বাবা নেই, আছে স্মৃতি। তারকা বাবার সঙ্গে কাটানো ঈদের স্মৃতিচারণা করেছেন তারকা সন্তানেরা -বাবার সঙ্গে ঈদের স্মৃতি

ঈদের দিন মানেই আব্বার ঘুম সামিনা চৌধুরী ঈদের দিন মানেই আব্বার ঘুম দিবস। কোনো কাজ নেই। সকালে নামাজ শেষে খুব আয়েশ করে ঘুম দিতেন আব্বা। সারা দিন টইটই করে ঘুরে বেড়াতাম আমরা। সন্ধ্যায় অবশ্যই তাঁর সঙ্গে যাওয়া হতো বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায়।


রিকশায় আব্বার সঙ্গে ঘুরছি, নানা রকম মজার মজার কথা বলছেন তিনি—শৈশবের ঈদের স্মৃতি মনে এলে এসব কেবলই ফিরে ফিরে আসে।
রোজার শুরু থেকেই ঈদের আমেজ ভর করত আমাদের মনে। আমরা তখন খুব ছোট। থাকতাম এলিফ্যান্ট রোডে। রোজার কদিন যেতেই আব্বার সঙ্গে নিউমার্কেটে গিয়ে জামাকাপড়ের অর্ডার দেওয়া, জুতা কেনা—সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার। জামা তৈরি হলে শুরু হতো সেগুলো লুকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা। আমি আর নুমা—ফাহমিদাকে বাড়িতে সবাই নুমা বলে ডাকে; দুজনের জামা লুকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা চলত চাঁদরাত পর্যন্ত। এসব দেখে আব্বা-আম্মা দুজনই হাসতেন।
ঈদের দিন নতুন জামা পরে ঘুরতে যাওয়া, আর ঈদ-সালামি তো ছিলই। নুমা ও আমাকে সব সময় সমান টাকা দেওয়া হতো। তবু এ নিয়ে আমাদের খুনসুটি লেগেই থাকত। মাঝেমধ্যে মারামারিও হতো। আসলে ওর সঙ্গে যেমন মারামারি করতাম, তেমনি ও-ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আব্বাকে ভোজনরসিক বললে কম বলা হবে—খেতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসতেন। পছন্দের খাবার ছিল গরুর মাংস ভুনা। তিনি খাচ্ছেন, আমরা বসে আছি পাশে—তাঁর খাওয়া দেখতেই যেন ভালো লাগত আমাদের। আব্বার কথা বলতে গিয়ে একটি বিশেষ স্মৃতি মনে পড়ছে। ১৯৭৮ সাল। আমি তখন বোধ হয় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। হঠাৎ একদিন দেখি, আব্বা একটি টু-ইন-ওয়ান কিনে নিয়ে এসেছেন।
এটি এমন এক যন্ত্র, যাতে রেডিও ও ক্যাসেট দুই-ই চালানো যায়। আজকাল অবশ্য টু-ইন-ওয়ানের চল একেবারে উঠেই গেছে। কিন্তু আমাদের সেই সোনালি শৈশবে এই যন্ত্রটি ছিল বিস্ময়ের মতো। কী যে খুশি হয়েছিলাম টু-ইন-ওয়ান পেয়ে! এখনো চাঁদরাত এলে সেই শৈশবে ফিরে যাই আমি। মনে পড়ে মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোড, নূরজাহান রোডে আল আমিন ভাই, কবির ভাই, নুমা—এঁদের সঙ্গে মিলে হইহুল্লোড়ের কথা। আর কোনো এক সুদূর থেকে আব্বার ঘ্রাণ ভেসে আসে যেন।

আমার রান্না আব্বু ভালোবাসতেন
ঐন্দ্রিলা আহমেদ
আব্বু আমাকে ঐন্দ্রিলা বলে ডাকতেন না। ডাকতেন আম্মী বলে। ‘আম্মীর রান্না আমার এত ভালো লাগে, পোলাওটা এত সুন্দর হয়...’ —আমার বাসায় নিজের শেষ জন্মদিনে খেতে খেতে এই কথাগুলো বলেছিলেন আব্বু। ওই দিন আমি তাঁকে একটি নতুন পোশাক দিয়েছিলাম। সেটি পেয়ে এত খুশি হয়েছিলেন যে শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন। আমার বাবা বুলবুল আহমেদ ছিলেন শিশুর মতো সরল। সারাক্ষণ গান ও আড্ডায় মাতিয়ে রাখতেন পুরো বাড়ি।
আমি সেই বাড়ির ছোট মেয়ে। ঈদের সময় অনেক পোশাক পেতাম। সেগুলো পরতাম পালাক্রমে। ছোটবেলায় আমার ছিল অদ্ভুত খেয়াল—ঈদের সময় যেহেতু অনেক পোশাক পেতাম, তাই বেড়াতে বের হলেও ব্যাগে নিয়ে যেতাম পোশাকগুলো। আমার কাণ্ড দেখে আব্বু বলতেন, ‘এটা কত নম্বর চলছে?’ আমি হাসতাম। ঈদের সকালে যখন তাঁকে আমার প্রথম পোশাকটি দেখাতাম, তখনো তিনি একই কথা বলতেন। আর আমি বলতাম, ‘আজ তোমার সঙ্গে এই প্রথম দেখা হলো, তাই এক নম্বর ড্রেসটি পরেছি।’ আব্বু ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার পর আমি দ্রুত গোসল-গোছগাছ শেষে পোশাক পরে রেডি হয়ে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কারণ, আব্বু বাসায় ফিরলে দরজা খুলে দিয়ে চকচকে নোটের সালামি নেব আমি। আমার কাছে সে সময় খুবই আকর্ষণীয় ছিল এটা। কারণ, ঘরে ফিরেই তো পকেট থেকে চকচকে নোট বের করে দেবেন তিনি। এরপর গাড়িতে ঘুরতে বের হবেন আমাদের নিয়ে। আমরা হয়তো হাটখোলা রোডে দাদাবাড়ি থেকে উত্তরার দিকে যাব। গাড়ির ভেতরে আব্বু গান ধরবেন, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে...।’ অথবা উত্তমকুমার, সায়রা বানুর গান উঠবে তাঁর গলায়। এর মধ্যে কখনো আবার গাড়ির স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে হাসতে থাকবেন। আর এটা দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরব আমি। বাড়ি ফিরে পরোটা-কোরমা খাব তাঁর সঙ্গে—ছোটবেলায় এ রকমই তো ছিল ঈদের মধুর দিনগুলো।
আমার বড় ভাই শুভ অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। সেবার তাঁর ওখানে বেড়াতে গিয়েছি আমরা। এর মধ্যে ঈদ এসে গেল। ভাইয়া আর ফিরতে দিলেন না আমাদের। ওই একবারই আমরা দেশের বাইরে ঈদ করেছি। সেখানে ভাইবোন সবাই মিলে মসজিদে একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছি। সেটি ছিল এক অন্য রকম আনন্দ!

উৎসব লেগেই থাকত বাড়িতে
আগুন
বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে প্রতি মুহূর্তেই। তবে ঈদের মতো বড় উৎসবে বুকের মধ্যে হাহাকার জাগিয়ে যেন বা প্রবলভাবে ফিরে আসেন তাঁরা—খান আতাউর রহমান ও নীলুফার ইয়াসমীন, আমার প্রিয় বাবা ও মা। ছেলেবেলায় আমার ঈদ শুরু হতো আব্বার সঙ্গে পুরোনো ঢাকার শাহি মসজিদে নামাজ পড়ার মাধ্যমে। প্রতিটি ঈদে বোর্ড অফিসের সামনে গাড়ি রেখে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে দাদার কবর জিয়ারত করতেন আব্বা। তাঁর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি।
আমার বয়স তখন ২১ বছর। এ সময় এক ঈদে দাদার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে মোনাজাত করছেন আব্বা, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ছি আমি—এসব স্মৃতি এখন ক্ষণে ক্ষণেই নাড়া দেয়।
এখন আমার ঈদ শুরু হয় আব্বার কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে। মাঝে মাঝে ভাবি, সময়গুলো কত দ্রুত চলে যায়, স্মৃতি হয়ে যায়। ঈদের দিন আম্মা চটপটি, বোরহানি, পায়েস রান্না করতেন। আমরা মজা করে খেতাম।
শুধু ঈদের দিন কেন, বাড়িতে আমাদের সব সময় উৎসব লেগেই থাকত। প্রায় প্রতি রাতেই গানবাজনার আসর বসাতেন আব্বা। ওই আসরে আসতেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আমীর হোসেন বাবু—বুলবুল কাকু গিটার বাজাতেন, বাবু কাকু নাচতেন। সেখানে মাঝে মাঝে আম্মাও গান গাইতেন। আর আসর শেষে মায়ের হাতের কই মাছ ভাজা—তার স্বাদ কি এ জীবনে ভুলতে পারব!
আব্বা ও আম্মা দুজনেই ঘুরতে খুব পছন্দ করতেন। ঈদের পর আমাদের নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া ছিল তাঁদের অভ্যাস।
বাবা-মাকে নিয়ে স্মৃতির তো শেষ নেই। প্রতিবছর ঈদে বাড়িতে যখন সেমাই-ফিরনি রান্না হয়, মনে পড়ে মায়ের কথা। আমার মা ছিলেন সর্বংসহা। তিনি শুধু ভালো কণ্ঠশিল্পী নন, রান্নাতেও অসাধারণ পটু। এখন প্রতিবছর ঈদ আসে, আর উৎসব-আনন্দে আমার শুধুই মনে পড়ে তাঁদের মুখ। অসম্ভব জানি, তবু মনে হয়, ঈদের দিন বাবার সঙ্গে আবার যদি দাদার কবরের পাশে দাঁড়াতে পারতাম; ঘরে ফিরে আবার যদি খাওয়া যেত আম্মার হাতের সেই অসাধারণ চটপটি...।

আব্বার সঙ্গে দাদাবাড়ি যেতাম
জীতু আহসান
আমার বাবা সৈয়দ আহসান আলী সিডনীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা হয়তো বলবেন, তিনি খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মতো। তাঁর সঙ্গে প্রতিদিন নানা রকম দুষ্টুমি করে দিন কাটত। আমি বাড়ির ছোট ছেলে। তাই আদর ও আবদার দুটোই ছিল বেশি। আমাদের ঈদ শুরু হতো আব্বার সঙ্গে পুরান ঢাকার বাবুবাজারে দাদাবাড়ি যাওয়ার মাধ্যমে। আব্বা গাড়ির সামনের সিটে, আমি বসে আছি তাঁর পাশে—এই স্মৃতি কেন যেন বারবার ঘুরেফিরে আসে।
যখন ছোট ছিলাম, ঈদের দিন আব্বা নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে গোসল করতে ঢুকলে আমি বাইরে থেকে স্নানঘরের বাতি নিভিয়ে দিতাম। কী যে মজা পেতাম এসব করে! এরপর নামাজ পড়তে যাওয়া। বাড়ি ফিরে ফিরনি-সেমাইয়ে হাপুস-হুপুস। ছেলেবেলায় সালামি ছিল ঈদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। এমনও হয়েছে, অধিকারবশত বাবার পকেট থেকে টাকা নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছি, কিছুই বলেননি তিনি। আজ তাঁর অভাব বোধ করি ক্ষণে ক্ষণে ।
আব্বার সঙ্গে শেষ ঈদ ২০০১ সালে। তখন তিনি খুব অসুস্থ। ঈদের দিন নামাজ পড়তে যেতে পারলেন না। তাই তাঁকে ছাড়াই আমরা গেলাম দাদাবাড়িতে। ওখানে গিয়ে মুঠোফোনে তাঁকে বললাম, ‘তুমি কি আসবে?’ ‘শরীরটা ভালো না, ভালো লাগলে বেলা ১০টার দিকে আসব।’—বললেন তিনি। আব্বা পরে দাদাবাড়িতে এসেছিলেন কি না এখন আর মনে নেই। শুধু মনে আছে, শেষ ঈদে তাঁর সঙ্গে পাশাপাশি সিটে বসে দাদাবাড়ি যাওয়া হয়নি।
আব্বার সঙ্গে অনেক স্মৃতি, সব গুছিয়ে লেখাও সম্ভব নয়। তিনি যেমন সু-অভিনেতা, তেমনি ছিলেন অভিনয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ে কট্টর। তাই নিজে যখন অভিনয়ে এলাম, খুব ভয় হতো তখন—যদি কিছু ভুল করি, তিনি যদি বকা দেন! এই ভয়ে আমার কোনো নাটক প্রচারের সময় পারতপক্ষে তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতাম না। তবে ছেলের নাটক খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতেন তিনি। প্রায়ই আমাকে বলতেন, ‘অভিনয় এমন একটা জিনিস, যেখানে একটা দৃশ্য ভালো হওয়া বড় কথা নয়, পুরো নাটকে ভালো করতে হবে। তবেই না মানুষ তোমাকে ভালো অভিনেতা বলবে।’ এ প্রসঙ্গে একটা স্মৃতি মনে পড়ছে। আব্বাকে সব সময় দেখতাম, কোনো নাটকে নিজের সংলাপগুলো আলাদা করে লিখছেন। জিজ্ঞেস করে বলতেন, ‘এভাবে সংলাপগুলো মুখস্থ হয়ে যায়।’
তখন তিনি সেন্ট্রাল হাসপাতালে শয্যাশায়ী। আবদুল্লাহ আল-মামুনের পরিচালনায় আমার অভিনীত জোয়ারভাটা নাটক প্রচারিত হচ্ছে। হাসপাতালে বসেই আমার নাটক দেখলেন আব্বা। ভয়ে সে সময় তাঁর সামনে যেতে পারিনি। আর এর পরদিনই চলে গেলেন আব্বা।
এখন ঈদ এলেই নানা স্মৃতি ভিড় করে মনের মধ্যে। সেই স্মৃতির আয়নায় বারবার দেখতে পাই জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধুকে—আব্বার মুখ।

No comments

Powered by Blogger.