সাদাকালো-অন্তর্বর্তী সরকার গঠন নিয়ে কিছু কথা by আহমদ রফিক

বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দিন থেকেই সংঘাতপ্রবণ। এর পরিণাম দেশ ও দশের জন্য শুভ হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলি এমন সত্যই তুলে ধরে। আর সেই রাজনৈতিক বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বা জোট পারস্পরিক সংঘাত থেকে সরে আসেনি।


বিকল্প আশঙ্কাও তাদের বোধোদয় ঘটাতে সাহায্য করেনি। তারা সংঘাতের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
যে দল বা জোট ক্ষমতাসীন থাকে, তাদের ইচ্ছাই প্রধান হয়ে ওঠে এবং চেষ্টা চলে সে ইচ্ছা প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার, চেষ্টা চলে সেটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক। এমনকি তৃতীয় বা দলনিরপেক্ষ লোকজনের কাছেও যদি তা যুক্তিসংগত মনে না হয়। এ অবস্থা সংঘাতের জন্ম দেবে তা স্বাভাবিক। প্রসংগত একাধিক ঘটনা আমরা স্মরণ করতে পারি। যেমন- বিএনপি সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ফেব্রুয়ারির জবরদস্তির নির্বাচন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম এ আজিজের উদ্ভট আচরণ কিংবা স্বঘোষিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের চরম স্বেচ্ছাচারিতা। বিএনপি চেয়ারপারসন এবং তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও মুখপাত্রদের সেসব ঘটনা মনে রেখে বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের বক্তব্য পেশ বা সংলাপে এগিয়ে আসা উচিত। বাস্তবতা চোখের সামনে থাকলে সমস্যা সমাধানের পথ যুক্তিসংগত হয়ে ওঠা অনেকটা সহজ হতে পারে। কথাটা ক্ষমতাসীনদের জন্য, বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের জন্যও অধিকতর সত্য, যেমন সত্য বিরোধী জোটের জন্য।
ক্ষমতা হাতে থাকলে জনম্যান্ডেটের দোহাই দিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন কিছু করা যায় না। ক্ষমতাসীন শক্তির জন্য এটাই বড় কথা। অতীত উদাহরণ ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। মনে রাখা উচিত যে বর্তমান বিরোধী দলও ভালোরকম নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিয়ে এসে ক্ষমতায় বসে নির্বাচন নিয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়েও বাজি জিততে পারেনি। তাই পঞ্চদশ সংশোধনী ক্ষমতাসীন সরকারকে তাদের একক পছন্দমতো পথে চলা নিশ্চিত করবে- এমন ভাবনাও ঠিক নয়।
হয়তোবা কিছুটা ঠিক হতো, যদি ম্যান্ডেটদাতা জনতা আগেকার অবস্থানে থাকত। তা যে নেই, সে সত্যটা সমাজের অস্থির অবস্থা দেখে বুঝতে পারা উচিত। যদিও আমরা জানি, বর্তমান সরকারের কিছু ইতিবাচক অর্জন রয়েছে যেমন- শিক্ষা খাতে, কৃষি খাতে এমনকি আমরা হয়তো লক্ষ করি না যে লোডশেডিং এখন প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে, দুই ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পর পর বিদ্যুৎ চলে যাওয়া দূরে থাক। তবু অনর্জিত বিষয় তো কম নেই। বিশেষ করে পদ্মা সেতু কেলেংকারি ও দুর্নীতি মহা আলোচিত বিষয় এবং তা জনমনে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি তো আছেই। আছে আরো একাধিক বিষয়।
এ অবস্থায় সরকারের আগামী নির্বাচনের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে এমন কিছু করা উচিত নয়, যা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে, জনমত বিগড়ে দেবে। বিষয়টা নিয়ে এত দিন অনড় অবস্থানে থেকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী যে সেখান থেকে সরে আভাস-ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সেটা সবার জন্যই স্বস্তির কারণ। তবে হাতে যেহেতু বেশি সময় নেই, তাই নষ্ট করার মতো সময়ও নেই ক্ষমতাসীন সরকারের অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে দেশের বিরাজমান রাজনীতিতে সম্ভব নয়- এটা সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী বোঝেন। তা যদি হয়, তাহলে আর দেরি না করে তাদের প্রস্তাব বা ভাবনা যেটাই হোক, খোলামেলা উপস্থাপন করা দরকার, যাতে বিষয়টা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ সবাই বিচার-ব্যাখ্যা করে খতিয়ে দেখতে পারে। বিরোধী জোটও যাতে এর গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে পারে, সমঝোতার পরিবেশে সংযোজন-বিয়োজন করে সবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য একটা অবস্থানে পৌঁছতে পারে।
তা ছাড়া আরো একটি বিষয় ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভেবে দেখার রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হলেও বিশ্ব পরাশক্তির হাত থেকে এর প্রকৃত সার্বভৌমত্ব কতটা রক্ষা করতে পেরেছি, তা ভেবে দেখার মতো। স্যার নিনিয়ান থেকে হাল আমলের মজিনা- কে বাকি রেখেছেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ব্যাপারে নাক গলাতে? আর আমাদেরই বা কতটা সাহস বা শক্তি যে দৃঢ়কণ্ঠে বলা, 'দোহাই আপনাদের, কূটনৈতিক সৌজন্য মেনে দূরে থাকুন, আমাদের সমস্যা আমাদের মিটিয়ে নিতে দিন।'
না। সেটা পারছি না। পদ্মা সেতু তার প্রমাণ। প্রমাণ গ্যাসকূপের অনেক ঘটনা- নিজের হক বুঝে নিতে পারছি না। বুঝে নেওয়া দূরে থাক, জোরগলায় দাবি করতেও পারছি না। পাছে বড় কর্তারা অসন্তুষ্ট হন। পাছে তাঁরা ফিতরা-জাকাত বা ধারদেনা বন্ধ করে দেন। না, তাঁরা তা করবেন না। তাঁরা তাঁদের স্বার্থ বোঝেন। আবার এটাও বোঝেন যে আমরা উপায়হীন। আত্মনির্ভর হতে শিখিনি। আমরা তাঁদের ওপর নির্ভরশীল এবং তাঁদের সলাপরামর্শের বাইরে যেতে পারব না।
তাই তাঁদের অভিভাবকত্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি আমাদের রাজনীতির ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। ফেলছে যাতে তাদের মর্জিমাফিক আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ কারণে তারা এখন আর ক্ষমতাসীন সরকারকে খুব একটা সুনজরে দেখছে না। এসব প্রকট বাস্তবতা সরকারের না বোঝার কথা নয়। তাই তাদের জন্য জরুরি দরকার ঘরের কাজিয়া ঘরেই মিটিয়ে ফেলা।
যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন হয়। যাতে কেউ অভিযোগের আঙুল তুলতে না পারে। নির্বাচন উপলক্ষে অশান্তির এক ফোঁটা রক্ত যেন মাটিতে না পড়ে। এর মূল দায়িত্বটা অবশ্যই ক্ষমতাসীন সরকারের। কাজেই প্রথম পদক্ষেপ তাদেরই নিতে হবে। বল এখন পর্যন্ত তাদের কোর্টে। প্রথম সার্ভ তাদেরই করতে হবে। স্পষ্ট করে বলতে হবে, নির্বাচনী পরিকল্পনা- প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন। প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো তাদের রয়েছেই।
এদিকে মৌচাকে ঢিল পড়ার মতো অবস্থা। কাগজগুলোতে নির্বাচন ও অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে কত রকম লেখা নামিদামি লোকদের। নানা প্রস্তাব নানা যুক্তিতর্ক। সমর্থক থেকে নিরপেক্ষ- কেউ বাদ নেই। এমনকি খাস বিদেশ মুলুক থেকেও নানা প্রস্তাব আসছে প্রযুক্তির ডানায় ভর করে। কিভাবে সমস্যা সামাল দেওয়া যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প ব্যবস্থা কি হতে পারে তা নিয়ে। কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার হলে তার প্রধান কে হবেন, কিভাবে, কী প্রক্রিয়ায় হবেন তা নিয়ে। ওই মিনি সরকারই বা কী পদ্ধতিতে গঠিত হবে তা নিয়ে।
