বিশেষ সাক্ষাৎকার : কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম-সারা জীবনে এত অপ্রিয় সরকার দেখিনি
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে এর প্রতিবাদে তিনি ভারতে চলে যান। ১৯৯০ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
১৯৯৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ নামের রাজনৈতিক দল গঠন করেন। কালের কণ্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য
কালের কণ্ঠ : স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। কেমন করছে সরকার?
কাদের সিদ্দিকী : সরকার ভালো করলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু রাস্তাঘাটে বের হলে যা দেখি, তাতে সরকার ভালো করছে- রোজার দিনে এ কথা হৃদয় থেকে বলতে পারছি না। এর জন্য নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এমন অপ্রিয় সরকার আর দেখিনি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করেছি, হাজার হাজার মানুষকে পাশে পেয়েছি; কিন্তু তখনো ঊনসত্তরের আগ পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে সভা-সমাবেশ করতে গিয়ে আইয়ুব খানের পক্ষেও লোক দেখেছি। তারা অন্তর থেকে আইয়ুব খানকে সমর্থন করেছে। কিন্তু এখন মহাজোট সরকারের পক্ষে নিবেদিত একজনও সে রকমভাবে দেখি না। রাস্তাঘাটে তো দেখা যায় না, দলের অনেক নেতা-কর্মীও খুব হতাশ। তাই বলতে হয়, সরকার খুব একটা ভালো করছে না। যেখানেই যাবেন, সরকারের যে পরিমাণ সমালোচনা শুনবেন, অতীতে কোনো সরকারের এত সমালোচনা হয়নি।
মানুষের জীবন এখন নিরাপদ নয়, সম্পদ নিরাপদ নয়। প্রধানমন্ত্রী বললেন, বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। দায়িত্বশীল সরকার হলে এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পদত্যাগ করা উচিত ছিল। মানুষের বেডরুম পাহারা তো বড় কথা, প্রয়োজন হলে বাথরুম পাহারা দিতে হবে। কারণ দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার অঙ্গীকার নিয়ে সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
কালের কণ্ঠ : মহাজোট মন্ত্রিসভার সদস্যরা কেমন করছেন। আপনার মূল্যায়ন কী এই মন্ত্রিসভা নিয়ে?
কাদের সিদ্দিকী : মহাজোটের মন্ত্রিসভা মানুষকে আশাহত করেছে। মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি কিভাবে সরকার চালাবেন, সেটা তাঁর একান্তই নিজের বিষয়। গণতন্ত্রে দলের হওয়ার কথা সুপ্রিম পাওয়ার। সরকার কী করবে তা দল ঠিক করে দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের গণতন্ত্রে দলের কোনো ক্ষমতা নেই। সরকারের ওপর দলের ক্ষমতা ছিল ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট যখন সরকার গঠন করেছিল তখন। প্রধানমন্ত্রীকে দলের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। বঙ্গবন্ধুও মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ সম্মানজনক মনে করেছিলেন। আগে দল ছিল ওপরে, সরকার ছিল নিচে। কিন্তু আজ দল নিচে, সরকার ওপরে। দলের যিনি প্রধান, সরকারেরও তিনি প্রধান- গণতন্ত্রের জন্য এটা অশনিসংকেত। এটা গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের নামান্তর, যা আমাদের দেশে চলছে। এমন এককেন্দ্রিক গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও খারাপ।
কালের কণ্ঠ : সরকার ভালো করছে না আপনি বললেন। বিরোধী দল বিএনপি কি মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে?
কাদের সিদ্দিকী : বিরোধী দল হয় সব সময় দেশবাসীর পাহারাদার। বিরোধী দল যদি তার যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে দেশের জনগণ নিরাপদ থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হলো, আমাদের দেশে সরকারের মতো বিরোধী দল দেশবাসীর প্রতি তাদের দায়িত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি, যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিরোধী দল কখনো যতটা গুরুত্বসহকারে গণমানুষের কথা তুলে ধরা উচিত ছিল, জনগণের দাবির জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম করার কথা ছিল, তা তারা পারছে না। তারা যেটা করছে, তার অনেকটায় তাদের ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে। ফলে জনসাধারণ তাদের আস্থায় আনতে পারছে না। তারাও জনগণকে তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারছে না।
কালের কণ্ঠ : কোন ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী নির্বাচন হবে, এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি মুখোমুখি। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
কাদের সিদ্দিকী : অসৎ চিন্তা নিয়ে কোনো কাজ করলে বা অন্যের জন্য ফাঁদ খুঁড়লে সেই ফাঁদে নিজেকেই পড়তে হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সোচ্চার ছিলেন। এমনকি সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী, কেমন এবং কত প্রকার। সেই মানুষই সংবিধানে লিপিবদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অযথা একটা ঝামেলা তৈরির জন্য বাতিল করে দিলেন। দেশের রাজনীতিবিদদের আস্থাহীনতার কারণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প এখনো নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠতে পারেনি। নিজের স্বার্থ, নিজের দলের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় আনতে পারছে না। এটা জাতির জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। তবে এই ভূখণ্ডে এর চেয়েও অনেক সমস্যা এসেছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সব বিপদ থেকে উত্তরণ ঘটেছে। ইনশাআল্লাহ এবারও বিপদ থেকে উত্তরণ হবে, তবে কিছুটা পানি ঘোলা করে।
বর্তমান সরকার যেটা ভাবছে, তাদের অধীনে নির্বাচন করলে তারা আবারও ক্ষমতায় চলে যাবে। হয়তো যেতেও পারে, তবে পরিণতি ১৯৯৬ সালের বিএনপি সরকারের চেয়ে ভালো কিছু হবে না। সেবার বিএনপি তিন-চার মাস ক্ষমতায় ছিল, এবার এরা হয়তো ছয় মাস থাকবে। বাংলার মানুষ একবার কোনো কিছু প্রত্যাখ্যান করলে সেটা দমন করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এইচ এম এরশাদ টেকেননি জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে। একসময় খালেদা জিয়াকেও নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এসব দেখেও যদি শিক্ষা না হয়, তবে যেমন করবে তেমন ফল ভোগ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ জোট বাড়ানোর জন্য আপনার দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। সেটার ফলাফল কী?
কাদের সিদ্দিকী : এখন সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ হয়। সবাই চায় শক্তি বৃদ্ধি করতে। আমরাও চাই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে। যখন আওয়ামী লীগ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তখন আমরা যদি মনে করতাম, যোগাযোগ করলে আমাদের ক্ষতি হবে, তাহলে যোগাযোগ হতো না। তারা মনে করেছে, আমাদের সঙ্গে কথা বললে তাদের সুবিধা হবে, তাই কথা বলেছে। সবাই সবার লাভ খোঁজে। আল্লাহ অন্তর্যামী তিনিই একমাত্র জানেন, কার কতটা লাভ।
কালের কণ্ঠ : দেশে এখন অনেকে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার কথা বলছেন। আপনি কি মনে করেন, তাঁদের মাইনাস করলে রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে?
কাদের সিদ্দিকী : রাজনীতিতে মাইনাস করা যায় না। এটা অবাস্তব। রাজনীতিতে নিজের গুণ ও দক্ষতায় যেমন প্লাস হয়, তেমনি নিজের অযোগ্যতায় নিজে নিজেকে মাইনাস করে ফেলে। রাজনীতিতে কেউ কাউকে মাইনাস করতে পারে না।
কালের কণ্ঠ : বড় দুই দলের বাইরে কোনো বিকল্প শক্তি ক্ষমতায় গেলে কি দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব?
কাদের সিদ্দিকী : দুই দলের অনেক শক্তি আছে। কিন্তু তাদের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা নেই, মায়া নেই। এই দুই দলের প্রতি দুই দলের নেতা-কর্মীদেরও নাড়িছেঁড়া টান নেই। অধিকাংশই সুবিধার জন্য দলের সঙ্গে থাকেন। 'জন্মিলে মরিতে হবে'- এটা যেমন অত্যন্ত স্বাভাবিক। মানুষের যেমন মৃত্যু আছে, দলেরও অধঃপতন আছে। দলও বৃদ্ধ হয়, বিলুপ্ত হয়। এর আগে বহু দল বিলুপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ, জার্মানির নাৎসি পার্টি বিলীন হয়ে গেছে।
কালের কণ্ঠ : বড় দুই দলের মধ্যে ছোট ছোট দলের ভবিষ্যৎ কী? এরা কি ক্ষমতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশীদার হয়েই থাকবে?
কাদের সিদ্দিকী : ভবিষ্যৎ কী হবে তা একমাত্র ভবিতব্যই জানে। রাজনৈতিক নেতার ঐক্য বা দলের ঐক্য বড় বিষয় নয়। দেশের আমজনতার কোনো বিষয় নিয়ে যখন ঐক্য হয়, সেটা সফল পরিণতির দিকে যায়। যারা আছে, তারাই চিরকাল থাকবে, যাদের দেখা পাওয়া যায়নি, তারা আসবে না- এটা ঠিক নয়। আমরা যদি উপযুক্ততার পরিচয় দিতে পারি, মানুষ যা চাইছে তা বলতে পারি এবং তাদের পাহারাদার হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাহলে আমাদেরও ভবিষ্যৎ আছে। চির সত্য বলে কিছু নয়।
কালের কণ্ঠ : আপনি এবং আপনার মতো অনেক রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছেন। ১/১১-এর প্রেক্ষাপটে দলের অনেক নেতা সাইডলাইনে চলে গেছেন। এতে কি আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়েছে?
কাদের সিদ্দিকী : এসব কারণে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়নি। আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়েছে দলে গণতন্ত্র না থাকার কারণে। আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে নিবেদিত কর্মীরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার কারণে। সব দলেই চাটুকারদের প্রাধান্য বেশি, নিবেদিত কর্মীদের গুরুত্ব নেই। নেতৃত্ব ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর কারণে বহুদিন বাংলাদেশে কোনো নেতা গড়ে উঠছে না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। এগুলো থেকেই ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা বেরিয়ে আসার কথা। এখান থেকে নেতা বেরিয়ে না এসে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, দখলবাজরা বের হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত নেতা নির্বাচিত হলে ঠিকই প্রতিবছর কয়েক হাজার প্রকৃত নেতা বেরিয়ে আসত। তাহলে জাতীয়ভাবে এই নেতৃত্বের সংকট তৈরি হতো না।
কালের কণ্ঠ : স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে ১৯৯০ সালে। তারপর গত দুই দশকে কি দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে?
কাদের সিদ্দিকী : স্বৈরাচারের পতনের পর গণতন্ত্র কিছুই আগায়নি। বরং আগে স্বৈরাচারের আমলে যে গণতন্ত্র ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোতে যে গণতান্ত্রিক শাসন ছিল, তা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন গণতন্ত্রই স্বৈরতন্ত্রের রূপ ধারণ করেছে। এটা জাতির জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত।
কালের কণ্ঠ : পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। আপনি কিভাবে দেখেন বিষয়টিকে?
কাদের সিদ্দিকী : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন উচ্চমহলেই বেশি আলোচিত হচ্ছে। বুদ্ধিমানদের হৃদয়ে এর জায়গা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা নিয়ে এত বেশি চিন্তিত যে এসব ব্যাপারে তাদের চিন্তা করার সুযোগ কম।
পানিতে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা চলে না। আসলে কেউ সাধু নয়। আজ কদিন ধরে দেখছি, আমেরিকাকে নিয়ে বেশি কথা বলা হচ্ছে। এই মহাজোট সরকার তো আমেরিকার সাপোর্ট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংককে এত বেশি গালাগাল করাটা ঠিক নয়।
কালের কণ্ঠ : সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের মাধ্যমে কি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ প্রমাণ হলো না?
কাদের সিদ্দিকী : একজন মানুষের পদত্যাগের মাধ্যমে তার দোষ প্রমাণ হয় না। তবে পদত্যাগের পরও প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখেন। খুব সম্ভব একমাত্র তাঁকেই দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর আস্থার লোকদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। আর প্রধানমন্ত্রীর এত আস্থা যাঁর ওপর, তাঁর মন্ত্রিত্ব যাওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী এখন যদি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন, তবে সেটা পুরোপুরি সংবিধানসম্মত হবে না। আবার তাঁর পদত্যাগপত্র এখন পর্যন্ত গ্রহণ না করে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করছে। এখন হয়তো সরকারকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। কিন্তু সময় আসবে- এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের অবস্থানকে কিভাবে দেখেন?
কাদের সিদ্দিকী : আগে শুনতাম- নাই কাজ তো খই ভাজ। আমার মনে হয়, সরকারের কোনো কাজ নেই। এ জন্য গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের এত নড়াচড়া। সব ব্যাংক যে নিয়মে চলে, গ্রামীণ ব্যাংকও সেই নিয়মে চলবে। হয়তো কিছু মানুষ গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে বেশির ভাগ মানুষ লাভবান হয়েছে। ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এমন সময় তাঁর পেছনে লাগা সরকারের ঠিক হয়নি। অন্যদিকে ইউনূস নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর তাকে সম্মান না জানানো হোক, আমাদের একমাত্র নোবেলপ্রাপ্তিতে যথাযোগ্য সম্মান জানানো উচিত ছিল। আমরা যদি নোবেলপ্রাপ্তির বিরোধিতা করি, তবে আমরা যে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, এর জন্য আড়ম্বর করে বর্ষপূর্তি করা উচিত ছিল। কাজগুলো ঠিক হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমাদের বিবেক আমরা কোথাও বন্ধক দিয়ে দিয়েছি।
কালের কণ্ঠ : আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক শীতল বলে মনে হচ্ছে। সরকার কি ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে?
কাদের সিদ্দিকী : দেশের মানুষের প্রতি ভরসা না করে বিশ্বনেতা হওয়ার জন্য এত ছোটাছুটি করলে তার পরিণতি এর চেয়ে ভালো হওয়ার কথা নয়। বর্তমান নেতাদের যা দেখছি, তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় নেতা হিসেবে আচরণ করছেন। এতবার এত বেশি দেশের টাকা খরচ করে বিশ্ব ফোরামে গেলে তার পরিণতি ভালো হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এত বিদেশ সফর করেছেন যে আমেরিকার একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকেও পেছনে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বলতেই হবে, আমাদের সরকার বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। সরকার বন্ধুহীন হলে কোনো সমস্যা ছিল না, দেশটা যদি বন্ধুহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যের।
কালের কণ্ঠ : অভিযোগ আছে, সরকারের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি একমুখী। শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে বর্তমান সরকার। আপনি কি এ ব্যাপারে একমত?
কাদের সিদ্দিকী : ভারতের সঙ্গে এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের অন্তরের সম্পর্ক সবচেয়ে নিম্নমানের। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে এই ভূখণ্ডের পাকিস্তান আমলের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। তবে স্বাধীনতার পর সেই সম্পর্ক সঠিকভাবে লালন-পালন করা হয়নি। কিন্তু তার পরও একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ-ভারত সরকারের হয়তো মধুর সম্পর্ক আছে, তবে বাংলাদেশের জনসাধারণের সঙ্গে ভারতের জনসাধারণের সম্পর্ক খুবই নিম্নমানের। কোনো উসকানি ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু নয়, আওয়ামী লীগের বন্ধু। একজন রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন, অনেকে মনে করে, এতেও ভারতের হাত আছে। এই মনে করা ভালো সম্পর্ক নয়। আজ বাদে কাল আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না থাকে, তবে কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে? যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে? ভারতের উচিত বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। অন্যদিকে বাংলাদেশের উচিত শুধু কংগ্রেস নয়, ভারতের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দীর্ঘদিন পর। এই বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আপনার অভিমত কী?
কাদের সিদ্দিকী : বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আমি খুশি নই। যুদ্ধাপরাধের বিচার কত দিন পর হচ্ছে সেটা বিবেচ্য নয়। প্রকৃত বিচার হচ্ছে কি না সেটাই বড় ব্যাপার। এখন যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের অনেকেই সেই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল না। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য এই বিচার হলে সেটা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনো অপরাধ হয়তো এক হাজার মানুষ করেছে। এর মধ্যে হয়তো ১০ জনকে পছন্দ না, সেই ১০ জনের বিচার হলো- এটা প্রকৃত বিচার নয়। যুদ্ধাপরাধের মূল আসামি পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তাদের একজনকেও এই বিচারে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি। মূল আসামি বাদ দিয়ে ডালপালার বিচার হচ্ছে। যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, তাতে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই সেটাই আগে প্রমাণ করতে হবে। প্রসিকিউশন টিমে যাঁরা আছেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কী করেছেন, কোথায় ছিলেন, সেটা জাতিকে জানাতে হবে। পাঁচজন-সাতজনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জাতির সামনে প্রমাণ করবেন বিচার হচ্ছে, সেটা ঠিক হবে না। আমার মনে হচ্ছে, এটা আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সাজানো-গোছানো নাটক। দেশে বড় বড় আইনজ্ঞ রয়েছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁদের কেউ চেনে না, তাঁদের প্রসিকিউশন টিমে রাখা হয়েছে। তাহলে এটা নিয়ে কি ছেলেখেলা হচ্ছে? দেড়-দুই বছর ধরে বিচার হচ্ছে, কই আমার কাছে তো কেউ আসেনি কোনো তথ্য জানার জন্য। যুদ্ধাপরাধের বিচারে মানুষের যে আকুতি ছিল, তা হালকা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি এমন হয়, যাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যদি তলে তলে তাদের সঙ্গে আপস হয়, তাহলে আমরা বিস্মিত হব না।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
কাদের সিদ্দিকী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায়। কেমন করছে সরকার?
