গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে by মো. আবদুল হামিদ
আজকে আপনাদের মাঝে উপস্থিত হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ হচ্ছে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। আইন প্রণয়ন সংসদের মূল কাজ হলেও সরকারি কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও সংসদের অন্যতম দায়িত্ব।
১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছরেও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা যতটুকু হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এর অনেক কারণও রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক যাত্রার পথ রুদ্ধ হয়। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথচলাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। চর্চার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হয়। তাই যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের আপামর জনগণকে গণতন্ত্রমনা করে গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই গণতন্ত্রের চর্চা ও লালন করবে—এটা ভাবলে চলবে না। দলমত-নির্বিশেষে এটা সবারই দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে এবং এ ব্যাপারে তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে মিডিয়া ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। টেকসই উন্নয়নের জন্য অব্যাহত গণতন্ত্র অপরিহার্য। একটি ছাড়া অপরটি চলতে পারে না। এ জন্য সংসদকে কার্যকর করতে হবে। সব সংসদ সদস্যকে আইন প্রণয়ন থেকে প্রতিটি কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। সংসদে আমরা যা কিছুই করি না কেন, জনগণ তা জানতে না পারলে এর সুফল তাদের কাছে পৌঁছাবে না। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কারণ তাদের মাধ্যমেই দেশবাসী সংসদে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা জানতে পারে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে গিয়ে কী দায়িত্ব পালন করেন, তা জানার অধিকারও জনগণের রয়েছে। আর এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলেই জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে আরও বেশি সচেতন হবেন।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা নিয়ে অনেকেই অনেক আশা-নিরাশার কথা বলেন। কিন্তু আমি হতাশ নই। গণতন্ত্রের বিকাশে চর্চার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা বারবার হোঁচট না খেলে হয়তো এত দিনে দেশে গণতন্ত্রের ভিত আরও বেশি মজবুত হতে পারত। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণতন্ত্র আরও এগিয়ে যাবে এবং প্রতিটি কাজকর্মে গণতান্ত্রিক রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।
সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় আপনাদেরও ভূমিকা আছে। অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে জনমত গঠনের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। সংসদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে আইন প্রণয়নের আগে প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে আপনাদের মতামত আইনকে ত্রুটিমুক্ত করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। এমনকি আমার নিজের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাকে স্বাগত জানাই।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারসহ কয়েকটি পত্রিকা অষ্টম জাতীয় সংসদের বিভিন্ন দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আমি আশা করি, এর ফলে ভবিষ্যতে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে। বর্তমান সংসদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ করতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমি ১০০ ভাগ সফল হয়েছি তা দাবি করব না, তবে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছি। কেনাকাটার ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বছর পুরোনো জিনিসপত্র নিলামে ৩৩ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। অথচ আগে এগুলো কম মূল্য দেখিয়ে নিজেরাই নিয়ে নিতেন।
জাতীয় সংসদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ওভারসাইট ফাংশন বা নজরদারি কার্যক্রম। সংসদের পক্ষে এ কাজটি সম্পন্ন করা খুব সহজসাধ্য বিষয় নয়। মূলত সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাঠামো এবং সংসদের আর্থিক সামর্থ্য, দক্ষ জনবলের অপ্রতুলতা ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা কাজটিকে আরও দুরূহ করে তোলে। সরকারের আয়-ব্যয়, প্রকল্প বাস্তবায়ন, জনগণের কল্যাণসাধনে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম—এসব বিষয় সংসদে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই নজরদারি কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, সংসদের মূল কাজটা কিন্তু হয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। নবম জাতীয় সংসদে প্রথম অধিবেশনেই সবগুলো স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং কমিটিগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগই প্রথমবারের মতো স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে মন্ত্রীর পরিবর্তে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব প্রদান করে। বর্তমান সংসদের মূল অধিবেশনে বিরোধী দল অনেক দিন অংশ না নিলেও সংসদীয় কমিটিগুলোতে কিন্তু তারা নিয়মিতভাবেই অংশ নিয়েছে। এটিও কিন্তু একটি ইতিবাচক ধারা। কমিটিগুলোতে সরকার ও বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুপারিশ করে থাকে। তবে প্রায়শই দেখা যায়, সরকারের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো কোনো কমিটির সদস্যদের একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। কমিটিগুলো মনে করছে, মন্ত্রণালয় সব তথ্য যেমন দিচ্ছে না, তেমনই কমিটির সব সুপারিশ বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় ভাবছে, কমিটিগুলো এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে, যা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বিষয়। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূরত্ব বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। এটা কীভাবে দূর করা যায়, সে বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। অন্যান্য উন্নত দেশে কীভাবে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাও জানা প্রয়োজন।
সংসদীয় কমিটি কার্যক্রমকে শক্তিশালী ও অর্থবহ করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি দক্ষ, কার্যকর ও শক্তিশালী সংসদ সচিবালয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে এবং দ্রুত এ অবস্থার উন্নয়নে সরকার ও উন্নয়ন-সহযোগীদের সহায়তায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাজেট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সংসদ সদস্যদের, বিশেষ করে নবীন সংসদ সদস্যদের সহযোগিতা করার জন্য ইউএসএইড প্রগতি প্রকল্পের অধীনে সংসদ সচিবালয়ে একটি বাজেট বিশ্লেষণ ও তদারকি ইউনিট গঠন করা হয়েছে এবং সংসদ সদস্যদের ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব ওরিয়েন্টেশন কোর্সে বাজেট বিষয়ে অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রিসোর্স পারসন হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। আর্থিক নজরদারি-সংক্রান্ত তিনটি কমিটি, যথা: পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি এবং কমিটি অন এস্টিমেটের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে অন্যান্য দাতা সংস্থার সহযোগিতায় স্ট্রেনথেনিং পার্লামেন্টারি ওভারসাইট প্রকল্পটি এ বছর থেকে কাজ শুরু করেছে। এর ফলে আর্থিক নজরদারি আরও সুদৃঢ় হবে। এ ছাড়া পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি দীর্ঘদিনের জমে থাকা অডিট রিপোর্টের ব্যাকলগ কমানোর জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে এবং ইতিমধ্যে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তা ছাড়া ইউএনডিপির সহযোগিতায় সংসদ সচিবালয় ও অন্যান্য সংসদীয় কমিটিকে শক্তিশালীকরণের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।
নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদকালে সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমকে যখন শক্তিশালীকরণের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নাধীন, এমন সময় এ ধরনের আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত সময়োচিত হয়েছে। এ জন্য আমি প্রথম আলোকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
(২৩ এপ্রিল প্রথম আলো কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দেওয়া বক্তব্য)
মো. আবদুল হামিদ: স্পিকার, জাতীয় সংসদ।
১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪০ বছরেও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা যতটুকু হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এর অনেক কারণও রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক যাত্রার পথ রুদ্ধ হয়। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথচলাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। চর্চার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হয়। তাই যেকোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের আপামর জনগণকে গণতন্ত্রমনা করে গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়াতে হবে এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
শুধু রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই গণতন্ত্রের চর্চা ও লালন করবে—এটা ভাবলে চলবে না। দলমত-নির্বিশেষে এটা সবারই দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে এবং এ ব্যাপারে তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে মিডিয়া ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে।
গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। টেকসই উন্নয়নের জন্য অব্যাহত গণতন্ত্র অপরিহার্য। একটি ছাড়া অপরটি চলতে পারে না। এ জন্য সংসদকে কার্যকর করতে হবে। সব সংসদ সদস্যকে আইন প্রণয়ন থেকে প্রতিটি কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। সংসদে আমরা যা কিছুই করি না কেন, জনগণ তা জানতে না পারলে এর সুফল তাদের কাছে পৌঁছাবে না। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কারণ তাদের মাধ্যমেই দেশবাসী সংসদে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা জানতে পারে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে গিয়ে কী দায়িত্ব পালন করেন, তা জানার অধিকারও জনগণের রয়েছে। আর এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলেই জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে আরও বেশি সচেতন হবেন।
বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা নিয়ে অনেকেই অনেক আশা-নিরাশার কথা বলেন। কিন্তু আমি হতাশ নই। গণতন্ত্রের বিকাশে চর্চার বিকল্প নেই। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা বারবার হোঁচট না খেলে হয়তো এত দিনে দেশে গণতন্ত্রের ভিত আরও বেশি মজবুত হতে পারত। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণতন্ত্র আরও এগিয়ে যাবে এবং প্রতিটি কাজকর্মে গণতান্ত্রিক রীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।
সংবাদপত্রকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় আপনাদেরও ভূমিকা আছে। অর্থাৎ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন ইস্যুতে জনমত গঠনের মাধ্যমে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। সংসদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে আইন প্রণয়নের আগে প্রস্তাবিত আইন সম্পর্কে আপনাদের মতামত আইনকে ত্রুটিমুক্ত করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। এমনকি আমার নিজের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাকে স্বাগত জানাই।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারসহ কয়েকটি পত্রিকা অষ্টম জাতীয় সংসদের বিভিন্ন দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আমি আশা করি, এর ফলে ভবিষ্যতে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে। বর্তমান সংসদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ করতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমি ১০০ ভাগ সফল হয়েছি তা দাবি করব না, তবে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছি। কেনাকাটার ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বছর পুরোনো জিনিসপত্র নিলামে ৩৩ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। অথচ আগে এগুলো কম মূল্য দেখিয়ে নিজেরাই নিয়ে নিতেন।
জাতীয় সংসদের একটি অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে ওভারসাইট ফাংশন বা নজরদারি কার্যক্রম। সংসদের পক্ষে এ কাজটি সম্পন্ন করা খুব সহজসাধ্য বিষয় নয়। মূলত সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাঠামো এবং সংসদের আর্থিক সামর্থ্য, দক্ষ জনবলের অপ্রতুলতা ইত্যাদি সীমাবদ্ধতা কাজটিকে আরও দুরূহ করে তোলে। সরকারের আয়-ব্যয়, প্রকল্প বাস্তবায়ন, জনগণের কল্যাণসাধনে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম—এসব বিষয় সংসদে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই নজরদারি কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, সংসদের মূল কাজটা কিন্তু হয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। নবম জাতীয় সংসদে প্রথম অধিবেশনেই সবগুলো স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং কমিটিগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে আওয়ামী লীগই প্রথমবারের মতো স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে মন্ত্রীর পরিবর্তে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব প্রদান করে। বর্তমান সংসদের মূল অধিবেশনে বিরোধী দল অনেক দিন অংশ না নিলেও সংসদীয় কমিটিগুলোতে কিন্তু তারা নিয়মিতভাবেই অংশ নিয়েছে। এটিও কিন্তু একটি ইতিবাচক ধারা। কমিটিগুলোতে সরকার ও বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুপারিশ করে থাকে। তবে প্রায়শই দেখা যায়, সরকারের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো কোনো কমিটির সদস্যদের একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। কমিটিগুলো মনে করছে, মন্ত্রণালয় সব তথ্য যেমন দিচ্ছে না, তেমনই কমিটির সব সুপারিশ বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় ভাবছে, কমিটিগুলো এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে, যা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বিষয়। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূরত্ব বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। এটা কীভাবে দূর করা যায়, সে বিষয়ে ভাবার সময় এসেছে। অন্যান্য উন্নত দেশে কীভাবে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাও জানা প্রয়োজন।
সংসদীয় কমিটি কার্যক্রমকে শক্তিশালী ও অর্থবহ করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি দক্ষ, কার্যকর ও শক্তিশালী সংসদ সচিবালয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা রয়েছে এবং দ্রুত এ অবস্থার উন্নয়নে সরকার ও উন্নয়ন-সহযোগীদের সহায়তায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাজেট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সংসদ সদস্যদের, বিশেষ করে নবীন সংসদ সদস্যদের সহযোগিতা করার জন্য ইউএসএইড প্রগতি প্রকল্পের অধীনে সংসদ সচিবালয়ে একটি বাজেট বিশ্লেষণ ও তদারকি ইউনিট গঠন করা হয়েছে এবং সংসদ সদস্যদের ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব ওরিয়েন্টেশন কোর্সে বাজেট বিষয়ে অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য, অর্থনীতিবিদ, অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রিসোর্স পারসন হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। আর্থিক নজরদারি-সংক্রান্ত তিনটি কমিটি, যথা: পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি, পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি এবং কমিটি অন এস্টিমেটের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে অন্যান্য দাতা সংস্থার সহযোগিতায় স্ট্রেনথেনিং পার্লামেন্টারি ওভারসাইট প্রকল্পটি এ বছর থেকে কাজ শুরু করেছে। এর ফলে আর্থিক নজরদারি আরও সুদৃঢ় হবে। এ ছাড়া পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি দীর্ঘদিনের জমে থাকা অডিট রিপোর্টের ব্যাকলগ কমানোর জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে এবং ইতিমধ্যে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তা ছাড়া ইউএনডিপির সহযোগিতায় সংসদ সচিবালয় ও অন্যান্য সংসদীয় কমিটিকে শক্তিশালীকরণের কার্যক্রম বাস্তবায়নাধীন। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।
নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদকালে সংসদীয় কমিটির কার্যক্রমকে যখন শক্তিশালীকরণের প্রক্রিয়া বাস্তবায়নাধীন, এমন সময় এ ধরনের আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত সময়োচিত হয়েছে। এ জন্য আমি প্রথম আলোকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।
(২৩ এপ্রিল প্রথম আলো কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দেওয়া বক্তব্য)
মো. আবদুল হামিদ: স্পিকার, জাতীয় সংসদ।
No comments