ধর্ম- আল বিদা মাহে রমজান by আবদুস সবুর খান
দেখতে দেখতে আমরা মাহে রমজানের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। আর মাত্র কয়েক দিন পরই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবে রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির মহান মাস পবিত্র রমজান। আল বিদা মাহে রমজান। আল বিদা মাহে রমজান। অগণিত সওয়াব অর্জনের মাস পবিত্র রমজান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে।
এই মাসে মহান আল্লাহ্ বান্দার নেক কাজের সওয়াব ১০ থেকে ৭০ গুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭০০ গুণ বৃদ্ধি করে দিতেন। মহান আল্লাহ্ এই মাসে প্রতিদিন রোজাদার বান্দাকে ইফতারের পূর্বমুহূর্তে এমন একটি দোয়া করার সুযোগ দিয়েছিলেন, যা কবুল করে নেওয়ার বিশেষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই মাসে কবরবাসীর কবরের আজাব সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কবরের আজাব আবার শুরু হয়ে যাবে। এই মাসে অভিশপ্ত শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়েছিল। রমজান মাস শেষ হয়ে গেলেই শয়তান আবার শৃঙ্খলমুক্ত হবে। এই মাসে এমন একটি রাত ছিল, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অন্যান্য নবীর উম্মতেরা এক হাজার মাস ইবাদত-বন্দেগি করে যে সওয়াব অর্জন করতেন, মহান আল্লাহ্ উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য এই মাসের এক মহিমান্বিত রাত ‘লাইলাতুল কদরে’ ইবাদত করে সেই সওয়াব অর্জন করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
আর কয়েক দিন পরই মসজিদে মসজিদে আর তারাবির জামাতে শরিক হতে আসা মুসল্লিদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়বে না। সেহির খাওয়া শেষ করে পাড়া-মহল্লার যুবক, কিশোর বৃদ্ধ মুসল্লিদের দল বেঁধে ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়বে না। ইফতারের পূর্বমুহূর্তের শান্তিময় বেহেশতি পরিবেশ লক্ষ করা যাবে না। সবই আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাসের প্রতিদিন ও রাতে দোজখের বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয় আর প্রত্যেক মুসলমানের একটি দোয়া অবশ্যই আল্লাহ্ পাকের দরবারে কবুল হয়।’ মাহে রমজানের শেষ প্রান্তে এসে আমাদের প্রত্যেকেরই আত্মজিজ্ঞাসা—গুনাহ্ মাফ করার, মাগফিরাত লাভ করার এবং দোজখের আগুন থেকে মুক্তি পেয়ে চিরশান্তির বেহেশত লাভ করার উত্তম সুযোগের এই ফজিলত ও বরকতপূর্ণ মাসকে কি আমরা যথাযথ কাজে লাগাতে পেরেছি? আমরা কি আমাদের গুনাহ্ মাফ করাতে পেরেছি? আমরা কি মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমাদের দোয়া কবুল করাতে পেরেছি? আমরা কি ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সম্যক উপলব্ধির মাধ্যমে অনাহারী গরিব-দুঃখীর কষ্ট অনুভব করতে পারছি? সারা বছর তাঁদের জন্য কিছু করার মানসিকতা কি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে?
হজরত কাব ইবনে আজুরাহ (রা.) এক হাদিসে বর্ণনা করেছেন, ‘একদিন রাসুল (সা.) তাঁর মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে কদম মোবারক রেখে বললেন, আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে আরোহণ করে বললেন, আমিন। তৃতীয় সিঁড়িতে পৌঁছেও বললেন, আমিন। পরে সাহাবিরা যখন এর কারণ জানতে চাইলেন, তখন তিনি বললেন, আমার নিকট জিবরাইল (আ.) এসেছিলেন। তিনি দোয়া করেছেন: যে ব্যক্তি রমজানের সুযোগ পেয়েছে অথচ সে ইবাদতের মাধ্যমে তার গুনাহ্ মাফ করাতে পারেনি, তার জন্য অভিসম্পাত। তখন আমি বলেছি, আমিন। (অর্থাৎ হে আল্লাহ্! কবুল করুন।) এরপর যখন জিবরাইল (আ.) বলেছেন, তার প্রতি অভিসম্পাত, যার সামনে রাসুল (সা.)-এর নাম আলোচনা হয় অথচ সে তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করে না। তখন আমি বলেছি, আমিন। এরপর যখন জিবরাইল (আ.) বলেছেন, সেই ব্যক্তির প্রতি অভিসম্পাত, যে ব্যক্তি তার মা-বাবা উভয়কে অথবা তাঁদের যেকোনো একজনকে পেয়ে তাঁদের সেবাযত্ন ও খেদমত করে জান্নাতের ব্যবস্থা করতে পারল না। তখন আমি বলেছি, আমিন।’ এই হাদিস শোনার পর থেকে মাহে রমজানের শেষ দিকে সাহাবিরা এই ভেবে মনে মনে খুবই উৎকণ্ঠিত থাকতেন—আমরা কি মাহে রমজানে ইবাদতের মাধ্যমে আমাদের গুনাহ্ মাফ করাতে পেরেছি? মাহে রমজানের শেষ দিকে সাহাবিদের মধ্যে নেক আমল করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। তাঁরা দুনিয়াবি কাজকর্ম কমিয়ে দিয়ে বেশির ভাগ সময় মসজিদেই ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন। এ সময় তাঁরা অধিক পরিমাণে দান-সদকাও করতেন। বাজারে বাজারে ঘুরে ঘুরে অনাথ, অসহায়, দরিদ্রদের খুঁজে খুঁজে বের করে দান-সদকা করতেন। কারণ, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ্ তাআলা মানবসন্তানকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি দান করো। তাহলে তোমার জন্য আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দান করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘হে আদমসন্তান, যদি তোমরা অতিরিক্ত সম্পদ দান করো, তাহলে তা তোমার জন্য কল্যাণকর হবে। আর যদি তা সঞ্চয় করে রাখো, তাহলে তা হবে তোমার জন্য অকল্যাণকর। তবে হ্যাঁ, তোমার জীবনধারণের ন্যূনতম সম্পদের জন্য তোমাকে শাস্তি দেওয়া হবে না। এ দানের সূচনা করো (তোমার গরিব আত্মীয়স্বজন) পরিবার থেকেই।’ (মুসলিম)
মাহে রমজানের শেষ দিকে, বিশেষ করে রমজানের শেষ জুমায় রাসুল (সা.) অশ্রু-ছলছল চোখে মাহে রমজানকে বিদায় জানাতেন আর আল্লাহ্র কাছে এই বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ্! আমাদের মাহে রমজানের রহমত, বরকত নসিব করো। আর আমাদের আগামী রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।’ আমরাও দুঃখভারাক্রান্ত হূদয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের এই মহান মাসকে বিদায় জানাচ্ছি; যে মাসের প্রত্যাশায় বিশ্বের মুমিন মুত্তাকিরা অধীর আগ্রহে দীর্ঘ ১১ মাস অপেক্ষা করছিলেন। হে আল্লাহ্! আমাদের কবুল করুন। জানি না, কবে আবার পবিত্র রমজান মাস পাব আর ইবাদত-বন্দেগিতে আরও অগ্রগামী হতে পারব। আল বিদা মাহে রমজান।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
আর কয়েক দিন পরই মসজিদে মসজিদে আর তারাবির জামাতে শরিক হতে আসা মুসল্লিদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়বে না। সেহির খাওয়া শেষ করে পাড়া-মহল্লার যুবক, কিশোর বৃদ্ধ মুসল্লিদের দল বেঁধে ফজরের নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়বে না। ইফতারের পূর্বমুহূর্তের শান্তিময় বেহেশতি পরিবেশ লক্ষ করা যাবে না। সবই আবার আগের মতো হয়ে যাবে।
প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘রমজান মাসের প্রতিদিন ও রাতে দোজখের বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয় আর প্রত্যেক মুসলমানের একটি দোয়া অবশ্যই আল্লাহ্ পাকের দরবারে কবুল হয়।’ মাহে রমজানের শেষ প্রান্তে এসে আমাদের প্রত্যেকেরই আত্মজিজ্ঞাসা—গুনাহ্ মাফ করার, মাগফিরাত লাভ করার এবং দোজখের আগুন থেকে মুক্তি পেয়ে চিরশান্তির বেহেশত লাভ করার উত্তম সুযোগের এই ফজিলত ও বরকতপূর্ণ মাসকে কি আমরা যথাযথ কাজে লাগাতে পেরেছি? আমরা কি আমাদের গুনাহ্ মাফ করাতে পেরেছি? আমরা কি মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমাদের দোয়া কবুল করাতে পেরেছি? আমরা কি ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সম্যক উপলব্ধির মাধ্যমে অনাহারী গরিব-দুঃখীর কষ্ট অনুভব করতে পারছি? সারা বছর তাঁদের জন্য কিছু করার মানসিকতা কি আমাদের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে?
হজরত কাব ইবনে আজুরাহ (রা.) এক হাদিসে বর্ণনা করেছেন, ‘একদিন রাসুল (সা.) তাঁর মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে কদম মোবারক রেখে বললেন, আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে আরোহণ করে বললেন, আমিন। তৃতীয় সিঁড়িতে পৌঁছেও বললেন, আমিন। পরে সাহাবিরা যখন এর কারণ জানতে চাইলেন, তখন তিনি বললেন, আমার নিকট জিবরাইল (আ.) এসেছিলেন। তিনি দোয়া করেছেন: যে ব্যক্তি রমজানের সুযোগ পেয়েছে অথচ সে ইবাদতের মাধ্যমে তার গুনাহ্ মাফ করাতে পারেনি, তার জন্য অভিসম্পাত। তখন আমি বলেছি, আমিন। (অর্থাৎ হে আল্লাহ্! কবুল করুন।) এরপর যখন জিবরাইল (আ.) বলেছেন, তার প্রতি অভিসম্পাত, যার সামনে রাসুল (সা.)-এর নাম আলোচনা হয় অথচ সে তাঁর প্রতি দরুদ পাঠ করে না। তখন আমি বলেছি, আমিন। এরপর যখন জিবরাইল (আ.) বলেছেন, সেই ব্যক্তির প্রতি অভিসম্পাত, যে ব্যক্তি তার মা-বাবা উভয়কে অথবা তাঁদের যেকোনো একজনকে পেয়ে তাঁদের সেবাযত্ন ও খেদমত করে জান্নাতের ব্যবস্থা করতে পারল না। তখন আমি বলেছি, আমিন।’ এই হাদিস শোনার পর থেকে মাহে রমজানের শেষ দিকে সাহাবিরা এই ভেবে মনে মনে খুবই উৎকণ্ঠিত থাকতেন—আমরা কি মাহে রমজানে ইবাদতের মাধ্যমে আমাদের গুনাহ্ মাফ করাতে পেরেছি? মাহে রমজানের শেষ দিকে সাহাবিদের মধ্যে নেক আমল করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। তাঁরা দুনিয়াবি কাজকর্ম কমিয়ে দিয়ে বেশির ভাগ সময় মসজিদেই ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাতেন। এ সময় তাঁরা অধিক পরিমাণে দান-সদকাও করতেন। বাজারে বাজারে ঘুরে ঘুরে অনাথ, অসহায়, দরিদ্রদের খুঁজে খুঁজে বের করে দান-সদকা করতেন। কারণ, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ্ তাআলা মানবসন্তানকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমি দান করো। তাহলে তোমার জন্য আল্লাহ্র পক্ষ থেকে দান করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘হে আদমসন্তান, যদি তোমরা অতিরিক্ত সম্পদ দান করো, তাহলে তা তোমার জন্য কল্যাণকর হবে। আর যদি তা সঞ্চয় করে রাখো, তাহলে তা হবে তোমার জন্য অকল্যাণকর। তবে হ্যাঁ, তোমার জীবনধারণের ন্যূনতম সম্পদের জন্য তোমাকে শাস্তি দেওয়া হবে না। এ দানের সূচনা করো (তোমার গরিব আত্মীয়স্বজন) পরিবার থেকেই।’ (মুসলিম)
মাহে রমজানের শেষ দিকে, বিশেষ করে রমজানের শেষ জুমায় রাসুল (সা.) অশ্রু-ছলছল চোখে মাহে রমজানকে বিদায় জানাতেন আর আল্লাহ্র কাছে এই বলে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ্! আমাদের মাহে রমজানের রহমত, বরকত নসিব করো। আর আমাদের আগামী রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।’ আমরাও দুঃখভারাক্রান্ত হূদয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের এই মহান মাসকে বিদায় জানাচ্ছি; যে মাসের প্রত্যাশায় বিশ্বের মুমিন মুত্তাকিরা অধীর আগ্রহে দীর্ঘ ১১ মাস অপেক্ষা করছিলেন। হে আল্লাহ্! আমাদের কবুল করুন। জানি না, কবে আবার পবিত্র রমজান মাস পাব আর ইবাদত-বন্দেগিতে আরও অগ্রগামী হতে পারব। আল বিদা মাহে রমজান।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফারসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
masaburk@yahoo.com
No comments