বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৮৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ আবদুল মালেক, বীর প্রতীক স্বাধীনতার ঊষালগ্নে শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেকসহ মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক দিন ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। থেমে থেমে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে।
কখনো এক ঘণ্টা, কখনো দেড়-দুই ঘণ্টা গোলাগুলির বিরতি থাকে। তখন চারদিক নিস্তব্ধ। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দে নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায়। আবদুল মালেক ও তাঁর সহযোদ্ধাদের গোলাগুলির শব্দ কান-সওয়া হয়ে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তুমুলভাবে তাঁদের প্রতিরোধ করছে। মরিয়া তাদের মনোভাব। তিন-চার দিন ধরে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত আছে। মুক্তিযোদ্ধারা দুই-এক ঘণ্টা পর পর ঝোড়োগতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন। আবার কখনো পাকিস্তান সেনাবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক দিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। আবদুল মালেকসহ মুক্তিযোদ্ধারা এমন আক্রমণের জন্য সতর্কই ছিলেন। বিপুল বিক্রমে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। তখন দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। কিন্তু শহীদ হন আবদুল মালেকসহ কয়েকজন।
আবদুল মালেক নিজের অবস্থানে থেকে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ চলা অবস্থায় একপর্যায়ে হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হন। একঝাঁক গুলির কয়েকটি তাঁর শরীরে লাগে। গুরুতর আহত হয়ে নিজ পরিখায় (ট্রেঞ্চ) ঢলে পড়েন তিনি। রক্তে ভেসে যায় পরিখা। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বরের। সাতক্ষীরা জেলার ভোমরায়। এর অবস্থান জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, ভারত সীমান্তে। সড়কপথে ভোমরা খুলনা ও যশোরের সঙ্গে সংযুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় সীমান্ত এলাকা থেকে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করেন। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। যশোরে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের বেশির ভাগ খুলনা ও সাতক্ষীরায় পালিয়ে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেয়।
ভোমরা হয়ে খুলনা ও যশোর অভিমুখে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে আগে থেকেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছিল। যশোর থেকে পালিয়ে যাওয়া সেনারা যোগ হওয়ায় তাদের শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। ভোমরায় দুই পক্ষ (পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী) ১১ ডিসেম্বর মুখোমুখি হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতি ইঞ্চি ভূমির দখল রাখার জন্য সেখানে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে লড়াই করে। এর ফলে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর পক্ষে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোমরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
১৫ ডিসেম্বরের যুদ্ধে আবদুল মালেকসহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সহযোদ্ধারা তাঁদের যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করেন ভোমরাতেই। তাঁদের সমাধি সংরক্ষিত।
আবদুল মালেক চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন যশোর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ৮ নম্বর সেক্টরের ভোমরা সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত ভোমরার যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল মালেককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫৯। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল মালেক পাটোয়ারী।
আবদুল মালেকের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার উত্তর পয়েলগাছা ইউনিয়নের হাটপুকুরিয়া (পাটোয়ারী বাড়ি) গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. ফজর আলী পাটোয়ারী, মা কদরুন নেছা। শহীদ আবদুল মালেকের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: মো. আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী (শহীদ আবদুল মালেক বীর প্রতীকের ভাই) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তুমুলভাবে তাঁদের প্রতিরোধ করছে। মরিয়া তাদের মনোভাব। তিন-চার দিন ধরে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত আছে। মুক্তিযোদ্ধারা দুই-এক ঘণ্টা পর পর ঝোড়োগতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন। আবার কখনো পাকিস্তান সেনাবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক দিন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। আবদুল মালেকসহ মুক্তিযোদ্ধারা এমন আক্রমণের জন্য সতর্কই ছিলেন। বিপুল বিক্রমে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। তখন দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হন। কিন্তু শহীদ হন আবদুল মালেকসহ কয়েকজন।
আবদুল মালেক নিজের অবস্থানে থেকে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধ চলা অবস্থায় একপর্যায়ে হঠাৎ গুলিবিদ্ধ হন। একঝাঁক গুলির কয়েকটি তাঁর শরীরে লাগে। গুরুতর আহত হয়ে নিজ পরিখায় (ট্রেঞ্চ) ঢলে পড়েন তিনি। রক্তে ভেসে যায় পরিখা। সহযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করার আগেই নিভে যায় তাঁর জীবনপ্রদীপ।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বরের। সাতক্ষীরা জেলার ভোমরায়। এর অবস্থান জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, ভারত সীমান্তে। সড়কপথে ভোমরা খুলনা ও যশোরের সঙ্গে সংযুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা মিত্রবাহিনীর সহায়তায় সীমান্ত এলাকা থেকে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করেন। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। যশোরে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের বেশির ভাগ খুলনা ও সাতক্ষীরায় পালিয়ে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেয়।
ভোমরা হয়ে খুলনা ও যশোর অভিমুখে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে আগে থেকেই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করেছিল। যশোর থেকে পালিয়ে যাওয়া সেনারা যোগ হওয়ায় তাদের শক্তি আরও বৃদ্ধি পায়। ভোমরায় দুই পক্ষ (পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী) ১১ ডিসেম্বর মুখোমুখি হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতি ইঞ্চি ভূমির দখল রাখার জন্য সেখানে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে লড়াই করে। এর ফলে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর পক্ষে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোমরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
১৫ ডিসেম্বরের যুদ্ধে আবদুল মালেকসহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সহযোদ্ধারা তাঁদের যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করেন ভোমরাতেই। তাঁদের সমাধি সংরক্ষিত।
আবদুল মালেক চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন যশোর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ৮ নম্বর সেক্টরের ভোমরা সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত ভোমরার যুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল মালেককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৫৯। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল মালেক পাটোয়ারী।
আবদুল মালেকের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার উত্তর পয়েলগাছা ইউনিয়নের হাটপুকুরিয়া (পাটোয়ারী বাড়ি) গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. ফজর আলী পাটোয়ারী, মা কদরুন নেছা। শহীদ আবদুল মালেকের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: মো. আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী (শহীদ আবদুল মালেক বীর প্রতীকের ভাই) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments