যানজট কি শুধু বেড়েই চলবে? by বিলকিস বানু
ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় যে যানজটের সমস্যা, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র দেশে। দূরপাল্লায় চলাচলের মহাসড়কগুলোতে পর্যন্ত আজকাল যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন ধরা যাক ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাতায়াতের মহাসড়কটির কথা। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর পূর্ব দিকে টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, বাইপাইল, গাজীপুর, সাভার—এই সড়কগুলো দিয়ে বাসে যাতায়াত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকাল। যানজট, পেট্রল পোড়ার দুর্গন্ধ, সময়ের দীর্ঘতা—সব মিলিয়ে উদ্ভট এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে এসব সড়কে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর অপর পারে, উত্তরবঙ্গের দিকে, ঢাকা থেকে ১৯৩ কিমি ও দিনাজপুর থেকে ২২১ কিমি দূরত্বে শেরপুরে অবস্থিত অ্যারিস্টক্র্যাট, ফুড কোড, ফুড ভিলেজ ইত্যাদি রেস্টুরেন্ট পার হওয়ার কিছু পর থেকেই শেরপুর, বগুড়া, রংপুর, সৈয়দপুর—এই শহরগুলো বাদ দিলেও তাদের মাঝামাঝি মহাসড়কগুলোতে যথেষ্ট যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে; যার কারণে বাসে ভ্রমণ আজকাল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অথচ বঙ্গবন্ধু সেতু যখন প্রথম উদ্বোধন করা হয় ১৯৯৮ সালে, তার পর থেকে বাসে ভ্রমণ অত্যন্ত আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছিল। ভ্রমণের সময় কমে ছয় ঘণ্টায় নেমে এসেছিল। কিন্তু আজকাল সেটা একটা অবাস্তব ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ এখন আট-নয় ঘণ্টায় উত্তরণ ঘটেছে।
আমরা সব সময় বলছি, দেশ দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব দিক থেকে আমাদের দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ ও বিশ্বায়নের লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অতি দ্রুত সামনে এগিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে আমরা আবার এও বলে থাকি, স্বাধীনতার ৩৯ বছর পার হওয়ার পরও আমাদের দেশ সেই হিসেবে তেমন একটা উন্নতি করতে পারেনি। এর জন্য জাতি অনেক কারণ শনাক্ত করেছে। কিন্তু আমরা বলি, জাতির পিছিয়ে পড়ার অনেক কারণের মধ্যে এই যানজটও একটি। ঢাকায় যে যানজট বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে, তাতে আমাদের জীবনের ও দেশের উন্নতির সোপানগুলো দিনের পর দিন কীভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, তা কি আমরা কখনো হিসাব করে দেখেছি? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিস-আদালতে যেতে এই যে বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় আমাদের জীবন থেকে খসে পড়ে গেছে, সেই সময়গুলোকে আমরা যদি উপযুক্তভাবে হাতে পেতাম, তাহলে এই কয়েক বছরে সেই ঘণ্টাগুলো কত ঘণ্টা হতো এবং সেই ঘণ্টাগুলোকে ব্যবহার করে বা সেই সময়ে বিশ্রাম নিলেও আমরা আমাদের লেখাপড়ায়, কাজেকর্মে আরও কত বেশি পারদর্শী, তীক্ষ বুদ্ধি ও উন্নত হতাম, পরের প্রজন্ম তারপর আরও কত ধাপ সামনের দিকে এগিয়ে যেত, তার বিনিময়ে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, চিকিৎসাব্যবস্থা, দোকানপাট, স্থাপনা, খেলার মাঠ, আরও কতটা উন্নতি করত, তা কি আমরা কখনো হিসাব করে দেখেছি?
আমাদের দেশের অনেক উন্নতি তো হয়েছে বটেই। দেশের মানুষের অনেক অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। তাই আজকাল দেশে আগের চেয়ে বেশি মানুষ গাড়ি কিনছে, ব্যবসা বা যাতায়াতের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি বাস কেনা হচ্ছে, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বেশি রিকশা চলছে। আমাদের দেশে উন্নতিটা আপাতত ‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি’র মতো যেন। গাড়ি, রিকশা, মানুষ বেশি, অথচ রাস্তাঘাট কম। মানুষ কি এ জন্য গাড়ি কিনবে না? বাসে চড়বে না? ব্রুনাইয়ে মাথাপিছু মানুষের চার-পাঁচটি করে গাড়ি থাকে। তাদের দেশের তাহলে কী অবস্থা হওয়ার কথা?
এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কি একটা রূপরেখা আমরা আঁকতে পারি না? ঢাকায় কি আরও বেশি করে সড়ক নির্মাণ করা যায় না? যেমন, আগারগাঁওয়ের সামনে দিয়ে একটি সড়ক চলে গিয়ে ভিআইপি রোডে মিশেছে। তেমনিভাবে শহরের মধ্য দিয়ে কিছু জায়গা বের করে নিয়ে আরও কিছু রাস্তাঘাট তো নির্মাণ করা যায়। ভিআইপি রোডের কিছু কিছু জায়গায় বাড়তি রাস্তা নির্মাণ করা প্রয়োজন এবং কিছু কিছু জায়গায় এই রাস্তাকে দ্বিগুণ-তিন গুণ প্রশস্ত করা প্রয়োজন। দুই পাশে রাখতে হবে দুটো ফুটপাত। মহাসড়কগুলো দিয়ে ভ্রমণের সময় আগে সড়কের দুই ধার দিয়ে সবুজ নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি দেখা যেত এবং নির্মল বাতাস সেবন করতে করতে ভ্রমণ করা যেত। কবির ভাষায়, ‘পরী বা ডাইনির থেকেও দ্রুত, বাড়ি, ঝোপ, খাল, বিল, নদীনালা, ব্রিজ, পাহাড়; সব যুদ্ধের সেনাবাহিনীর মতো আক্রমণের ভঙ্গিতে; বৃষ্টির মতো ঘন হয়ে ধেয়ে চলে যায় এবং আঁকা স্টেশনগুলো চোখের পলকে শিটি বাজিয়ে পার হয়ে যায়।’ এমনি রেলগাড়িতে চড়ার মতো দৃশ্যাবলি দেখা যেত। কিন্তু আজকাল মহাসড়কগুলোর দুই ধার দিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন প্রকারের ছোট-বড় আকারের কলকারখানা, দোকানপাট, চায়ের দোকান, হাটবাজার, স্থাপনা ইত্যাদি। সবুজ দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়ে। প্রকৃতির নির্মল বাতাসও নেই বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। কিন্তু সময় নিশ্চিতভাবে এসে গেছে মহাসড়কগুলোকে বাড়িয়ে দুই ডবল বা তিন ডবল করার। আর এই মহাসড়কগুলোকে দুই ধারে প্রশস্ত করার জন্য ও তার দুই ধার দিয়ে পথচারী ও রিকশাভ্যানের জন্য ফুটপাত রাখার জন্য যে জায়গাজমির প্রয়োজন, সেই চাহিদা অনুযায়ী মহাসড়কের দুই ধার দিয়ে অন্তত আধামাইল দূরত্ব বজায় রেখে স্থাপনা, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ গড়ে তোলার সরকারি আইন এখনই প্রয়োগ ও চালু করা প্রয়োজন। নইলে নতুন মহাসড়ক নির্মাণ কোনো দিনই সম্ভব হবে না। পরিশেষে আমি আবার প্রস্তাব রাখব, যেখানে সম্ভব নতুন সড়ক নির্মাণ করা হোক এবং যেখানে সম্ভব বিদ্যমান সড়ককে দুই পাশ দিয়ে আরও প্রশস্ত করা হোক।
বিলকিস বানু: সহকারী অধ্যাপক, কেবিএম কলেজ, দিনাজপুর।
অথচ বঙ্গবন্ধু সেতু যখন প্রথম উদ্বোধন করা হয় ১৯৯৮ সালে, তার পর থেকে বাসে ভ্রমণ অত্যন্ত আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছিল। ভ্রমণের সময় কমে ছয় ঘণ্টায় নেমে এসেছিল। কিন্তু আজকাল সেটা একটা অবাস্তব ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই ছয় ঘণ্টার ভ্রমণ এখন আট-নয় ঘণ্টায় উত্তরণ ঘটেছে।
আমরা সব সময় বলছি, দেশ দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব দিক থেকে আমাদের দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ ও বিশ্বায়নের লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অতি দ্রুত সামনে এগিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে আমরা আবার এও বলে থাকি, স্বাধীনতার ৩৯ বছর পার হওয়ার পরও আমাদের দেশ সেই হিসেবে তেমন একটা উন্নতি করতে পারেনি। এর জন্য জাতি অনেক কারণ শনাক্ত করেছে। কিন্তু আমরা বলি, জাতির পিছিয়ে পড়ার অনেক কারণের মধ্যে এই যানজটও একটি। ঢাকায় যে যানজট বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে, তাতে আমাদের জীবনের ও দেশের উন্নতির সোপানগুলো দিনের পর দিন কীভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, তা কি আমরা কখনো হিসাব করে দেখেছি? স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিস-আদালতে যেতে এই যে বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় আমাদের জীবন থেকে খসে পড়ে গেছে, সেই সময়গুলোকে আমরা যদি উপযুক্তভাবে হাতে পেতাম, তাহলে এই কয়েক বছরে সেই ঘণ্টাগুলো কত ঘণ্টা হতো এবং সেই ঘণ্টাগুলোকে ব্যবহার করে বা সেই সময়ে বিশ্রাম নিলেও আমরা আমাদের লেখাপড়ায়, কাজেকর্মে আরও কত বেশি পারদর্শী, তীক্ষ বুদ্ধি ও উন্নত হতাম, পরের প্রজন্ম তারপর আরও কত ধাপ সামনের দিকে এগিয়ে যেত, তার বিনিময়ে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, চিকিৎসাব্যবস্থা, দোকানপাট, স্থাপনা, খেলার মাঠ, আরও কতটা উন্নতি করত, তা কি আমরা কখনো হিসাব করে দেখেছি?
আমাদের দেশের অনেক উন্নতি তো হয়েছে বটেই। দেশের মানুষের অনেক অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। তাই আজকাল দেশে আগের চেয়ে বেশি মানুষ গাড়ি কিনছে, ব্যবসা বা যাতায়াতের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি বাস কেনা হচ্ছে, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বেশি রিকশা চলছে। আমাদের দেশে উন্নতিটা আপাতত ‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি’র মতো যেন। গাড়ি, রিকশা, মানুষ বেশি, অথচ রাস্তাঘাট কম। মানুষ কি এ জন্য গাড়ি কিনবে না? বাসে চড়বে না? ব্রুনাইয়ে মাথাপিছু মানুষের চার-পাঁচটি করে গাড়ি থাকে। তাদের দেশের তাহলে কী অবস্থা হওয়ার কথা?
এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কি একটা রূপরেখা আমরা আঁকতে পারি না? ঢাকায় কি আরও বেশি করে সড়ক নির্মাণ করা যায় না? যেমন, আগারগাঁওয়ের সামনে দিয়ে একটি সড়ক চলে গিয়ে ভিআইপি রোডে মিশেছে। তেমনিভাবে শহরের মধ্য দিয়ে কিছু জায়গা বের করে নিয়ে আরও কিছু রাস্তাঘাট তো নির্মাণ করা যায়। ভিআইপি রোডের কিছু কিছু জায়গায় বাড়তি রাস্তা নির্মাণ করা প্রয়োজন এবং কিছু কিছু জায়গায় এই রাস্তাকে দ্বিগুণ-তিন গুণ প্রশস্ত করা প্রয়োজন। দুই পাশে রাখতে হবে দুটো ফুটপাত। মহাসড়কগুলো দিয়ে ভ্রমণের সময় আগে সড়কের দুই ধার দিয়ে সবুজ নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি দেখা যেত এবং নির্মল বাতাস সেবন করতে করতে ভ্রমণ করা যেত। কবির ভাষায়, ‘পরী বা ডাইনির থেকেও দ্রুত, বাড়ি, ঝোপ, খাল, বিল, নদীনালা, ব্রিজ, পাহাড়; সব যুদ্ধের সেনাবাহিনীর মতো আক্রমণের ভঙ্গিতে; বৃষ্টির মতো ঘন হয়ে ধেয়ে চলে যায় এবং আঁকা স্টেশনগুলো চোখের পলকে শিটি বাজিয়ে পার হয়ে যায়।’ এমনি রেলগাড়িতে চড়ার মতো দৃশ্যাবলি দেখা যেত। কিন্তু আজকাল মহাসড়কগুলোর দুই ধার দিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন প্রকারের ছোট-বড় আকারের কলকারখানা, দোকানপাট, চায়ের দোকান, হাটবাজার, স্থাপনা ইত্যাদি। সবুজ দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়ে। প্রকৃতির নির্মল বাতাসও নেই বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। কিন্তু সময় নিশ্চিতভাবে এসে গেছে মহাসড়কগুলোকে বাড়িয়ে দুই ডবল বা তিন ডবল করার। আর এই মহাসড়কগুলোকে দুই ধারে প্রশস্ত করার জন্য ও তার দুই ধার দিয়ে পথচারী ও রিকশাভ্যানের জন্য ফুটপাত রাখার জন্য যে জায়গাজমির প্রয়োজন, সেই চাহিদা অনুযায়ী মহাসড়কের দুই ধার দিয়ে অন্তত আধামাইল দূরত্ব বজায় রেখে স্থাপনা, হাটবাজার, স্কুল-কলেজ গড়ে তোলার সরকারি আইন এখনই প্রয়োগ ও চালু করা প্রয়োজন। নইলে নতুন মহাসড়ক নির্মাণ কোনো দিনই সম্ভব হবে না। পরিশেষে আমি আবার প্রস্তাব রাখব, যেখানে সম্ভব নতুন সড়ক নির্মাণ করা হোক এবং যেখানে সম্ভব বিদ্যমান সড়ককে দুই পাশ দিয়ে আরও প্রশস্ত করা হোক।
বিলকিস বানু: সহকারী অধ্যাপক, কেবিএম কলেজ, দিনাজপুর।
No comments