ক্যাবিনেট কমিটি আসলে কী চায় by আসিফ নজরুল
আমার
জীবনে প্রথম চাকরি ১৯৮৯ সালে, সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। রিপোর্ট করার জন্য
মধুর ক্যান্টিনে যাই মাঝেমধ্যে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার তখন এই
ক্যান্টিন। সারা দিন বড় বড় ছাত্রনেতার ভিড়। তাঁদের অনেকেই ধূমপায়ী। দু-একজন
বেনসন খেতেন তখনই। কিন্তু বেশির ভাগই খেতেন গোল্ডলিফ, ক্যাপিস্টান, এমনকি
স্টার; এগুলো কম দামি সিগারেট। স্টার তো ছিল দরিদ্র লোকের সিগারেট!
এই ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ পরে মন্ত্রী হয়েছেন, আরও অনেকে সাংসদ। গত ১৫-২০ বছরে তাঁদের কারও কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। তাঁরা অনেকেই ছিলেন আমারই মতো মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। কিন্তু মন্ত্রী বা সাংসদ হওয়ার পর তাঁদের চেহারা বদলে গেছে। অর্থ-বিত্তে ফুলেফেঁপে উঠেছেন তাঁরা। শুনি, কেউ কেউ শত কোটি টাকার মালিক। শোনা কথা, যাচাই করার উপায় নেই। তবে তাঁদের গায়ের পোশাক দেখি, দেখি চেহারার চেকনাই, সঙ্গে দানবাকৃতির আলিশান গাড়ি। ঈর্ষা না, শুধু নিখাদ বিস্ময় জন্মে মনে। কোন আলাদীনের চেরাগ বদলে দিয়েছে তাঁদের!
কত বেতন মন্ত্রীর? কত টাকা পান সাংসদেরা? আধা লাখেরও কম, আগে ছিল আরও অনেক কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে দুই-চারটা জায়গায় পড়িয়ে, জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সি করে এর চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন করে থাকেন। একটা পাঁচ-দশ লাখ টাকার গাড়ি কিনতে তবু ১০-১৫ বছর চেষ্টা করতে হয় কাউকে কাউকে। অথচ নেতাদের কোটি টাকার গাড়ি কিনতেও অপেক্ষা করতে হয় না এত দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাই বলে সবাই সাধু নয়। আমারই কোনো কোনো সহকর্মী পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হয়ে বা উপাচার্য হয়ে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আমারই একসময়ের সহকর্মী কোনো কোনো সাংবাদিক আশ্চর্য দ্রুততায় সংবাদপত্র, প্রতিষ্ঠান বা দালানকোঠার মালিক বনে গেছেন। আমারই ছাত্রজীবনের সহপাঠী কয়েক হাজার টাকার সরকারি চাকরি করে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
আমার তো ধারণা, আমাদের সবার অভিজ্ঞতা একই রকম। আমরা কি প্রত্যেকেই জানি না কী ভয়াবহ দুর্নীতি চলছে দেশে? আমাদের প্রত্যেকের সহপাঠী, সহকর্মী বা একসময়ের সঙ্গীদের কেউ না কেউ কি রাতারাতি কোটিপতি হয়ে ওঠেনি?
টিআইবি বা অন্য কারও গবেষণার প্রয়োজন নেই। চারপাশের চেনা মানুষজনের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই বুঝতে পারি, দুর্নীতিবাজদের কী দাপট চলছে দেশে।
২.