কাদের সিদ্দিকী : সরকার ভালো করলে আমার ভালো লাগত। কিন্তু রাস্তাঘাটে বের হলে যা দেখি, তাতে সরকার ভালো করছে- রোজার দিনে এ কথা হৃদয় থেকে বলতে পারছি না। এর জন্য নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এমন অপ্রিয় সরকার আর দেখিনি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করেছি, হাজার হাজার মানুষকে পাশে পেয়েছি; কিন্তু তখনো ঊনসত্তরের আগ পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে সভা-সমাবেশ করতে গিয়ে আইয়ুব খানের পক্ষেও লোক দেখেছি। তারা অন্তর থেকে আইয়ুব খানকে সমর্থন করেছে। কিন্তু এখন মহাজোট সরকারের পক্ষে নিবেদিত একজনও সে রকমভাবে দেখি না। রাস্তাঘাটে তো দেখা যায় না, দলের অনেক নেতা-কর্মীও খুব হতাশ। তাই বলতে হয়, সরকার খুব একটা ভালো করছে না। যেখানেই যাবেন, সরকারের যে পরিমাণ সমালোচনা শুনবেন, অতীতে কোনো সরকারের এত সমালোচনা হয়নি।
মানুষের জীবন এখন নিরাপদ নয়, সম্পদ নিরাপদ নয়। প্রধানমন্ত্রী বললেন, বেডরুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। দায়িত্বশীল সরকার হলে এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পদত্যাগ করা উচিত ছিল। মানুষের বেডরুম পাহারা তো বড় কথা, প্রয়োজন হলে বাথরুম পাহারা দিতে হবে। কারণ দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার অঙ্গীকার নিয়ে সরকার ক্ষমতায় এসেছে।
কালের কণ্ঠ : মহাজোট মন্ত্রিসভার সদস্যরা কেমন করছেন। আপনার মূল্যায়ন কী এই মন্ত্রিসভা নিয়ে?
কাদের সিদ্দিকী : মহাজোটের মন্ত্রিসভা মানুষকে আশাহত করেছে। মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি কিভাবে সরকার চালাবেন, সেটা তাঁর একান্তই নিজের বিষয়। গণতন্ত্রে দলের হওয়ার কথা সুপ্রিম পাওয়ার। সরকার কী করবে তা দল ঠিক করে দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের গণতন্ত্রে দলের কোনো ক্ষমতা নেই। সরকারের ওপর দলের ক্ষমতা ছিল ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট যখন সরকার গঠন করেছিল তখন। প্রধানমন্ত্রীকে দলের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। বঙ্গবন্ধুও মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ সম্মানজনক মনে করেছিলেন। আগে দল ছিল ওপরে, সরকার ছিল নিচে। কিন্তু আজ দল নিচে, সরকার ওপরে। দলের যিনি প্রধান, সরকারেরও তিনি প্রধান- গণতন্ত্রের জন্য এটা অশনিসংকেত। এটা গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের নামান্তর, যা আমাদের দেশে চলছে। এমন এককেন্দ্রিক গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও খারাপ।
কালের কণ্ঠ : সরকার ভালো করছে না আপনি বললেন। বিরোধী দল বিএনপি কি মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে?
কাদের সিদ্দিকী : বিরোধী দল হয় সব সময় দেশবাসীর পাহারাদার। বিরোধী দল যদি তার যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে দেশের জনগণ নিরাপদ থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হলো, আমাদের দেশে সরকারের মতো বিরোধী দল দেশবাসীর প্রতি তাদের দায়িত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি, যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিরোধী দল কখনো যতটা গুরুত্বসহকারে গণমানুষের কথা তুলে ধরা উচিত ছিল, জনগণের দাবির জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম করার কথা ছিল, তা তারা পারছে না। তারা যেটা করছে, তার অনেকটায় তাদের ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে। ফলে জনসাধারণ তাদের আস্থায় আনতে পারছে না। তারাও জনগণকে তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারছে না।
কালের কণ্ঠ : কোন ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী নির্বাচন হবে, এ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি মুখোমুখি। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
