আশা ও আশাভঙ্গ-জয় নয়, অভীষ্ট চাহিয়াছি by ফারুক ওয়াসিফ
কাপ ছাড়া আর সবই জিতেছে বাংলাদেশ। সাবধান, বাংলাদেশআসছে!’—ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা মিরপুরের সেই রাত কি কুরুক্ষেত্রের মতো হয়ে উঠেছিল? দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সেই রাতে মুখোমুখি। আমরা যেন কৌরব, ওরা যেন পাণ্ডব।
জয়ের কাছাকাছি এসে রানের গতি আটকে যাওয়া বাংলাদেশ দলকে দেখে কেবলই কর্ণের কথা মনে হচ্ছিল। মহাভারতের ট্র্যাজিক বীর কর্ণ। বিয়োগান্তক কিন্তু করুণ নন, পরাজিত কিন্তু মহীয়ান। পাণ্ডবকুলপতি অর্জুনের বিরুদ্ধে কৌরবদের হয়ে লড়ছেন কর্ণ। লড়ছেন ন্যায়ের জন্য, জয়ের জন্য নয়। যুদ্ধের চরম মুহূর্তে তাঁরই কি না রথ আটকে যায় কাদায়! কৃষ্ণ তাঁর প্রতি বিরূপ, তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন গুরু পরশুরাম, বসুন্ধরা দেবীর হিংসারও শিকার তিনি। এত সব সমীকরণেরই ফল চরম মুহূর্তে রথ অচল হয়ে যাওয়া।
জন্মমুহূর্ত থেকে নিয়তি তাঁর শত্রু, জীবনের চরম সংকটে সেই নিয়তিই তাঁকে অন্তিম ছলনাটি করে। সে রকম বেকায়দা অবস্থাতেই অর্জুন তাঁকে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। মহাভারতের মহানায়ক অর্জুন হলেও তাঁকে কোথাও শঠ, কোথাও ক্ষুদ্রমনা লাগে। নিয়তির নির্দেশ, অর্জুনই কুরু ময়দানে জয় পাবেন; কিন্তু মানবহূদয়ের ময়দানে যিনি বিজয়ী, তিনি কর্ণ। সমগ্র মহাভারতের আখ্যানজুড়ে এই পরাজিত বীরকেই বেশি উজ্জ্বল লাগে। মানবমনে কর্ণ চরিত্র এমনই বিষণ্ন মায়া জাগায়। এশিয়া কাপের ফাইনালে মিরপুর মাঠে যেন সেই কর্ণ-কাহিনিরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। নইলে পুরো ম্যাচে দাপটের সঙ্গে খেলে শেষ মুহূর্তে রানের চাকা কঠিন মাটিতে আটকে যাবে কেন? নইলে পরাজয়ের পরেও কেন ক্রিকেট বিশ্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ দলের ভাবমূর্তি? কেন সাকিবের হূদয় উথলানো নীরব কান্নাকে ট্র্যাজিক বীরের মতো দেখাবে, কেন তাঁকে মনে হবে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণের মতো?
কর্ণের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে যেমন কৌরবকুলে হায়হায় উঠেছিল, তেমনি শেষ বল খেলা হয়ে গেলে, সেই নিয়তিতাড়িত রাতে, মিরপুর থেকে সমবেত কান্নার এক রোদন নীরব তরঙ্গ হয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন আবেগ, এমন কান্নাও এক মহত্তর মানবিকতা। বাঙালিরা এর যোগ্য।
মাঠের খেলায় ২ রানের হার হার নয়, জয়েরই সমান। তারও অধিক প্রাপ্তি কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা। সাকিব-তামিম-মুশফিকেরা তেমন ভালোবাসা ও সমীহয় ধন্য হয়েছেন। পরাজয়ে যার গরিমা কিছুমাত্র কমে না, তেমন বীরের আখ্যান কেবল গ্রিক ট্র্যাজেডিতে বা মহাভারতে নেই, আমাদের জাতীয় জীবনে এমন গরিমাময় বিয়োগান্তক কাহিনি আগেও ঘটেছে, আবারও ঘটল।
কর্ণই তো বলেছিলেন, ‘জয় নয়, অভীষ্ট চাহিয়াছি।’ বাংলাদেশ দলের জন্যও জয়ের থেকে যা বেশি, তা সেই অভীষ্ট—যার নাম সম্মান, যার নাম হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, যার নাম একেবারে তলা থেকে শীর্ষে উঠে আসার নাটকীয়তা। ক্রিকেট বিশ্বের নিম্নবর্গ হিসেবে, নিম্নবর্গীয় মানুষের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই উত্থান কৈবর্তের রাজাসন নেওয়ার মতোই রোমাঞ্চকর। কিন্তু ইতিহাসের করুণ-কঠিন লীলা এই: নিম্নবর্গের উত্থান ট্র্যাজিকই হয়, ক্ষমতার অভিষেক তার হয় না। বাংলাদেশের জন্মও তেমন এক ট্র্যাজিক ঘটনা, নিম্নবর্গীয় জনমানুষের কলিজাপোড়ানো জেদের পরিণতি এই দেশ। কিন্তু বারবার সেই সংগ্রামের সোনা বেহাত হয়, আশার সমাধিক্ষেত্রে তামার বালা হাতে বসে থাকতে হয় আমাদের।
অনেক অপ্রাপ্তির ভারে নিমজ্জিত এই দেশে তাই ক্রিকেটীয় উত্থান জাতীয় আশাবাদের জন্য দারুণ সুফলা হয়ে দেখা দেয়। কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, যারা ঘরে বা ময়দানে, দোকানের শোরুমের সামনে, কিংবা বিদেশ-বিভুঁইয়ে একটা দুর্বার জয়ের জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছে, সেই জয়ে তাদের অধিকার ষোলোআনা ন্যায্য। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে এক অস্ত্রে রাম ও রাবণবধের পর যে তরুণেরা রাস্তায় নেমে গায়ের জামা খুলে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে গলা ভেঙেছে, দেশের জয়কে যারা ব্যক্তিগত বিজয় গণ্য করে উচ্ছ্বাসে ভেসেছিল, মন ভেঙে দেওয়া এই পরাজয় তাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই বেদনার হুতাশন জ্বালিয়েছে। এরা যেভাবে দলে দলে উল্লাসে রাস্তায় নামে, সেভাবে প্রতিবাদেও অফুরান জনস্রোত হয়ে সড়ক-মাঠ-ঘাট প্লাবিত করে। খেলায় নিপুণতায় নয়, এই প্রাণবন্ত জন-উচ্ছ্বাসও আমাদের এক বড় শক্তি। আমাদের জাতীয় জীবনের চলমান বদ্ধাবস্থায় এ রকম এক হূদয়ধোয়া আবেগ-প্লাবনের খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নিজেদের ছাড়া এই অপ্রাপ্তির জন্য কাকে দোষারোপ করব আমরা?
ইতালীয় দার্শনিক বেনেদিত্তো ক্রোচে মনে করতেন, ইতিহাস আসলে মনের ইতিহাস। বিপরীতভাবে জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের চিন্তায় ইতিহাস কর্মের ও সংগ্রামের ইতিহাস। এ কথাও বলা যায়, ইতিহাস ব্যক্তি ও যৌথ মানুষের ইচ্ছাশক্তিরও ইতিহাস।
বারবার ইতিহাসের ট্রেন আমাদের স্টেশনে আসি আসি করেও যে আসে না, তার জন্য অনেক কারণই দায়ী। কিন্তু বাধিত হয়ে এই কথাও বলা যায়, আমাদের সমবেত ইচ্ছাশক্তির মধ্যে কোথাও কি চুল পরিমাণ ঘাটতি ছিল? রয়েছে কি? নইলে এত এত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ লড়ে লড়েও আমরা সাফল্যের দুয়ার থেকে কেন ফিরে যাই? কেন ফিরে যেতে হয়?
দক্ষ শিকারি যখন নিশানা করে, তখন সে আর কিছুই দেখে না, এমনকি পাখির পুরো দেহটাও নয়, কেবল মাথাটাতেই সব মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে তার। জাতীয় লক্ষ্যই বলি, রাজনৈতিক অভীষ্টই বলি, আর বলি শিরোপা অর্জনের নিশানার কথা, যা চাই তা কি সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে চেয়েছিলাম? যেদিন তা চাইতে জানব, সেদিন সবই আমাদের হবে। ট্র্যাজিক হয়েও আমরা জয়ী হব। মহাকাব্যের বীরের মতো ইতিহাসের বিষণ্ন চরিত্র হয়ে থাকা আর কতকাল? আশার সমাধিতে ফুল ফোটানোর সাধনা ছাড়া আর কী বিকল্প আমাদের?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
জন্মমুহূর্ত থেকে নিয়তি তাঁর শত্রু, জীবনের চরম সংকটে সেই নিয়তিই তাঁকে অন্তিম ছলনাটি করে। সে রকম বেকায়দা অবস্থাতেই অর্জুন তাঁকে তীরবিদ্ধ করে হত্যা করেন। মহাভারতের মহানায়ক অর্জুন হলেও তাঁকে কোথাও শঠ, কোথাও ক্ষুদ্রমনা লাগে। নিয়তির নির্দেশ, অর্জুনই কুরু ময়দানে জয় পাবেন; কিন্তু মানবহূদয়ের ময়দানে যিনি বিজয়ী, তিনি কর্ণ। সমগ্র মহাভারতের আখ্যানজুড়ে এই পরাজিত বীরকেই বেশি উজ্জ্বল লাগে। মানবমনে কর্ণ চরিত্র এমনই বিষণ্ন মায়া জাগায়। এশিয়া কাপের ফাইনালে মিরপুর মাঠে যেন সেই কর্ণ-কাহিনিরই পুনরাবৃত্তি ঘটল। নইলে পুরো ম্যাচে দাপটের সঙ্গে খেলে শেষ মুহূর্তে রানের চাকা কঠিন মাটিতে আটকে যাবে কেন? নইলে পরাজয়ের পরেও কেন ক্রিকেট বিশ্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ দলের ভাবমূর্তি? কেন সাকিবের হূদয় উথলানো নীরব কান্নাকে ট্র্যাজিক বীরের মতো দেখাবে, কেন তাঁকে মনে হবে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণের মতো?
কর্ণের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে যেমন কৌরবকুলে হায়হায় উঠেছিল, তেমনি শেষ বল খেলা হয়ে গেলে, সেই নিয়তিতাড়িত রাতে, মিরপুর থেকে সমবেত কান্নার এক রোদন নীরব তরঙ্গ হয়ে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছিল। এমন আবেগ, এমন কান্নাও এক মহত্তর মানবিকতা। বাঙালিরা এর যোগ্য।
মাঠের খেলায় ২ রানের হার হার নয়, জয়েরই সমান। তারও অধিক প্রাপ্তি কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা। সাকিব-তামিম-মুশফিকেরা তেমন ভালোবাসা ও সমীহয় ধন্য হয়েছেন। পরাজয়ে যার গরিমা কিছুমাত্র কমে না, তেমন বীরের আখ্যান কেবল গ্রিক ট্র্যাজেডিতে বা মহাভারতে নেই, আমাদের জাতীয় জীবনে এমন গরিমাময় বিয়োগান্তক কাহিনি আগেও ঘটেছে, আবারও ঘটল।
কর্ণই তো বলেছিলেন, ‘জয় নয়, অভীষ্ট চাহিয়াছি।’ বাংলাদেশ দলের জন্যও জয়ের থেকে যা বেশি, তা সেই অভীষ্ট—যার নাম সম্মান, যার নাম হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, যার নাম একেবারে তলা থেকে শীর্ষে উঠে আসার নাটকীয়তা। ক্রিকেট বিশ্বের নিম্নবর্গ হিসেবে, নিম্নবর্গীয় মানুষের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই উত্থান কৈবর্তের রাজাসন নেওয়ার মতোই রোমাঞ্চকর। কিন্তু ইতিহাসের করুণ-কঠিন লীলা এই: নিম্নবর্গের উত্থান ট্র্যাজিকই হয়, ক্ষমতার অভিষেক তার হয় না। বাংলাদেশের জন্মও তেমন এক ট্র্যাজিক ঘটনা, নিম্নবর্গীয় জনমানুষের কলিজাপোড়ানো জেদের পরিণতি এই দেশ। কিন্তু বারবার সেই সংগ্রামের সোনা বেহাত হয়, আশার সমাধিক্ষেত্রে তামার বালা হাতে বসে থাকতে হয় আমাদের।
অনেক অপ্রাপ্তির ভারে নিমজ্জিত এই দেশে তাই ক্রিকেটীয় উত্থান জাতীয় আশাবাদের জন্য দারুণ সুফলা হয়ে দেখা দেয়। কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, যারা ঘরে বা ময়দানে, দোকানের শোরুমের সামনে, কিংবা বিদেশ-বিভুঁইয়ে একটা দুর্বার জয়ের জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছে, সেই জয়ে তাদের অধিকার ষোলোআনা ন্যায্য। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে এক অস্ত্রে রাম ও রাবণবধের পর যে তরুণেরা রাস্তায় নেমে গায়ের জামা খুলে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে গলা ভেঙেছে, দেশের জয়কে যারা ব্যক্তিগত বিজয় গণ্য করে উচ্ছ্বাসে ভেসেছিল, মন ভেঙে দেওয়া এই পরাজয় তাদের মনে স্বাভাবিকভাবেই বেদনার হুতাশন জ্বালিয়েছে। এরা যেভাবে দলে দলে উল্লাসে রাস্তায় নামে, সেভাবে প্রতিবাদেও অফুরান জনস্রোত হয়ে সড়ক-মাঠ-ঘাট প্লাবিত করে। খেলায় নিপুণতায় নয়, এই প্রাণবন্ত জন-উচ্ছ্বাসও আমাদের এক বড় শক্তি। আমাদের জাতীয় জীবনের চলমান বদ্ধাবস্থায় এ রকম এক হূদয়ধোয়া আবেগ-প্লাবনের খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নিজেদের ছাড়া এই অপ্রাপ্তির জন্য কাকে দোষারোপ করব আমরা?
ইতালীয় দার্শনিক বেনেদিত্তো ক্রোচে মনে করতেন, ইতিহাস আসলে মনের ইতিহাস। বিপরীতভাবে জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের চিন্তায় ইতিহাস কর্মের ও সংগ্রামের ইতিহাস। এ কথাও বলা যায়, ইতিহাস ব্যক্তি ও যৌথ মানুষের ইচ্ছাশক্তিরও ইতিহাস।
বারবার ইতিহাসের ট্রেন আমাদের স্টেশনে আসি আসি করেও যে আসে না, তার জন্য অনেক কারণই দায়ী। কিন্তু বাধিত হয়ে এই কথাও বলা যায়, আমাদের সমবেত ইচ্ছাশক্তির মধ্যে কোথাও কি চুল পরিমাণ ঘাটতি ছিল? রয়েছে কি? নইলে এত এত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ লড়ে লড়েও আমরা সাফল্যের দুয়ার থেকে কেন ফিরে যাই? কেন ফিরে যেতে হয়?
দক্ষ শিকারি যখন নিশানা করে, তখন সে আর কিছুই দেখে না, এমনকি পাখির পুরো দেহটাও নয়, কেবল মাথাটাতেই সব মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে তার। জাতীয় লক্ষ্যই বলি, রাজনৈতিক অভীষ্টই বলি, আর বলি শিরোপা অর্জনের নিশানার কথা, যা চাই তা কি সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে চেয়েছিলাম? যেদিন তা চাইতে জানব, সেদিন সবই আমাদের হবে। ট্র্যাজিক হয়েও আমরা জয়ী হব। মহাকাব্যের বীরের মতো ইতিহাসের বিষণ্ন চরিত্র হয়ে থাকা আর কতকাল? আশার সমাধিতে ফুল ফোটানোর সাধনা ছাড়া আর কী বিকল্প আমাদের?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments