মা-মেয়ের লাশ মিলল পাশাপাশি দুই কক্ষে

সৌদি আরব থেকে গত তিন দিন টেলিফোন করে স্ত্রী মাবিয়া বা একমাত্র মেয়ে সাদিয়া কারোরই সাড়া পাচ্ছিলেন না আহম্মদ আলী। স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি। বাধ্য হয়ে গতকাল বুধবার সকালে ছোট ভাই জসিম উদ্দিনকে টেলিফোন করে বলেন ভাড়া বাসায় গিয়ে স্ত্রী ও মেয়ের খোঁজ নিতে।


বড় ভাইয়ের টেলিফোন পেয়ে জসিম উদ্দিন গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩৮ শাহ সুজা রোডের (পাইকপাড়া) আমেনা মঞ্জিলের ভাড়া বাসা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দেখতে পান। সেই সঙ্গে ঘরের ভেতর থেকে দুর্গন্ধ পাচ্ছিলেন। পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটেদের জিজ্ঞেস করে জসিম ভাবি ও ভাতিজির ব্যাপারে কোনো সদুত্তর পাননি। পরে বাসার মালিক আবদুল করিম ভুঁইয়া বাবু ওরফে ডিশ বাবুকে ঘটনা জানান। বাবু তালাবদ্ধ ঘরের দরজা ফাঁক করে খাটের ওপর একজনের নিথর দেহ দেখে এবং দুর্গন্ধ পেয়ে বিষয়টি সদর মডেল থানাকে অবহিত করেন। বিকেল ৪টায় পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘরের তালা ভেঙে ফ্ল্যাটের আলাদা কক্ষে মা ও মেয়ের জবাই করা লাশ দেখতে পান।
খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আশরাফুজ্জামান, সদর মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের, ওসি তদন্ত আবদুর রাজ্জাক, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্যরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে লাশ উদ্ধার না করে ঢাকা থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষজ্ঞদের খবর পাঠায়। সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা থেকে সিআইডির বিশেষজ্ঞদল ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়নি।
নিহত মাবিয়া আক্তার (৪০) প্রায় এক বছর ধরে আমেনা মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকেন। এর আগে তিনি পাইকপাড়ায় ছিলেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ আহম্মদ আলীর বাড়ি বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জ টি হোসেন রোড এলাকায় আর বাবার বাড়ি সদর থানার ডিক্রিরচর গ্রামে। মেয়ে সাদিয়া (১২) বাসার পাশে অবস্থিত আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।
ঘটনাস্থল
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যে বাসায় হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় এর ৫০ গজ দূরেই নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) সাজ্জাদুর রহমানের সরকারি বাসভবন। পুরনো বর্গাকার চার তলা ভবনের দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের দুই কক্ষের ফ্ল্যাটে মাবিয়া তাঁর মেয়েকে নিয়ে থাকতেন। প্রথম কক্ষের খাটের ওপর অর্ধেক টানানো মশারির পাশে মুখ ঢাকা অবস্থায় সাদিয়ার জবাই করা লাশটি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সাদিয়ার বুকের ওপর খুনির ফেলে যাওয়া ছুরি পড়ে আছে। ওই কক্ষে থাকা স্টিলের আলমারিতে ঝুলছিল চাবি। সাদিয়ার কক্ষ থেকে বারান্দায় যাওয়ার দরজাটি খোলা। বারান্দা দিয়েই পাশের কক্ষে যেতে হয়। ওই কক্ষে বালিশ দিয়ে মুখ ঢাকা এবং পা বাঁধা অবস্থায় মাবিয়ার জবাই করা লাশ পড়ে আছে। পুলিশ বলেছে, লাশের পাশে তারা একটি লুঙ্গি পেয়েছে।
পাশের ফ্ল্যাটের কেউ কিছু জানে না
পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আমেনা খাতুন জানান, তিন দিন থেকেই (সোমবার থেকে) তিনি মাবিয়াদের ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ দেখতে পাচ্ছেন। উচ্চ স্বরে গানও বাজছিল। একই কথা জানান চার তলার ভাড়াটে শাবানা বেগম। তাঁরা দুজন জানান, গত এক বছর ধরে মাবিয়া ও তাঁর মেয়ে সাদিয়া এই বাসায় থাকলেও তাঁরা কারো সঙ্গে তেমন একটা মিশতেন না।
মাবিয়ার ননদ রৌশন আরা জানান, চার দিন আগে ভাবির সঙ্গে তাঁর শেষ কথা হয়েছে। তিনি আরো জানান, তাঁদের সঙ্গে কারো বড় ধরনের কোনো শত্রুতা ছিল না। তবে শহরের সেন্ট্রাল চায়নিজ রেস্টুরেন্টের মালিক নিয়াজের সঙ্গে নবীগঞ্জের একটি জমি নিয়ে তাঁদের মামলা চলছিল।
মাবিয়ার দেবর জসিম উদ্দিন জানান, গতকাল সকালে বড় ভাইয়ের টেলিফোন পেয়ে তিনি বাসায় এসে দেখেন বাইরে থেকে তালাবদ্ধ।
বাড়িওয়ালা বাবু যা বললেন
বাড়ির মালিক আবদুল করিম ভুঁইয়া বাবু পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ঘটনাটি কোনোভাবেই ডাকাতি হতে পারে না। কারণ এই বাড়িটি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু দুজনকে হত্যা করে ফেলে গেছে কয়েক দিন হলো, অথচ কেউ জানে না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি।
ঘাতক একাধিক ও পরিচিত
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মঞ্জুর কাদের জানান, আলামত দেখে তাঁরা ধারণা করছেন হত্যাকাণ্ডে একাধিক ব্যক্তি অংশ নিয়েছে এবং তারা পূর্বপরিচিত; যে কারণে হত্যাকাণ্ডের আগে কোনো হৈচৈ, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়নি। তবে ঘটনাটি পরকীয়া প্রেম, না অন্য কোনো কারণে ঘটেছে তা তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন ওসি। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডটি দুই-তিন দিন আগে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) আশরাফুজ্জামান বলেন, হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনই বলা সম্ভব নয়। অনুসন্ধানেই প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.