নই বৌদ্ধ খ্রিস্টান হিন্দু মুসলমান, আমি মানবসন্তান by শাহজাহান মিয়া
আমার লেখার শিরোনামটি দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, লেখক ভদ্রলোক তো মনে হয় মুসলমান! আর আমাদের সমাজের কিছু লোক যাঁরা আমাকে ভালো করে চেনেন-জানেন তাঁরা হয়তো মনে করতে পারেন, শাহজাহান মিয়া এমন লিখতেই পারেন।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যা লিখেছেন, ঠিকই লিখেছেন। তাই পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে আশ্বস্ত করেই বলতে চাই যে ধর্মপ্রাণ মুসলমান মা-বাবার ঘরে জন্মগ্রহণ করার সুবাদে আমি অবশ্যই মুসলমান। একজন খাঁটি মুসলমান এবং বাঙালি। বাচ্চা বয়সে না বুঝেই গ্রামের মৌলভি সাহেবের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আরবি ভাষায় পবিত্র কোরআন শরীফ সুর করে জোরে জোরে একবার পুরোটা পড়া শেষ করেছিলাম বা খতম দিয়েছিলাম। গত প্রায় ২০ বছরে কমপক্ষে পাঁচবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পাদটীকাসহ বুঝে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত পবিত্র গ্রন্থটির বাংলা ভাষায় অনূদিত সংখ্যাটি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাই মনটা কেঁদে ওঠে। হাহাকার করে। যাঁরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি পড়েছেন, তাঁরা সবাই জানেন, জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে আল্লাহর তরফ থেকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে প্রেরিত শান্তির ধর্ম ইসলামের মর্মবাণী ও শিক্ষা কী। সব ধর্মের মর্মকথাই শান্তি। সব ধর্মই শান্তির কথা বলে ও প্রচার করে। জন্মগ্রহণ করার সুবাদেই মূলত মানুষের ধর্মীয় পরিচয়টি নির্ণীত বা নির্ধারিত হয়ে থাকে। নিজের কথাই বলছি। যেমন আমার জন্মও তো অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীর পরিবারে হতে পারত। তাহলে হয়তো আমাকে ওই ধর্মের আচার-আচরণ-অনুশাসনের প্রতিই অনুগত থাকতে হতো। বিধি-বিধান মেনে চলতে হতো। সব রকম অপকর্ম-অনাচার, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে একটি পবিত্র-পরিশুদ্ধ জীবন পালন করাই ধর্মের মর্মকথা। যে ধর্মাবলম্বী পরিবারেই কারো জন্ম হোক না কেন, সে একজন মানুষরূপেই জন্মলাভ করে। তাই সর্বপ্রথম আমি মানুষের ঘরে জন্মগ্রহণকারী একজন মানবসন্তান। সমাজের মুরবি্বরাও অনেক সময় ভদ্র বা ভালো হওয়া অর্থে বা কাউকে উপদেশ দেওয়ার সুরেও বলে থাকেন, 'মানুষ হ'। কারণ মানুষরূপী জীবগুলোই মাঝেমধ্যে পশুর মতো আচরণ করে থাকে। পশুর চেয়েও খারাপ হয়ে যায়। পাশবিক হয়ে যায়। পশুর মধ্যে আল্লাহ বিচারশক্তির ক্ষমতাটি দেননি। কিন্তু মানুষকে দিয়েছেন। আর তাই আমরা মানুষ। এই বিচারশক্তি-বোধ হারিয়ে আমরা মানুষ নামের কলঙ্ক হয়ে যাই বলেই আমাদের পশুর সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। পাঠক, ক্ষমা করবেন। আমার মন ক্ষত-বিক্ষত। তাই আবোল-তাবোল বলে এতক্ষণ আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটালাম। কারণ সম্প্রতি রামুতে যে পৈশাচিক ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তা কোনো প্রকৃত মানুষের কাজ হতে পারে না। মানুষরূপী পশুরাই এমন কাজ করতে পারে। কক্সবাজারের রামু, টেকনাফ ও উখিয়া এবং চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় গত ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ ও তাঁদের শত শত বছরের পুরনো পবিত্র উপাসনালয়ের ওপর যে নজিরবিহীন নারকীয় তাণ্ডবলীলা চালানো হয়েছে, সে সম্পর্কে এই পত্রিকার বহুল প্রচারিত সহযোগী প্রকাশনা বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ ৬ অক্টোবর আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওই নিবন্ধে আমি সাধ্যমতো লেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার আত্মা তৃপ্ত হয়নি। তাই আমার এই প্রয়াস। গত দুই সপ্তাহে অনেক নতুন তথ্যও বেরিয়ে এসেছে। ওই পৈশাচিক উন্মত্ততার জোর প্রতিবাদ জানাতেই আবার কলম ধরা। মনে করেছিলাম, রামুতে গিয়ে সরেজমিন প্রত্যক্ষ করে ঘটনা সম্পর্কে বিশদ লিখব। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দুজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তা আর হয়নি। ইতিমধ্যে ঘটনা সম্পর্কে গণমাধ্যমে নানা ধরনের কথা উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও শিল্পমন্ত্রী দীলিপ বড়ুয়া ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের মতো করে বক্তব্যও দিয়েছেন। রামুর ধ্বংসলীলা দেখে প্রধানমন্ত্রী অনেকটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। বসতবাড়ি মেরামতের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে টাকা বিতরণ করেছেন। তাদের মনে প্রয়োজনীয় সাহস জুগিয়েছেন। রামু, উখিয়া ও টেকনাফের ক্ষতিগ্রস্ত ১৭ বিহার-মন্দিরের জন্য ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে দলের একটি তদন্ত কমিটি রামুর ঘটনা তদন্ত করে একটি রিপোর্টও জনসমক্ষে তুলে ধরেছে। পরে দীর্ঘ ৬৭ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টের একটি কপি বাংলাদেশে অবস্থানরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
কথায় কথায় আইনের শাসন ও মানবাধিকারের কথা বলা হলেও সারা বিশ্বের কয়টি দেশে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটিই বড় প্রশ্ন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে। আর তাই যদি করা যেত তাহলে দেশে দেশে মানুষের এত প্রাণহানি ঘটত না। এত রক্তপাত হতো না। এরই মধ্যে হিংস্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। এ গোষ্ঠী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অনেক দেশে শান্তি ও উন্নয়ন বিপদাপন্ন করে তুলেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থির করে তোলা আমাদের দেশে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর ঘৃণ্য রাজনৈতিক কৌশল। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এ দেশের জামায়াতপন্থীদের সম্পর্ক বহু পুরনো। রোহিঙ্গাদের কল্যাণ তাদের কাম্য নয়। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ওদের ব্যবহার করে ফায়দা লোটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে সুসম্পর্ক। জাপান বাংলাদেশের একটি বড় দাতা দেশ। জাপান ছাড়াও চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করাও এই চক্রটির উদ্দেশ্য। নির্বাচন সামনে রেখে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করাও তাদের টার্গেট। যাতে করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজেও বিঘ্ন সৃষ্টি করা যায়। হুজি আরকান, লস্কর-ই-তৈয়বা ও জঈশ-ই-মোহাম্মদসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন রামুর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই খুবই তৎপর হয়ে ওঠে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক থেকেই আইএসআই এই ভূখণ্ডে আসা রোহিঙ্গাদের জঙ্গি বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। একটি বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য যে একটি সংঘবদ্ধ চক্র সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার চেষ্টায় এখনো সক্রিয়। সহজলভ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে তারা এ কাজটি খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে পারছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মাত্র কয়েক দিন আগে একটি গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে মিয়ানমারে অবস্থিত ৮০০ বছরের পুরনো একটি বড় মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ আগুন লাগানো দূরের কথা, মসজিদটিতে কোনো ধরনের হামলাও হয়নি। অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে রামুতে সংঘটিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কোনো মসজিদে হামলা হয়নি বলে জানিয়ে দেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাবোধ জাগিয়েছিলেন। কিন্তু ঘাতকের দল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই মহান নেতাকে হত্যার পর এ দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি সহস্র ফণা তুলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। দেশের ভেতর সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সব তছনছ করে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিই তাদের উদ্দেশ্য।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে রোহিঙ্গারা এ দেশে আসে। সীমান্তবর্তী কক্সবাজার শরণার্থী শিবির ও অন্য আরো অনেক জায়গায় তারা বসবাস করছে। কক্সবাজার জেলা এখন তাদের অপকর্মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও মদদে তারা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। রামু ও উখিয়ার সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ সেই কঠিন সত্যটিই সামনে নিয়ে এসেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার ও আলবদরের অনেক সদস্য পালিয়ে মিয়ানমার গিয়ে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের আতিথেয়তা লাভ করেছিল। তাই এ দেশের মৌলবাদীদের সঙ্গে তাদের সখ্য বেশ পুরনো। শরণার্থী হয়ে ঢুকে এ দেশের মানুষের শান্তি বিনষ্টকারীদের হালকাভাবে দেখার আর কোনো সুযোগ নেই।
সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর বর্বর হামলায় একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। কৌশলে তারা বিএনপি-আওয়ামী লীগের দু-একজন নেতা-কর্মীসহ অন্য দলের নেতা-কর্মীদেরও ব্যবহার করে। এই তাণ্ডব চালাতে টাকা-পয়সার জোগান দেয় রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরএসওসহ কয়েকটি এনজিও। ঘটনা সম্পর্কে আগাম খবর পেলেও স্থানীয় প্রশাসন তাতে গুরুত্ব দেয়নি। পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল মারাত্মক সমন্বয়হীনতা। গোয়েন্দারা ছিলেন হাত গুটিয়ে। হামলায় জড়িত দুই শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামে সংঘটিত আট খুনের মামলার অন্যতম আসামি দুর্ধর্ষ সাবেক শিবির ক্যাডার ও বর্তমানে জামায়াত নেতা তোফাইল আহমদের নাম। তোফাইল আহমদ এখন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান। সে ভয়ংকর হত্যা মামলার আসামি হয়েও খালাস পেয়ে যায়। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে বৌদ্ধ যুবক উত্তমের ফেসবুকে সংযুক্ত করা ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটিই মূল কারণ নয়। ছবিটি সংযুক্ত করার সংবাদ প্রকাশ পায় ১৮ সেপ্টেম্বর। হামলার ঘটনা ঘটে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। গণ্ডগোল সৃষ্টির জন্যই ছবিটি ট্যাগ করা হয়েছিল। আর এই সুপরিকল্পিত নীলনকশার পেছনে ছিল তোফাইল আহমদ। বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে ছবি সংযুক্ত করার অভিযোগে তোফাইল আহমদের ভায়রার ছেলে আটক মুক্তাদিরের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। হামলায় লোক সমাগম বেশি করার লক্ষ্যেই রামুর সাপ্তাহিক হাটের দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তি ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে বসবাস করে আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহিমায় উজ্জ্বল এক দেশ বলেই এত দিন বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত ছিল। মানুষ নামধারী বিকৃতমনা কিছু লোকের পৈশাচিক বর্বরতা আমাদের সেই সুমহান ও গৌরবোজ্জ্বল পরিচয় ভূলুণ্ঠিত করেছে। এই নরপিশাচরা বসে থাকবে না। সুযোগ পেলেই ওরা আবার ছোবল মারবে। দেশের মান রক্ষার্থে ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, সরকার ও প্রশাসন_সবাইকে একযোগে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে মানুষ মানুষের জন্য। দেখাতে হবে মানবতাই আমাদের আদর্শ। যার যার ধর্মের মহিমা বজায় রেখে মানবসন্তান হিসেবে আমরা আসলেই মানুষ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
কথায় কথায় আইনের শাসন ও মানবাধিকারের কথা বলা হলেও সারা বিশ্বের কয়টি দেশে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটিই বড় প্রশ্ন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে। আর তাই যদি করা যেত তাহলে দেশে দেশে মানুষের এত প্রাণহানি ঘটত না। এত রক্তপাত হতো না। এরই মধ্যে হিংস্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। এ গোষ্ঠী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অনেক দেশে শান্তি ও উন্নয়ন বিপদাপন্ন করে তুলেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থির করে তোলা আমাদের দেশে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর ঘৃণ্য রাজনৈতিক কৌশল। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এ দেশের জামায়াতপন্থীদের সম্পর্ক বহু পুরনো। রোহিঙ্গাদের কল্যাণ তাদের কাম্য নয়। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ওদের ব্যবহার করে ফায়দা লোটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে সুসম্পর্ক। জাপান বাংলাদেশের একটি বড় দাতা দেশ। জাপান ছাড়াও চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করাও এই চক্রটির উদ্দেশ্য। নির্বাচন সামনে রেখে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করাও তাদের টার্গেট। যাতে করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজেও বিঘ্ন সৃষ্টি করা যায়। হুজি আরকান, লস্কর-ই-তৈয়বা ও জঈশ-ই-মোহাম্মদসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন রামুর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই খুবই তৎপর হয়ে ওঠে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক থেকেই আইএসআই এই ভূখণ্ডে আসা রোহিঙ্গাদের জঙ্গি বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। একটি বিষয় খুবই প্রণিধানযোগ্য যে একটি সংঘবদ্ধ চক্র সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার চেষ্টায় এখনো সক্রিয়। সহজলভ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বদৌলতে তারা এ কাজটি খুব দ্রুত সম্পন্ন করতে পারছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মাত্র কয়েক দিন আগে একটি গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে মিয়ানমারে অবস্থিত ৮০০ বছরের পুরনো একটি বড় মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ আগুন লাগানো দূরের কথা, মসজিদটিতে কোনো ধরনের হামলাও হয়নি। অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে রামুতে সংঘটিত ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে কোনো মসজিদে হামলা হয়নি বলে জানিয়ে দেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাবোধ জাগিয়েছিলেন। কিন্তু ঘাতকের দল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই মহান নেতাকে হত্যার পর এ দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি সহস্র ফণা তুলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। দেশের ভেতর সাম্প্রদায়িক অপশক্তি এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। সব তছনছ করে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিই তাদের উদ্দেশ্য।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সরকারের আমলে রোহিঙ্গারা এ দেশে আসে। সীমান্তবর্তী কক্সবাজার শরণার্থী শিবির ও অন্য আরো অনেক জায়গায় তারা বসবাস করছে। কক্সবাজার জেলা এখন তাদের অপকর্মের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও মদদে তারা এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। রামু ও উখিয়ার সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ সেই কঠিন সত্যটিই সামনে নিয়ে এসেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার ও আলবদরের অনেক সদস্য পালিয়ে মিয়ানমার গিয়ে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের আতিথেয়তা লাভ করেছিল। তাই এ দেশের মৌলবাদীদের সঙ্গে তাদের সখ্য বেশ পুরনো। শরণার্থী হয়ে ঢুকে এ দেশের মানুষের শান্তি বিনষ্টকারীদের হালকাভাবে দেখার আর কোনো সুযোগ নেই।
সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ওপর বর্বর হামলায় একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। কৌশলে তারা বিএনপি-আওয়ামী লীগের দু-একজন নেতা-কর্মীসহ অন্য দলের নেতা-কর্মীদেরও ব্যবহার করে। এই তাণ্ডব চালাতে টাকা-পয়সার জোগান দেয় রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরএসওসহ কয়েকটি এনজিও। ঘটনা সম্পর্কে আগাম খবর পেলেও স্থানীয় প্রশাসন তাতে গুরুত্ব দেয়নি। পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল মারাত্মক সমন্বয়হীনতা। গোয়েন্দারা ছিলেন হাত গুটিয়ে। হামলায় জড়িত দুই শতাধিক ব্যক্তির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামে সংঘটিত আট খুনের মামলার অন্যতম আসামি দুর্ধর্ষ সাবেক শিবির ক্যাডার ও বর্তমানে জামায়াত নেতা তোফাইল আহমদের নাম। তোফাইল আহমদ এখন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান। সে ভয়ংকর হত্যা মামলার আসামি হয়েও খালাস পেয়ে যায়। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে বৌদ্ধ যুবক উত্তমের ফেসবুকে সংযুক্ত করা ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটিই মূল কারণ নয়। ছবিটি সংযুক্ত করার সংবাদ প্রকাশ পায় ১৮ সেপ্টেম্বর। হামলার ঘটনা ঘটে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে। গণ্ডগোল সৃষ্টির জন্যই ছবিটি ট্যাগ করা হয়েছিল। আর এই সুপরিকল্পিত নীলনকশার পেছনে ছিল তোফাইল আহমদ। বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে ছবি সংযুক্ত করার অভিযোগে তোফাইল আহমদের ভায়রার ছেলে আটক মুক্তাদিরের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। হামলায় লোক সমাগম বেশি করার লক্ষ্যেই রামুর সাপ্তাহিক হাটের দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তি ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে বসবাস করে আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহিমায় উজ্জ্বল এক দেশ বলেই এত দিন বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত ছিল। মানুষ নামধারী বিকৃতমনা কিছু লোকের পৈশাচিক বর্বরতা আমাদের সেই সুমহান ও গৌরবোজ্জ্বল পরিচয় ভূলুণ্ঠিত করেছে। এই নরপিশাচরা বসে থাকবে না। সুযোগ পেলেই ওরা আবার ছোবল মারবে। দেশের মান রক্ষার্থে ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, সরকার ও প্রশাসন_সবাইকে একযোগে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে মানুষ মানুষের জন্য। দেখাতে হবে মানবতাই আমাদের আদর্শ। যার যার ধর্মের মহিমা বজায় রেখে মানবসন্তান হিসেবে আমরা আসলেই মানুষ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments