ওষুধ নিয়ে লুকোচুরিঃ জেনেরিক নাম ও ওটিসির পক্ষে বিশেষজ্ঞরা by তৌফিক মারুফ
বাংলাদেশে ১৯৮২ ও ১৯৯৭ সালের (সংশোধিত) ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে ওষুধের বাণিজ্যিক প্রচারণা নিষিদ্ধ_তবে ওষুধ কম্পানিগুলো নিজ নিজ ওষুধ সম্পর্কে চিকিৎসকদের মধ্যে প্রচারণা চালাতে পারবে। তবে কম্পানিগুলো বিভিন্ন স্মারক, প্রকাশনাসহ বিভিন্ন কৌশলে প্রতিনিয়ত ওষুধের প্রচারণা চালাচ্ছে। টেলিভিশনেও বিভিন্ন অজুহাতে ওষুধ কম্পানির বিজ্ঞাপন চলছে। এ ছাড়া দেশের বাইরের অনেক ওষুধের প্রচারণা চলছে টেলিভিশনের মাধ্যমে। বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের আর্থিক সুবিধাসহ নানা উপঢৌকন দেওয়ার জোরালো অভিযোগ তো আছেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ নিয়ে এমন লুকোচুরি না করে বরং বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের মতো এ দেশেও ওষুধের জেনেরিক নাম চালু করে কিছু জরুরি ওষুধ বাছাই করে প্রচারণার আওতায় আনা উচিত। এটি করা হলে ওষুধ কেনা ও সেবনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি ও হয়রানি দুটিই কমে আসবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, 'জেনেরিক নাম প্রচলনের পাশাপাশি আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছি দেশে বিদ্যমান ওষুধগুলোর মধ্য থেকে একটি ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করার জন্য, যাতে মানুষ তার প্রয়োজনমতো সাধারণ জ্ঞান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে ওই তালিকার যেকোনো ওষুধ কিনতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই ওটিসিভুক্ত ওষুধগুলোর ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। তবে ওই তালিকার বাইরের কোনো ওষুধ নিয়ে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক প্রচারণা এখনকার মতোই নিষিদ্ধ রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।'
জাতীয় অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, জেনেরিক নাম ব্যবহার ও ওটিসির তালিকা করা হলে নিম্নমানের ওষুধ বেচাকেনা বন্ধ হবে। এ ছাড়া ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে কমবে দাম। পাশাপাশি কম্পানিগুলোর সঙ্গে চিকিৎসকদের নেতিবাচক সম্পর্ক থাকার যে অভিযোগ আছে তা দূর হবে। চিকিৎসার সময় কম্পানির লোকজন চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত করবে না।
জেনেরিক নাম ও ওটিসি চালুর বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. শিফায়েত উল্লাহও সমর্থন করেন। তিনি আরো বলেন, 'এখন যেভাবে ফুড সাপ্লিমেন্টের নামে কিংবা বিভিন্ন অজুহাতে আইন লঙ্ঘন করে ফাঁকফোকর দিয়ে প্রচার চলছে, সেটাও বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সুষ্ঠু একটি নীতিমালা করা যেতে পারে।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, দেশের কোনো ওষুধের সরাসরি কোনো প্রচারণা স্থানীয় গণমাধ্যমে না থাকলেও ভারত ও আরো কিছু দেশের ওষুধের প্রচারণা টিভিতে দেখা যায়। বিষয়টি দর্শকদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেল। বিষয়টি ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে জানিয়ে কর্মকর্তারা বলেন, এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ ওই সব দেশের মতো বাংলাদেশেও জরুরি কিছু ওষুধের প্রচারণার পক্ষে মত দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ বিদ্যমান আইন বহাল রাখার পক্ষে বলছেন। তবে এ বিষয়টি নিয়ে এখনো সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ক্রেতারা বিভ্রান্ত : রাজধানীর ধানমণ্ডি-সাত