রাজনৈতিক আলোচনা- 'আশির দশকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন' by আবুল কাসেম ফজলুল হক

বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির লক্ষে যাঁরা চিন্তা ও কাজ করেন, তাঁদেরকে ইতিহাসের দিক দিয়েও সমস্যাবলির প্রকৃতি বিচার করতে হবে। আর এটাও বুঝতে হবে যে, জনগণের উন্নতি কেবল নেতাদের ও বুদ্ধিজীবীদের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে মূলত জনগণের নিজেদের উপরেই। নিজেদেরকে নিজেদেরই উন্নত করতে হয়। নিজেরা সক্রিয় হয়ে নিজেদের উন্নত না করলে কেউই তা করে দেয় না। অভীষ্ট নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হয়, তৈরি পাওয়া যায় না। নেতৃত্বের আশায় থাকলে ফল হয় না। এটাও বুঝতে হবে যে, রাজনৈতিক আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা যদিও আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণের উপর নির্ভর করে, তবু আন্দোলনের চরিত্র জনগণের অংশগ্রহণের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় সম্পূর্ণই নেতৃত্বের চরিত্রের দ্বারা। এজন্য নেতৃত্ব সৃষ্টি সম্পর্কে জনগণের সতর্কতা দরকার।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছে নানা আয়োজনের সঙ্গে জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণের ফলে। কিন্তু স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধেরকালে জনগণের নেতৃত্ব (খবধফবৎংযরঢ় ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব) সৃষ্টি করার চিন্তা ও চেষ্টা জনগণের পক্ষ থেকে না করার ফলে ভোটাভুটি-সর্বস্ব গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালিত হয়ে চলছে গণবিরোধী ধারায়। ২০০১ সালে এবং ২০০৯ সালে ভোটাভুটির মাধ্যমে বিপুল জনসমর্থন ও জাতীয় সংসদে বিরাট সংখ্যাধিক্য নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু ভোট দিয়ে জনগণ কি নিজেদের সরকার গঠন করেছে? ক্ষমতায় আসীন হয়ে দুটি সরকারই মনোযোগ দিয়েছে 'দলীয়করণে'। যত সময় গিয়েছে জনস্বার্থ বিরোধী দলীয়করণের তৎপরতা ততই বেড়েছে। পূর্ববতর্ী সরকারের চেয়ে পরবতর্ী সরকার দলীয়করণে অধিকতর তৎপর হয়েছে। সরকারের চরিত্র জনগণের বিপুল ভোটের উপর একটুও নির্ভর করেনি, সম্পূর্ণই নির্ভর করেছে সরকারি দলের ও সরকারি লোকদের রাজনৈতিক চরিত্রের উপর। দলীয়করণ কি কোনো সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়? এ সম্পর্কে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি সন্দর্ভে শেখ আবদুল বাতেন লিখেছেন: "পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র-পার্লামেন্টারি কিংবা প্রেসিডেনশিয়াল যাই হোক আসলে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। সেটা একটা সিস্টেমের মধ্যে কাজ করে। সেখানে রাষ্ট্রের ভেতরে সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ছাড়াও যথেষ্ট সংখ্যক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থাকে যেখানে আর্থিক বিনিয়োগ, আয়, লেনদেন ও লুটপাট করার যথেষ্ট সুযোগ থাকে- যা এমনকি অন্য রাষ্ট্র পর্যন্ত সম্প্রসারিত। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে লুটপাটের জন্য রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জন্য কোনো উলেস্নখযোগ্য প্রতিষ্ঠান নেই। তাই লুটপাটের প্রয়োজনে সচিবালয়, এর অধীনসস্থ দপ্তর, অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান- উপজেলা, জেলা প্রশাসন, এলজিইডি, সড়ক ভবন, নগরভবন, ভূমি অফিস ইত্যাদি সীমিত চারণভূমির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। সেখানে যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করা যায় তার জন্য সকল স্তরের বিচারাদালত, প্রশাসন ও ল'-এন্ফোর্সিং এজেন্সিতে নিজেদের লোক রাখতে হয়, অর্থাৎ লুটপাটের জন্য দলীয়করণ জরুরি হয়ে পড়ে। তাছাড়া গণস্বার্থ বিচ্ছিন্ন রাজনীতি নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনের দলানুগত্য গুরুত্বপূর্ণ। বৈধ অস্ত্রের আনুকূল্য না পেলে অবৈধ অস্ত্র সক্রিয় থাকতে পারে না। দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে তার অস্তিত্বে সব রকমের চাপ পড়ে। অতএব দুবর্ৃত্তায়নের বাস্তব প্রয়োজনে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে দলের পক্ষে আনতে টানা-হেঁচড়া শুরু হয়ে যায় যা ন্যক্কারজনক পর্যায়ে পেঁৗছে বিগত জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬)। দলীয়করণের একটা সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় বিদায়কালে ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিবের খোলামেলা স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিতে (সাক্ষাৎকার: প্রশাসন দলীয়করণ- ড. কামাল সিদ্দিকি, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৮.১০.২০০৬)। জনপ্রশাসন দলীয়করণের একটি উলেস্নখযোগ্য সাম্প্রতিক প্রবণতা হল মেয়াদোত্তীর্ণ অনুগত আমলাদের পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া। সবাই জানেন, একজন সচিব ক্যাডার সার্ভিসের সদস্য হলেও কার্যত তিনি হয়ে যান দলীয় ক্যাডার। এঁরা প্রশাসনের উপরের স্তরে থাকেন, তরুণ ও মেধাবী অফিসারদের নিরপেক্ষ কাজে বাধা সৃষ্টি করেন, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের প্রমোশনে ও ক্যারিয়ারে ব্যাঘাত ঘটান। ফলে জন্ম নেয় পেশাগত হতাশা, হতাশা থেকে দুনর্ীতি, জনস্বার্থের প্রতি অনাস্থা। জনপ্রশাসন রাষ্ট্রযন্ত্রের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী অংশ-বিবদমান রাজনৈতিক দল ও শক্তির মধ্যে মধ্যস্থতা করার ও ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব পালনে অযোগ্য হয়ে পড়ে। ক্রমে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রে নির্দলীয় পক্ষপাতমুক্ত প্রশাসনের বিলুপ্তি ঘটে।"
বিগত জোট সরকারের আমলে যেমন, তেমনি বর্তমান জোট সরকারের (২০০৯- আমলেও দলীয়করণ চলছে এবং তার গতি অনেক বেড়েছে। কুফলও বেড়েছে-বাড়ছে। আগের সরকার যে উদ্দেশ্যে যতটা দলীয়করণ করেছে, বর্তমান সরকারও ঠিক সেই উদ্দেশ্যে তার চেয়ে বেশী দলীয়করণ করে চলছে। কোনো সুফল কি আছে এর? জনজীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে দলবাজদের দৌরাত্ম্যে। দলীয়করণকে সাধারণ মানুষ 'দলবাজি' বলে থাকে। জনগণই ভোট দিয়ে 'দলবাজ সরকার' গঠন করে। দলবাজ দলগুলোকে কেন ভোট দেয় জনগণ? দার্শনিক হেগেলের একটি উক্তিঃ 'যে জনগণ যখন যেমন, নেতৃত্বের যোগ্য হয়, সেই জনগণ তখন ঠিক সেই রকম নেতৃত্বই লাভ করে।' আজকাল গ্রামাঞ্চলে লোকমুখে শোনা যায়: 'যে খাইতে পারে সে খাওয়াইতেও পারে।' খাইতে পারা মানে লুটপাট করতে পারা! কেড়ে নেওয়া মেরে খাওয়া আর কি। জনগণ সতর্ক হয়ে নিজেদের চরিত্র উন্নত না করলে, নিজেদের সরকার ও নিজেদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেষ্টা না করলে কে করে দেবে? সজ্ঞান সতর্ক চেষ্টা ছাড়া কিছু হবে না।
আমাদের দেশে জন চরিত্র ও নেতৃত্বের চরিত্র সব সময় এত নিকৃষ্ট ছিল না। ব্রিটিশ-শাসনের অবসান ঘটানো, জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ সাধন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, বৌদ্ধিক জাগরণ ও গণজাগরণ (ৎবহধরংংধহপব ধহফ ঢ়বড়ঢ়ষব'ং ধধিশবহরহম)-এর মতো মহান সব ঘটনা রাজনীতিবিদদের, বুদ্ধিজীবীদের এবং জনগণের চরিত্র এত নিকৃষ্ট হলে কস্মিনকালেও সম্ভব হত না। ওই সময়ে জাতির জীবনে সৃষ্টি শক্তি ও সৃষ্টিশীলতা ছিল। এখন?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং বৌদ্ধিক কর্মধারায় (রহঃবষষবপঃঁধষ ধপঃরারঃরবং) যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেছে ১৯৮০-র দশকে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির জন্য কাজ করতে হলে এই পরিবর্তনের প্রকৃতিকে অবশ্যই বুঝতে হবে।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়ার নিহত হওয়ার পর থেকেই আমি অনুভব করে আসছি যে, দেশী-বিদেশী প্রবল সব শক্তি দ্বারা বাংলাদেশ পরিচালিত হয়ে চলছে নিজের অস্তিত্ববিরোধী ধারায়। তখনই আমি লক্ষ্য করলাম-রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বিরোধী, জাতীয় অস্তিত্ব বিরোধী, গণবিরোধী অনেক বড় বড় কাজ অবাধে প্রকাশ্যভাবে চলছে। অচিরেই লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী এনজিও অধু্যষিত রাষ্ট্র। এনজিও হল বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী সরকার দ্বারা পরিচালিত সংস্থা। দেখতে পেলাম এনজিওরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতিক সব কিছুর নিয়ন্তা হয়ে চলছে। ১৯৯০-এর দশকে 'সিভিল সোসাইটি'- বাংলায় 'সুশীল সমাজ'- নাম নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের কিছু সংস্থা নতুনভাবে তৎপর হল যারা এনজিও ধারায় এনজিওদেরও পরিচালক। আমি বুঝতে পারলাম এদেশে সিভিল সোসাইটি বা 'সুশীল সমাজ' হল 'বুদ্ধিজীবীদের এনজিও। তারা রাজনীতিকে দুর্বল করার পক্ষে তৎপর। ১৯৮০-র দশকেই আমি লক্ষ করলাম, বিবিসি রেডিওর প্রচার দ্বারা পরিচালিত হয়ে চলছে আমাদের রাজনীতি এবং রাজনীতিতে সক্রিয় এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের অর্থাৎ সিভিল সোসাইটির কর্মকাণ্ড। আমি লক্ষ্য করলাম, বিবিসির প্রচার যে ইঙ্গ-মার্কিন আধিপত্যবাদী শক্তির স্বঘোষিত শক্তিশালী কূটনৈতিক অস্ত্র, এটা কেউই ভেবে দেখছেন না। আমি অনুভব করলাম, নতুন প্রযুক্তি বিশেষ করে ফটোকপিয়ার, ক্যালকুলেটর, স্যাটেলাইট টেলিভিশন, মোবাইল টেলিফোন, ইন্টারনেট, ফ্যাক্স, ই-মেল, ওয়েব সাইট আরো নানা কিছু- সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, মস্তিষ্ককে স্তম্ভিত করে রেখেছে, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ সকলে বিচার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। উন্নত নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের বেলায়ও যে বিচার বিবেচনার দরকার, সেগুলোর সদ্ব্যবহার দরকার, সে কথা কেউ ভাবতেই চাইলেন না। সকলকেই মনে হল 'চোখ থাকিতে অন্ধ, কান থাকিতে বধির, স্বাদ, গন্ধ, অনুভব শক্তিহীন।' ১৯৮০'র দশকেই বিবিসির প্রচারের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে দুটি আন্দোলন- মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন আর নারীবাদী আন্দোলন। এই দুই আন্দোলনের তোড়ে গণতন্ত্র পরিণত হল নিতান্ত সেস্নাগানসর্বস্ব ধারণার আর সমাজতন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রের কথা ভুলে গিয়ে লিপ্ত হলেন অরাজনৈতিক ইসু্যভিত্তিক আন্দোলনে। 'ধর্ম' আর 'নারী' পরিণত হল 'কথিত প্রগতিশীলদের' চিন্তার ও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় বিষয়ে। নারী ও ধর্ম বিষয়ে লিখে কিছু লেখক অভাবনীয় জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় পরাজিত শক্তি পুনরুজ্জীবিত হল, মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা, মাজার, পীর, ফকির ইত্যাদিতে দেশ ভরে যেতে লাগল। দাঁড়ি, টুপি, বোরখা হেজাবের দিকে লোক ঝুঁকে পড়তে লাগল। মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা-কালে এবং পাকিস্তান-কালে অবস্থা এমন ছিল না। এজন্যই বলছি, ১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন-যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেছে। আশির দশকের কয়েকটি যুগান্তকারী ঘটনাঃ
১. ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী হঠাৎ করে 'নাগরিক কমিটি' নামে এক দল গঠন করে জেনারেল ওসমানিকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রাথর্ী করে নির্বাচন করলেন। ওসমানি ছিলেন আওয়ামী লীগ জোটের প্রাথর্ী। সেখান থেকে উক্ত নাগরিক কমিটি তাঁকে সরিয়ে এনে প্রাথর্ী করলেন। এতে নির্বাচনের ফলাফল ও রাজনীতির প্রকৃতি বিরাটভাবে প্রভাবিত হল। উক্ত বুদ্ধিজীবীদের ওই নাগরিক কমিটির অস্তিত্ব নির্বাচনের পরে আর দেখা গেল না। ওই বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বামপন্থী, পিকিংপন্থী ধারার। নির্বাচনের পরে বিএনপির প্রাথর্ী বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হলেন, নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগ মেনে নিল না এবং আন্দোলন চালাতে লাগল, পূর্বোক্ত নাগরিক কমিটির বুদ্ধিজীবীরা এবং বামপন্থীরাও নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতির উৎখাতের জন্য আন্দোলন চালাতে লাগলেন, ক্ষমতাসীন বিএনপির ও সরকারের ভেতরে নানা স্বার্থ নিয়ে অন্তর্বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিল ও তা তীব্র হয়ে উঠল, সর্বব্যাপ্ত বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের কারণে জনজীবন অতীষ্ঠ হয়ে উঠল। অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করলেন সেনা প্রধান এরশাদ; বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত 'অথর্ব' বলে অভিহিত রাষ্ট্রপতি সাত্তার টেলিভিশনে ঘোষণা দিয়ে সেনাপতি এরশাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছেড়ে গেলেন। নির্বাচিত হয়ে মাত্র তিনমাস তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর সমর্থনে তখন উলেস্নখযোগ্য কোনো শক্তিই ছিল না। তাঁর নিজের দলের একাংশও তখন কাজ করেছিল তাঁর রাষ্ট্রপতি থাকার বিরুদ্ধে। তাঁর ক্ষমতা ত্যাগে এবং এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণে আওয়ামী লীগ আনন্দিত হয়েছিল।
২. এরশাদ সরকারের আমলে স্বৈরাচার ও সম্প্রদায়িকতার বিরোধীতা আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী ধারার বুদ্ধিজীবীরা গঠন করেন ভিন্ন একটি নাগরিক কমিটি যাকে বলা যায় আশির দশকের দ্বিতীয় নাগরিক কমিটি। নাগরিক কমিটির বুদ্ধিজীবীরা প্রথমে আত্মপ্রকাশ করেছিল একত্রিশ বুদ্ধিজীবী গ্রুপ নামে। এই বুদ্ধিজীবী গ্রুপই প্রথমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য অন্তর্বতর্ীকালীন অনির্বাচিত, অরাজনৈতিক, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের এবং ভোটাভুটির সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশ থেকে পর্যবেক্ষক আনার দাবি তুলতে থাকেন। নাগরিক কমিটি গঠনের পর উক্ত বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র রাজনীতিবিদদের চেয়েও অনেক বেশী সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং এরশাদ-বিরোধী গোটা আন্দোলনের ধারাটি তাঁরাই পরিচালনা করেন। তাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কানাডা প্রভৃতি রাষ্ট্রের স্থানীয় দূতাবাসে নিয়ে যান ও তাদের মুখাপেক্ষী করে তোলেন। শেষ পর্যন্ত যে আবেগ এ ধারার রাজনীতিকে পরিচালনা করে তা হল 'এক দফা এক দাবি এরশাদ তুই কবে যাবি।' কার্যক্ষেত্রে নাগরিক কমিটি রাজনীতিকে পরিণত করে নিরেট ক্ষমতার লড়াইয়ে। রাজনীতিকে করে ফেলা হয় আদর্শ শূন্য ও কর্মসূচিহীন। বামপন্থী অধিকাংশ গ্রুপ নাগরিক কমিটির পরিচালনায় সর্বশক্তি দিয়ে এরশাদ- বিরোধী আন্দোলন করেছে। এই নাগরিক কমিটির বুদ্ধিজীবীরাই ১৯৯০-এর দশকে এসে নিজেদের জন্য সিভিল সোসাইটি বাংলায় 'সুশীল সমাজ' কথাটা চালু করেন।
৩. আশির দশকেই এনজিওদের অস্তিত্ব প্রবর্তিত হতে থাকে। দ্বিতীয় নাগরিক কমিটির বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশ বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে জড়িত। এনজিওদের কর্মকাণ্ড কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও তারা ক্রমে নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠতে থাকে। পৃথিবীতে বাংলাদেশই সবচেয়ে এনজিও অধু্যষিত রাষ্ট্র। এত বেশী এনজিও আর কোনো রাষ্ট্রেই নেই।
৪. ১৯৮০-র দশকে বিবিসি রেডিওর প্রচার অনুসরণ করে দ্বিতীয় নাগরিক কমিটি রাজনীতি পরিচালনা করে। বিবিসির বিপুল সমর্থন লাভ করে এই নাগরিক কমিটি। বিবিসি তখন মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন নামে দুটি আন্দোলন পরিচালনা করে। এই দুই আন্দোলনই তখন অত্যন্ত প্রবল হয়। এর তোরে রাজনৈতিক বক্তব্য গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র সবই ভেসে যায়। রাজনৈতিক আন্দোলন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কেবল এরশাদ বিরোধী বক্তব্যে। বিবিসির অনুসরণে স্থানীয় সব প্রচার মাধ্যমও এই দুটি আন্দোলনকে বিপুল প্রচার দিয়ে সহায়তা করে। দুটি আন্দোলনের সঙ্গেই ধর্মকে জড়িয়ে ফেলা হয়। ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও বামপন্থীদের মধ্যে চলে তীব্র বিরোধ। এরই মধ্যে দেখা যায় দাঁড়ি, টুপি, বোরখা, হেজাব, মসজিদ, মাজার, দরগা ইত্যাদির দিকে অনেক লোক ঝুঁকে যাচ্ছে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকেই জিয়া সরকার মাদ্রাসাকে আধুনিক করে মাদ্রাসা বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হয়েছিল। সে ধারা আশির দশকে অব্যাহত থাকে। আশির দশকে এরশাদ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করে। একদিকে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন, আর অপরদিকে মাদ্রাসা, মসজিদ, দরগা, মাজার, দাঁড়ি, টুপি, বোরখা, হেজাব, আটরশি, রাষ্ট্রধর্ম। এসবের পেছনে বিবিসি, এনজিও, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাউথ এশিয়া ডেস্ক, বিরাজনীতিকরণ! রাজনীতিবিদেরা কোথায়? সৃষ্টিশীল প্রগতিশীল শক্তি কোথায়?
৫. দ্বিতীয় নাগরিক কমিটির, এনজিওদের, স্থানীয় কয়েকটি দূতাবাসের এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাউথ এশিয়া ডেস্কের ভূমিকা লক্ষ্য করে ১৯৮০-র দশকেই কেউ কেউ বলতে থাকেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য বি:রাজনীতিকরণের (ফবঢ়ড়ষরঃরপরুধঃরড়হ) কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বিবিসি রেডিও থেকে বাংলাদেশকে ১৯৭০-এর দশকের শেষার্ধে ক্রমাগত বলা হয়েছে 'পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশ', আশির দশকে প্রচারিত হয়েছে মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলন, নব্বইয়ের দশকে ক্রমাগত বলা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুনর্ীতিগ্রস্ত দেশ, তারপর বলা হয়েছে ব্যর্থ রাষ্ট্রঃইত্যাদি। নির্বাচনের জন্য অন্তর্বতর্ীকালীন অরাজনৈতিক, অনির্বাচিত, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কোন গন্তব্যের দিকে চলছে?
৬. ১৯৮০-র দশকে প্রথমে শেখ হাসিনাকে, পরে খালেদা জিয়াকে দেশের প্রধান দু'টি দলের আওয়ামী লীগের ও বিএনপির দল প্রধান করা হয়। দল প্রধান হওয়ার সময়ে তাঁদের কারো রাজনীতি করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আগে দলের শীর্ষ নেতা হয়েছেন, তার পরে দল করতে আরম্ভ করেছেন। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নতুন করে রাজনীতিতে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ও পরিবারতন্ত্রের দ্বারোদঘাটন করে। তার ধারাবাহিকতায় গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে এখন পুঁজিবাদী রাজতন্ত্র এবং পরিবারতন্ত্র তথা নব্য অভিজাততন্ত্র কায়েম হতে চলেছে। তাছাড়াও আরও অনেক ক্ষতিকর প্রবণতা এর ফলে সমাজে, সরকার ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে।
আমি স্মৃতি থেকে কয়েকটি বিষয় উলেস্নখ করলাম। কেউ যদি বিচারমূলক ও বিশেস্নষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ১৯৮০-র দশকের ঘটনা প্রবাহ পর্যালোচনা করেন এবং বিশ শতকের ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে তার তুলনা করেন তাহলে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন যে, ১৯৮০-র দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি গুণগতভাবে বদলে গেছে। এরই মধ্যে মানুষও বদলে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের এক দশক আগেই বাংলাদেশ বদলে গেছে। ১৯৮০-র দশক থেকে বাংলাদেশ বিরাজনীতিকৃত (ফবঢ়ড়ষরঃরপরুবফ) হয়ে পরাধীনতার ধারায় এগিয়েছে। আর ১৯৮০-র দশকেই রাজনৈতিক ক্ষমতায় বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার ও পরিবারতন্ত্র কায়েম হতে আরম্ভ করেছে। ২০০৬ সালে গঠিত 'নাগরিক কমিটি ২০০৬' এবং উক্ত কমিটির 'যোগ্য প্রাথর্ী আন্দোলন' জরুরী অবস্থাও বাংলাদেশের রাজনীতির গতি ও প্রকৃতি নির্ধারণে গুরুতর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ব্যর্থতার জন্য জিয়া ও এরশাদকে দায়ী করা হয়। এর মধ্যেই যে পরম সত্য নিহিত রয়েছে, তা কি বলা যাবে? জিয়া ও এরশাদের দায়-দায়িত্বের সঙ্গে আমি যেসব বিষয় উলেস্নখ করলাম সেগুলোকেও বিবেচনায় ধরা এবং পক্ষপাতমুক্ত সত্যসন্ধ বিচার কি সকলের জন্য কল্যাণকর হবে না? নানা কিছুর অভিশাপে বাংলাদেশ ভুগছে। কবে বাংলাদেশের চৈতন্যোদয় হবে এবং কবে এসবের অভিশাপ থেকে জনগণ মুক্তি পাবে কে জানে? আজো যাঁরা বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে চিন্তা ও কাজ করেন, এসব বিষয়ে তাঁদের সচেতনতা ও সতর্কতা দরকার। রাজনীতির যে ধারা চলছে তার মৌলিক পরিবর্তন দরকার। দরকার নতুন রাজনীতি। সম্পূর্ণ নতুন রাজনীতি।
====================
আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আকাশচুম্বী' by ড. নিয়াজ আহম্মেদ  ইতিহাস- 'প্রত্যন্ত জনপদে ইতিহাস-সঙ্গী হয়ে' by সাযযাদ কাদির  আন্তর্জাতিক- 'জাতিসংঘ বনাম যুক্তরাষ্ট্র' by শহিদুল শহিদুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ?' by মহসীন মহসীন হাবিব  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বন্দিত কান্না, নিন্দিত হরতাল আর রাজকীয় অশ্রুপাতের গল্প' by ফারুক ওয়াসিফ  খবর- উত্তর কোরিয়ার নতুন পরমাণু প্ল্যান্ট দেখে 'তাজ্জব' মার্কিন বিজ্ঞানীরা  গল্পসল্প- 'মুজিব একবার আসিয়া সোনার বাংলা যাওরে দেখিয়ারে' by মোস্তফা হোসেইন  আন্তর্জাতিক- 'ওবামা কি ক্লিনটনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন?' by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী  কৃষি আলোচনা- 'পোষের শেষ মাঘের বারো' by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস  মণিপুরি মহা রাসলীলা উৎসবের ইতিকথা by মুজিবুর রহমান  প্রকৃতি- সমুদ্রে উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রবাল মড়ক  মণিপুরি রাসমেলা উৎসব by আকমল হোসেন নিপু  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'মডার্ন হাম্মুরাবি এবং কাঠের ঘোড়া' by আলমগীর সাত্তার  আলোচনা- 'কারাগার থেকে সংশোধনাগার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ' by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু  শিল্প-অর্থনীতি 'ক্ষুদ্রঋণের বিড়ম্বনা' by আহমদ রফিক


ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ আবুল কাসেম ফজলুল হক
সমাজচিন্তক, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


এই ইতিহাস'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.