অহেতুক বিতর্ক by উৎপল শুভ্র
মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, মিথ্যা তিন প্রকার—মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ও পরিসংখ্যান। আমি বলি—মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ও আত্মজীবনী। নিয়মকে প্রমাণ করতে ব্যতিক্রম তো থাকেই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আত্মজীবনী মানে ‘যা যা করা উচিত ছিল, সে সব করেছি দাবি করে খারাপ যা করেছি তা লিখতে ভুলে যাওয়া।’ মনে হচ্ছে, শোয়েব আখতার ব্যতিক্রম হতে গিয়েই সমস্যাটা বাধালেন। শোয়েবের আত্মজীবনী কন্ট্রোভার্সিয়ালি ইয়োরস এখনো পড়া হয়নি। পড়লেই বা কীভাবে বলা সম্ভব, সব সত্যি না মিথ্যা লিখেছেন! কিছু ব্যাপার তো শুধু শোয়েবই জানবেন। অথবা যাঁর সঙ্গে ঘটনা, তিনি। তাহলে শোয়েবের আত্মজীবনীকে ‘ব্যতিক্রম’ বলছি কেন?
বলছি, পত্রপত্রিকা আর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই বইয়ের নির্বাচিত অংশ পড়ে। তাতে তর্কযোগ্যভাবে ক্রিকেট ইতিহাসের দ্রুততম বোলারকে ‘অকপট’ বলেই মনে হয়েছে। শোয়েব তো শুধু অন্যের গায়ে কাদা ছোঁড়েননি, নিজের গায়ে লেগে থাকা কাদার কথাও নির্দ্বিধায় স্বীকার করছেন। যদি এমন দাবি করতেন যে, তিনি ছিলেন ধোয়া তুলসী পাতা আর বাকি সবাই খারাপ, তা হলে একটা কথা ছিল।
কিন্তু তাতেও শোয়েব আখতারের রেহাই মিলছে না। ‘কন্ট্রোভার্সায়ালি ইয়োরস’ তাঁকে আরও ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ বানিয়ে দিয়েছে। অথচ বইয়ের যে অংশগুলো নিয়ে এত হইচই হচ্ছে, সেগুলো এমন অজানা কিছু নয়। হ্যাঁ, ওয়াসিম আকরাম তাঁর ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন—এই তথ্যটা অনেকের কাছে নতুন হতে পারে। তবে ‘দুই ডব্লিউ’র সঙ্গে শোয়েবের সম্পর্ক যে ভালো ছিল না, এটা অবশ্যই কোনো নতুন তথ্য নয়। যদিও শোয়েব ছেলেবেলা থেকেই ওয়াকারের পাগল ভক্ত ছিলেন, বোলার ওয়াসিম আকরামের প্রশস্তি তো আত্মজীবনীতেও আছে। ১৯৯৯ সালে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে আমাকে বলেছিলেন, রাওয়ালপিন্ডিতে ওয়াসিম-ওয়াকারের সঙ্গে মাঠে নামার সময় ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে বলে মনে হয়েছিল তাঁর।
শোয়েব বল টেম্পারিংয়ের কথা স্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন, সব দেশের বোলাররাই তা করে। অজানা কিছু কি বলা হলো? রিভার্স সুইংয়ের মতো বল টেম্পারিংয়ের কলাকৌশল আবিষ্কারের ‘কৃতিত্ব’ও পাকিস্তানকেই দেওয়া হয়। তবে সেই ‘বিদ্যা’ আস্তে আস্তে সবারই কম-বেশি আয়ত্ত হয়েছে। টিভি ক্যামেরার সদাজাগ্রত চোখের কারণে কাজটা এখন আর আগের মতো সহজ নয়। তবে নিত্যনতুন কৌশলের চর্চা ঠিকই চলছে। একবার পাকিস্তানের পক্ষে কয়েকটি টেস্ট খেলা এক পেসার তার দু-একটি দেখিয়ে আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিলেন। বল টেম্পারিং বৈধ করে দেওয়ার যে দাবি শোয়েবের, সেটিও নতুন কিছু নয়। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ও অ্যালান ডোনাল্ডের মতো কালজয়ী বোলাররা অনেক আগেই এই দাবি তুলেছেন।
এবার আসল জায়গায় আসি। যে কারণে শোয়েবের আত্মজীবনী নিয়ে এত হইচই। ‘শচীন টেন্ডুলকার ও রাহুল দ্রাবিড় ভালো ফিনিশার নন’ বলে মনে করেন শোয়েব। মনে করায় কী অন্যায় হয়েছে? এত সব রেকর্ডের পরও টেন্ডুলকার কত বড় ম্যাচ উইনার—এটা কি সর্বজনীন ক্রিকেটীয় আড্ডায়ও তর্কের বিষয় হয়ে নেই? রানে-সেঞ্চুরিতে অনেক পিছিয়ে থাকার পরও ব্রায়ান লারাকে কি এই মানদণ্ডে অনেকে এগিয়ে রাখেন না?
সবচেয়ে বড় কথা, এটা টেন্ডুলকার সম্পর্কে শোয়েবের ব্যক্তিগত মত। কেউ তাতে একমত না-ই হতে পারেন। এ জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা শোয়েব আখতারের ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলবেন কেন? কেন মুম্বাইয়ে শোয়েবের আত্মজীবনীর প্রকাশনা উৎসব বাতিল হয়ে যাবে হুমকি আর হুমকিতে? প্রতীকী অর্থে ভারতের ‘ক্রিকেট-ঈশ্বর’ লিখতে লিখতে শচীন টেন্ডুলকার কি সত্যিই ‘ঈশ্বর’ হয়ে গেছেন, যে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলা বা লেখা যাবে না?
একবার তাঁর বোলিংয়ের সময় টেন্ডুলকার সরে যাচ্ছিলেন বলে শোয়েবের যে দাবিটা মুম্বাইয়ে ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে, এতেই বা এত হইচইয়ের কী হলো? সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানও কি বিশ্বমানের কোনো বোলারের বিপক্ষে কখনো অস্বস্তিতে পড়তে পারেন না! আমি নিজেই তো ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে ফয়সালাবাদ টেস্টে ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। টেন্ডুলকার তখন টেনিস-এলবোতে আক্রান্ত আর শোয়েব গতির তুঙ্গে। শোয়েব যে তাঁকে পরিষ্কার অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন, সেটি স্পষ্ট মনে আছে। পরদিন প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া ম্যাচ রিপোর্টেও তার আভাস ছিল—
.....তখনই শুরু শোয়েব আখতারের অসাধারণ এক স্পেল। এমনই অসাধারণ যে, শচীন টেন্ডুলকারকেও তার সামনে নড়বড়ে মনে হতে লাগল।
... শোয়েবের লেগ স্টাম্পের বল উইকেটকিপারের গ্লাভসে যাওয়ার আগে টেন্ডুলকারের গ্লাভস ছুঁয়ে গেছে কি না, অনেকবার রিপ্লে দেখেও কমেন্টটররা তা বুঝতে পারলেন না। অথচ টেন্ডুলকার আম্পায়ার আঙুল তোলার আগেই হাঁটতে শুরু করেছেন।
ওই ঘটনার জের আরও কয়েক দিন ছিল। মোহাম্মদ আসিফ ভারতীয় এক টিভি চ্যানেলকে বলেন, শোয়েবকে খেলার সময় তিনি টেন্ডুলকারকে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখেছেন। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় পরদিন বহুল আলোচিত সেই শিরোনাম—’Endulkar’!
শোয়েব আখতারের আত্মজীবনীটা পড়তে কেমন হয়েছে, কে জানে! তবে একটা শিক্ষা কিন্তু তা দিয়েছে। আত্মজীবনীতে অকপট হতে নেই।
কিন্তু তাতেও শোয়েব আখতারের রেহাই মিলছে না। ‘কন্ট্রোভার্সায়ালি ইয়োরস’ তাঁকে আরও ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ বানিয়ে দিয়েছে। অথচ বইয়ের যে অংশগুলো নিয়ে এত হইচই হচ্ছে, সেগুলো এমন অজানা কিছু নয়। হ্যাঁ, ওয়াসিম আকরাম তাঁর ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন—এই তথ্যটা অনেকের কাছে নতুন হতে পারে। তবে ‘দুই ডব্লিউ’র সঙ্গে শোয়েবের সম্পর্ক যে ভালো ছিল না, এটা অবশ্যই কোনো নতুন তথ্য নয়। যদিও শোয়েব ছেলেবেলা থেকেই ওয়াকারের পাগল ভক্ত ছিলেন, বোলার ওয়াসিম আকরামের প্রশস্তি তো আত্মজীবনীতেও আছে। ১৯৯৯ সালে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে আমাকে বলেছিলেন, রাওয়ালপিন্ডিতে ওয়াসিম-ওয়াকারের সঙ্গে মাঠে নামার সময় ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে বলে মনে হয়েছিল তাঁর।
শোয়েব বল টেম্পারিংয়ের কথা স্বীকার করেছেন এবং দাবি করেছেন, সব দেশের বোলাররাই তা করে। অজানা কিছু কি বলা হলো? রিভার্স সুইংয়ের মতো বল টেম্পারিংয়ের কলাকৌশল আবিষ্কারের ‘কৃতিত্ব’ও পাকিস্তানকেই দেওয়া হয়। তবে সেই ‘বিদ্যা’ আস্তে আস্তে সবারই কম-বেশি আয়ত্ত হয়েছে। টিভি ক্যামেরার সদাজাগ্রত চোখের কারণে কাজটা এখন আর আগের মতো সহজ নয়। তবে নিত্যনতুন কৌশলের চর্চা ঠিকই চলছে। একবার পাকিস্তানের পক্ষে কয়েকটি টেস্ট খেলা এক পেসার তার দু-একটি দেখিয়ে আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিলেন। বল টেম্পারিং বৈধ করে দেওয়ার যে দাবি শোয়েবের, সেটিও নতুন কিছু নয়। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ও অ্যালান ডোনাল্ডের মতো কালজয়ী বোলাররা অনেক আগেই এই দাবি তুলেছেন।
এবার আসল জায়গায় আসি। যে কারণে শোয়েবের আত্মজীবনী নিয়ে এত হইচই। ‘শচীন টেন্ডুলকার ও রাহুল দ্রাবিড় ভালো ফিনিশার নন’ বলে মনে করেন শোয়েব। মনে করায় কী অন্যায় হয়েছে? এত সব রেকর্ডের পরও টেন্ডুলকার কত বড় ম্যাচ উইনার—এটা কি সর্বজনীন ক্রিকেটীয় আড্ডায়ও তর্কের বিষয় হয়ে নেই? রানে-সেঞ্চুরিতে অনেক পিছিয়ে থাকার পরও ব্রায়ান লারাকে কি এই মানদণ্ডে অনেকে এগিয়ে রাখেন না?
সবচেয়ে বড় কথা, এটা টেন্ডুলকার সম্পর্কে শোয়েবের ব্যক্তিগত মত। কেউ তাতে একমত না-ই হতে পারেন। এ জন্য ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা শোয়েব আখতারের ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলবেন কেন? কেন মুম্বাইয়ে শোয়েবের আত্মজীবনীর প্রকাশনা উৎসব বাতিল হয়ে যাবে হুমকি আর হুমকিতে? প্রতীকী অর্থে ভারতের ‘ক্রিকেট-ঈশ্বর’ লিখতে লিখতে শচীন টেন্ডুলকার কি সত্যিই ‘ঈশ্বর’ হয়ে গেছেন, যে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলা বা লেখা যাবে না?
একবার তাঁর বোলিংয়ের সময় টেন্ডুলকার সরে যাচ্ছিলেন বলে শোয়েবের যে দাবিটা মুম্বাইয়ে ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে, এতেই বা এত হইচইয়ের কী হলো? সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানও কি বিশ্বমানের কোনো বোলারের বিপক্ষে কখনো অস্বস্তিতে পড়তে পারেন না! আমি নিজেই তো ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে ফয়সালাবাদ টেস্টে ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। টেন্ডুলকার তখন টেনিস-এলবোতে আক্রান্ত আর শোয়েব গতির তুঙ্গে। শোয়েব যে তাঁকে পরিষ্কার অস্বস্তিতে ফেলেছিলেন, সেটি স্পষ্ট মনে আছে। পরদিন প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া ম্যাচ রিপোর্টেও তার আভাস ছিল—
.....তখনই শুরু শোয়েব আখতারের অসাধারণ এক স্পেল। এমনই অসাধারণ যে, শচীন টেন্ডুলকারকেও তার সামনে নড়বড়ে মনে হতে লাগল।
... শোয়েবের লেগ স্টাম্পের বল উইকেটকিপারের গ্লাভসে যাওয়ার আগে টেন্ডুলকারের গ্লাভস ছুঁয়ে গেছে কি না, অনেকবার রিপ্লে দেখেও কমেন্টটররা তা বুঝতে পারলেন না। অথচ টেন্ডুলকার আম্পায়ার আঙুল তোলার আগেই হাঁটতে শুরু করেছেন।
ওই ঘটনার জের আরও কয়েক দিন ছিল। মোহাম্মদ আসিফ ভারতীয় এক টিভি চ্যানেলকে বলেন, শোয়েবকে খেলার সময় তিনি টেন্ডুলকারকে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখেছেন। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় পরদিন বহুল আলোচিত সেই শিরোনাম—’Endulkar’!
শোয়েব আখতারের আত্মজীবনীটা পড়তে কেমন হয়েছে, কে জানে! তবে একটা শিক্ষা কিন্তু তা দিয়েছে। আত্মজীবনীতে অকপট হতে নেই।
No comments