মসজিদ সড়কের এক ফার্মেসিতে ওষুধ নিতে এসে মধ্যবয়সী মোখলেসুর রহমান 'এঙ্লে' নামের সিরাপ চাইলেন। দোকানি তাঁকে দিলেন 'এইস'। মোখলেসুর রহমান ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, 'ডাক্তার যেইটা লেখছে সেইটাই দিবেন, অন্যটা নেব না।' দোকানি বললেন, 'দুইটা একই গ্রুপের ওষুধ; আসলে হচ্ছে প্যারাসিটাল (জেনেরিক নাম)। কাজ একই। প্যারাসিটাল গ্রুপে আরো আছে নাপা, জেরিন, ফাস্ট, টামেন, রিসেটসহ আরো বহু কম্পানির বহু নাম।' মোখলেসুর সন্তুষ্ট হতে না পেরে অন্য ফার্মেসিতে চলে গেলেন। পরে ওই দোকানি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'সব ঝামেলার মূলে ডাক্তাররা। ওষুধের আসল নামের প্রচারণা না থাকায় যত সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তাররা একেকজন একেক কম্পানির সুবিধা নিয়ে ওষুধ লিখে দেন। ক্রেতারা তাঁদের লেখা নামের ওষুধ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চান না। ফলে অনেক ডাক্তারই আছেন নিম্নমানের কম্পানির ওষুধ লিখে রোগীকে ঠকান।' পাশের আরেক ক্রেতা বলেন, 'এটা তো ডাক্তারদের এক ধরনের প্রতারণা।'
মেডিক্যাল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, 'আমরা ডাক্তারি পড়ার সময় জেনেরিক নামই পড়েছি। নীতিগতভাবে আমাদের ওই জেনেরিক নামই লেখার কথা। আগে জেনেরিক নামই ব্যবহার হতো। তবে বাস্তবতার নিরিখে ব্র্যান্ড বা ট্রেড নাম ব্যবহারই এখন আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে চিকিৎসকদের ঘিরে নানা অভিযোগ ওঠে। জেনেরিক নাম চালু হলে এ সমস্যা দূর হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, 'আমরা অনেক দিন ধরেই ওষুধের ব্র্যান্ড নাম বা ট্রেড নামের বদলে জেনেরিক নাম ব্যবহারের কথা বলে আসছি। এ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। এখনো আমরা এটা চাই। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের ওষুধ প্রশাসনকে আরো কার্যকর হতে হবে, যাবে ওষুধের পুরো ব্যবস্থাপনায় যথাযথ মনিটরিং থাকে।' তিনি বলেন, জেনেরিক নামের প্রচলন হলে ওষুধের ভোক্তারা লাভবান হবেন।
ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ১৯৮২ ও ১৯৯৭ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে ওষুধের বাণিজ্যিক প্রচারণা নিষিদ্ধ। তবে ওষুধ কম্পানি চিকিৎসকদের মধ্যে ওষুধ সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে পারবে।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেন, জেনেরিক ওষুধের নাম প্রচারণায় কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইনের সংশোধন করা যেতে পারে। তাতে বরং ভোক্তাদের উপকার হবে।
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের মতো এত বেশি ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতের প্রবণতা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। ওষুধকে জীবন রক্ষাকারী পণ্য না ভেবে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী অন্য পণ্যের মতোই লাভজনক পণ্য হিসেবে বাণিজ্য করার লক্ষ্যে ওষুধের অনুমোদন নেন। সরকারের তরফ থেকেও এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ফার্মাসিটিউক্যাল প্রফেশনালসের মহাসচিব জাভেদ ইয়াহিয়া বলেন, এখন বিশ্বব্যাপী ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহারের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশেও এটা চালু করতে পারলে ভোক্তা হয়রানি অনেকাংশে কমে যাবে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ওষুধ সম্পর্কে একদিকে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে প্রতিটি ওষুধের ফার্মেসিতে আইন অনুযায়ী দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