মাস কয় আগে তারকা লেখকদের এক পাশ থেকে এই হেঁজিপেঁজি লেখকও কিছু প্রস্তাব রেখেছিল, একটু ভিন্ন ধরনের প্রস্তাব। তাতে বলা হয়েছিল, দুই জোট বসে পাঁচ-পাঁচ ১০ জন সদস্য যথাক্রমে দুই জোট থেকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হোক যথারীতি মন্ত্রিসভা ও সংসদ ভেঙে দিয়ে। কিন্তু এ প্রস্তাবের বর্তমান বৈশিষ্ট্য হলো- চলমান সংসদের নির্বাচিত কোনো সদস্য অর্থাৎ এমপি ও মন্ত্রী নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য হতে পারবেন না। সদস্য হবেন দুই জোটেরই নিজ নিজ প্রস্তাবে; কিন্তু সমাজের বিশেষ মেধাবী শ্রেণী থেকে। তাঁরা হতে পারেন পেশাজীবী শ্রেণীর, যেমন- আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাবেক রাজনীতিক- যাঁরা সৎ, সুনামে-স্বনামে সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অপরাধের কোনো ধরনের অভিযোগ নেই।
সদস্য নির্বাচনে অসুবিধা হবে না এ কারণে যে এ দেশের বিশিষ্ট নাগরিক এবং পেশাজীবী সমাজের বড়সড় অংশ এখন কোনো না কোনোভাবে প্রধান দুই দলের বা জোট শরিকদের সমর্থক। আবার এঁদের মধ্যেও আছেন কিছুসংখ্যক গভীর সমর্থক, ইংরেজিতে বলা চলে- 'হার্ডকোর সাপোর্টার'। তাই দুই প্রধান দল অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য মনোনয়নের জন্য বিভিন্ন খাতের লোক, বলা যায় দল সমর্থক সদস্য ঠিকই খুঁজে পাবে। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের যে সমস্যা, এখানে তা ততটা থাকবে না। দুই বিপরীত মতাদর্শের সমর্থক হয়েও তাঁরা ন্যস্ত দায়িত্ব মোটামুটি ভালোভাবে পালন করতে পারবেন।
এঁরাই সম্মিলিতভাবে সরকার প্রধান ঠিক করবেন। সরকার প্রধানের মনোনয়ন একই পদ্ধতিতে হবে। তাঁকে অবশ্য হতে হবে একজন সৎ ও দক্ষ প্রশাসক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্দলীয় ব্যক্তি। এই সরকার একটি দক্ষ, শক্তিশালী, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। সুষ্ঠুভাব নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তাদের পালন করতে হবে আনুষঙ্গিক প্রথামাফিক। অর্থাৎ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তারা তা নেবে, নিতে পারবে। প্রয়োজনে নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনী মোতায়েনের অধিকারও তাদের থাকবে।
নির্বাচন সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় মন্ত্রণালয় সরকার প্রধানের হাতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যসংখ্যা প্রয়োজনে বাড়ানো যেতে পারে। মোটামুটিভাবে নির্দলীয় এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচন যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারার কথা। আবারও বলতে হয়, নির্বাচনের জন্য এ জাতীয় যেকোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হলো দুই জোট, বিশেষ করে প্রধান দুই দলের আলোচনায় বসা। বিএনপির মনে রাখা উচিত, কোনো পূর্বশর্ত বা হুমকি দিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়, কিছু অর্জনও সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অঙ্গন জেদ ও একগুঁয়েমির জায়গা নয়। নমনীয়, সহিষ্ণু, স্থিতিস্থাপক মানসিকতা গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাফল্যের চাবিকাঠি।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.