সময়চিত্র- ‘অধিক’ গণতন্ত্র: মালদ্বীপ মডেল by আসিফ নজরুল

৫ আগস্ট মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে পা রাখামাত্র রানার সঙ্গে পরিচয়। তিনি মালদ্বীপ বিএনপির সহসভাপতি। মালদ্বীপে মাত্র গত মাসে এসেছিলেন বিএনপির একজন তরুণ নেতা। মালদ্বীপের বাংলাদেশিদের আমন্ত্রণে সপরিবারে ভ্রমণ শেষে তিনি একটি কাগজে লিখে কমিটি গঠন করে দিয়ে গিয়েছেন।


মালদ্বীপ বিএনপি যদি থাকে, তাহলে মালদ্বীপ আওয়ামী লীগও থাকার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ছোট ছোট আরও কিছু দলও আছে মালদ্বীপে!
মালদ্বীপে বাংলাদেশির সংখ্যা ৫০ থেকে ৮০ হাজারের মধ্যে। সরকারি হিসাবে কম, বেসরকারি হিসাবে বেশি। কিন্তু সাড়ে তিন হাজার দ্বীপের (এর মধ্যে লোকজন বসবাস করে মাত্র শ তিনেক দ্বীপে) মাত্র সাড়ে তিন লাখ লোকের দেশ মালদ্বীপে যদি ৫০ হাজার বাংলাদেশিও থাকেন, তাহলে তা অনেক বেশি বলা যায়। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তাঁরা প্রায় কেউই মালদ্বীপের নাগরিক হতে পারেননি। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে কেবল সুন্নি মুসলমানরা মালদ্বীপের নাগরিক হতে পারেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মালদ্বীপ ভিনদেশিদের নাগরিকত্ব দেয় না বললেই চলে। সেখানকার বহু বাংলাদেশির অবস্থা আরও করুণ। নাগরিকত্ব দূরের কথা, দালালদের খপ্পরে পড়ে অবৈধ, এমনকি কেউ কেউ মানবেতর বেকারজীবনও কাটাচ্ছেন সেখানে।
মালদ্বীপে আসলে আমরা বাংলাদেশিদের খোঁজ নিতে যাইনি। আমরা মানে আমি, ড. কামাল হোসেন, পাকিস্তানের স্বনামধন্য আইনজীবী হিনা জিলানি এবং ভারতের হিমাচল রাজ্যের সাবেক প্রধান বিচারপতি লীলা শেঠ। হিনা জিলানি সাউথ এশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটসের (সাহার) প্রধান। সাহারের সিদ্ধান্ত অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের চার দিনের এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল, মালদ্বীপে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণ অনুসন্ধান এবং সুপারিশসংবলিত একটি রিপোর্ট তৈরি করা।

দুই.
মালদ্বীপে রাজনৈতিক বিতর্কের যিনি মধ্যমণি, সেই মোহামেদ নাশিদকে তাঁর সমর্থকেরা আদর করে ডাকে আন্নি নামে। আন্নি মালদ্বীপের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে মালদ্বীপে চলছিল প্রায় ৪০ বছরের মামুন আবদুল গাইয়ুমের শাসনকাল। এর অবসানে মাত্র ৩৮ বছরের নাশিদ মালদ্বীপ রিপাবলিকের যাত্রা শুরু করেন মালদ্বীপের জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা সঙ্গে নিয়ে। অথচ মেয়াদ পূর্তির আগেই তাঁর পতন ঘটে কিছুসংখ্যক পুলিশের বিদ্রোহের কারণে! প্রথমে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে এটিই বলা হয় যে ৬ ফেব্রুয়ারি কিছু পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দিলে নাশিদ পরের দিন পদত্যাগ করেন। ২৪ ঘণ্টা পর নাশিদ নিজে আবার সাংবাদিকদের জানান, তিনি ইচ্ছা করে পদত্যাগ করেননি। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়েছে। কাজেই তিনি এখন চান দ্রুত নির্বাচন। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনেরা বলছেন, সংবিধান অনুসারে ২০১৩ সালের জুলাইয়ের আগে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই। মাত্র বছর খানেক আগে পরের এই নির্বাচন নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে দুই পক্ষ। আমরা মালদ্বীপে থাকাকালীন দেখলাম, প্রতি রাত (জি, প্রতি রাতেই!) ১০টায় মালেতে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল করে সড়ক প্রদক্ষিণ করছে নাশিদের দল। আর প্রতিদিন গাইয়ুমপন্থী ও নাশিদবিরোধীরা পরিকল্পনা করছেন, কীভাবে নাশিদকে মামলায় ফেলে শাস্তি দিয়ে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা যায়!
মালদ্বীপে দুই পক্ষের বিরোধের এটি কারণ নয়, এটি উপসর্গ মাত্র। আসল কারণ নিহিত মালদ্বীপের শাসনতন্ত্রে, শাসনতন্ত্রপ্রদত্ত অবাধ ক্ষমতা আর গণতন্ত্রের নামে সব মহলের কম-বেশি স্বেচ্ছাচারিতায়। মালদ্বীপের সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকারসংক্রান্ত অনুচ্ছেদের সংখ্যাই ৫৩টি (ভারতে ২৩টি, বাংলাদেশে ২১টি), সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই নয়টি (ভারতে ও বাংলাদেশে চার)! মালদ্বীপে উচ্চ আদালতের তো বটেই, এমনকি নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি থেকে অপসারণের কোনো ক্ষমতা নেই সরকারের। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের তদন্তে গুরুতর অসদাচরণ প্রমাণিত হলে এবং তারপর পার্লামেন্টের মোট সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অপসারিত না হলে যেকোনো বিচারকের চাকরির মেয়াদ সেখানে ৭০ বছর পর্যন্ত! আপাতদৃষ্টিতে অতিশয় ইতিবাচক এসব বিধানই মালদ্বীপে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ডেকে আনে একপর্যায়ে। গণতন্ত্র অনুশীলনে অপ্রস্তুত এবং পশ্চাৎপদ একটি জাতি সময়ের চেয়ে বহুগুণে এগোনো একটি সংবিধান নিয়ে যে বিপদে পড়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর!

