পুলিশের পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের লাঠিপেটার গল্প by প্রণব সাহা
মুজিবনগর সরকার থেকে শুরু করে বর্তমান মন্ত্রিসভা পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে ৩২তম নামটি হবে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের। এর আগে যে ৩১ জন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী,
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টারাও ছিলেন।
তালিকার দিকে চোখ বুলালে দেখা যাবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচ এম এরশাদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদ জিয়াও। আর আলোচিত-সমালোচিত মন্ত্রীদের মধ্যে আছেন মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান, আবদুল মতিন চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর এবং হাল আমলের সাহারা খাতুন ও সোহেল তাজ।
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে সাংবাদিকদের জন্য স্পর্শকাতর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড বিষয়টিকে হ্যান্ডেল করতে হচ্ছে। আট মাসের মাথায় এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর পাওয়া গেলেও খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি সাংবাদিক মহল এবং রুনি-সাগরের নিকটাত্মীয়রা। আবার এই অসন্তুষ্টি নিয়ে সাংবাদিক নেতারা যে মন্তব্য করেছেন, তাও ইতিবাচক নয় বলে মনে করেন মহীউদ্দীন আলমগীর নিজেই।
একজন চৌকস আমলা হিসেবে প্রশাসনে তাঁর শক্ত অবস্থানের ইতি ঘটেছিল প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তাই এবার এমপি হওয়ার পর মন্ত্রী না হতে পেরে একটি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ড. আলমগীর। বর্তমান মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে যখন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেন, তখন উত্তরাধিকারসূত্রেই তাঁর কাছে বর্তেছিল সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ফয়সালার গুরুদায়িত্ব। তাই সূচনায়ই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয়েছে এই ঝানু আমলা কাম পলিটিশিয়ানকে। প্রশাসনিক বাংলা পরিভাষা তৈরির ক্ষেত্রেও তাঁর একাগ্রতা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করি। সর্বশেষ যেদিন তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, তার আগের দিন এটিএন নিউজে ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার আগে পাওয়া তথ্য যখন যাচাই করছিলাম, তখনো ফোন করেছিলাম মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। আমি পাওয়া তথ্য সঠিক কি না জানার জন্য প্রশ্ন করলাম_'কাল নাকি শপথ নিচ্ছেন?' বুদ্ধিদীপ্ত জবাব এবং সাংবাদিকদের জন্য কৌশলে যেভাবে বলা দরকার, সেভাবেই বললেন, 'আমি তোমাদের টিভির দিকে তাকিয়ে আছি স্ক্রল দেখার জন্য।'
এমন একজন চৌকস মন্ত্রীর জন্য কিছু পুরনো অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। যখনই পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্য বা বাহিনী হিসেবেই পুলিশের কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের সুনামহানি হয়, তখনই দেখা যায়, পুলিশের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পুলিশের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও এর বিপরীতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদেরই রাজপথে পুলিশের হাতে নির্যাতিত বা নিগৃহীত হতে দেখা গেছে নিকট এবং দূর অতীতেও।
স্বাধীনতার পর এম এ মান্নান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ১২ এপ্রিল ১৯৭২ থেকে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৩ পর্যন্ত। টাঙ্গাইলের এই জননেতা যথেষ্ট বয়স হওয়ার পরও রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে দেশে যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেখেছি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মান্নানকে। পুলিশের একজন হাবিলদার শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে ধাক্কা দেওয়ায় সেই হাবিলদারকে ধমক দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তখনকার প্রেসিডিয়াম সদস্য এম এ মান্নান। ধমক খেয়ে উল্টো প্রবীণ রাজনীতিবিদকেই অপমান করলেন সেই পুলিশ সদস্য।
একজন সজ্জন এবং ঠাণ্ডা মাথার রাজনীতিক হিসেবেই ১৯৯১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আবদুল মতিন চৌধুরী। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর খালেদা জিয়া প্রথমে নিজেই কিছুদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়ে পুরো দায়িত্ব দিয়ে দেন আবদুল মতিন চৌধুরীকে। বড় ধরনের কোনো বিতর্ক ছাড়াই তিনি ১৯৯১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর আমলেই পুলিশ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে ঢুকে একবার বেধড়ক পিটিয়েছিল সাংবাদিকদের। টিয়ার গ্যাসেও আচ্ছন্ন করে দেওয়া হয়েছিল পুরো প্রেসক্লাব। তখনো মতিন চৌধুরী পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন যে পুলিশ নাকি অন্ধকারে সাংবাদিকদের চিনতে পারেননি। এ নিয়ে তখন সিনিয়র জার্নালিস্ট আতাউস সামাদ দুর্দান্ত লেখা লিখেছিলেন মতিন চৌধুরীর সমালোচনা করে। সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রাজপথের আন্দোলনে বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচিতে নিয়মিতই অংশ নিতেন মতিন চৌধুরী। তেমনই একটি কর্মসূচিতে রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের সামনে অংশ নেওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে মতিন চৌধুরীর মাথা ফেটে যায়। তাঁর এই ছবি তখনকার পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল গুরুত্বের সঙ্গে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মোহাম্মদ নাসিমকে স্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ১২ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্বে থাকার সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীদের দমনে সাফল্য দেখিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতায় এটা করতে পেরে খুশি হয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলতেন 'আমার পুলিশ'। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর আবার রাজপথে নেমে পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। যতই পুলিশের জন্য করুন না কেন, পুলিশই তাঁকে আঘাত করতে দ্বিধা করেননি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
আর বিএনপির দ্বিতীয়বারে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী প্রথমে মন্ত্রী হিসেবে এবং পরে লুৎফুজ্জামান বাবর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি সরকারের শেষ দুই সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালাতে গিয়ে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জজ মিয়ার গল্প এবং চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার খেসারত এখনো দিয়ে যাচ্ছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী বাবর। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীও জেল খেটেছেন ।
এ তো গেল হালজমানার খবর। আর ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের জাঁদরেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানকেও প্রেসক্লাবের সামনে ১৯৯২ সালে পুলিশের হাতে নাজেহাল হতে দেখেছি। দেশের জাতীয় চার নেতার দুজন মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলী তো গুলিতে নিহত হয়েছেন কেন্দ্রীয় কারাগারে। যে কারাগারের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই।
গত কিছুদিন আগেও পুলিশের কিছু অন্যায় কাজের পক্ষে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনও আগ বাড়িয়ে সাফাই গেয়েছেন। আইনজীবী সাহারা খাতুন রাজপথের একজন সংগ্রামী কর্মী এবং নিজের সহকর্মীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো তাঁর পোড় খাওয়া রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন করেই তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভালো-মন্দ মিলিয়েই ছিল তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পরিচালনা। ভয় হয় হরতালে রাজপথে সব সময় সক্রিয় থাকা সাহারা খাতুনকে না আবার ভবিষ্যতে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হতে দেখতে হয়। এখন পুলিশ চালাচ্ছেন মহীউদ্দীন আলমগীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়, ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তারপর ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে, পুলিশি রিমান্ডের অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। আমরা আশা করতেই পারি, তিনি এবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এমনভাবে পরিচালনা করবেন, যাতে ভবিষ্যতে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে না হয় কোনো রাজনীতিককে। আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের পুলিশ যেন একটু সমীহ করে সেই নিয়ম-বিধিমালাও যেন তিনি সূচনা করেন, সেই প্রত্যাশায় সাফল্য কামনা করছি নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
লেখক : এডিটর, আউটপুট, এটিএন নিউজ, pranab67@gmail.com
তালিকার দিকে চোখ বুলালে দেখা যাবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচ এম এরশাদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদ জিয়াও। আর আলোচিত-সমালোচিত মন্ত্রীদের মধ্যে আছেন মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান, আবদুল মতিন চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর এবং হাল আমলের সাহারা খাতুন ও সোহেল তাজ।
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে সাংবাদিকদের জন্য স্পর্শকাতর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড বিষয়টিকে হ্যান্ডেল করতে হচ্ছে। আট মাসের মাথায় এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর পাওয়া গেলেও খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি সাংবাদিক মহল এবং রুনি-সাগরের নিকটাত্মীয়রা। আবার এই অসন্তুষ্টি নিয়ে সাংবাদিক নেতারা যে মন্তব্য করেছেন, তাও ইতিবাচক নয় বলে মনে করেন মহীউদ্দীন আলমগীর নিজেই।
একজন চৌকস আমলা হিসেবে প্রশাসনে তাঁর শক্ত অবস্থানের ইতি ঘটেছিল প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। তাই এবার এমপি হওয়ার পর মন্ত্রী না হতে পেরে একটি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ড. আলমগীর। বর্তমান মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে যখন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেন, তখন উত্তরাধিকারসূত্রেই তাঁর কাছে বর্তেছিল সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ফয়সালার গুরুদায়িত্ব। তাই সূচনায়ই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হয়েছে এই ঝানু আমলা কাম পলিটিশিয়ানকে। প্রশাসনিক বাংলা পরিভাষা তৈরির ক্ষেত্রেও তাঁর একাগ্রতা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করি। সর্বশেষ যেদিন তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, তার আগের দিন এটিএন নিউজে ব্রেকিং নিউজ দেওয়ার আগে পাওয়া তথ্য যখন যাচাই করছিলাম, তখনো ফোন করেছিলাম মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে। আমি পাওয়া তথ্য সঠিক কি না জানার জন্য প্রশ্ন করলাম_'কাল নাকি শপথ নিচ্ছেন?' বুদ্ধিদীপ্ত জবাব এবং সাংবাদিকদের জন্য কৌশলে যেভাবে বলা দরকার, সেভাবেই বললেন, 'আমি তোমাদের টিভির দিকে তাকিয়ে আছি স্ক্রল দেখার জন্য।'
এমন একজন চৌকস মন্ত্রীর জন্য কিছু পুরনো অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। যখনই পুলিশ বাহিনীর কোনো সদস্য বা বাহিনী হিসেবেই পুলিশের কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের সুনামহানি হয়, তখনই দেখা যায়, পুলিশের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পুলিশের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও এর বিপরীতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদেরই রাজপথে পুলিশের হাতে নির্যাতিত বা নিগৃহীত হতে দেখা গেছে নিকট এবং দূর অতীতেও।
স্বাধীনতার পর এম এ মান্নান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ১২ এপ্রিল ১৯৭২ থেকে ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৩ পর্যন্ত। টাঙ্গাইলের এই জননেতা যথেষ্ট বয়স হওয়ার পরও রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে দেশে যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেখেছি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মান্নানকে। পুলিশের একজন হাবিলদার শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে ধাক্কা দেওয়ায় সেই হাবিলদারকে ধমক দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তখনকার প্রেসিডিয়াম সদস্য এম এ মান্নান। ধমক খেয়ে উল্টো প্রবীণ রাজনীতিবিদকেই অপমান করলেন সেই পুলিশ সদস্য।
একজন সজ্জন এবং ঠাণ্ডা মাথার রাজনীতিক হিসেবেই ১৯৯১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আবদুল মতিন চৌধুরী। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর খালেদা জিয়া প্রথমে নিজেই কিছুদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়ে পুরো দায়িত্ব দিয়ে দেন আবদুল মতিন চৌধুরীকে। বড় ধরনের কোনো বিতর্ক ছাড়াই তিনি ১৯৯১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর আমলেই পুলিশ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে ঢুকে একবার বেধড়ক পিটিয়েছিল সাংবাদিকদের। টিয়ার গ্যাসেও আচ্ছন্ন করে দেওয়া হয়েছিল পুরো প্রেসক্লাব। তখনো মতিন চৌধুরী পুলিশের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন যে পুলিশ নাকি অন্ধকারে সাংবাদিকদের চিনতে পারেননি। এ নিয়ে তখন সিনিয়র জার্নালিস্ট আতাউস সামাদ দুর্দান্ত লেখা লিখেছিলেন মতিন চৌধুরীর সমালোচনা করে। সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রাজপথের আন্দোলনে বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচিতে নিয়মিতই অংশ নিতেন মতিন চৌধুরী। তেমনই একটি কর্মসূচিতে রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের সামনে অংশ নেওয়ার সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে মতিন চৌধুরীর মাথা ফেটে যায়। তাঁর এই ছবি তখনকার পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল গুরুত্বের সঙ্গে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পর তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মোহাম্মদ নাসিমকে স্বরাষ্ট্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালের ১২ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ১৬ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্বে থাকার সময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীদের দমনে সাফল্য দেখিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতায় এটা করতে পেরে খুশি হয়ে মোহাম্মদ নাসিম বলতেন 'আমার পুলিশ'। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর আবার রাজপথে নেমে পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। যতই পুলিশের জন্য করুন না কেন, পুলিশই তাঁকে আঘাত করতে দ্বিধা করেননি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
আর বিএনপির দ্বিতীয়বারে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী প্রথমে মন্ত্রী হিসেবে এবং পরে লুৎফুজ্জামান বাবর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালিয়েছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি সরকারের শেষ দুই সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালাতে গিয়ে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জজ মিয়ার গল্প এবং চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার খেসারত এখনো দিয়ে যাচ্ছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী বাবর। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীও জেল খেটেছেন ।
এ তো গেল হালজমানার খবর। আর ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের জাঁদরেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানকেও প্রেসক্লাবের সামনে ১৯৯২ সালে পুলিশের হাতে নাজেহাল হতে দেখেছি। দেশের জাতীয় চার নেতার দুজন মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলী তো গুলিতে নিহত হয়েছেন কেন্দ্রীয় কারাগারে। যে কারাগারের দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই।
গত কিছুদিন আগেও পুলিশের কিছু অন্যায় কাজের পক্ষে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনও আগ বাড়িয়ে সাফাই গেয়েছেন। আইনজীবী সাহারা খাতুন রাজপথের একজন সংগ্রামী কর্মী এবং নিজের সহকর্মীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো তাঁর পোড় খাওয়া রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন করেই তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভালো-মন্দ মিলিয়েই ছিল তাঁর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পরিচালনা। ভয় হয় হরতালে রাজপথে সব সময় সক্রিয় থাকা সাহারা খাতুনকে না আবার ভবিষ্যতে পুলিশের হাতে নিগৃহীত হতে দেখতে হয়। এখন পুলিশ চালাচ্ছেন মহীউদ্দীন আলমগীর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়, ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তারপর ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে, পুলিশি রিমান্ডের অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। আমরা আশা করতেই পারি, তিনি এবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এমনভাবে পরিচালনা করবেন, যাতে ভবিষ্যতে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে না হয় কোনো রাজনীতিককে। আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের পুলিশ যেন একটু সমীহ করে সেই নিয়ম-বিধিমালাও যেন তিনি সূচনা করেন, সেই প্রত্যাশায় সাফল্য কামনা করছি নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।
লেখক : এডিটর, আউটপুট, এটিএন নিউজ, pranab67@gmail.com
No comments