কৃষি-বন্ধ হোক ধরিত্রীর বুকে এই ‘জেনোসাইড’ by মহিউদ্দিন আহমদ
আমাদের প্রধান খাবার ভাত। একটা সময় ছিল, যখন আমাদের কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবন আবর্তিত হতো এমন মৌসুমকে কেন্দ্র করে। অঘ্রানে কৃষকের গোলায় ধান উঠত। পিঠা-পায়েসে জমে উঠত নবান্ন উৎসব। আমন আর আমাদের কৃষকের প্রধান ফসল নেই। তার স্থান দখল করে নিয়েছে বোরো। যদিও আমন ধানের জমির পরিমাণ অনেক অনেক বেশি,
উৎপাদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের প্রধান ফসল এখন বোরো ধান। ১৯৯৯ সাল থেকে এই চালচিত্র।
গত কয়েক দশকে কৃষিব্যবস্থা আমূল পাল্টে গেছে। সেচ সুবিধা বেড়ে যাওয়ার ফলে উচ্চ ফলনশীল বোরো ধান আবাদের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক অবকাঠামো। অবকাঠামোর আনুকূল্য আর ব্যাপক ভর্তুকির সুযোগ পেয়ে আমাদের দেশের কৃষকেরা শুকনো মৌসুমেও জমি সবুজে সয়লাব করে দিচ্ছেন। আর খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী আমরা ‘খাদ্যে স্বয়ম্ভর’ হতে চলেছি। তাঁদের কাছে খাদ্য মানেই চাল কিংবা ভাত। এই মনোকালচারের ঘেরাটোপে পড়ে আমরা প্রচুর পরিমাণে ভাত খেতে পারছি, যদিও ভাত ছাড়া আর বেশির ভাগ খাবারই আমাদের বিদেশ থেকে নগদ টাকায় কিনে আনতে হচ্ছে। এই ভাতের সংস্থান করতে গিয়ে আমরা প্রকৃতির ওপর কী নির্মম ‘জেনোসাইড’ অব্যাহত রেখেছি, তা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। কেননা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
আমরা ধান উৎপাদনের খরচের যে হিসাব করি তাতে বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক, আর শ্রমের বাজারমূল্যের হিসাবটা থাকে, কিন্তু প্রকৃত হিসাবটা করি না। করলে অনেক আগেই বোরো ধনের চাষ বন্ধ হয়ে যেত, কিংবা বিকল্প চিন্তাভাবনা হতো।
আমাদের দেশে বোরো ধনের আবাদ বেড়েছে জলসেচের সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবদান স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু বাইরে আমরা যে ছবিটা দেখি, সেটাই সবটুকু নয়।
এক কেজি চাল উৎপাদন করতে চার হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এই পানির দাম কত?
বাংলাদেশের যে সেচব্যবস্থা, তা ভূপ্রকৃতির সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। এটা নদীনালা-খালবিলের দেশ। কিন্তু এই পানিসম্পদ আমরা কৃষিতে ব্যবহার করি খুবই কম। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, আমরা খালবিল-নদীনালার (ভূ-উপরস্থ)পানি ব্যবহার করি সেচের আওতাধীন জমির মাত্র ২১ শতাংশে আর ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করি বাকি ৭৯ শতাংশ জমিতে। এর মধ্যে গভীর নলকূপ দিয়ে ১৫ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয়। প্রায় ৬৪ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয় অগভীর নলকূপ দিয়ে। এক লিটার পানির বোতলের জন্য আমরা ১৫ টাকা খরচ করি। এক কেজি চালের জন্য আমরা সেই হিসাবে কত খরচ করি? লিটারপ্রতি দুই টাকা হিসাব করলে তো শুধু সেচের খরচ হবে প্রতি কেজিতে আট হাজার টাকা। সেই চাল আমরা ৩০ টাকা (কেজি) দিয়ে কিনে ভাবি, অনেক দাম দিচ্ছি!
পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয় নিষিদ্ধ নয়তো সীমিত। আমাদের দেশে যেভাবে পানি নলকূপের সাহায্যে উত্তোলন করা হয়, তাকে সোজা কথায় বলা যায় ‘ওয়াটার মাইনিং’। বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফলে ভূগর্ভের অগভীর স্তরে বেশ পরিমাণ পানি প্রবেশ করে ভারসাম্য কিছুটা ঠিক রাখে। কিন্তু গভীর স্তরে, যেখান থেকে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি ওঠানো হয়, তার ক্ষতি পূরণ হয় না। পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। একটা অবস্থা তৈরি হবে, যখন এই নলকূপগুলো আর পানি ওঠাতে পারবে না। চারদিকে হাহাকার পড়ে যাবে।
সেচের জন্য আমরা যে পানি ব্যবহার করি, তার উপযোগিতা কতটুকু? আর যেভাবে আলের ধারে মাটির নালা কেটে জমিতে পানি নিয়ে যাই, তাতে করে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পানি ব্যবহারযোগ্য থাকে। বাকিটা অপচয় হয়। ব্যতিক্রম শুধু বরেন্দ্র প্রকল্প এলাকার কিছু জমি।
ধান একটি ‘পানিখেকো’ ফসল। এক কেজি পেঁয়াজ উৎপাদন করতে ৪৯০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। ভুট্টার জন্য লাগে প্রতি কেজিতে ৭৮০ লিটার। আখ চাষে দরকার হয় ২০০ লিটার, তরমুজে ২৭০ লিটার। আমরা জল সাশ্রয়ী অন্যান্য ফসলের আবাদ বন্ধ করে কিংবা কমিয়ে দিয়ে যেভাবে ধানের দিকে ছুটছি, যেভাবে ধরিত্রীর বুক চিরে তাকে নিঃশোষিত করে দিচ্ছি, তার মূল্য একদিন আমাদের দিতে হবে। তখন হয়তো কিছুই করার থাকবে না।
পানির প্রাপ্যতা আর মাটির গুণাগুণ বিচার করলে দেখা যাবে, বরিশাল অঞ্চল ধান চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এখানে আছে প্রচুর নদীনালা এবং এসব নদীতে শুকনো মৌসুমে লবণাক্ততার সমস্যা নেই বললেই চলে। অথচ এখানে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ সবচেয়ে কম। তুলনামূলকভাবে বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। অথচ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে আমরা ওই সব জেলাকে ‘শস্যভান্ডার’ করে তুলেছি। যদিও সেখানে কম পানি ব্যবহার করে শুকনো মৌসুমে অন্যান্য অর্থকরী ফসল ফলানো সম্ভব।
নলকূপের জন্য বাড়তি চাপ তেরি হচ্ছে অর্থনীতিতে। জোগান দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেল। কেবল রাজশাহী বিভাগে প্রায় ২০ হাজার গভীর নলকূপ আছে। জলের তো দামই নেই, তার ওপর আছে ভর্তুকির মাধ্যমে ডিজেল কিংবা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা। তাতেও কুলানো যাচ্ছে না। এ ধরনের হঠকারী নীতি অবশ্যই বর্জন করা দরকার।
আমাদের প্রয়োজন, যে মৌসুমে যে ফসল উৎপাদন করা সহজ ও সাশ্রয়ী সেই পথ ধরা। বর্ষাকালটাই ধান উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে আরও পরিবেশবান্ধব এবং যুগোপযোগী করে আমাদের উচিত হবে আমন ধানের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। বোরো ধানের জন্য আমাদের দরকার ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহার।
আমাদের দেশে যে পরিমাণ পানি সীমান্তের বাইরে থেকে বিভিন্ন নদীনালার মাধ্যমে আসে, তার ৫৫ শতাংশই আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। অথচ এখনো আমরা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় সেচের অবকাঠামো গড়ে তুলিনি। আমরা একটা ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে কৃষির বারোটা বাজিয়েছি। সব ফসল বাদ দিয়ে ধানের দিকে ঝুঁকেছি। এখন আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, তেল ইত্যাদি আমদানি করছি। আর সেই বস্তাপচা বাগাড়ম্বরে বিশ্বাস করি যে, এ দেশের মানুষ একটু ভাত, নুন আর মরিচ পেলেই সুখে থাকে। আমরা তাই সব ধরনের দামি ফসল থেকে মুখ সরিয়ে রেখে অন্নপ্রেমে মশগুল!