তিন.
মালদ্বীপের সুলতানের শাসনের অবসানের পর মামুন আবদুল গাইয়ুম একনায়কের মতো দেশ চালিয়েছেন। কার্যত তিনি মালদ্বীপের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, সেনাপ্রধান, বিচার বিভাগের প্রধান এমনকি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা—সব ক্ষমতা ভোগ করেছেন এককভাবে। মালদ্বীপে কোনো ঔপনিবেশিক শাসন কখনো ছিল না বলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো আইন ও শাসনব্যবস্থাও প্রচলিত হয়নি সেখানে। প্রথমে সুলতানেরা ও পরে গাইয়ুমের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল লোকজ বিচার ও শাসনব্যবস্থা—যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানই ছিলেন মুখ্য, প্রতিষ্ঠান বা নাগরিকেরা নন।
অবশ্য কম্যুনিজম পতনের পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী নতুন রিপাবলিকদের উত্থানের ঢেউ লাগে মালদ্বীপেও। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে সূচিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একপর্যায়ে ২০০৩ সালে জেলখানায় মানবাধিকারকর্মী এভান নাসিমসহ চারজন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে গাইয়ুমবিরোধী আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। চতুর গাইয়ুম আন্দোলনকে প্রশমিত করতে ২০০৪ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেন, ২০০৬ সালে গণতন্ত্রের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন, ২০০৮ সালে নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন এবং এর অধীনে পাঁচ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। সমস্যা হচ্ছে, তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও রাজনীতির কলকাঠি নাড়া থেকে বিরত থাকেননি। তা ছাড়া গাইয়ুমের মতো সুদীর্ঘকালীন একনায়কতন্ত্রের সুবিধাভোগী ও অংশীদারি যে বিশাল চক্র গড়ে ওঠে, সংস্কারের পথে তারা সব সময়ই পরে প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে। এই সমস্যায় আরব বসন্তময় মধ্যপ্রাচ্যের সব কটি দেশ এখন ভুগছে, মালদ্বীপ তা অনুধাবন করতে শুরু করে আরও আগে, প্রেসিডেন্ট নাশিদ নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই।

চার.
নাশিদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও পার্লামেন্টে বিজয়ী হয় গাইয়ুমের বা তাঁর সুবিধাভোগীদের দলগুলো। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার বিভাগে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে গাইয়ুমের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের, যাঁদের অধিকাংশই তাঁর অনুগত। নাশিদ নতুন সংবিধান অনুসারে স্থায়ী সুপ্রিম কোর্ট গঠনের উদ্যোগ নিলে মালদ্বীপের পার্লামেন্ট তা অনুমোদনে বিরত থাকে তাঁদের পছন্দসই ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত না করা পর্যন্ত। ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, এমনকি পুলিশ ইন্টেগ্রিটি কমিশনের অনেক সদস্যও নাশিদের প্রতি নকল আনুগত্য ঝেড়ে ফেলেন তাঁর বিরুদ্ধে গাইয়ুমপন্থীদের সংগঠিত আন্দোলন শুরু হওয়ার পর।
নাশিদের সংকট তীব্র হয়ে ওঠে তাঁর অনভিজ্ঞতা, অধৈর্য ও মরিয়া আচরণের কারণেও। এসব প্রকট হয়ে ওঠে তাঁর সরাসরি নির্দেশে মালের প্রধান ফৌজদারি বিচারক আবদুল্লাহ গাজীকে সেনাবাহিনী দিয়ে গ্রেপ্তার করে সেনা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ২১ দিন আটক রাখার মধ্য দিয়ে। তিনি নাশিদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গাইয়ুম-সমর্থকদের বিরুদ্ধে বহু ফৌজদারি মামলা আটকে দেন। একপর্যায়ে প্রকাশ্যে সরকারকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার ঘোষণা পর্যন্ত দেন। অসহায় নাশিদ তাঁকে অপসারণের বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন প্রথম দিকে বিচারক আবদুল্লাহকে অপসারণের সুপারিশ করলেও একই স্বার্থচক্রের সদস্য হিসেবে পরিচিত একটি দেওয়ানি আদালত তা স্থগিত করে দেন। অতিষ্ঠ এবং সম্ভবত মরিয়া হয়ে নাশিদ তাঁকে সেনাবাহিনী দিয়ে গ্রেপ্তার করে সংবিধান লঙ্ঘনের দায় মাথায় নেন।
নাশিদ আরও সমস্যায় পড়েন তাঁর তুলনামূলক সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও। তিনি সর্বশেষ সার্ক সম্মেলনস্থলে মূর্তি বসিয়ে শিরক করেছেন, আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে, এমন দ্বীপে মদ বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন—এসব অভিযোগে গত বছরের ডিসেম্বরে তাঁর বিরুদ্ধে ইসলাম রক্ষার যে কোয়ালিশন গড়ে ওঠে, তাতে যোগ দেন আদালত পার্টিসহ তাঁর একসময়ের মিত্ররা, পিপিএম, ডিআরপিসহ ক্ষমতাপ্রত্যাশী গাইয়ুমের মিত্রদলগুলো এবং গোঁড়া ধার্মিক বহু মানুষ। মালদ্বীপ সংবিধান অনুসারে ইসলাম-পরিপন্থী যেকোনো কিছু নিষিদ্ধ হলেও সেখানকার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে, পর্যটকদের কাছে অতিলোভনীয় হলিডে রিসোর্টগুলো। ছোট ছোট দ্বীপের এসব রিসোর্টে বিদেশিদের মদ্যপান অবাধে চললেও এ ব্যাপারে অবশ্য আন্দোলনকারী দলগুলোর কোনো আপত্তি নেই!
নাশিদ মালদ্বীপের সমাজের এসব বৈপরীত্য এবং ক্ষমতাকেন্দ্রে থাকা গাইয়ুমের অবশিষ্টাংশের শক্তিমত্তা সম্ভবত বুঝতে পারেননি। দমকা হাওয়ার গতিতে সংস্কার করতে গিয়ে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অতিষ্ঠ তিনি পুরোনো সুপ্রিম কোর্ট ও পার্লামেন্টে তালা ঝুলিয়েছেন, এক বিচারককে আটক করেছেন, অন্য বিচারকদের বেতন বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন। তাঁর প্রতিপক্ষরা বারবার সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। কেউই বুঝতে চাননি, গণতন্ত্র মানে ক্ষমতার দাপট দেখানো নয়, গণতন্ত্র মানে সহনশীলতা, বহুমতের চর্চা, যত দূর সম্ভব, সমাজের বিভিন্ন মতদ্বৈধতাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা। প্রতিটি পক্ষ সংবিধানে প্রদত্ত নিজের ক্ষমতাকে উৎকটভাবে প্রয়োগ করেছেন, দেশ ও জনগণের প্রতি অন্তর্নিহিত দায়িত্ববোধকে হূদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রের ট্র্যাজেডি মালদ্বীপেও তাই একইভাবে ঘটে চলেছে। আমার মনে হয় না খুব দ্রুত সমাপ্তি ঘটবে এর। এই ট্র্যাজেডিতে কিছুটা হলেও বিপাকে পড়েছেন মালদ্বীপের বাংলাদেশিরাও। নাশিদের সময় অবৈধ বাংলাদেশিদের বৈধকরণের যে সূচনা ঘটেছিল, তা থেমে গেছে এখন। রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে মালদ্বীপে পর্যটনশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে চাকরি হারানোর আশঙ্কায় প্রথমেই পড়বেন বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক অদক্ষ কর্মী ও শ্রমিক। মালদ্বীপের বাংলাদেশিদের এসব উৎকণ্ঠার প্রতি সচেতন আছে কি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.