাশ যে নেই, দুটি জাতি, দুটি দেশ_এ ক্ষেত্রে বড় ভাইসুলভ আচরণ বাঞ্ছনীয় নয়। আশা করি, ভারতের এ উপলব্ধি হচ্ছে। উভয় দেশ পাশাপাশি বন্ধু দেশ হিসেবে অবস্থান করতে পারে তখনই যখন যে যার মর্যাদা নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারে। আর এটাই ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।
অনুলিখন
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত
No comments