কাদের সিদ্দিকী : অসৎ চিন্তা নিয়ে কোনো কাজ করলে বা অন্যের জন্য ফাঁদ খুঁড়লে সেই ফাঁদে নিজেকেই পড়তে হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই সোচ্চার ছিলেন। এমনকি সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী, কেমন এবং কত প্রকার। সেই মানুষই সংবিধানে লিপিবদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অযথা একটা ঝামেলা তৈরির জন্য বাতিল করে দিলেন। দেশের রাজনীতিবিদদের আস্থাহীনতার কারণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প এখনো নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের কাছে আস্থাশীল হয়ে উঠতে পারেনি। নিজের স্বার্থ, নিজের দলের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় আনতে পারছে না। এটা জাতির জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। তবে এই ভূখণ্ডে এর চেয়েও অনেক সমস্যা এসেছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে সব বিপদ থেকে উত্তরণ ঘটেছে। ইনশাআল্লাহ এবারও বিপদ থেকে উত্তরণ হবে, তবে কিছুটা পানি ঘোলা করে।
বর্তমান সরকার যেটা ভাবছে, তাদের অধীনে নির্বাচন করলে তারা আবারও ক্ষমতায় চলে যাবে। হয়তো যেতেও পারে, তবে পরিণতি ১৯৯৬ সালের বিএনপি সরকারের চেয়ে ভালো কিছু হবে না। সেবার বিএনপি তিন-চার মাস ক্ষমতায় ছিল, এবার এরা হয়তো ছয় মাস থাকবে। বাংলার মানুষ একবার কোনো কিছু প্রত্যাখ্যান করলে সেটা দমন করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এইচ এম এরশাদ টেকেননি জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে। একসময় খালেদা জিয়াকেও নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এসব দেখেও যদি শিক্ষা না হয়, তবে যেমন করবে তেমন ফল ভোগ করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ জোট বাড়ানোর জন্য আপনার দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। সেটার ফলাফল কী?
কাদের সিদ্দিকী : এখন সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ হয়। সবাই চায় শক্তি বৃদ্ধি করতে। আমরাও চাই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে। যখন আওয়ামী লীগ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তখন আমরা যদি মনে করতাম, যোগাযোগ করলে আমাদের ক্ষতি হবে, তাহলে যোগাযোগ হতো না। তারা মনে করেছে, আমাদের সঙ্গে কথা বললে তাদের সুবিধা হবে, তাই কথা বলেছে। সবাই সবার লাভ খোঁজে। আল্লাহ অন্তর্যামী তিনিই একমাত্র জানেন, কার কতটা লাভ।
কালের কণ্ঠ : দেশে এখন অনেকে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার কথা বলছেন। আপনি কি মনে করেন, তাঁদের মাইনাস করলে রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে?
কাদের সিদ্দিকী : রাজনীতিতে মাইনাস করা যায় না। এটা অবাস্তব। রাজনীতিতে নিজের গুণ ও দক্ষতায় যেমন প্লাস হয়, তেমনি নিজের অযোগ্যতায় নিজে নিজেকে মাইনাস করে ফেলে। রাজনীতিতে কেউ কাউকে মাইনাস করতে পারে না।
কালের কণ্ঠ : বড় দুই দলের বাইরে কোনো বিকল্প শক্তি ক্ষমতায় গেলে কি দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব?
কাদের সিদ্দিকী : দুই দলের অনেক শক্তি আছে। কিন্তু তাদের প্রতি দেশবাসীর শ্রদ্ধা নেই, মায়া নেই। এই দুই দলের প্রতি দুই দলের নেতা-কর্মীদেরও নাড়িছেঁড়া টান নেই। অধিকাংশই সুবিধার জন্য দলের সঙ্গে থাকেন। 'জন্মিলে মরিতে হবে'- এটা যেমন অত্যন্ত স্বাভাবিক। মানুষের যেমন মৃত্যু আছে, দলেরও অধঃপতন আছে। দলও বৃদ্ধ হয়, বিলুপ্ত হয়। এর আগে বহু দল বিলুপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ, জার্মানির নাৎসি পার্টি বিলীন হয়ে গেছে।
কালের কণ্ঠ : বড় দুই দলের মধ্যে ছোট ছোট দলের ভবিষ্যৎ কী? এরা কি ক্ষমতার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশীদার হয়েই থাকবে?
কাদের সিদ্দিকী : ভবিষ্যৎ কী হবে তা একমাত্র ভবিতব্যই জানে। রাজনৈতিক নেতার ঐক্য বা দলের ঐক্য বড় বিষয় নয়। দেশের আমজনতার কোনো বিষয় নিয়ে যখন ঐক্য হয়, সেটা সফল পরিণতির দিকে যায়। যারা আছে, তারাই চিরকাল থাকবে, যাদের দেখা পাওয়া যায়নি, তারা আসবে না- এটা ঠিক নয়। আমরা যদি উপযুক্ততার পরিচয় দিতে পারি, মানুষ যা চাইছে তা বলতে পারি এবং তাদের পাহারাদার হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাহলে আমাদেরও ভবিষ্যৎ আছে। চির সত্য বলে কিছু নয়।
কালের কণ্ঠ : আপনি এবং আপনার মতো অনেক রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছেন। ১/১১-এর প্রেক্ষাপটে দলের অনেক নেতা সাইডলাইনে চলে গেছেন। এতে কি আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়েছে?
কাদের সিদ্দিকী : এসব কারণে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়নি। আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়েছে দলে গণতন্ত্র না থাকার কারণে। আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে নিবেদিত কর্মীরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার কারণে। সব দলেই চাটুকারদের প্রাধান্য বেশি, নিবেদিত কর্মীদের গুরুত্ব নেই। নেতৃত্ব ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর কারণে বহুদিন বাংলাদেশে কোনো নেতা গড়ে উঠছে না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। এগুলো থেকেই ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা বেরিয়ে আসার কথা। এখান থেকে নেতা বেরিয়ে না এসে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, দখলবাজরা বের হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত নেতা নির্বাচিত হলে ঠিকই প্রতিবছর কয়েক হাজার প্রকৃত নেতা বেরিয়ে আসত। তাহলে জাতীয়ভাবে এই নেতৃত্বের সংকট তৈরি হতো না।
কালের কণ্ঠ : স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে ১৯৯০ সালে। তারপর গত দুই দশকে কি দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে?
কাদের সিদ্দিকী : স্বৈরাচারের পতনের পর গণতন্ত্র কিছুই আগায়নি। বরং আগে স্বৈরাচারের আমলে যে গণতন্ত্র ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোতে যে গণতান্ত্রিক শাসন ছিল, তা ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন গণতন্ত্রই স্বৈরতন্ত্রের রূপ ধারণ করেছে। এটা জাতির জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত।
কালের কণ্ঠ : পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। আপনি কিভাবে দেখেন বিষয়টিকে?
কাদের সিদ্দিকী : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন উচ্চমহলেই বেশি আলোচিত হচ্ছে। বুদ্ধিমানদের হৃদয়ে এর জায়গা বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের মানুষ তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা নিয়ে এত বেশি চিন্তিত যে এসব ব্যাপারে তাদের চিন্তা করার সুযোগ কম।
পানিতে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা চলে না। আসলে কেউ সাধু নয়। আজ কদিন ধরে দেখছি, আমেরিকাকে নিয়ে বেশি কথা বলা হচ্ছে। এই মহাজোট সরকার তো আমেরিকার সাপোর্ট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংককে এত বেশি গালাগাল করাটা ঠিক নয়।
কালের কণ্ঠ : সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের মাধ্যমে কি বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ প্রমাণ হলো না?
কাদের সিদ্দিকী : একজন মানুষের পদত্যাগের মাধ্যমে তার দোষ প্রমাণ হয় না। তবে পদত্যাগের পরও প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখেন। খুব সম্ভব একমাত্র তাঁকেই দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর আস্থার লোকদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। আর প্রধানমন্ত্রীর এত আস্থা যাঁর ওপর, তাঁর মন্ত্রিত্ব যাওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রী এখন যদি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন, তবে সেটা পুরোপুরি সংবিধানসম্মত হবে না। আবার তাঁর পদত্যাগপত্র এখন পর্যন্ত গ্রহণ না করে সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করছে। এখন হয়তো সরকারকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। কিন্তু সময় আসবে- এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের অবস্থানকে কিভাবে দেখেন?
কাদের সিদ্দিকী : আগে শুনতাম- নাই কাজ তো খই ভাজ। আমার মনে হয়, সরকারের কোনো কাজ নেই। এ জন্য গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের এত নড়াচড়া। সব ব্যাংক যে নিয়মে চলে, গ্রামীণ ব্যাংকও সেই নিয়মে চলবে। হয়তো কিছু মানুষ গ্রামীণ ব্যাংকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে বেশির ভাগ মানুষ লাভবান হয়েছে। ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এমন সময় তাঁর পেছনে লাগা সরকারের ঠিক হয়নি। অন্যদিকে ইউনূস নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর তাকে সম্মান না জানানো হোক, আমাদের একমাত্র নোবেলপ্রাপ্তিতে যথাযোগ্য সম্মান জানানো উচিত ছিল। আমরা যদি নোবেলপ্রাপ্তির বিরোধিতা করি, তবে আমরা যে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, এর জন্য আড়ম্বর করে বর্ষপূর্তি করা উচিত ছিল। কাজগুলো ঠিক হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমাদের বিবেক আমরা কোথাও বন্ধক দিয়ে দিয়েছি।
কালের কণ্ঠ : আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক শীতল বলে মনে হচ্ছে। সরকার কি ধীরে ধীরে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে?
কাদের সিদ্দিকী : দেশের মানুষের প্রতি ভরসা না করে বিশ্বনেতা হওয়ার জন্য এত ছোটাছুটি করলে তার পরিণতি এর চেয়ে ভালো হওয়ার কথা নয়। বর্তমান নেতাদের যা দেখছি, তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় নেতা হিসেবে আচরণ করছেন। এতবার এত বেশি দেশের টাকা খরচ করে বিশ্ব ফোরামে গেলে তার পরিণতি ভালো হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এত বিদেশ সফর করেছেন যে আমেরিকার একসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকেও পেছনে ফেলে দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বলতেই হবে, আমাদের সরকার বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। সরকার বন্ধুহীন হলে কোনো সমস্যা ছিল না, দেশটা যদি বন্ধুহীন হয়ে পড়ে, তাহলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যের।
কালের কণ্ঠ : অভিযোগ আছে, সরকারের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি একমুখী। শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে বর্তমান সরকার। আপনি কি এ ব্যাপারে একমত?
কাদের সিদ্দিকী : ভারতের সঙ্গে এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের অন্তরের সম্পর্ক সবচেয়ে নিম্নমানের। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে এই ভূখণ্ডের পাকিস্তান আমলের ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। তবে স্বাধীনতার পর সেই সম্পর্ক সঠিকভাবে লালন-পালন করা হয়নি। কিন্তু তার পরও একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশ-ভারত সরকারের হয়তো মধুর সম্পর্ক আছে, তবে বাংলাদেশের জনসাধারণের সঙ্গে ভারতের জনসাধারণের সম্পর্ক খুবই নিম্নমানের। কোনো উসকানি ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে, ভারত বাংলাদেশের বন্ধু নয়, আওয়ামী লীগের বন্ধু। একজন রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলী গুম হয়েছেন, অনেকে মনে করে, এতেও ভারতের হাত আছে। এই মনে করা ভালো সম্পর্ক নয়। আজ বাদে কাল আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় না থাকে, তবে কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে? যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে? ভারতের উচিত বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। অন্যদিকে বাংলাদেশের উচিত শুধু কংগ্রেস নয়, ভারতের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা।
কালের কণ্ঠ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দীর্ঘদিন পর। এই বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আপনার অভিমত কী?
কাদের সিদ্দিকী : বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে আমি খুশি নই। যুদ্ধাপরাধের বিচার কত দিন পর হচ্ছে সেটা বিবেচ্য নয়। প্রকৃত বিচার হচ্ছে কি না সেটাই বড় ব্যাপার। এখন যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের অনেকেই সেই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল না। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য এই বিচার হলে সেটা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কোনো অপরাধ হয়তো এক হাজার মানুষ করেছে। এর মধ্যে হয়তো ১০ জনকে পছন্দ না, সেই ১০ জনের বিচার হলো- এটা প্রকৃত বিচার নয়। যুদ্ধাপরাধের মূল আসামি পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। তাদের একজনকেও এই বিচারে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি। মূল আসামি বাদ দিয়ে ডালপালার বিচার হচ্ছে। যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে, তাতে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই সেটাই আগে প্রমাণ করতে হবে। প্রসিকিউশন টিমে যাঁরা আছেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কী করেছেন, কোথায় ছিলেন, সেটা জাতিকে জানাতে হবে। পাঁচজন-সাতজনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জাতির সামনে প্রমাণ করবেন বিচার হচ্ছে, সেটা ঠিক হবে না। আমার মনে হচ্ছে, এটা আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য সাজানো-গোছানো নাটক। দেশে বড় বড় আইনজ্ঞ রয়েছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁদের কেউ চেনে না, তাঁদের প্রসিকিউশন টিমে রাখা হয়েছে। তাহলে এটা নিয়ে কি ছেলেখেলা হচ্ছে? দেড়-দুই বছর ধরে বিচার হচ্ছে, কই আমার কাছে তো কেউ আসেনি কোনো তথ্য জানার জন্য। যুদ্ধাপরাধের বিচারে মানুষের যে আকুতি ছিল, তা হালকা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি এমন হয়, যাদের যুদ্ধাপরাধের বিচারে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যদি তলে তলে তাদের সঙ্গে আপস হয়, তাহলে আমরা বিস্মিত হব না।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
কাদের সিদ্দিকী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments