ছাত্রলীগ, ছাত্রদল by মাহমুদুর রহমান মান্না
এক সাংবাদিক ফোনে বললেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির পাঁচ বছর পূর্ণ হলো, মন্তব্য করুন। আমি প্রায়ই বলি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রধানত অ্যাডহক ভিত্তিতে চলে। এটা শুধু আওয়ামী লীগের বেলায় নয়, আওয়ামী লীগের যে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সেটা আরও অগোছালো। এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত ছাত্রদলের কমিটি গঠন করার প্রক্রিয়া যদি দেখা যায়, তাহলে এ কথার সত্যতা স্পষ্ট হবে। সেই যে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়া হত্যার দেড় মাস পর ছাত্রদলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো, সেখান থেকে শুরু। দুজন ছাত্র নিহত হয়েছিল প্রতিপক্ষের ওপর ইলিয়াস গ্রুপের হামলায়। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ইলিয়াস আলী গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘদিন কারা ভোগ করেন তাঁরই সরকারের আমলে। তখন থেকে ছাত্রদলে মূল দলের চেয়ারপারসন কর্তৃক নেতৃত্বের সিলেকশন প্রক্রিয়া চালু হয়। সেই সিলেকশনে নাসির উদ্দীন পিন্টু ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর মতো ব্যক্তিরা ছাত্রদলের নেতা হন। সর্বশেষ টুকু যে কমিটির সভাপতি হন, তাঁকে কেন্দ্র করেই বেগম জিয়া বেশি সমালোচিত হন। কারণ, শোনা যায়, টুকু ছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব।
শেখ হাসিনা এই জন্যই প্রশংসিত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগেও এ ধরনের বয়স্ক নেতারা ছিলেন। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের কারণে তাঁরা বাদ পড়ে যান। এখন তাঁদের কাউকে আর রাজনীতিতে দেখা যায় না। তবে নেত্রীর এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন সবাই। সবাই আশা করেছিলেন, ছাত্রলীগ একটি নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে বড় হবে।
কিন্তু কী দেখা গেল? দল ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সংগঠনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা গোষ্ঠীটি তাদের কুৎসিত থাবা বিস্তার করতে শুরু করল। শুরু হলো চর দখলের মতো হল দখল, ভর্তি-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চাপাতি, রামদার কোপে আহত হন ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হন। রাজশাহীতে নিহত হন পলিটেকনিকের এক ছাত্র। খোদ আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে লাগলেন, ক্ষমতার এই অল্প দিনে আমাদের যা কিছুই অর্জন, তা বিসর্জন করা হচ্ছে ছাত্রলীগের ক্রিয়াকলাপে। পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হতে লাগল, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’।
বিব্রত হয়ে পড়ল সরকার। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, ছাত্রলীগের কোনো সভায় যাবেন না তিনি। এমনকি অন্য কোনো সহযোগী সংগঠনের সভায় যদি ছাত্রলীগ নেতারা উপস্থিত থাকেন, তবে সেখানেও যাবেন না তিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মতিয়া চৌধুরী বর্তমান সরকারের একজন খুবই প্রভাবশালী মন্ত্রী। তার পরও তাঁর কথাকে অত গুরুত্ব দেননি অনেকে। কারণ, সবাই জানে, ওনার ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তা ছাড়া ব্যক্তিগত আচরণে-উচ্চারণে তিনি একজন কঠোর ধরনের নারী। কিন্তু দলের সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী বলে কথা। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশের সবচেয়ে বড় মহিলা কলেজের ভিপি ছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন, একটা কিছু হবে।