এই দুর্নীতিবাজেরা মহা বিপদে পড়েছিল একবারই। সেটি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মন্ত্রী-আমলা-রাজনীতিক-ব্যবসায়ী অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পত্রপত্রিকা, টিভি-রেডিওতে প্রশংসার ঢল নেমেছিল। তবে কারও কারও গ্রেপ্তারে সংশয় ছিল, কোনো কোনো গ্রেপ্তারে কুমতলব ছিল। সবচেয়ে শোচনীয় যা, অধিকাংশ গ্রেপ্তারের পেছনে ছিল তৎকালীন গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তার উচ্চাভিলাষ। উচ্চাভিলাষ থাকলে বুদ্ধি থাকতে হয়, কৌশলী হতে হয়। তাদের বুদ্ধি যত না ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন স্পর্ধা। কালো আইন করে (যেমন, কোনো ক্ষেত্রেই জামিন না দেওয়ার বিধান), মানবিক মূল্যবোধে আঘাত করে (যেমন, মহিউদ্দিন খান আলমগীরের প্রবাসী পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা বা ইকবাল হাসান মাহমুদের কিশোরী মেয়েকে গ্রেপ্তার), ভয়ভীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে (যেমন, গণহারে ‘দুর্নীতিবাজ’দের তালিকা করে) এরা সবাইকে চমকে দেয়। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের জন্য যে প্রজ্ঞা, ধৈর্য, মেধা নিয়ে আইনগত সংস্কার এবং পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, তা করতে তারা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। হুমকি-ধমকির আদালতে অনেকের শাস্তি হয়। কিন্তু এই শাস্তি অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে মুখ ধুবড়ে পড়ে।
নির্বাচনের পর দেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গণতন্ত্রের জোয়ারে সরকারপক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার হয়। বিরোধী পক্ষের সবার বিরুদ্ধে করা মামলার গ্রহণযোগ্যতাও তাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সরকারবিরোধী পক্ষ এরপর সবাই মিলে খড়্গহস্ত হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের বিরুদ্ধে। তাই বলে এই কমিশনের কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে বা তাদের পেছনে কলকাঠি নেড়ে কারা কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে, তা জানার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। সবাই বরং উঠেপড়ে লাগে দুদক নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
এর মানে কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে ব্যক্তিরা ক্ষমতাশালী ছিলেন তাঁরা আর কোনো দিনই ক্ষমতাবান হতে পারবেন না। এখনকার রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি করার সামর্থ্যও আর নেই তাঁদের। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক শক্তিশালী থাকলে যেকোনো অনাগত সময়ে আবারও বিপদে পড়তে পারেন তাঁরা। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, দুদককে এখন অথর্ব করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে কি সে জন্যই?
৩.
অতীতে বিএনপি সরকারের সময় একটি পুতুল কমিশন গঠন করে নানাভাবে একে স্থবির করে রাখা হয়েছিল। তখন অন্য অনেকের সঙ্গে আওয়ামী লীগও এর তীব্র সমালোচনা করেছিল। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে জোরদার করার প্রতিশ্রুতি জাতিকে দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগকে সে কাজে মোটেও উদ্যোগী মনে হয়নি। বরং গত বছর অক্টোবরে একটি ক্যাবিনেট কমিটি দুদক আইনের যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে দুদক অতীতের মতো বহুল নিন্দিত ও সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
দুদকের বর্তমান প্রধান নিজেই এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা, সাংসদ, মন্ত্রী যাঁরা ‘সরল বিশ্বাসে’ কোনো অপরাধ করেছেন বলে প্রতীয়মান, তাঁদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো মামলা করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট অনুসারে ‘সরল বিশ্বাস’ শব্দাবলির সহজ মানে হচ্ছে, এমনভাবে দায়িত্বে অবহেলা যাতে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য প্রতীয়মান নয়। এই সংজ্ঞা ভয়াবহ রকমের শিথিল এবং এর অপব্যাখ্যা করে যেকোনো দুর্নীতিতে অংশগ্রহণ অনিচ্ছাকৃত অবহেলা বা ভুল বলে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। তা ছাড়া কোনো কাজ সরল বিশ্বাসে করা হলো কি না তা নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকলে মন্ত্রী, সাংসদ বা আজ্ঞাবাহী আমলাদের বিরুদ্ধে দুদক কখনোই ব্যবস্থা নিতে অনুমতি পাবে না এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে চিরকাল তাই হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী অতীতের সব আন্দোলনে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বর্তমান আইনে এই বাধ্যবাধকতা নেই, দুদক আইনে এর পুনরায় অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা স্বয়ং দুদকের প্রধান করেছেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ডেইলি স্টার-এ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি হবে বৈষম্যমূলক এবং এটি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সহায়ক হবে না।
ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাবে দুদকের স্বশাসিত চরিত্র হরণ, কমিশনের চেয়ারম্যানের কিছু আর্থিক ক্ষমতা সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সচিবকে অর্পণ, রাষ্ট্রপতির (আসলে প্রধানমন্ত্রীর) কাছে কমিশনের জবাবদিহির প্রস্তাব করা হয়েছে। মোট কথা, অতীতের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আদলে কমিশনকে সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দুদকের চেয়ারম্যান ক্যাবিনেটের প্রস্তাব সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার দুদকের ডানা কেটে দেওয়ার জন্য কোনো আইন করবে।’ (১১ অক্টোবর, ২০০৯, ডেইলি স্টার)
আমরাও তাই বিশ্বাস করতে চাই। দুদক বরং তার কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য জনবল সম্প্রসারণ এবং মামলার সব পর্যায়ে পক্ষভুক্ত হওয়ার সুযোগ চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সুযোগ না থাকার ফলে এবং উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের শৈথিল্যের কারণে বহু মামলা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। দুদকের প্রস্তাব তাই সঠিক ছিল। কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি। উপরন্তু ক্যাবিনেট কমিটি দুদককে সরকারের আজ্ঞাবাহী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দুর্নীতি দমন অভিযানকে দলীয়করণ করার প্রস্তাব দিয়েছে প্রকারান্তরে। দুর্নীতি সত্যিই দমন করতে হলে কমিটির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান শুধু নয়, এর প্রণয়নকারীদের বিষয়েও সাবধান হতে হবে সরকারকে।
৪.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদককে ব্যবহার করে বা এর নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বহু কিছুর সঙ্গে দুদকের অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। দুদকের আইনে দুদক কর্তৃক দুর্নীতিবাজের তালিকা করে তা পত্রিকায় প্রকাশের ক্ষমতা নেই, কাউকে গ্রেপ্তার করে অত্যাচারের এখতিয়ার নেই, কাউকে জামিন না দেওয়ার ক্ষমতা নেই। দুদক তার জনবল, বিধি প্রণয়ন ও অর্থসংস্থানের বিষয়ে সরকার কর্তৃক গ্রহণযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রিত। দুদককে তার কাজের জন্য বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয় সংসদে।
দুদকের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর জন্য তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা যেতে পারে, সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটিকে তদারকের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, এর বিভিন্ন স্তরে নাগরিক প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট করা যেতে পারে।
কিন্তু ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাবে এসব চাওয়া হয়নি। যা চাওয়া হয়েছে তা দুদককে সরকারের আজ্ঞাবহ বা অথর্ব একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। সরকারের লোক এবং অনুগত আমলাদের দুর্নীতির সুযোগ বহু গুণে সম্প্রসারিত করবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বহুবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলেছেন। ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাব সেই অঙ্গীকারের মারাত্মক প্রতিবন্ধক। দুদককে বরং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে এবং এর সামর্থ্য আরও বাড়ালে সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ পরে মন্ত্রী হয়েছেন, আরও অনেকে সাংসদ। গত ১৫-২০ বছরে তাঁদের কারও কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। তাঁরা অনেকেই ছিলেন আমারই মতো মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। কিন্তু মন্ত্রী বা সাংসদ হওয়ার পর তাঁদের চেহারা বদলে গেছে। অর্থ-বিত্তে ফুলেফেঁপে উঠেছেন তাঁরা। শুনি, কেউ কেউ শত কোটি টাকার মালিক। শোনা কথা, যাচাই করার উপায় নেই। তবে তাঁদের গায়ের পোশাক দেখি, দেখি চেহারার চেকনাই, সঙ্গে দানবাকৃতির আলিশান গাড়ি। ঈর্ষা না, শুধু নিখাদ বিস্ময় জন্মে মনে। কোন আলাদীনের চেরাগ বদলে দিয়েছে তাঁদের!
কত বেতন মন্ত্রীর? কত টাকা পান সাংসদেরা? আধা লাখেরও কম, আগে ছিল আরও অনেক কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকে দুই-চারটা জায়গায় পড়িয়ে, জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সি করে এর চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন করে থাকেন। একটা পাঁচ-দশ লাখ টাকার গাড়ি কিনতে তবু ১০-১৫ বছর চেষ্টা করতে হয় কাউকে কাউকে। অথচ নেতাদের কোটি টাকার গাড়ি কিনতেও অপেক্ষা করতে হয় না এত দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাই বলে সবাই সাধু নয়। আমারই কোনো কোনো সহকর্মী পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হয়ে বা উপাচার্য হয়ে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আমারই একসময়ের সহকর্মী কোনো কোনো সাংবাদিক আশ্চর্য দ্রুততায় সংবাদপত্র, প্রতিষ্ঠান বা দালানকোঠার মালিক বনে গেছেন। আমারই ছাত্রজীবনের সহপাঠী কয়েক হাজার টাকার সরকারি চাকরি করে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
আমার তো ধারণা, আমাদের সবার অভিজ্ঞতা একই রকম। আমরা কি প্রত্যেকেই জানি না কী ভয়াবহ দুর্নীতি চলছে দেশে? আমাদের প্রত্যেকের সহপাঠী, সহকর্মী বা একসময়ের সঙ্গীদের কেউ না কেউ কি রাতারাতি কোটিপতি হয়ে ওঠেনি?
টিআইবি বা অন্য কারও গবেষণার প্রয়োজন নেই। চারপাশের চেনা মানুষজনের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই বুঝতে পারি, দুর্নীতিবাজদের কী দাপট চলছে দেশে।
২.
এই দুর্নীতিবাজেরা মহা বিপদে পড়েছিল একবারই। সেটি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। মন্ত্রী-আমলা-রাজনীতিক-ব্যবসায়ী অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পত্রপত্রিকা, টিভি-রেডিওতে প্রশংসার ঢল নেমেছিল। তবে কারও কারও গ্রেপ্তারে সংশয় ছিল, কোনো কোনো গ্রেপ্তারে কুমতলব ছিল। সবচেয়ে শোচনীয় যা, অধিকাংশ গ্রেপ্তারের পেছনে ছিল তৎকালীন গুটিকয়েক সেনা কর্মকর্তার উচ্চাভিলাষ। উচ্চাভিলাষ থাকলে বুদ্ধি থাকতে হয়, কৌশলী হতে হয়। তাদের বুদ্ধি যত না ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন স্পর্ধা। কালো আইন করে (যেমন, কোনো ক্ষেত্রেই জামিন না দেওয়ার বিধান), মানবিক মূল্যবোধে আঘাত করে (যেমন, মহিউদ্দিন খান আলমগীরের প্রবাসী পুত্রের বিরুদ্ধে মামলা বা ইকবাল হাসান মাহমুদের কিশোরী মেয়েকে গ্রেপ্তার), ভয়ভীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে (যেমন, গণহারে ‘দুর্নীতিবাজ’দের তালিকা করে) এরা সবাইকে চমকে দেয়। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের জন্য যে প্রজ্ঞা, ধৈর্য, মেধা নিয়ে আইনগত সংস্কার এবং পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, তা করতে তারা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। হুমকি-ধমকির আদালতে অনেকের শাস্তি হয়। কিন্তু এই শাস্তি অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে মুখ ধুবড়ে পড়ে।
নির্বাচনের পর দেশে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গণতন্ত্রের জোয়ারে সরকারপক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার হয়। বিরোধী পক্ষের সবার বিরুদ্ধে করা মামলার গ্রহণযোগ্যতাও তাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সরকারবিরোধী পক্ষ এরপর সবাই মিলে খড়্গহস্ত হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের বিরুদ্ধে। তাই বলে এই কমিশনের কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে বা তাদের পেছনে কলকাঠি নেড়ে কারা কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছে, তা জানার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। সবাই বরং উঠেপড়ে লাগে দুদক নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
এর মানে কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে ব্যক্তিরা ক্ষমতাশালী ছিলেন তাঁরা আর কোনো দিনই ক্ষমতাবান হতে পারবেন না। এখনকার রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি করার সামর্থ্যও আর নেই তাঁদের। কিন্তু প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক শক্তিশালী থাকলে যেকোনো অনাগত সময়ে আবারও বিপদে পড়তে পারেন তাঁরা। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, দুদককে এখন অথর্ব করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে কি সে জন্যই?
৩.
অতীতে বিএনপি সরকারের সময় একটি পুতুল কমিশন গঠন করে নানাভাবে একে স্থবির করে রাখা হয়েছিল। তখন অন্য অনেকের সঙ্গে আওয়ামী লীগও এর তীব্র সমালোচনা করেছিল। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে জোরদার করার প্রতিশ্রুতি জাতিকে দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগকে সে কাজে মোটেও উদ্যোগী মনে হয়নি। বরং গত বছর অক্টোবরে একটি ক্যাবিনেট কমিটি দুদক আইনের যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে দুদক অতীতের মতো বহুল নিন্দিত ও সরকারের আজ্ঞাবহ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
দুদকের বর্তমান প্রধান নিজেই এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা, সাংসদ, মন্ত্রী যাঁরা ‘সরল বিশ্বাসে’ কোনো অপরাধ করেছেন বলে প্রতীয়মান, তাঁদের বিরুদ্ধে দুদক কোনো মামলা করতে চাইলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট অনুসারে ‘সরল বিশ্বাস’ শব্দাবলির সহজ মানে হচ্ছে, এমনভাবে দায়িত্বে অবহেলা যাতে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য প্রতীয়মান নয়। এই সংজ্ঞা ভয়াবহ রকমের শিথিল এবং এর অপব্যাখ্যা করে যেকোনো দুর্নীতিতে অংশগ্রহণ অনিচ্ছাকৃত অবহেলা বা ভুল বলে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব। তা ছাড়া কোনো কাজ সরল বিশ্বাসে করা হলো কি না তা নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকলে মন্ত্রী, সাংসদ বা আজ্ঞাবাহী আমলাদের বিরুদ্ধে দুদক কখনোই ব্যবস্থা নিতে অনুমতি পাবে না এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে চিরকাল তাই হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী অতীতের সব আন্দোলনে সরকারের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বর্তমান আইনে এই বাধ্যবাধকতা নেই, দুদক আইনে এর পুনরায় অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা স্বয়ং দুদকের প্রধান করেছেন। ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ডেইলি স্টার-এ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি হবে বৈষম্যমূলক এবং এটি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সহায়ক হবে না।
ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাবে দুদকের স্বশাসিত চরিত্র হরণ, কমিশনের চেয়ারম্যানের কিছু আর্থিক ক্ষমতা সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সচিবকে অর্পণ, রাষ্ট্রপতির (আসলে প্রধানমন্ত্রীর) কাছে কমিশনের জবাবদিহির প্রস্তাব করা হয়েছে। মোট কথা, অতীতের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আদলে কমিশনকে সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে।
দুদকের চেয়ারম্যান ক্যাবিনেটের প্রস্তাব সম্পর্কে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার দুদকের ডানা কেটে দেওয়ার জন্য কোনো আইন করবে।’ (১১ অক্টোবর, ২০০৯, ডেইলি স্টার)
আমরাও তাই বিশ্বাস করতে চাই। দুদক বরং তার কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য জনবল সম্প্রসারণ এবং মামলার সব পর্যায়ে পক্ষভুক্ত হওয়ার সুযোগ চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সুযোগ না থাকার ফলে এবং উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনায় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের শৈথিল্যের কারণে বহু মামলা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। দুদকের প্রস্তাব তাই সঠিক ছিল। কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি। উপরন্তু ক্যাবিনেট কমিটি দুদককে সরকারের আজ্ঞাবাহী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে দুর্নীতি দমন অভিযানকে দলীয়করণ করার প্রস্তাব দিয়েছে প্রকারান্তরে। দুর্নীতি সত্যিই দমন করতে হলে কমিটির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান শুধু নয়, এর প্রণয়নকারীদের বিষয়েও সাবধান হতে হবে সরকারকে।
৪.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদককে ব্যবহার করে বা এর নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর বহু কিছুর সঙ্গে দুদকের অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। দুদকের আইনে দুদক কর্তৃক দুর্নীতিবাজের তালিকা করে তা পত্রিকায় প্রকাশের ক্ষমতা নেই, কাউকে গ্রেপ্তার করে অত্যাচারের এখতিয়ার নেই, কাউকে জামিন না দেওয়ার ক্ষমতা নেই। দুদক তার জনবল, বিধি প্রণয়ন ও অর্থসংস্থানের বিষয়ে সরকার কর্তৃক গ্রহণযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রিত। দুদককে তার কাজের জন্য বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয় সংসদে।
দুদকের কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর জন্য তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা যেতে পারে, সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটিকে তদারকের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে, এর বিভিন্ন স্তরে নাগরিক প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট করা যেতে পারে।
কিন্তু ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাবে এসব চাওয়া হয়নি। যা চাওয়া হয়েছে তা দুদককে সরকারের আজ্ঞাবহ বা অথর্ব একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। সরকারের লোক এবং অনুগত আমলাদের দুর্নীতির সুযোগ বহু গুণে সম্প্রসারিত করবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে বহুবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলেছেন। ক্যাবিনেট কমিটির প্রস্তাব সেই অঙ্গীকারের মারাত্মক প্রতিবন্ধক। দুদককে বরং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে এবং এর সামর্থ্য আরও বাড়ালে সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments