চারদিক- দিঘিকাহিনি by আবদুল মান্নান
কারও মতে ‘কমলা রানী’ বা ‘সুতানালি’, আবার কারও কারও কাছে ‘রানী বিরহিণী’ নামে দিঘিটি পরিচিত। এই বিশাল দিঘির নামকরণে রয়েছে চমকপ্রদ প্রাচীন কাহিনি। তবে দিঘিটি এলাকায় সুতানালি নামে বেশি পরিচিত। ৬০ একর (১৮০ বিঘা) জমির ওপর দিঘিটি। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার শালমারা গ্রামে অবস্থিত।
এটি এলাকার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রতিদিন উৎসুক মানুষ ছুটে আসে একনজর এ দিঘিটি দেখার জন্য।
উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়ন। ইউনিয়নের শালমারা গ্রামে দিঘিটি অবস্থিত। দিঘিটি কে, কখন, কোন উদ্দেশ্যে খনন করেছিলেন, তার ইতিহাসনির্ভর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে জানা যায়, মোগল আমলের শেষের দিকে এ গ্রামে কোনো এক সামন্ত রাজার বাড়ি ছিল। আবার কেউ বলেন, এখানে একটি বৌদ্ধবিহার ছিল।
কথিত আছে, সামন্ত রাজা রানিকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের জন্য উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এবং সামান্ত রাজা রানিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি কী চাও?’
রানি বলেন, ‘ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে যেহেতু দিতে চান, তা হলে এমন কিছু দান করুন, যা যুগ যুগ ধরে মানুষ আমাকে মনে রাখবে।’
রাজবংশী সামন্ত রাজা রানিকে খুশি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবিরাম এক দিন এক রাত সুতা কাটা হবে। যে পরিমাণ সুতা হবে, সেই সুতার সমপরিমাণ লম্বা এবং প্রশস্ত একটি দিঘি খনন করা হবে। সেই দিঘির জল জনগণ ব্যবহার করবে। সেই সঙ্গে তোমাকে স্মরণে রাখবে।
রানির সম্মতিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী খননকাজ শুরু হলো। দিনের পর দিন খননকাজ চলতে থাকে। নির্মিত হয় বিশাল এক দিঘি। এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের মানুষ চেনা যায় না। কথিত আছে, খননেন পর দিঘিতে জল ওঠেনি। জল না ওঠায় নিচের দিকে যতটুকু খনন করা সম্ভব, তাও করা হয়। তবু জল না ওঠায় রাজা, প্রজা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে কমলা রানী নাকি স্বপ্নাদেশ পান, ‘গঙ্গাপূজা কর, নর বলি দিয়া, তবেই উঠিবে দিঘি জলেতে ভরিয়া।’
স্বপ্ন দেখে রানি চিন্তিত হয়ে পড়েন। নরবলি দিতে তিনি নারাজ। নরবলি না দিয়ে রানি গঙ্গামাকে প্রণতি জানান। মহাধুমধামে বাদ্যবাজনা বাজিয়ে দিঘির মধ্যে গঙ্গাপূজার বিরাট আয়োজন করা হয়। কমলা রানী গঙ্গামায়ের পায়ে প্রার্থনা জানিয়ে বলেন, ‘কোন মায়ের বুক করিয়া খালি/ তোমারে দিব মাতা নরবলি? আমি যে সন্তানের মা, আশায় করিয়া ক্ষমা কোলে তুলিয়া নাও। মা পূর্ণ কর তোমার পূজা’। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে দিঘির তলায় মাটির ফাটল দিয়ে জল উঠতে লাগল। লোকজন হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে পাড়ে উঠল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে দিঘির টইটম্বুর জলে রানি তলিয়ে গেলেন। কমলা রানীর আর তীরে উঠে আসা সম্ভব হয়নি। রাজার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন। সেই থেকে কমলা রানী বা সুতানালি নামেই এ দিঘি পরিচিতি পায়।
সাবেক এমপি ও মন্ত্রী অধ্যাপক আবদুস সালাম রচিত নালিতাবাড়ী মাটি মানুষ এবং আমি বই থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শালমারা গ্রামে সশাল নামের এক গারো রাজা রাজত্ব করতেন। শালমারা গ্রামের উত্তরে গারো পাহাড় পর্যন্ত তাঁর অধীনে ছিল। সামস-ইলিয়াস শাহ তখন বাংলার শাসনকর্তা। ১৩৫১ সালে তিনি সশাল রাজার বিরুদ্ধে সেনা প্রেরণ করেন। সশাল রাজার রাজধানী ছিল শালমারা গ্রামে। রাজা পলায়ন করে আশ্রয় নেন জঙ্গলে। পরবর্তীকালে গারো রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর রাজা সশাল শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দিঘির মাঝখানে ছোট একটি ঘর তৈরি করে চারদিকে পরিখার মতো খনন করেন। রাজা যখন সেখানে অবস্থান করতেন, তখন তাঁর বাহিনী বড় বড় ডিঙি নৌকা নিয়ে চারদিকে পাহারা দিত। কালক্রমে, ওই ভূখণ্ডটি ধসে দিঘিতে রূপ নিয়েছে। রাজার শেষ বংশধর ছিলেন রানী বিরহিণী। দিঘিটি রানী বিরহিণী নামে পরিচিতি পায়। ১৯৪০ সালে সরকারি ভূমি জরিপে দিঘিটিকে রানী বিরহিণী নামেই রেকর্ড করা হয়েছে। তবে দিঘিটি খননের সত্যিকার দিন, ক্ষণ, ইতিহাস জানা না গেলেও এটা যে একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন, এ বিষয়ে এলাকার কারও সন্দেহ নেই। দীর্ঘদিন দিঘিটি পরিত্যক্ত থাকায় জলের ওপর শৈবাল জমে ওঠে। শৈবালগুলো এত ভারী হয়ে ওঠে যে এর ওপর গজিয়ে ওঠে ঘাস। যার ওপর গরু অবাধে ঘাস খেতে পারত। ১৯৭২ সালে প্রথম দিঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে এই দিঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘সুতানালি দিঘিপাড় ভূমিহীন মজাপুকুর সমবায় সমিতি’। ১৯৮৪ সালে সমিতি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে সমিতির সদস্যসংখ্যা ১১৮ জন। সব সদস্যই দিঘির পাড়ে ঘরবাড়ি করে বসবাস করেন। দিঘিটি কেন্দ্র করে প্রতিবছর এখানে শৌখিন মৎস্য শিকারিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সারা দেশ থেকে মৎস্য শিকারিরা সমিতির দেওয়া টিকিটের মাধ্যমে মাছ শিকার করে থাকেন। এ দিঘির মাছ খুব সুস্বাদু বলে প্রশংসা রয়েছে। ঐতিহাসিক এ দিঘিকে কেন্দ্র করে ভূমিহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রতিবছর দূর-দূরান্ত থেকে শৌখিন মৎস্য শিকারি ও উৎসুক মানুষের আনাগোনায় পরিবেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর।
আবদুল মান্নান
নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়ন। ইউনিয়নের শালমারা গ্রামে দিঘিটি অবস্থিত। দিঘিটি কে, কখন, কোন উদ্দেশ্যে খনন করেছিলেন, তার ইতিহাসনির্ভর কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে জানা যায়, মোগল আমলের শেষের দিকে এ গ্রামে কোনো এক সামন্ত রাজার বাড়ি ছিল। আবার কেউ বলেন, এখানে একটি বৌদ্ধবিহার ছিল।
কথিত আছে, সামন্ত রাজা রানিকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের জন্য উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এবং সামান্ত রাজা রানিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি কী চাও?’
রানি বলেন, ‘ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে যেহেতু দিতে চান, তা হলে এমন কিছু দান করুন, যা যুগ যুগ ধরে মানুষ আমাকে মনে রাখবে।’
রাজবংশী সামন্ত রাজা রানিকে খুশি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবিরাম এক দিন এক রাত সুতা কাটা হবে। যে পরিমাণ সুতা হবে, সেই সুতার সমপরিমাণ লম্বা এবং প্রশস্ত একটি দিঘি খনন করা হবে। সেই দিঘির জল জনগণ ব্যবহার করবে। সেই সঙ্গে তোমাকে স্মরণে রাখবে।
রানির সম্মতিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী খননকাজ শুরু হলো। দিনের পর দিন খননকাজ চলতে থাকে। নির্মিত হয় বিশাল এক দিঘি। এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের মানুষ চেনা যায় না। কথিত আছে, খননেন পর দিঘিতে জল ওঠেনি। জল না ওঠায় নিচের দিকে যতটুকু খনন করা সম্ভব, তাও করা হয়। তবু জল না ওঠায় রাজা, প্রজা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে কমলা রানী নাকি স্বপ্নাদেশ পান, ‘গঙ্গাপূজা কর, নর বলি দিয়া, তবেই উঠিবে দিঘি জলেতে ভরিয়া।’
স্বপ্ন দেখে রানি চিন্তিত হয়ে পড়েন। নরবলি দিতে তিনি নারাজ। নরবলি না দিয়ে রানি গঙ্গামাকে প্রণতি জানান। মহাধুমধামে বাদ্যবাজনা বাজিয়ে দিঘির মধ্যে গঙ্গাপূজার বিরাট আয়োজন করা হয়। কমলা রানী গঙ্গামায়ের পায়ে প্রার্থনা জানিয়ে বলেন, ‘কোন মায়ের বুক করিয়া খালি/ তোমারে দিব মাতা নরবলি? আমি যে সন্তানের মা, আশায় করিয়া ক্ষমা কোলে তুলিয়া নাও। মা পূর্ণ কর তোমার পূজা’। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে দিঘির তলায় মাটির ফাটল দিয়ে জল উঠতে লাগল। লোকজন হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে পাড়ে উঠল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে দিঘির টইটম্বুর জলে রানি তলিয়ে গেলেন। কমলা রানীর আর তীরে উঠে আসা সম্ভব হয়নি। রাজার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন। সেই থেকে কমলা রানী বা সুতানালি নামেই এ দিঘি পরিচিতি পায়।
সাবেক এমপি ও মন্ত্রী অধ্যাপক আবদুস সালাম রচিত নালিতাবাড়ী মাটি মানুষ এবং আমি বই থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শালমারা গ্রামে সশাল নামের এক গারো রাজা রাজত্ব করতেন। শালমারা গ্রামের উত্তরে গারো পাহাড় পর্যন্ত তাঁর অধীনে ছিল। সামস-ইলিয়াস শাহ তখন বাংলার শাসনকর্তা। ১৩৫১ সালে তিনি সশাল রাজার বিরুদ্ধে সেনা প্রেরণ করেন। সশাল রাজার রাজধানী ছিল শালমারা গ্রামে। রাজা পলায়ন করে আশ্রয় নেন জঙ্গলে। পরবর্তীকালে গারো রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর রাজা সশাল শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দিঘির মাঝখানে ছোট একটি ঘর তৈরি করে চারদিকে পরিখার মতো খনন করেন। রাজা যখন সেখানে অবস্থান করতেন, তখন তাঁর বাহিনী বড় বড় ডিঙি নৌকা নিয়ে চারদিকে পাহারা দিত। কালক্রমে, ওই ভূখণ্ডটি ধসে দিঘিতে রূপ নিয়েছে। রাজার শেষ বংশধর ছিলেন রানী বিরহিণী। দিঘিটি রানী বিরহিণী নামে পরিচিতি পায়। ১৯৪০ সালে সরকারি ভূমি জরিপে দিঘিটিকে রানী বিরহিণী নামেই রেকর্ড করা হয়েছে। তবে দিঘিটি খননের সত্যিকার দিন, ক্ষণ, ইতিহাস জানা না গেলেও এটা যে একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন, এ বিষয়ে এলাকার কারও সন্দেহ নেই। দীর্ঘদিন দিঘিটি পরিত্যক্ত থাকায় জলের ওপর শৈবাল জমে ওঠে। শৈবালগুলো এত ভারী হয়ে ওঠে যে এর ওপর গজিয়ে ওঠে ঘাস। যার ওপর গরু অবাধে ঘাস খেতে পারত। ১৯৭২ সালে প্রথম দিঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে এই দিঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘সুতানালি দিঘিপাড় ভূমিহীন মজাপুকুর সমবায় সমিতি’। ১৯৮৪ সালে সমিতি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে সমিতির সদস্যসংখ্যা ১১৮ জন। সব সদস্যই দিঘির পাড়ে ঘরবাড়ি করে বসবাস করেন। দিঘিটি কেন্দ্র করে প্রতিবছর এখানে শৌখিন মৎস্য শিকারিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সারা দেশ থেকে মৎস্য শিকারিরা সমিতির দেওয়া টিকিটের মাধ্যমে মাছ শিকার করে থাকেন। এ দিঘির মাছ খুব সুস্বাদু বলে প্রশংসা রয়েছে। ঐতিহাসিক এ দিঘিকে কেন্দ্র করে ভূমিহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রতিবছর দূর-দূরান্ত থেকে শৌখিন মৎস্য শিকারি ও উৎসুক মানুষের আনাগোনায় পরিবেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর।
আবদুল মান্নান
নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
No comments