কিন্তু বাস্তব হলো এমন কিছুই হয়নি। অবস্থার বরং আরও অবনতি হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তাকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিমাণ বেশ কমেছে, কিন্তু যুক্ত হয়েছে নতুন প্রপঞ্চ, যা উদ্বেগজনক। কয়েক দিন আগে আমার কাছে ঢাকার একটি বড় কলেজের ছয়টি হোস্টেলের কয়েকজন ছাত্র দেখা করতে এসেছিল। তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। বর্তমানে ছাত্রলীগ না করলে হলে থাকা যায় না (বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো একই প্রকার নিয়ম চালু ছিল)। সেই ছাত্রলীগের কর্মীরা জানাল, তাদের কলেজের সঙ্গের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির স্ত্রী মাঝেমধ্যে কলেজের পাশের বাজারে মাছ, শাক-সবজি কিনতে আসেন। তাঁকে প্রটোকল দিতে হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। খুবই অপমানজনক মনে হয়েছে তাদের কাছে ব্যাপারটা। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারছে না তারা। প্রতিবাদ করলে হল থেকে বের করে দেবেন নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে কথা হয় আমার। এক ছাত্রনেতাকে জিজ্ঞেস করলাম; বিষয়টি উনি স্বীকার করলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম একটা ব্যাপার চালু আছে। বলেই তিনি বললেন, তা করবে না? যাদের আমি ভর্তি করিয়েছি তারা আমার কথা শুনবে না? আমাকে প্রটোকল দেবে না? এটাকে তার পাওনা বলে ধরে নিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হলের ছাত্রলীগ সভাপতি আবাসিক ছাত্রদের আদবকায়দা শিক্ষা দেওয়ার মধ্যযুগীয় কায়দার কথা আমরা পড়েছি না পত্রিকায়? হূদয়হীন, বিবেকহীন একদঙ্গল নেতা তৈরি করছি না আমরা? আর হাজার হাজার অসহায় ছাত্র অবনত মস্তকে তাদের কুর্নিশ করছে। এরা কি বরকত-সালামের উত্তরাধিকারী, কিংবা সেলিম, দেলোয়ারের?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে ছাত্রশিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমি ছাত্রলীগের সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কীভাবে হয়? তারা ঢুকল কীভাবে? আর ঢুকেও যদি থাকে, তাদের বহিষ্কার করছে না কেন? নিজেদের, মানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তো তোমরা নিশ্চয় চেনো। আমি যে দিন তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, সেই দিনই একটি দৈনিক পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ওপরে বিস্তারিত রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, যার মধ্যে শিবিরের অনুপ্রবেশের ব্যাপারটি এসেছিল। ছাত্রলীগের সভাপতি সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, ধরুন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৩৫ হাজার ছাত্র। এরা সবাই ছাত্রলীগ করে। আমি কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব?
ভেবে দেখুন, কী ভয়াবহ অবস্থা! এর ফলে সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতি হয়েছে তা নীতির। জরুরি অবস্থার সময় অভিযোগ করা হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরাজনৈতিকীকরণ করছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই দুটি দল আর তাদের ছাত্রসংগঠন তাদের অঙ্গনে এই প্রক্রিয়াই চালু রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেককে আমি প্রশ্ন করে দেখেছি, তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। একজনও ছাত্রদল কিংবা অন্য কোনো দল করে না। কেন—জানতে চাইলে তাদের জবাব, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী ছাত্রসংগঠন বলতে কিছু নেই। বলা বাহুল্য, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো এই পরিস্থিতি ছিল।
এর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এ রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মূলত কোনো রাজনীতি করে না। সরকার বদলালেই যখন তাদের দল বদলাতে হয়, তখন তাদের সঙ্গে মিরপুরের হাজি খালেকের পার্থক্য কী, যিনি বলতেন, আমি তো দল বদলাই না। সরকার দল বদলায়া ফেলায়। আমি সব সময় সরকারি দল করি।
আমি মনে করি, কালবিলম্ব না করে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু সম্মেলন কথাটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। সম্মেলন মানেই নতুন কমিটি বানানো নয়। পাঁচ বছর হয়ে গেছে, ছাত্রনেতাদের বয়সসীমা পার হয়ে গেছে, কেবল সেই বিবেচনায় সম্মেলন করতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা নয়। এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন থাকতে পারে, যখন সম্মেলন করা যাবে না। বর্তমান সময়ের মূল কথা হলো ছাত্ররাজনীতি যে অন্ধকার গলিতে ঢুকে যাচ্ছে, সেখান থেকে তাকে টেনে বের করতে হবে।
বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির এই যে অবক্ষয় তা কেন? কখন কীভাবে এই ক্ষতিটা হলো। দুই নেত্রীকে এবং বিশেষভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমি বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যদি ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিক বিকাশকে পর্যালোচনা করি, তবে আমরা দেখব, নব্বইয়ের আন্দোলনের পর থেকে এই সময় পর্যন্ত দুই দশকে ছাত্ররাজনীতির বিপথগামী হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এটাকে একটা অবক্ষয়ের অধ্যায় বললেও সম্ভবত ভুল করা হবে না। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত যে খুন, গুম খুন হয়েছে তার বিশদ বিবরণ হাজির করলে সবাইকে শিউরে উঠতে হয়। আমি দুটি ছাত্রসংগঠনকেই এ জন্য দায়ী করব। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করব এ জন্য যে, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুই টার্মে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তিনি ক্ষমতায় আসার পরই ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র নিহত হন। পরবর্তী সময়ে যাঁকে তিনি ছাত্রদলের দায়িত্ব দেন সেই সভাপতি বর্তমানে কারাগারে; দীর্ঘদিন ধরে। যখন তাঁকে তিনি সভাপতি নিযুক্ত করেন, তখনো তাঁর নামে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। ৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে পড়লাম, ৩২ বছরেও পূর্ণাঙ্গ গঠনতন্ত্র দিতে পারেনি ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’। উল্লেখ্য, ছাত্রদল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি। অদূর ভবিষ্যতেও এটা হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান নেতা-কর্মীরা। ছাত্রত্বের বয়সসীমা নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে—এমন শঙ্কা থেকেই গঠনতন্ত্র প্রণয়নে কেন্দ্রীয় নেতারা আগ্রহী নন। বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হলে অধিকাংশ নেতাকেই পদ হারাতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির একটি বয়সসীমা অবশ্যই থাকা উচিত। এবং সে বিবেচনায় শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নিশ্চয় অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে বলেছেন, সারা দেশে ৮০ শতাংশ জেলায় তাঁরা সম্মেলন করেছেন। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের জন্য সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আমি জানতে চাইলাম, কিসের অপেক্ষা? ওরা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন জিজ্ঞেস করছে, আপনি জানেন না?
শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব ছেড়েছেন ঠিকই, কিন্তু ‘কমলি তো ছাড়ছে না’। ছাত্রলীগের সম্মেলন! সে তো মেলা খরচের ব্যাপার। নতুন একটা কমিটি বানাতে হবে। সে কী সোজা কথা! ওকে কমিশন এখন আর নেই। তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদককে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দুই বছরে তাদের তৎপরতার কোনো খবর আমরা পাইনি। তার মানে যত দায়িত্ব ‘পড়বি তো পর মালির ঘাড়ে’?
শেখ হাসিনা কি এই পরিস্থিতি উপভোগ করেন? উনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কত দায়িত্ব তাঁর। কত চ্যালেঞ্জ। তাঁর তো বিরক্তি ধরে যাওয়ার কথা। কথা ছিল সহযোগী সংগঠনগুলো স্বকীয়ভাবে বিকশিত হবে। নিজেদের মতো করে দায়িত্ব পালন করবে।
দেখা যাক কী হয়। কিন্তু ভালো একটা কিছু দেখতে চাই।
মাহমুদুর রহমান মান্না: ডাকসুর সাবেক ভিপি। বর্তমানের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
শেখ হাসিনা এই জন্যই প্রশংসিত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগেও এ ধরনের বয়স্ক নেতারা ছিলেন। শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের কারণে তাঁরা বাদ পড়ে যান। এখন তাঁদের কাউকে আর রাজনীতিতে দেখা যায় না। তবে নেত্রীর এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন সবাই। সবাই আশা করেছিলেন, ছাত্রলীগ একটি নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে বড় হবে।
কিন্তু কী দেখা গেল? দল ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সংগঠনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা গোষ্ঠীটি তাদের কুৎসিত থাবা বিস্তার করতে শুরু করল। শুরু হলো চর দখলের মতো হল দখল, ভর্তি-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চাপাতি, রামদার কোপে আহত হন ছাত্রলীগের অসংখ্য কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হন। রাজশাহীতে নিহত হন পলিটেকনিকের এক ছাত্র। খোদ আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে লাগলেন, ক্ষমতার এই অল্প দিনে আমাদের যা কিছুই অর্জন, তা বিসর্জন করা হচ্ছে ছাত্রলীগের ক্রিয়াকলাপে। পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখা হতে লাগল, ‘প্রধানমন্ত্রী, ছাত্রলীগকে সামলান’।
বিব্রত হয়ে পড়ল সরকার। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, ছাত্রলীগের কোনো সভায় যাবেন না তিনি। এমনকি অন্য কোনো সহযোগী সংগঠনের সভায় যদি ছাত্রলীগ নেতারা উপস্থিত থাকেন, তবে সেখানেও যাবেন না তিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মতিয়া চৌধুরী বর্তমান সরকারের একজন খুবই প্রভাবশালী মন্ত্রী। তার পরও তাঁর কথাকে অত গুরুত্ব দেননি অনেকে। কারণ, সবাই জানে, ওনার ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তা ছাড়া ব্যক্তিগত আচরণে-উচ্চারণে তিনি একজন কঠোর ধরনের নারী। কিন্তু দলের সভানেত্রী, প্রধানমন্ত্রী বলে কথা। তিনি নিজেও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশের সবচেয়ে বড় মহিলা কলেজের ভিপি ছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন, একটা কিছু হবে।
কিন্তু বাস্তব হলো এমন কিছুই হয়নি। অবস্থার বরং আরও অবনতি হয়েছে। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং তাকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিমাণ বেশ কমেছে, কিন্তু যুক্ত হয়েছে নতুন প্রপঞ্চ, যা উদ্বেগজনক। কয়েক দিন আগে আমার কাছে ঢাকার একটি বড় কলেজের ছয়টি হোস্টেলের কয়েকজন ছাত্র দেখা করতে এসেছিল। তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। বর্তমানে ছাত্রলীগ না করলে হলে থাকা যায় না (বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো একই প্রকার নিয়ম চালু ছিল)। সেই ছাত্রলীগের কর্মীরা জানাল, তাদের কলেজের সঙ্গের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতির স্ত্রী মাঝেমধ্যে কলেজের পাশের বাজারে মাছ, শাক-সবজি কিনতে আসেন। তাঁকে প্রটোকল দিতে হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। খুবই অপমানজনক মনে হয়েছে তাদের কাছে ব্যাপারটা। কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারছে না তারা। প্রতিবাদ করলে হল থেকে বের করে দেবেন নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে কথা হয় আমার। এক ছাত্রনেতাকে জিজ্ঞেস করলাম; বিষয়টি উনি স্বীকার করলেন— বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম একটা ব্যাপার চালু আছে। বলেই তিনি বললেন, তা করবে না? যাদের আমি ভর্তি করিয়েছি তারা আমার কথা শুনবে না? আমাকে প্রটোকল দেবে না? এটাকে তার পাওনা বলে ধরে নিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হলের ছাত্রলীগ সভাপতি আবাসিক ছাত্রদের আদবকায়দা শিক্ষা দেওয়ার মধ্যযুগীয় কায়দার কথা আমরা পড়েছি না পত্রিকায়? হূদয়হীন, বিবেকহীন একদঙ্গল নেতা তৈরি করছি না আমরা? আর হাজার হাজার অসহায় ছাত্র অবনত মস্তকে তাদের কুর্নিশ করছে। এরা কি বরকত-সালামের উত্তরাধিকারী, কিংবা সেলিম, দেলোয়ারের?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে ছাত্রশিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমি ছাত্রলীগের সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কীভাবে হয়? তারা ঢুকল কীভাবে? আর ঢুকেও যদি থাকে, তাদের বহিষ্কার করছে না কেন? নিজেদের, মানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তো তোমরা নিশ্চয় চেনো। আমি যে দিন তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, সেই দিনই একটি দৈনিক পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ওপরে বিস্তারিত রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল, যার মধ্যে শিবিরের অনুপ্রবেশের ব্যাপারটি এসেছিল। ছাত্রলীগের সভাপতি সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে বললেন, ধরুন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০-৩৫ হাজার ছাত্র। এরা সবাই ছাত্রলীগ করে। আমি কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব?
ভেবে দেখুন, কী ভয়াবহ অবস্থা! এর ফলে সবচেয়ে বেশি যে ক্ষতি হয়েছে তা নীতির। জরুরি অবস্থার সময় অভিযোগ করা হয়েছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরাজনৈতিকীকরণ করছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই দুটি দল আর তাদের ছাত্রসংগঠন তাদের অঙ্গনে এই প্রক্রিয়াই চালু রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেককে আমি প্রশ্ন করে দেখেছি, তারা সবাই ছাত্রলীগ করে। একজনও ছাত্রদল কিংবা অন্য কোনো দল করে না। কেন—জানতে চাইলে তাদের জবাব, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরোধী ছাত্রসংগঠন বলতে কিছু নেই। বলা বাহুল্য, বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখনো এই পরিস্থিতি ছিল।
এর মানে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এ রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মূলত কোনো রাজনীতি করে না। সরকার বদলালেই যখন তাদের দল বদলাতে হয়, তখন তাদের সঙ্গে মিরপুরের হাজি খালেকের পার্থক্য কী, যিনি বলতেন, আমি তো দল বদলাই না। সরকার দল বদলায়া ফেলায়। আমি সব সময় সরকারি দল করি।
আমি মনে করি, কালবিলম্ব না করে ছাত্রলীগের সম্মেলন হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু সম্মেলন কথাটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। সম্মেলন মানেই নতুন কমিটি বানানো নয়। পাঁচ বছর হয়ে গেছে, ছাত্রনেতাদের বয়সসীমা পার হয়ে গেছে, কেবল সেই বিবেচনায় সম্মেলন করতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা নয়। এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে, দীর্ঘদিন স্বৈরশাসন থাকতে পারে, যখন সম্মেলন করা যাবে না। বর্তমান সময়ের মূল কথা হলো ছাত্ররাজনীতি যে অন্ধকার গলিতে ঢুকে যাচ্ছে, সেখান থেকে তাকে টেনে বের করতে হবে।
বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির এই যে অবক্ষয় তা কেন? কখন কীভাবে এই ক্ষতিটা হলো। দুই নেত্রীকে এবং বিশেষভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমি বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যদি ছাত্ররাজনীতির ধারাবাহিক বিকাশকে পর্যালোচনা করি, তবে আমরা দেখব, নব্বইয়ের আন্দোলনের পর থেকে এই সময় পর্যন্ত দুই দশকে ছাত্ররাজনীতির বিপথগামী হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এটাকে একটা অবক্ষয়ের অধ্যায় বললেও সম্ভবত ভুল করা হবে না। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কত যে খুন, গুম খুন হয়েছে তার বিশদ বিবরণ হাজির করলে সবাইকে শিউরে উঠতে হয়। আমি দুটি ছাত্রসংগঠনকেই এ জন্য দায়ী করব। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করব এ জন্য যে, ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুই টার্মে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তিনি ক্ষমতায় আসার পরই ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র নিহত হন। পরবর্তী সময়ে যাঁকে তিনি ছাত্রদলের দায়িত্ব দেন সেই সভাপতি বর্তমানে কারাগারে; দীর্ঘদিন ধরে। যখন তাঁকে তিনি সভাপতি নিযুক্ত করেন, তখনো তাঁর নামে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ছিল। ৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে পড়লাম, ৩২ বছরেও পূর্ণাঙ্গ গঠনতন্ত্র দিতে পারেনি ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’। উল্লেখ্য, ছাত্রদল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি। অদূর ভবিষ্যতেও এটা হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান নেতা-কর্মীরা। ছাত্রত্বের বয়সসীমা নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে—এমন শঙ্কা থেকেই গঠনতন্ত্র প্রণয়নে কেন্দ্রীয় নেতারা আগ্রহী নন। বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হলে অধিকাংশ নেতাকেই পদ হারাতে হবে।
ছাত্ররাজনীতির একটি বয়সসীমা অবশ্যই থাকা উচিত। এবং সে বিবেচনায় শেখ হাসিনা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নিশ্চয় অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমাকে বলেছেন, সারা দেশে ৮০ শতাংশ জেলায় তাঁরা সম্মেলন করেছেন। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের জন্য সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। আমি জানতে চাইলাম, কিসের অপেক্ষা? ওরা এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যেন জিজ্ঞেস করছে, আপনি জানেন না?
শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব ছেড়েছেন ঠিকই, কিন্তু ‘কমলি তো ছাড়ছে না’। ছাত্রলীগের সম্মেলন! সে তো মেলা খরচের ব্যাপার। নতুন একটা কমিটি বানাতে হবে। সে কী সোজা কথা! ওকে কমিশন এখন আর নেই। তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদককে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই দুই বছরে তাদের তৎপরতার কোনো খবর আমরা পাইনি। তার মানে যত দায়িত্ব ‘পড়বি তো পর মালির ঘাড়ে’?
শেখ হাসিনা কি এই পরিস্থিতি উপভোগ করেন? উনি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। কত দায়িত্ব তাঁর। কত চ্যালেঞ্জ। তাঁর তো বিরক্তি ধরে যাওয়ার কথা। কথা ছিল সহযোগী সংগঠনগুলো স্বকীয়ভাবে বিকশিত হবে। নিজেদের মতো করে দায়িত্ব পালন করবে।
দেখা যাক কী হয়। কিন্তু ভালো একটা কিছু দেখতে চাই।
মাহমুদুর রহমান মান্না: ডাকসুর সাবেক ভিপি। বর্তমানের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
No comments