বাজেটে অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নেই
বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া খাতগুলোর বাস্তবায়ন নেই। বর্তমান সরকারের প্রথম অর্থবছরে (২০০৯-১০) অগ্রাধিকার হিসেবে যে খাতগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, বাস্তবায়িত না হওয়ায় দ্বিতীয় অর্থবছরেও (২০১০-১১) একই তালিকায় রাখা হয়েছিল সেগুলোকে। কিন্তু দুই বছরেও বাস্তবায়নের হার প্রায় শূন্য। আগামী ২০১১-১২ অর্থবছরেও এই খাতগুলোকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হচ্ছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, অগ্রাধিকার খাতগুলোর মধ্যে কয়লানীতি ও জ্বালানিনীতি চূড়ান্ত করা, স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) কাঠামো শক্তিশালী করা, রেলপথের সংস্কার, ব্যবসায়ের খরচ কমানোর পদক্ষেপ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণমুক্ত করা, ভূমি জরিপ ও ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় আনাসহ মোট ২৭টি বিষয়ের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়নি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে দেশের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের অংশগ্রহণে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কমিশনসহ ৫৬টি সংস্থার বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ২০টির অগ্রগতি সন্তোষজনক ও নয়টির অগ্রগতি প্রক্রিয়াধীন উল্লেখ করে জানানো হয়, ২৭টির কোনো অগ্রগতি নেই এবং চলতি অর্থবছরের মধ্যে অগ্রগতির কোনো সম্ভাবনাও নেই।
বৈঠকে দুই বছরের বাজেটে বিভিন্ন আইন প্রণয়নসহ মোট ৪৬টি নীতি ও কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানায় অর্থ বিভাগ। আর অগ্রাধিকার খাত বাস্তবায়নে সফল মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা হিসেবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পররাষ্ট্র এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়; বিদ্যুৎ, খাদ্য, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ; নির্বাচন, সরকারি কর্ম এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের অনেক অঙ্গীকার আছে। সবকিছু এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আবার অনেকগুলো বাস্তবায়িতও হয়েছে। তবে এটা ঠিক, অগ্রাধিকার খাতের অনেক বিষয় এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।’ অবাস্তবায়িত অগ্রাধিকার খাতগুলোকে আগামী বাজেটেও অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
যোগাযোগ করলে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে বাস্তবায়নে সরকারের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর এই ক্ষমতা বাড়াতে দরকার প্রশাসনে যোগ্যতম কর্মকর্তা নিযুক্ত করা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। তা না হলে প্রতিবছর অগ্রাধিকার খাত নির্ধারণ করা হবে, তাতে অর্থ বরাদ্দও থাকবে, কিন্তু কাজ আর হবে না। এসব খাতের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ বরং অন্য খাতে চলে যাবে। আকবর আলি খান আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান। অগ্রাধিকার খাতগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ।
ব্যর্থতার তালিকায় অর্থ ছাড়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ-অর্থাৎ অর্থ বিভাগের নামও রয়েছে। এ বিভাগ একীভূত ও জেলা বাজেট প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ দুই বছর ধরেই অর্থমন্ত্রী জেলা বাজেটের কথা বলে আসছেন। চলতি বছরের জন্য একটি আলাদা ধারণাপত্রও তৈরি করা হয়েছিল। অনলাইনে সব ধরনের ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে অর্থ জমা দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে এ বিভাগ।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পারেনি বাজেটে ঘোষণা দেওয়া ব্যাংক কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের সংস্কার করতে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন করতে পারেনি এ বিভাগ।
এ বছর নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বিল এবং নতুন আয়কর বিল জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার কথা ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। ব্যবসায়ের খরচ কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতির খসড়া তৈরি, কর প্রশাসনকে আধুনিকায়ন এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনারও কথা ছিল এনবিআরের। এসবের কিছুই পারেনি সংস্থাটি।
পিপিপি ও অর্থনৈতিক এলাকা: অগ্রাধিকার পাওয়া কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি—এমন তালিকায় খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরই রয়েছে দুটি বিষয়। একটি হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) কাঠামো আরও স্বচ্ছ ও শক্তিশালীকরণ। আর অন্যটি অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তোলা।
পিপিপি নিয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত, পিপিপির নতুন নীতি ও কৌশল এবং প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির সহজ, স্বচ্ছ ও সমন্বিত রূপ দেখে আপনারা আশ্বস্ত হবেন। বেসরকারি খাতের ব্যাপক অংশগ্রহণে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অনুকূল গতি পাবে।’ অথচ অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া তিন হাজার কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই অব্যয়িত থেকে গেছে।
আর ওদিকে বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা হয়নি অর্থনৈতিক এলাকা। কারণ, আইনই পাস হয়নি। অথচ অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে আমি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম। আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০ জাতীয় সংসদে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: বাজেট দেওয়ার সময় সংসদে অর্থমন্ত্রী ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে পথনকশা’ নামে আলাদা একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলেন। এতে তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গ্রহণের কথা এসেছিল।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, আমাদের সরকার বর্তমান মেয়াদেই বিদ্যুতের সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বাংলাদেশের জনগণকে উপহার দিতে চায়। আশা করছি, এ খাতে উন্নয়নের বিরল এক নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হব এবং ২০১২ সালের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের পার্থক্য দূর করতে সক্ষম হব।’
এ বছর স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) চূড়ান্ত করার কথা ছিল বিদ্যুৎ বিভাগের। কিন্তু কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে এ বিভাগ। আর এদিকে জ্বালানি সরবরাহ টেকসই করার লক্ষ্যে সমন্বিত জ্বালানিনীতি প্রণয়ন করতে পারেনি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এ বিভাগ জাতীয় জ্বালানি ও কয়লানীতি চূড়ান্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা: এ বছর থেকে ভূমি নিবন্ধন (দলিল) ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য একটি কারিগরি সমীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যৌথভাবে আইন ও বিচার বিভাগ এবং এনবিআরকে। কিন্তু কাজটি তারা পারেনি।
আর ভূমি মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল, সারা দেশে ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়ন করতে এবং ভূমি জরিপ, রেকর্ডপত্র প্রণয়ন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রকল্পের আওতায় ৪৫টি উপজেলায় এবং পিপিপির মাধ্যমে বাকি উপজেলায় ভূমি জরিপ করার কথাও বলা হয়েছিল এ মন্ত্রণালয়কে। অথচ এসব কাজের কোনো কিছু শুরুই করতে পারেনি এ মন্ত্রণালয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভূমি ব্যবস্থার উন্নয়নে জোরোলো বক্তব্য রয়েছে অর্থমন্ত্রীর। আগেরবার অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের ষান্মাসিক প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, এ দেশে একটি ডিজিটাইজেশন ভূমি ব্যবস্থা চালু করা, যাতে ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের চলমান অচলায়তন ভেঙে তা আধুনিকায়ন করতে পারি।’
রেলপথের সংস্কার: দুই বছর ধরেই রেলপথকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কথা বলে আসছেন অর্থমন্ত্রী। রাজধানীর ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে ঢাকার চারপাশে সার্কুলার রেল স্থাপনের কথাও দুই বছর ধরে তিনি বলে আসছেন। এ ছাড়া টঙ্গী-ভৈরববাজার সেকশনের ডাবল লাইন নির্মাণের ঘোষণা ছিল। তিন-তিনবার দরপত্র আহ্বান হলেও মূল্যায়নে গিয়েই তা বাতিল হয়ে যায়। তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেলসংযোগ বর্তমান অর্থবছরেই সমাপ্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘আমরা রেলপথকে ঢেলে সাজাতে চাই এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই।’
কিন্তু এসবের কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেনি সড়ক ও রেলপথ বিভাগ। সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটেও রেলপথের সংস্কার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা বলতে শোনা যাবে।
অন্যান্য ব্যর্থতা: অর্থ বিভাগের মতে, বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষণমুক্ত করতে পারেনি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী এবং প্রজনন নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার উন্নীত করতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গড়াই নদী পুনঃ খনন করতে পারেনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সুপ্রিম কোর্টকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে আইন ও বিচার বিভাগ। পরিকল্পনা বিভাগ পারেনি প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে আরও সুনির্দিষ্ট করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে দিতে।
এ ছাড়া ভিক্ষুক জরিপ ও ভিক্ষাবৃত্তির অবসানে কোনো উদ্যোগই নিতে পারেনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে সড়ক ও রেলপথ বিভাগ। মংলা বন্দরের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন হয়নি। এ দায়িত্ব ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পারেনি ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের কার্যক্রম শক্তিশালী করতে। গৃহ নির্মাণ কোম্পানির বিভিন্ন ছাড়পত্র গ্রহণের সুবিধার্থে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, অগ্রাধিকার খাতগুলোর মধ্যে কয়লানীতি ও জ্বালানিনীতি চূড়ান্ত করা, স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) কাঠামো শক্তিশালী করা, রেলপথের সংস্কার, ব্যবসায়ের খরচ কমানোর পদক্ষেপ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করা, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণমুক্ত করা, ভূমি জরিপ ও ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় আনাসহ মোট ২৭টি বিষয়ের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়নি। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে দেশের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের অংশগ্রহণে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, কমিশনসহ ৫৬টি সংস্থার বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ২০টির অগ্রগতি সন্তোষজনক ও নয়টির অগ্রগতি প্রক্রিয়াধীন উল্লেখ করে জানানো হয়, ২৭টির কোনো অগ্রগতি নেই এবং চলতি অর্থবছরের মধ্যে অগ্রগতির কোনো সম্ভাবনাও নেই।
বৈঠকে দুই বছরের বাজেটে বিভিন্ন আইন প্রণয়নসহ মোট ৪৬টি নীতি ও কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানায় অর্থ বিভাগ। আর অগ্রাধিকার খাত বাস্তবায়নে সফল মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা হিসেবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পররাষ্ট্র এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়; বিদ্যুৎ, খাদ্য, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ; নির্বাচন, সরকারি কর্ম এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের অনেক অঙ্গীকার আছে। সবকিছু এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আবার অনেকগুলো বাস্তবায়িতও হয়েছে। তবে এটা ঠিক, অগ্রাধিকার খাতের অনেক বিষয় এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।’ অবাস্তবায়িত অগ্রাধিকার খাতগুলোকে আগামী বাজেটেও অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
যোগাযোগ করলে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা আকবর আলি খান প্রথম আলোকে বলেন, বাজেট বাস্তবায়ন করতে হলে বাস্তবায়নে সরকারের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর এই ক্ষমতা বাড়াতে দরকার প্রশাসনে যোগ্যতম কর্মকর্তা নিযুক্ত করা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। তা না হলে প্রতিবছর অগ্রাধিকার খাত নির্ধারণ করা হবে, তাতে অর্থ বরাদ্দও থাকবে, কিন্তু কাজ আর হবে না। এসব খাতের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ বরং অন্য খাতে চলে যাবে। আকবর আলি খান আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান। অগ্রাধিকার খাতগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ।
ব্যর্থতার তালিকায় অর্থ ছাড়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ-অর্থাৎ অর্থ বিভাগের নামও রয়েছে। এ বিভাগ একীভূত ও জেলা বাজেট প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ দুই বছর ধরেই অর্থমন্ত্রী জেলা বাজেটের কথা বলে আসছেন। চলতি বছরের জন্য একটি আলাদা ধারণাপত্রও তৈরি করা হয়েছিল। অনলাইনে সব ধরনের ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে অর্থ জমা দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে এ বিভাগ।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পারেনি বাজেটে ঘোষণা দেওয়া ব্যাংক কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের সংস্কার করতে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন করতে পারেনি এ বিভাগ।
এ বছর নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বিল এবং নতুন আয়কর বিল জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করার কথা ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। ব্যবসায়ের খরচ কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতির খসড়া তৈরি, কর প্রশাসনকে আধুনিকায়ন এবং স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনারও কথা ছিল এনবিআরের। এসবের কিছুই পারেনি সংস্থাটি।
পিপিপি ও অর্থনৈতিক এলাকা: অগ্রাধিকার পাওয়া কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি—এমন তালিকায় খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েরই রয়েছে দুটি বিষয়। একটি হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) কাঠামো আরও স্বচ্ছ ও শক্তিশালীকরণ। আর অন্যটি অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তোলা।
পিপিপি নিয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত, পিপিপির নতুন নীতি ও কৌশল এবং প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির সহজ, স্বচ্ছ ও সমন্বিত রূপ দেখে আপনারা আশ্বস্ত হবেন। বেসরকারি খাতের ব্যাপক অংশগ্রহণে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অনুকূল গতি পাবে।’ অথচ অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া তিন হাজার কোটি টাকার প্রায় পুরোটাই অব্যয়িত থেকে গেছে।
আর ওদিকে বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা হয়নি অর্থনৈতিক এলাকা। কারণ, আইনই পাস হয়নি। অথচ অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে আমি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম। আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০ জাতীয় সংসদে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি: বাজেট দেওয়ার সময় সংসদে অর্থমন্ত্রী ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উন্নয়নে পথনকশা’ নামে আলাদা একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলেন। এতে তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গ্রহণের কথা এসেছিল।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, আমাদের সরকার বর্তমান মেয়াদেই বিদ্যুতের সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বাংলাদেশের জনগণকে উপহার দিতে চায়। আশা করছি, এ খাতে উন্নয়নের বিরল এক নজির সৃষ্টি করতে সক্ষম হব এবং ২০১২ সালের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের পার্থক্য দূর করতে সক্ষম হব।’
এ বছর স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি) চূড়ান্ত করার কথা ছিল বিদ্যুৎ বিভাগের। কিন্তু কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে এ বিভাগ। আর এদিকে জ্বালানি সরবরাহ টেকসই করার লক্ষ্যে সমন্বিত জ্বালানিনীতি প্রণয়ন করতে পারেনি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এ বিভাগ জাতীয় জ্বালানি ও কয়লানীতি চূড়ান্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা: এ বছর থেকে ভূমি নিবন্ধন (দলিল) ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এ জন্য একটি কারিগরি সমীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যৌথভাবে আইন ও বিচার বিভাগ এবং এনবিআরকে। কিন্তু কাজটি তারা পারেনি।
আর ভূমি মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল, সারা দেশে ভূমি ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়ন করতে এবং ভূমি জরিপ, রেকর্ডপত্র প্রণয়ন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রকল্পের আওতায় ৪৫টি উপজেলায় এবং পিপিপির মাধ্যমে বাকি উপজেলায় ভূমি জরিপ করার কথাও বলা হয়েছিল এ মন্ত্রণালয়কে। অথচ এসব কাজের কোনো কিছু শুরুই করতে পারেনি এ মন্ত্রণালয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভূমি ব্যবস্থার উন্নয়নে জোরোলো বক্তব্য রয়েছে অর্থমন্ত্রীর। আগেরবার অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের ষান্মাসিক প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, এ দেশে একটি ডিজিটাইজেশন ভূমি ব্যবস্থা চালু করা, যাতে ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের চলমান অচলায়তন ভেঙে তা আধুনিকায়ন করতে পারি।’
রেলপথের সংস্কার: দুই বছর ধরেই রেলপথকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কথা বলে আসছেন অর্থমন্ত্রী। রাজধানীর ওপর জনসংখ্যার চাপ কমাতে ঢাকার চারপাশে সার্কুলার রেল স্থাপনের কথাও দুই বছর ধরে তিনি বলে আসছেন। এ ছাড়া টঙ্গী-ভৈরববাজার সেকশনের ডাবল লাইন নির্মাণের ঘোষণা ছিল। তিন-তিনবার দরপত্র আহ্বান হলেও মূল্যায়নে গিয়েই তা বাতিল হয়ে যায়। তারাকান্দি থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেলসংযোগ বর্তমান অর্থবছরেই সমাপ্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ‘আমরা রেলপথকে ঢেলে সাজাতে চাই এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই।’
কিন্তু এসবের কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেনি সড়ক ও রেলপথ বিভাগ। সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটেও রেলপথের সংস্কার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা বলতে শোনা যাবে।
অন্যান্য ব্যর্থতা: অর্থ বিভাগের মতে, বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষণমুক্ত করতে পারেনি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী এবং প্রজনন নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার উন্নীত করতে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গড়াই নদী পুনঃ খনন করতে পারেনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সুপ্রিম কোর্টকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে আইন ও বিচার বিভাগ। পরিকল্পনা বিভাগ পারেনি প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে আরও সুনির্দিষ্ট করে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে দিতে।
এ ছাড়া ভিক্ষুক জরিপ ও ভিক্ষাবৃত্তির অবসানে কোনো উদ্যোগই নিতে পারেনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে সড়ক ও রেলপথ বিভাগ। মংলা বন্দরের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন হয়নি। এ দায়িত্ব ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পারেনি ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের কার্যক্রম শক্তিশালী করতে। গৃহ নির্মাণ কোম্পানির বিভিন্ন ছাড়পত্র গ্রহণের সুবিধার্থে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
No comments