কালের পুরাণ-জনগণের টাকায় মোসাহেবি! by সোহরাব হাসান

‘বাংলাদেশের সমুদ্রজয়’-এ বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উপাচার্যের অভিনন্দনের বহর দেখে পাকিস্তানের প্রখ্যাত বিচারপতি কায়ানির সেই অবিস্মরণীয় বাণীই মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানে অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনী অস্ত্র দ্বারা অন্য দেশ জয় করে, সেখানে পাকিস্তানের
সেনাবাহিনী অস্ত্র দ্বারা নিজের দেশ জয় করে।’ বাংলাদেশের আমত্যরা, মান্যবরেরা দেশ জয় না করলেও প্রধানমন্ত্রীর মন জয় করতে অকাতরে জনগণের অর্থ অপচয় করে চলেছেন।
হামবুর্গে অবস্থিত সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন, যাতে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের ওপর ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত কর্তৃত্ব ও অধিকার পেয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। এতে দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক আনন্দিত। এমনকি বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াও সংসদে এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। দেশের তাবৎ সংবাদপত্র ও বেসরকারি টিভি চ্যানেল ফলাও করে বাংলাদেশের সমুদ্র জয়ের খবর প্রচার করেছে। পৌনে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে যে সফল কূটনৈতিক ও আইনি লড়াই চালিয়ে গেছে সেজন্য সবাই বাহবা দিয়েছে। সরকারের এই বিরল কূটনৈতিক সাফল্যে (তিন বছরের মধ্যে প্রথম ও একমাত্র বলেও অনেকে মনে করেন) ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে শুরু করে ওষুধশিল্প মালিকেরা সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীকে অভিভনন্দন জানিয়েছেন। অভিনন্দন জানিয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠকও। এসব অভিনন্দনের মূল উদ্দেশ্য হলো সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পেশাগত বাড়তি সুবিধা আদায়। কিছু সংগঠন বা ব্যক্তি বরাবর উন্মুখ থাকেন, এ ধরনের অভিনন্দন জানানোর অছিলায় নিজের নাম ও ছবি প্রকাশ করতে। তবে কাজটি যখন তাঁরা নিজের গাঁটের পয়সা দিয়ে করছেন, তখন খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না।
কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাতে যে অর্থ ব্যয় করেছে, তা বাংলাদেশের জনগণের টাকা। জনগণের টাকা দিয়ে অভিনন্দন জানানোর তারা কে?
বাংলাদেশের জনগণই বাজেটের মাধ্যমে ঠিক করে দেয়, কোন খাতে কত টাকা ব্যয় করা হবে। বিগত বাজেটে সরকারি ব্যাংক ও সংস্থাগুলো নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখেনি এবং রাখার কথাও নয়। কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বছরে কোন খাতে কত টাকা খরচ করবে তা বাজেটে পরিস্কার লেখা থাকে।
যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে তার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা এখানে তুলে ধরছি—জনতা ব্যাংক লিমিটেড, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। এ ছাড়া আছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড, এলপি গ্যাস লিমিটেড, ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেড, স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, উপাচার্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মৎস্য অধিদপ্তর।
সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এ রকম: ‘বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি পেয়েছে ১৪৪০০০ বর্গকিলোমিটারের সার্বভৌম বাংলাদেশে। আর বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পেল সমুদ্রসীমানার ১,১১,৬৩২ বর্গকিলোমিটারের আরও এক নতুন বাংলাদেশ।’ অন্যান্য ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের ভাষাও প্রায় অনুরূপ।
এর মাধ্যমে কি তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে উচুঁতে উঠালেন, না বঙ্গবন্ধুকে নিচে নামালেন? সমুদ্রে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা বড় অর্জন হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে কোনোভাবে তুলনীয় হতে পারে না।
এসব প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা চাইলে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাতে পারতেন, এমনকি ঢাকার যানজট উপেক্ষা করে গণভবনে গিয়ে তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েও আসতে পারতেন। কেউ কিছু বলতেন না। কিন্তু সেই অভিনন্দন বা বন্দনা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এই অর্থ দিয়ে কয়েকজন দরিদ্র ও দুস্থ নারী, শিশু বা বৃদ্ধের সেবা দিলে, রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে একটি শয্যার ব্যবস্থা করলে দেশ অনেক বেশি লাভবান হতো। কিন্তু অত্যন্ত কঠিন ও পরিশ্রমলব্ধ কাজ তাঁরা করবেন কেন? তার চেয়ে সরকারের টাকায়(প্রকৃত অর্থে জনগণের) সরকারকে অভিনন্দন জানানো অনেক সহজ।
প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানানোর নামে আত্মপ্রচারে নেমে ছিলেন হাজী দানেশ ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অন্যরা চক্ষু লজ্জার খাতিরে নিজেদের নাম প্রকাশ না করলেও এই দুই উপাচার্য নাম জাহির করতে ছাড়েননি। তাঁদের নাম পত্রিকায় প্রকাশের জন্য জনগণ কেন অর্থ দেবে?
আমাদের সাফ কথা, জনগণের টাকা দিয়ে এ ধরনের স্তুতি, তোয়াজ ও মোসাহেবি চলতে পারে না। উপাচার্যের আসনে বসা একজন ব্যক্তি কতটা নিচে নামলে এ ধরনের কাজ করতে পারেন? আগে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হতো গুণী শিক্ষাবিদদের দিয়ে, এখন পরিচালিত হচ্ছে ‘কতিপয় দালাল’ দিয়ে। এই দালালেরা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়কেই ডোবাচ্ছেন না, ডোবাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীকেও।
জনগণের টাকায় যাঁরা বিজ্ঞাপণ দিয়ে নিজেদের নাম ছাপাচ্ছেন কিংবা মোসাহেবি করছেন, সরকারের উচিত হবে তাঁদের কাছ থেকে সেই টাকা ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করা। নিজের পয়সায় যত পারুন স্তুতি গান, মোসাহেবি করুন, তবে জনগণের অর্থে নয়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.