বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নানামুখী সাফাই গাওয়া উদ্দেশ্যমূলক by মোহাম্মদ মতিন উদ্দিন
বাংলাদেশে এখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তাণ্ডব চলছে! ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে। সম্প্রতি খুলনার ডুমুরিয়া থানা পুলিশ ৫৮ বছর বয়স্ক কথিত চরমপন্থী নিরাপদ বৈরাগীকে ক্রসফায়ারে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পেয়ে তাকেই আবার রাতের আঁধারে স্যালুট দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৎকার করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান।
এ সন্তানদের একজনকে বিনা বিচারে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৎকার করার মাধ্যমে এ সরকার প্রমাণ করল মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা নিছক তামাশা। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি অস্ত্র ধরেছিলেন, সেই স্বাধীন রাষ্ট্রে তাকে বিনা বিচারে প্রাণ দিতে হলো। এ ঘটনা প্রমাণ করে বতৃমান রাষ্ট্রীয় প্রশাসন মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে আগ্রহী নয়। নিরাপদ বৈরাগীর স্ত্রী কল্পনা রানী জানান, তার স্বামী একজন দর্জি ছিলেন। তিনি টেইলার্সের দোকানে কাজ করে সংসার চালাতেন। শুক্রবার রাতে ক্রসফায়ারে দেয়া হলেও তার কর্মস্থল দাকোপের সল্টাইল টেইলার্স থেকে মঙ্গলবার রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ চরমপন্থীদের যে বৈঠকের কথা বলছে তা সাজানো। এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। তিনি জানান, তার স্বামী সন্ত্রাসী নন। তার নামে একটি অপহরণ মামলা আছে। তাও একজন প্রভাবশালী লোক ষড়যন্ত্র করে জড়িয়েছে। এ মামলায় তিনি জামিনে ছিলেন। এ ব্যাপারে এলাকার স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, রাজধানীর একটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক যার বাড়ি রানাই গ্রামে, তিনি পুলিশকে প্রভাবিত করে এ ঘটনা ঘটাতে পারেন। (সূত্র ‘আমার দেশ’, ১১ অক্টোবর, ২০০৯)।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ-র্যাবের বানানো গল্প এখন আর এ দেশে মানুষ বিশ্বাস করে না; কিন্তু বিশ্বাস করে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল কুশীলবরা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কখনই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বিশ্বাস করি না; কিন্তু আইন-শৃগ্ধখলা রক্ষাকারী বাহিনী একতরফাভাবে গুলি খাবে, প্রাণ হারাবে, তা তো হতে পারে না। (সূত্র ‘আমাদের সময়’, ১০ অক্টোবর, ২০০৯)। এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেন, ক্রসফায়ার বলতে কিছু নেই। ক্রসফায়ার নিয়ে যা বলা হয় তা আদৌ ক্রসফায়ার নয়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে আইন-শৃগ্ধখলা রক্ষাকারী বাহিনীর আত্মরক্ষার সময় এসব মৃত্যু ঘটে।
এরপর গত ৩ অক্টোবর বিবিসি’র সংলাপে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান বলেন, ক্রসফায়ারের মাধ্যমেই একদিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ব্দ হবে, বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় সন্ত্রাসীদের বিচার করা সম্ভব নয়। সর্বশেষ গত ৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জে শাহজাহান খান আরও বলেন, শান্তির জন্য এনকাউন্টারে সন্ত্রাসী মারা গেলে মানবাধিকার লগ্ধঘন হয় না। এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য ও অবস্থানের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য সরকারের এই মনোভাব বর্বরতার শামিল এবং একই সঙ্গে তা আইনের শাসন ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে পুলিশ-র্যাবের বানানো গল্পই এখন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের মুখে। অথচ এরাই এক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সেটা আছে। এসব রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশ্বাস বাণীর যে দু’পয়সার মূল্য নেই সেটাই তারা প্রমাণ করে চলেছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ৯৭ জন। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই সর্বাধিক ৩৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এখনও প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলছে। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে গল্প বানিয়ে মানুষ মারার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। হয়তোবা দেখা যাবে জীবিকার প্রয়োজনে চাকরি করতে এসে এভাবে একের পর এক মানুষ মারার কারণে একদিন এই লোকগুলো মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন মানুষের রক্ত দেখতে না পেলে পাগলের মতো আচরণ করবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হচ্ছেন তাদের কাউকে বলা হচ্ছে চরমপন্থী, আবার কাউকে বলা হচ্ছে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী। সরকারদলীয় লোকজন যখন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করেন, টেন্ডারবাজি করেন, অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হন, তখন পুলিশ প্রশাসনকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায় না। তাদের কাউকে গ্রেফতার করলেও পরে এদের ছাড়া পেতেও খুব একটা অসুবিধা হয় না। সরকারদলীয় এসব লোকজন রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ঠিক যেমন সক্রিয় যারা চরমপন্থী নামে পরিচিত। পূর্ববাংলার কমিউনিসল্ট পার্টি (এমএল), পূর্ববাংলার কমিউনিসল্ট পার্টি (এমএল-জনযুদ্ধ), পূর্ববাংলার কমিউনিসল্ট পার্টি (এমএল-লাল পতাকা), নিউ বিপ্লবী কমিউনিসল্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিসল্ট পার্টি—এরকম নামের আরও কিছু গোপন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে তথাকথিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার তারাই বেশি। সমাজে বিদ্যমান সমস্যা থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের তত্ত্বে এরা বিশ্বাস করে। তাদের এই তত্ত্ব সঠিক না বেঠিক এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় এরা রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষ। এদের এই কার্যকলাপ বাংলাদেশের সমাজে নতুন করে সৃষ্টি হয়নি। মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া এক সময় এরকম একটি দলের সদস্য ছিলেন এ কথা অনেকেই জানেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তিনিই দলটির প্রধান।অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে আগের তাত্ত্বিক অবস্থান তারা কার্যত পরিত্যাগ করেছেন—এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। বাংলাদেশের সমাজে সব মানুষ একইভাবে চিন্তা করে বিষয়টি এমন নয়। সমাজে মানুষের মাঝে স্বার্থের বিভিন্নতার কারণে রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক প্রবণতার কারণে মানুষ হত্যা করা বাঞ্ছনীয় নয়, ঠিক তেমনই যে রাষ্ট্র নিজেকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে সে রাষ্ট্রে নাগরিকের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারকে ক্ষুণম্ন করা উচিত নয়। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে কেউ আইন লগ্ধঘন করলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার দিয়েই তার বিচার করা উচিত। যখন কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকের প্রতি এ আচরণ করে না, তখন সে রাষ্ট্রকে আর গণতান্ত্রিক বলা যায় না। প্রশ্ন, বাংলাদেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রটি কী আসলেই গণতান্ত্রিক? বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যারা এ দেশ শাসন করে আসছেন, তারা কী গণতান্ত্রিক চরিত্রবিশিষ্ট? ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে এরা অগণতান্ত্রিক চরিত্রবিশিষ্ট। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এ দেশে নতুন করে শুরু হয়নি। জন্মলগ্ন থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের শুরুতে আওয়ামী শাসন থেকেই এটা শুরু হয়েছে। সিরাজ সিকদারসহ অগণিত রাজনৈতিক কর্মীকে এ দেশে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। শেষদিকে এসে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য বিশেষ বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়েছে; কিন্তু কেন এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড? এটা বলাই বাস্লল্য যে, এ দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র জনগণের ভোটের ওপর নির্ভরশীল নয়। দেশের ভেতরের বিভিন্ন শক্তি ও পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সমঝোতা এ দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়া ক্ষেত্রে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ দেখা এ দেশের শাসকশ্রেণীর অন্যতম কাজ। যে যত সুচারুভাবে এ কাজ সম্পন্ন করতে পারে রাষ্ট্র ক্ষমতায় তার টিকে থাকার বিষয়টি তত পাকাপোক্ত হয়। বিদেশি পরাশক্তির স্বার্থ দেখতে গিয়ে এ দেশের সম্পদ ও বাজারের ওপর বিদেশি বস্লজাতিক পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ধরনের চুক্তি সম্পাদন করে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গোপনে তাদের বৈষয়িক স্বার্থচরিতার্থ করে। এ প্রবণতার কারণে এ দেশে জাতীয় স্বার্থ বরাবর উপেক্ষিত হয়ে চলেছে। ফলে জনজীবনের প্রশ্নটি হয়েছে উপেক্ষিত। এ কারণে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে বিভিন্ন। জনজীবনের সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক রাজনীতির অভাবের কারণে নিয়তিনির্ভর মানসিকতাগুলো জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকেছে, অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ককে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে ছোট ছোট গ্রুপে পরিণত হয়েছে। বঞ্চিত যুবকেরা যেমন এদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছে তেমনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত দলগুলোতে ঢুকে নিজস্ব জীবন-জীবিকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে জনগণের জীবন-জীবিকার সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বগুলোর উপেক্ষার কারণে। বিগত ৩৮ বছরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল কুশীলবরা তাদের বৈষয়িক স্বার্থের ভিত্তি এতটাই পাকাপোক্ত করেছে যে, বিদেশে বাড়ি-ব্যবসা, ছেলেমেয়ের শিক্ষাসহ সব ব্যবস্থাই করে নিয়েছে। সামান্য অসুখে চিকিত্সার জন্য তারা বিদেশে পাড়ি জমান। আর সাধারণ জনগণ পয়সার অভাবে দেশেই ভালো চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে পারেন না। জাতীয় স্বার্থ তথা জনগণের স্বার্থের প্রতি বিমুখ শাসক শ্রেণীর কারণে এ দেশে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এসব সমস্যা থেকে জনগণকে মুক্ত করার কোনো কার্যকর প্রচেষ্টা না থাকার কারণে সমাজে বিশৃগ্ধখল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের জন্য গঠিত বাহিনী র্যাব সদস্যরাও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির কথা এ দেশে কারও না জানার কথা নয়। সর্বত্রই একটা লুটেরা মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিদেশি স্বার্থের প্রতি দেশীয় শাসকদের ভূমিকার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আন্তরিক হতে হবে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে বিশ্বস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া এ দেশের সম্পদ ও বাজারের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এছাড়া দেশ শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। ব্যাপক শিল্পয়নই জনজীবনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। জনজীবনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর এ ভূমিকার প্রশ্নে আন্তরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বই জনগণের কাম্য। এ দেশের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ ভূমিকা পালন করলে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজ দমনের জন্য যারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে জায়েজ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারাই মূলত দায়ী আমাদের সমাজে এসবের উত্পত্তির জন্য। সমস্যা সমাধানে মূল প্রশ্নে কার্যকর ভূমিকা পালন না করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে, জনগণকে বাদ দিয়ে নিজেদের বিলাসবস্লল ভবিষ্যত্ জীবন নিশ্চিত করাই তাদের উদ্দেশ্য।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ-র্যাবের বানানো গল্প এখন আর এ দেশে মানুষ বিশ্বাস করে না; কিন্তু বিশ্বাস করে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল কুশীলবরা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কখনই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বিশ্বাস করি না; কিন্তু আইন-শৃগ্ধখলা রক্ষাকারী বাহিনী একতরফাভাবে গুলি খাবে, প্রাণ হারাবে, তা তো হতে পারে না। (সূত্র ‘আমাদের সময়’, ১০ অক্টোবর, ২০০৯)। এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বলেন, ক্রসফায়ার বলতে কিছু নেই। ক্রসফায়ার নিয়ে যা বলা হয় তা আদৌ ক্রসফায়ার নয়। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে আইন-শৃগ্ধখলা রক্ষাকারী বাহিনীর আত্মরক্ষার সময় এসব মৃত্যু ঘটে।
এরপর গত ৩ অক্টোবর বিবিসি’র সংলাপে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান বলেন, ক্রসফায়ারের মাধ্যমেই একদিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ব্দ হবে, বর্তমান বিচার ব্যবস্থায় সন্ত্রাসীদের বিচার করা সম্ভব নয়। সর্বশেষ গত ৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জে শাহজাহান খান আরও বলেন, শান্তির জন্য এনকাউন্টারে সন্ত্রাসী মারা গেলে মানবাধিকার লগ্ধঘন হয় না। এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য ও অবস্থানের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য সরকারের এই মনোভাব বর্বরতার শামিল এবং একই সঙ্গে তা আইনের শাসন ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে পুলিশ-র্যাবের বানানো গল্পই এখন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের মুখে। অথচ এরাই এক সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সেটা আছে। এসব রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশ্বাস বাণীর যে দু’পয়সার মূল্য নেই সেটাই তারা প্রমাণ করে চলেছেন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে ৯৭ জন। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বরেই সর্বাধিক ৩৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এখনও প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলছে। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে গল্প বানিয়ে মানুষ মারার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। হয়তোবা দেখা যাবে জীবিকার প্রয়োজনে চাকরি করতে এসে এভাবে একের পর এক মানুষ মারার কারণে একদিন এই লোকগুলো মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন মানুষের রক্ত দেখতে না পেলে পাগলের মতো আচরণ করবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হচ্ছেন তাদের কাউকে বলা হচ্ছে চরমপন্থী, আবার কাউকে বলা হচ্ছে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী। সরকারদলীয় লোকজন যখন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করেন, টেন্ডারবাজি করেন, অবৈধ অস্ত্র নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হন, তখন পুলিশ প্রশাসনকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায় না। তাদের কাউকে গ্রেফতার করলেও পরে এদের ছাড়া পেতেও খুব একটা অসুবিধা হয় না। সরকারদলীয় এসব লোকজন রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ঠিক যেমন সক্রিয় যারা চরমপন্থী নামে পরিচিত। পূর্ববাংলার কমিউনিসল্ট পার্টি (এমএল), পূর্ববাংলার কমিউনিসল্ট পার্টি (এমএল-জনযুদ্ধ), পূর্ববাংলার কমিউনিসল্ট পার্টি (এমএল-লাল পতাকা), নিউ বিপ্লবী কমিউনিসল্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিসল্ট পার্টি—এরকম নামের আরও কিছু গোপন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশে তথাকথিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার তারাই বেশি। সমাজে বিদ্যমান সমস্যা থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের তত্ত্বে এরা বিশ্বাস করে। তাদের এই তত্ত্ব সঠিক না বেঠিক এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় এরা রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষ। এদের এই কার্যকলাপ বাংলাদেশের সমাজে নতুন করে সৃষ্টি হয়নি। মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া এক সময় এরকম একটি দলের সদস্য ছিলেন এ কথা অনেকেই জানেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তিনিই দলটির প্রধান।অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে আগের তাত্ত্বিক অবস্থান তারা কার্যত পরিত্যাগ করেছেন—এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। বাংলাদেশের সমাজে সব মানুষ একইভাবে চিন্তা করে বিষয়টি এমন নয়। সমাজে মানুষের মাঝে স্বার্থের বিভিন্নতার কারণে রাজনৈতিক মতাদর্শের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক প্রবণতার কারণে মানুষ হত্যা করা বাঞ্ছনীয় নয়, ঠিক তেমনই যে রাষ্ট্র নিজেকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে সে রাষ্ট্রে নাগরিকের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারকে ক্ষুণম্ন করা উচিত নয়। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে কেউ আইন লগ্ধঘন করলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার দিয়েই তার বিচার করা উচিত। যখন কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকের প্রতি এ আচরণ করে না, তখন সে রাষ্ট্রকে আর গণতান্ত্রিক বলা যায় না। প্রশ্ন, বাংলাদেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রটি কী আসলেই গণতান্ত্রিক? বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যারা এ দেশ শাসন করে আসছেন, তারা কী গণতান্ত্রিক চরিত্রবিশিষ্ট? ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে এরা অগণতান্ত্রিক চরিত্রবিশিষ্ট। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এ দেশে নতুন করে শুরু হয়নি। জন্মলগ্ন থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের শুরুতে আওয়ামী শাসন থেকেই এটা শুরু হয়েছে। সিরাজ সিকদারসহ অগণিত রাজনৈতিক কর্মীকে এ দেশে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। শেষদিকে এসে এসব কর্মকাণ্ডের জন্য বিশেষ বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়েছে; কিন্তু কেন এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড? এটা বলাই বাস্লল্য যে, এ দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র জনগণের ভোটের ওপর নির্ভরশীল নয়। দেশের ভেতরের বিভিন্ন শক্তি ও পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সমঝোতা এ দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়া ক্ষেত্রে গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ দেখা এ দেশের শাসকশ্রেণীর অন্যতম কাজ। যে যত সুচারুভাবে এ কাজ সম্পন্ন করতে পারে রাষ্ট্র ক্ষমতায় তার টিকে থাকার বিষয়টি তত পাকাপোক্ত হয়। বিদেশি পরাশক্তির স্বার্থ দেখতে গিয়ে এ দেশের সম্পদ ও বাজারের ওপর বিদেশি বস্লজাতিক পুঁজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ধরনের চুক্তি সম্পাদন করে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গোপনে তাদের বৈষয়িক স্বার্থচরিতার্থ করে। এ প্রবণতার কারণে এ দেশে জাতীয় স্বার্থ বরাবর উপেক্ষিত হয়ে চলেছে। ফলে জনজীবনের প্রশ্নটি হয়েছে উপেক্ষিত। এ কারণে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে বিভিন্ন। জনজীবনের সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক রাজনীতির অভাবের কারণে নিয়তিনির্ভর মানসিকতাগুলো জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকেছে, অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের মধ্যে বিতর্ককে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে ছোট ছোট গ্রুপে পরিণত হয়েছে। বঞ্চিত যুবকেরা যেমন এদের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছে তেমনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত দলগুলোতে ঢুকে নিজস্ব জীবন-জীবিকার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এসব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে জনগণের জীবন-জীবিকার সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বগুলোর উপেক্ষার কারণে। বিগত ৩৮ বছরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল কুশীলবরা তাদের বৈষয়িক স্বার্থের ভিত্তি এতটাই পাকাপোক্ত করেছে যে, বিদেশে বাড়ি-ব্যবসা, ছেলেমেয়ের শিক্ষাসহ সব ব্যবস্থাই করে নিয়েছে। সামান্য অসুখে চিকিত্সার জন্য তারা বিদেশে পাড়ি জমান। আর সাধারণ জনগণ পয়সার অভাবে দেশেই ভালো চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে পারেন না। জাতীয় স্বার্থ তথা জনগণের স্বার্থের প্রতি বিমুখ শাসক শ্রেণীর কারণে এ দেশে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এসব সমস্যা থেকে জনগণকে মুক্ত করার কোনো কার্যকর প্রচেষ্টা না থাকার কারণে সমাজে বিশৃগ্ধখল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সন্ত্রাস দমনের জন্য গঠিত বাহিনী র্যাব সদস্যরাও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির কথা এ দেশে কারও না জানার কথা নয়। সর্বত্রই একটা লুটেরা মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিদেশি স্বার্থের প্রতি দেশীয় শাসকদের ভূমিকার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আন্তরিক হতে হবে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে বিশ্বস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া এ দেশের সম্পদ ও বাজারের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এছাড়া দেশ শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। ব্যাপক শিল্পয়নই জনজীবনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। জনজীবনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর এ ভূমিকার প্রশ্নে আন্তরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বই জনগণের কাম্য। এ দেশের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ ভূমিকা পালন করলে সমাজ থেকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজ দমনের জন্য যারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে জায়েজ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তারাই মূলত দায়ী আমাদের সমাজে এসবের উত্পত্তির জন্য। সমস্যা সমাধানে মূল প্রশ্নে কার্যকর ভূমিকা পালন না করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে, জনগণকে বাদ দিয়ে নিজেদের বিলাসবস্লল ভবিষ্যত্ জীবন নিশ্চিত করাই তাদের উদ্দেশ্য।
No comments