মিডফোর্ট ওষুধ মার্কেটের একাধিক ওষুধ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা যত দূর জানেন, ডাক্তারি বইতে ওষুধের নাম কোনো কম্পানির নামানুসারে থাকে না। বইতে ওষুধের মূল নাম (জেনরিক) থাকে। কিন্তু পেশায় এসে ডাক্তাররা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের প্ররোচনায় প্রেসক্রিপশনে কম্পানির দেওয়া নাম ব্যবহার করেন। এভাবে ডাক্তাররা নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের বদলে ওষুধ কম্পানিরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। একজন বিক্রেতা বলেন, 'এ কারণেই হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ যেখানেই ডাক্তার ও চিকিৎসার গন্ধ পায়, সেখানেই ওষুধ কম্পানির লোকজন সব সময় ভিড় করে থাকে।'
ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে সব মিলিয়ে দেশে অনুমোদিত জেনেরিক ওষুধের (অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা এক হাজার ২০০। এর মধ্যে কেবল অ্যালোপ্যাথিক ২৫৮টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানই জেনেরিক ওষুধের আওতায় ব্র্যান্ড বা ট্রেড হিসেবে তৈরি বা বাজারজাত করছে ২০ হাজার ৪৫৬টি ওষুধ। অন্য ব্র্যান্ড ওষুধের মধ্যে ২৬৮টি ইউনানি প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ৩২০, ২০১ আয়ুর্বেদিকে তিন হাজার ১২০ ও ৭৯টি হোমিওপ্যাথিক প্রতিষ্ঠানের ৭৫০টি ওষুধ রয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ গেজেটের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের (অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগস) সর্বশেষ তালিকায় থাকা ২০৯টি ওষুধের মধ্যে ১৩৬ নম্বরে রয়েছে প্যারাসিটামলের নাম। ওর্যাল লিকুইড, সাপোজিটরি ও ট্যাবলেট ক্যাটাগরির এই ওষুধটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও প্রচলিত। কমপক্ষে ১১০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এই প্যারাসিটামলের কোনো না কোনো ক্যাটাগরির ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করে থাকে। বিপণন ব্যবস্থার সুবিধার কৌশল হিসেবে সব কম্পানি ডাক্তারদের নিজ নিজ কম্পানির দেওয়া ট্রেড বা ব্র্যান্ড নাম লেখার জন্য প্রভাবিত করে থাকে। ডাক্তাররাও সে অনুসারে রোগীর পরামর্শপত্রে জেনেরিক নাম বাদ দিয়ে কম্পানির নাম ব্যবহার করে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, 'জেনেরিক নাম প্রচলনের পাশাপাশি আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছি দেশে বিদ্যমান ওষুধগুলোর মধ্য থেকে একটি ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করার জন্য, যাতে মানুষ তার প্রয়োজনমতো সাধারণ জ্ঞান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়াই ফার্মেসিতে গিয়ে ওই তালিকার যেকোনো ওষুধ কিনতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওই ওটিসিভুক্ত ওষুধগুলোর ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। তবে ওই তালিকার বাইরের কোনো ওষুধ নিয়ে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক প্রচারণা এখনকার মতোই নিষিদ্ধ রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।'
জাতীয় অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম আর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, জেনেরিক নাম ব্যবহার ও ওটিসির তালিকা করা হলে নিম্নমানের ওষুধ বেচাকেনা বন্ধ হবে। এ ছাড়া ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে কমবে দাম। পাশাপাশি কম্পানিগুলোর সঙ্গে চিকিৎসকদের নেতিবাচক সম্পর্ক থাকার যে অভিযোগ আছে তা দূর হবে। চিকিৎসার সময় কম্পানির লোকজন চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত করবে না।
জেনেরিক নাম ও ওটিসি চালুর বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. শিফায়েত উল্লাহও সমর্থন করেন। তিনি আরো বলেন, 'এখন যেভাবে ফুড সাপ্লিমেন্টের নামে কিংবা বিভিন্ন অজুহাতে আইন লঙ্ঘন করে ফাঁকফোকর দিয়ে প্রচার চলছে, সেটাও বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সুষ্ঠু একটি নীতিমালা করা যেতে পারে।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, দেশের কোনো ওষুধের সরাসরি কোনো প্রচারণা স্থানীয় গণমাধ্যমে না থাকলেও ভারত ও আরো কিছু দেশের ওষুধের প্রচারণা টিভিতে দেখা যায়। বিষয়টি দর্শকদের মধ্যে বিশেষ প্রভাব ফেল। বিষয়টি ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে জানিয়ে কর্মকর্তারা বলেন, এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ ওই সব দেশের মতো বাংলাদেশেও জরুরি কিছু ওষুধের প্রচারণার পক্ষে মত দিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ বিদ্যমান আইন বহাল রাখার পক্ষে বলছেন। তবে এ বিষয়টি নিয়ে এখনো সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ক্রেতারা বিভ্রান্ত : রাজধানীর ধানমণ্ডি-সাত মসজিদ সড়কের এক ফার্মেসিতে ওষুধ নিতে এসে মধ্যবয়সী মোখলেসুর রহমান 'এঙ্লে' নামের সিরাপ চাইলেন। দোকানি তাঁকে দিলেন 'এইস'। মোখলেসুর রহমান ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, 'ডাক্তার যেইটা লেখছে সেইটাই দিবেন, অন্যটা নেব না।' দোকানি বললেন, 'দুইটা একই গ্রুপের ওষুধ; আসলে হচ্ছে প্যারাসিটাল (জেনেরিক নাম)। কাজ একই। প্যারাসিটাল গ্রুপে আরো আছে নাপা, জেরিন, ফাস্ট, টামেন, রিসেটসহ আরো বহু কম্পানির বহু নাম।' মোখলেসুর সন্তুষ্ট হতে না পেরে অন্য ফার্মেসিতে চলে গেলেন। পরে ওই দোকানি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'সব ঝামেলার মূলে ডাক্তাররা। ওষুধের আসল নামের প্রচারণা না থাকায় যত সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তাররা একেকজন একেক কম্পানির সুবিধা নিয়ে ওষুধ লিখে দেন। ক্রেতারা তাঁদের লেখা নামের ওষুধ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চান না। ফলে অনেক ডাক্তারই আছেন নিম্নমানের কম্পানির ওষুধ লিখে রোগীকে ঠকান।' পাশের আরেক ক্রেতা বলেন, 'এটা তো ডাক্তারদের এক ধরনের প্রতারণা।'
মেডিক্যাল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, 'আমরা ডাক্তারি পড়ার সময় জেনেরিক নামই পড়েছি। নীতিগতভাবে আমাদের ওই জেনেরিক নামই লেখার কথা। আগে জেনেরিক নামই ব্যবহার হতো। তবে বাস্তবতার নিরিখে ব্র্যান্ড বা ট্রেড নাম ব্যবহারই এখন আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে চিকিৎসকদের ঘিরে নানা অভিযোগ ওঠে। জেনেরিক নাম চালু হলে এ সমস্যা দূর হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, 'আমরা অনেক দিন ধরেই ওষুধের ব্র্যান্ড নাম বা ট্রেড নামের বদলে জেনেরিক নাম ব্যবহারের কথা বলে আসছি। এ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। এখনো আমরা এটা চাই। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের ওষুধ প্রশাসনকে আরো কার্যকর হতে হবে, যাবে ওষুধের পুরো ব্যবস্থাপনায় যথাযথ মনিটরিং থাকে।' তিনি বলেন, জেনেরিক নামের প্রচলন হলে ওষুধের ভোক্তারা লাভবান হবেন।
ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ১৯৮২ ও ১৯৯৭ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশে ওষুধের বাণিজ্যিক প্রচারণা নিষিদ্ধ। তবে ওষুধ কম্পানি চিকিৎসকদের মধ্যে ওষুধ সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে পারবে।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেন, জেনেরিক ওষুধের নাম প্রচারণায় কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইনের সংশোধন করা যেতে পারে। তাতে বরং ভোক্তাদের উপকার হবে।
ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের মতো এত বেশি ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতের প্রবণতা বিশ্বের অন্য কোথাও নেই। ওষুধকে জীবন রক্ষাকারী পণ্য না ভেবে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী অন্য পণ্যের মতোই লাভজনক পণ্য হিসেবে বাণিজ্য করার লক্ষ্যে ওষুধের অনুমোদন নেন। সরকারের তরফ থেকেও এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাংলাদেশ সোসাইটি ফর ফার্মাসিটিউক্যাল প্রফেশনালসের মহাসচিব জাভেদ ইয়াহিয়া বলেন, এখন বিশ্বব্যাপী ওষুধের জেনেরিক নাম ব্যবহারের দাবি উঠেছে। বাংলাদেশেও এটা চালু করতে পারলে ভোক্তা হয়রানি অনেকাংশে কমে যাবে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ওষুধ সম্পর্কে একদিকে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে প্রতিটি ওষুধের ফার্মেসিতে আইন অনুযায়ী দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
মিডফোর্ট ওষুধ মার্কেটের একাধিক ওষুধ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা যত দূর জানেন, ডাক্তারি বইতে ওষুধের নাম কোনো কম্পানির নামানুসারে থাকে না। বইতে ওষুধের মূল নাম (জেনরিক) থাকে। কিন্তু পেশায় এসে ডাক্তাররা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের প্ররোচনায় প্রেসক্রিপশনে কম্পানির দেওয়া নাম ব্যবহার করেন। এভাবে ডাক্তাররা নিজের পেশাগত দায়িত্ব পালনের বদলে ওষুধ কম্পানিরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। একজন বিক্রেতা বলেন, 'এ কারণেই হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ যেখানেই ডাক্তার ও চিকিৎসার গন্ধ পায়, সেখানেই ওষুধ কম্পানির লোকজন সব সময় ভিড় করে থাকে।'
ওষুধ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে সব মিলিয়ে দেশে অনুমোদিত জেনেরিক ওষুধের (অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক) সংখ্যা এক হাজার ২০০। এর মধ্যে কেবল অ্যালোপ্যাথিক ২৫৮টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানই জেনেরিক ওষুধের আওতায় ব্র্যান্ড বা ট্রেড হিসেবে তৈরি বা বাজারজাত করছে ২০ হাজার ৪৫৬টি ওষুধ। অন্য ব্র্যান্ড ওষুধের মধ্যে ২৬৮টি ইউনানি প্রতিষ্ঠানে এক হাজার ৩২০, ২০১ আয়ুর্বেদিকে তিন হাজার ১২০ ও ৭৯টি হোমিওপ্যাথিক প্রতিষ্ঠানের ৭৫০টি ওষুধ রয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ গেজেটের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের (অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগস) সর্বশেষ তালিকায় থাকা ২০৯টি ওষুধের মধ্যে ১৩৬ নম্বরে রয়েছে প্যারাসিটামলের নাম। ওর্যাল লিকুইড, সাপোজিটরি ও ট্যাবলেট ক্যাটাগরির এই ওষুধটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও প্রচলিত। কমপক্ষে ১১০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এই প্যারাসিটামলের কোনো না কোনো ক্যাটাগরির ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করে থাকে। বিপণন ব্যবস্থার সুবিধার কৌশল হিসেবে সব কম্পানি ডাক্তারদের নিজ নিজ কম্পানির দেওয়া ট্রেড বা ব্র্যান্ড নাম লেখার জন্য প্রভাবিত করে থাকে। ডাক্তাররাও সে অনুসারে রোগীর পরামর্শপত্রে জেনেরিক নাম বাদ দিয়ে কম্পানির নাম ব্যবহার করে থাকেন।
No comments