কৃষিতে সম্প্রতি একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। যেখানে যাতায়াতের সুবিধা আছে, পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেখানে উচ্চমূল্যের ফসল, যেমন শাক-সবজি, ফল-মূল, এমনকি ফুলের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। হাইওয়ের আশপাশে এ ধরনের আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষির করিডর গড়ে উঠছে। এটাকে আরও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
সবশেষে যে কথাটি বলতে চাই, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিত করতে হবে, তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেখে দিতে হবে কেবল পানীয় জলের জন্য। কৃষির জন্য যতটুকু সম্ভব, বৃষ্টির পানি এবং অন্যান্য ভূ-উপরিস্থ জলাভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com.
গত কয়েক দশকে কৃষিব্যবস্থা আমূল পাল্টে গেছে। সেচ সুবিধা বেড়ে যাওয়ার ফলে উচ্চ ফলনশীল বোরো ধান আবাদের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক অবকাঠামো। অবকাঠামোর আনুকূল্য আর ব্যাপক ভর্তুকির সুযোগ পেয়ে আমাদের দেশের কৃষকেরা শুকনো মৌসুমেও জমি সবুজে সয়লাব করে দিচ্ছেন। আর খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী আমরা ‘খাদ্যে স্বয়ম্ভর’ হতে চলেছি। তাঁদের কাছে খাদ্য মানেই চাল কিংবা ভাত। এই মনোকালচারের ঘেরাটোপে পড়ে আমরা প্রচুর পরিমাণে ভাত খেতে পারছি, যদিও ভাত ছাড়া আর বেশির ভাগ খাবারই আমাদের বিদেশ থেকে নগদ টাকায় কিনে আনতে হচ্ছে। এই ভাতের সংস্থান করতে গিয়ে আমরা প্রকৃতির ওপর কী নির্মম ‘জেনোসাইড’ অব্যাহত রেখেছি, তা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। কেননা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
আমরা ধান উৎপাদনের খরচের যে হিসাব করি তাতে বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক, আর শ্রমের বাজারমূল্যের হিসাবটা থাকে, কিন্তু প্রকৃত হিসাবটা করি না। করলে অনেক আগেই বোরো ধনের চাষ বন্ধ হয়ে যেত, কিংবা বিকল্প চিন্তাভাবনা হতো।
আমাদের দেশে বোরো ধনের আবাদ বেড়েছে জলসেচের সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবদান স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু বাইরে আমরা যে ছবিটা দেখি, সেটাই সবটুকু নয়।
এক কেজি চাল উৎপাদন করতে চার হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এই পানির দাম কত?
বাংলাদেশের যে সেচব্যবস্থা, তা ভূপ্রকৃতির সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। এটা নদীনালা-খালবিলের দেশ। কিন্তু এই পানিসম্পদ আমরা কৃষিতে ব্যবহার করি খুবই কম। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, আমরা খালবিল-নদীনালার (ভূ-উপরস্থ)পানি ব্যবহার করি সেচের আওতাধীন জমির মাত্র ২১ শতাংশে আর ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করি বাকি ৭৯ শতাংশ জমিতে। এর মধ্যে গভীর নলকূপ দিয়ে ১৫ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয়। প্রায় ৬৪ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়া হয় অগভীর নলকূপ দিয়ে। এক লিটার পানির বোতলের জন্য আমরা ১৫ টাকা খরচ করি। এক কেজি চালের জন্য আমরা সেই হিসাবে কত খরচ করি? লিটারপ্রতি দুই টাকা হিসাব করলে তো শুধু সেচের খরচ হবে প্রতি কেজিতে আট হাজার টাকা। সেই চাল আমরা ৩০ টাকা (কেজি) দিয়ে কিনে ভাবি, অনেক দাম দিচ্ছি!
পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয় নিষিদ্ধ নয়তো সীমিত। আমাদের দেশে যেভাবে পানি নলকূপের সাহায্যে উত্তোলন করা হয়, তাকে সোজা কথায় বলা যায় ‘ওয়াটার মাইনিং’। বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফলে ভূগর্ভের অগভীর স্তরে বেশ পরিমাণ পানি প্রবেশ করে ভারসাম্য কিছুটা ঠিক রাখে। কিন্তু গভীর স্তরে, যেখান থেকে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি ওঠানো হয়, তার ক্ষতি পূরণ হয় না। পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। একটা অবস্থা তৈরি হবে, যখন এই নলকূপগুলো আর পানি ওঠাতে পারবে না। চারদিকে হাহাকার পড়ে যাবে।
সেচের জন্য আমরা যে পানি ব্যবহার করি, তার উপযোগিতা কতটুকু? আর যেভাবে আলের ধারে মাটির নালা কেটে জমিতে পানি নিয়ে যাই, তাতে করে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পানি ব্যবহারযোগ্য থাকে। বাকিটা অপচয় হয়। ব্যতিক্রম শুধু বরেন্দ্র প্রকল্প এলাকার কিছু জমি।
ধান একটি ‘পানিখেকো’ ফসল। এক কেজি পেঁয়াজ উৎপাদন করতে ৪৯০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। ভুট্টার জন্য লাগে প্রতি কেজিতে ৭৮০ লিটার। আখ চাষে দরকার হয় ২০০ লিটার, তরমুজে ২৭০ লিটার। আমরা জল সাশ্রয়ী অন্যান্য ফসলের আবাদ বন্ধ করে কিংবা কমিয়ে দিয়ে যেভাবে ধানের দিকে ছুটছি, যেভাবে ধরিত্রীর বুক চিরে তাকে নিঃশোষিত করে দিচ্ছি, তার মূল্য একদিন আমাদের দিতে হবে। তখন হয়তো কিছুই করার থাকবে না।
পানির প্রাপ্যতা আর মাটির গুণাগুণ বিচার করলে দেখা যাবে, বরিশাল অঞ্চল ধান চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এখানে আছে প্রচুর নদীনালা এবং এসব নদীতে শুকনো মৌসুমে লবণাক্ততার সমস্যা নেই বললেই চলে। অথচ এখানে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ সবচেয়ে কম। তুলনামূলকভাবে বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। অথচ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে আমরা ওই সব জেলাকে ‘শস্যভান্ডার’ করে তুলেছি। যদিও সেখানে কম পানি ব্যবহার করে শুকনো মৌসুমে অন্যান্য অর্থকরী ফসল ফলানো সম্ভব।
নলকূপের জন্য বাড়তি চাপ তেরি হচ্ছে অর্থনীতিতে। জোগান দিতে হচ্ছে বিদ্যুৎ কিংবা ডিজেল। কেবল রাজশাহী বিভাগে প্রায় ২০ হাজার গভীর নলকূপ আছে। জলের তো দামই নেই, তার ওপর আছে ভর্তুকির মাধ্যমে ডিজেল কিংবা বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা। তাতেও কুলানো যাচ্ছে না। এ ধরনের হঠকারী নীতি অবশ্যই বর্জন করা দরকার।
আমাদের প্রয়োজন, যে মৌসুমে যে ফসল উৎপাদন করা সহজ ও সাশ্রয়ী সেই পথ ধরা। বর্ষাকালটাই ধান উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে আরও পরিবেশবান্ধব এবং যুগোপযোগী করে আমাদের উচিত হবে আমন ধানের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া। বোরো ধানের জন্য আমাদের দরকার ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহার।
আমাদের দেশে যে পরিমাণ পানি সীমান্তের বাইরে থেকে বিভিন্ন নদীনালার মাধ্যমে আসে, তার ৫৫ শতাংশই আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। অথচ এখনো আমরা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় সেচের অবকাঠামো গড়ে তুলিনি। আমরা একটা ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে কৃষির বারোটা বাজিয়েছি। সব ফসল বাদ দিয়ে ধানের দিকে ঝুঁকেছি। এখন আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, তেল ইত্যাদি আমদানি করছি। আর সেই বস্তাপচা বাগাড়ম্বরে বিশ্বাস করি যে, এ দেশের মানুষ একটু ভাত, নুন আর মরিচ পেলেই সুখে থাকে। আমরা তাই সব ধরনের দামি ফসল থেকে মুখ সরিয়ে রেখে অন্নপ্রেমে মশগুল!
কৃষিতে সম্প্রতি একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। যেখানে যাতায়াতের সুবিধা আছে, পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেখানে উচ্চমূল্যের ফসল, যেমন শাক-সবজি, ফল-মূল, এমনকি ফুলের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। হাইওয়ের আশপাশে এ ধরনের আধুনিক ও বাণিজ্যিক কৃষির করিডর গড়ে উঠছে। এটাকে আরও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
সবশেষে যে কথাটি বলতে চাই, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিত করতে হবে, তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেখে দিতে হবে কেবল পানীয় জলের জন্য। কৃষির জন্য যতটুকু সম্ভব, বৃষ্টির পানি এবং অন্যান্য ভূ-উপরিস্থ জলাভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com.
No comments