একটি ঐতিহাসিক জীবাণু by শাহাদুজ্জামান
একটি ঐতিহাসিক জীবাণুর গল্প হোক এবার। ১৮৩২ সালে ইউরোপের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে এক ব্যাপক কলেরা মহামারি দেখা দিয়েছিল। কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, সেই মহামারির জীবাণুটি তার যাত্রা শুরু করেছিল আমাদের এই বাংলাদেশ থেকে। এখান থেকে রওনা দিয়ে নৌ ও স্থল বাণিজ্যের পথ ধরে এই কলেরার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, রাশিয়াসহ ইউরোপের বিশাল অঞ্চলে। ইতিহাসে এটি ‘বেঙ্গল কলেরা প্যান্ডেমিক’ হিসেবেই পরিচিত। ইউরোপের সামাজিক, আত্মিক, স্থাপত্যিক, রাজনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে এই কলেরা এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন, রোগ একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলেও মহামারির অভিজ্ঞতাটি সামাজিক। ফলে মহামারির একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। ইতিহাসে রোগ ও মহামারির ভূমিকা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য কাজটি করেছেন উইলিয়াম ম্যাকনিল (১৯৭৭) তাঁর প্লেগ অ্যান্ড দ্য পিপল বইটিতে। তিনি মূলত অনুসন্ধান করেছেন উপনিবেশ বিস্তারে জীবাণুর ভূমিকা নিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন, কলম্বাসের আমেরিকা জয়ে যেমন বন্দুকের ভূমিকা ছিল তেমনি ভূমিকা ছিল জীবাণুরও। কলম্বাস তাঁর জাহাজে করে পুরোনো পৃথিবী থেকে যেসব রোগ নতুন পৃথিবীতে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার কোনোটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা ছিল না আদিবাসী আমেরিকানদের। ব্যাপক মহামারিতে অতি অল্প সময়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে লাখ লাখ আদিবাসী। তাতে কলম্বাসের জয়ের পথ সুগম হয়েছে।
বেঙ্গল কলেরার গল্পটি অবশ্য খানিকটা ভিন্ন। পিটার স্ট্রিফল্যান্ড (১৯৯৭), আর জে ইভান্স (১৯৮৮) প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের মহামারির ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে উপনিবেশ স্থাপন করে ইউরোপ যখন জ্ঞানবিজ্ঞান, অর্থনীতিতে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি করে দারুণ আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে, ঠিক তখন দূরপ্রাচ্যের ‘বর্বর’ এক দেশ থেকে কলেরা নামের বর্বর এই রোগটি আঘাত করে তাদের। ইউরোপের শহরে শহরে তখন কেবল লাশের মিছিল। চিকিৎসকেরা বিমূঢ়। তাঁদের হাতে কলেরার কোনো সমাধান নেই। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি নিয়ে তখন তাঁদের সীমাহীন গর্ব। হাসপাতালের শুভ্র বিছানায় মৃত্যুকে যখন তাঁরা নান্দনিক করে তোলার চেষ্টা করছেন তখন কিনা তাঁদের হতবিহ্বল করে তোলে দাস্তবমির বিদঘুটে উপসর্গের কলেরা নামের এই রোগ। কলেরার কারণ নিয়ে তর্কবিতর্কে উদভ্রান্ত হয়ে ওঠেন ইউরোপের চিকিৎসকেরা। কুল নামের এক ডাচ্ চিকিৎসক কলেরা সারানোর জন্য রীতিমতো একটি মেশিন তৈরি করে বসেন, যার ভেতর তিনি তাঁর রোগীদের ঢুকিয়ে রাখতেন। বলাবাহুল্য, সে মেশিনে কোনো কাজ হয় না। কলেরাকে পর্যুদস্ত করতে না পেরে হতাশ সেই চিকিৎসক শেষে কবি হয়ে ওঠেন এবং কলেরা নিয়ে ‘এনিমি উইদাউট আ ফেইস’ নামে এক দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলেন। কলেরা যখন এক এক করে ইউরোপের শহরগুলোতে আঘাত করছে, তখন প্যারিসের নগরপ্রধান ঘোষণা করেন, ফরাসিরা ইউরোপের সবচেয়ে সভ্য জাতি। ফলে তাদের কলেরার মতো এমন একটি অসভ্য রোগ আক্রান্ত করতে পারে না। এই ঘোষণার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই ফ্রান্সের রাজপরিবারের একজন সদস্য কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বলা যায়, সামগ্রিকভাবে ইউরোপের রেনেসাঁ-উত্তর আভিজাত্যবোধকে একেবারে চুরমার করে দেয় এই কলেরা।
পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের চিকিৎসক স্নো কলেরার সঙ্গে দূষিত পানির সম্পর্কটি আবিষ্কার করেন। এই কলেরার সূত্র ধরেই পরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘পাবলিক হেলথ’ নামে একটি নতুন জ্ঞানকাণ্ডের সূচনা ঘটে। বস্তুত, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই কলেরার প্রেক্ষাপটেই ইউরোপ তাঁর শহরগুলোর পানি এবং পয়ঃপ্রণালি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। লন্ডন, প্যারিসের মতো বহু শহরে তখন ঘরে ঘরে খাটা পায়খানার ব্যবস্থা ছিল। ভোরবেলা নগরের পরিচ্ছন্নকর্মী এসে মলের বালতি পরিষ্কার করে যেত। কলেরা মহামারি তাদের বাধ্য করে পয়োনিষ্কাশন নিয়ে নতুন করে ভাবতে। ইউরোপের শহরে শহরে শুরু হয় স্যানিটেশন নিয়ে উপর্যুপরি কনফারেন্স। নগরপরিকল্পনাবিদেরা পুরো শহরের পানিবিতরণ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। রাস্তা, দালানকোঠা নির্মাণে তৈরি হয় নতুন নীতিমালা।
বলাবাহুল্য, ইউরোপীয় সেই কলেরা মহামারির প্রধান শিকার হয় শহরের দরিদ্র মানুষ। কর্তৃপক্ষ কলেরা ছড়ানোর জন্য দরিদ্র মানুষকে অভিযুক্ত করতে থাকে। তাদের শহরের কেন্দ্র থেকে ঝেঁটিয়ে বের করে দেওয়া হয় বাইরে। শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে গরিবদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবে কলেরাকে কেন্দ্র করে ধনী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে সামাজিক ও ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়তে থাকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এমন গুজবও ছড়ায় যে ধনবানেরা ষড়যন্ত্র করে কলেরার মাধ্যমে গরিবদের মেরে ফেলার ব্যবস্থা করছে। ইউরোপের সেই ঐতিহাসিক কলেরা মহামারির সময় একাধিক বিক্ষোভ, সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কলেরাকে কেন্দ্র করে কয়েকজন অভিজাত ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনাও ঘটে। কলেরাজাত ওই আন্দোলনের কারণে সরকারকে অনেক দরিদ্রবান্ধব আইন পাস করতে হয়।
এভাবেই কলেরা নানাভাবে বদলে দেয় ইউরোপকে। সেই সূত্রে বলা যায়, আধুনিক ইউরোপ গড়ার এবং তার নয়নাভিরাম শহরগুলো তৈরির পেছনে এক অর্থে বাংলার ঐতিহাসিক সেই কলেরা জীবাণুরও একটি ভূমিকা আছে। সেই সঙ্গে এও প্রতিষ্ঠিত যে বিধ্বংসী এই কলেরার সমাধান যে রয়েছে সামান্য এক প্যাকেট স্যালাইনে, সে সত্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে এই বাংলাদেশেরই কলেরা হাসপাতালের গবেষণাগারে। তবে আপসোস এই, কলেরাকে ইউরোপ ইতিহাসের পাতায় পাঠিয়ে দিলেও আমাদের সেই পর্যটক জীবাণু এখনো আস্তানা গেড়ে আছে এই মাটিতে। আমাদের জীবাণু ওদের বদলে ফেললেও আমরা বদলাই না।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
বেঙ্গল কলেরার গল্পটি অবশ্য খানিকটা ভিন্ন। পিটার স্ট্রিফল্যান্ড (১৯৯৭), আর জে ইভান্স (১৯৮৮) প্রমুখ ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপের মহামারির ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে উপনিবেশ স্থাপন করে ইউরোপ যখন জ্ঞানবিজ্ঞান, অর্থনীতিতে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি করে দারুণ আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে, ঠিক তখন দূরপ্রাচ্যের ‘বর্বর’ এক দেশ থেকে কলেরা নামের বর্বর এই রোগটি আঘাত করে তাদের। ইউরোপের শহরে শহরে তখন কেবল লাশের মিছিল। চিকিৎসকেরা বিমূঢ়। তাঁদের হাতে কলেরার কোনো সমাধান নেই। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি নিয়ে তখন তাঁদের সীমাহীন গর্ব। হাসপাতালের শুভ্র বিছানায় মৃত্যুকে যখন তাঁরা নান্দনিক করে তোলার চেষ্টা করছেন তখন কিনা তাঁদের হতবিহ্বল করে তোলে দাস্তবমির বিদঘুটে উপসর্গের কলেরা নামের এই রোগ। কলেরার কারণ নিয়ে তর্কবিতর্কে উদভ্রান্ত হয়ে ওঠেন ইউরোপের চিকিৎসকেরা। কুল নামের এক ডাচ্ চিকিৎসক কলেরা সারানোর জন্য রীতিমতো একটি মেশিন তৈরি করে বসেন, যার ভেতর তিনি তাঁর রোগীদের ঢুকিয়ে রাখতেন। বলাবাহুল্য, সে মেশিনে কোনো কাজ হয় না। কলেরাকে পর্যুদস্ত করতে না পেরে হতাশ সেই চিকিৎসক শেষে কবি হয়ে ওঠেন এবং কলেরা নিয়ে ‘এনিমি উইদাউট আ ফেইস’ নামে এক দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলেন। কলেরা যখন এক এক করে ইউরোপের শহরগুলোতে আঘাত করছে, তখন প্যারিসের নগরপ্রধান ঘোষণা করেন, ফরাসিরা ইউরোপের সবচেয়ে সভ্য জাতি। ফলে তাদের কলেরার মতো এমন একটি অসভ্য রোগ আক্রান্ত করতে পারে না। এই ঘোষণার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই ফ্রান্সের রাজপরিবারের একজন সদস্য কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বলা যায়, সামগ্রিকভাবে ইউরোপের রেনেসাঁ-উত্তর আভিজাত্যবোধকে একেবারে চুরমার করে দেয় এই কলেরা।
পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের চিকিৎসক স্নো কলেরার সঙ্গে দূষিত পানির সম্পর্কটি আবিষ্কার করেন। এই কলেরার সূত্র ধরেই পরে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘পাবলিক হেলথ’ নামে একটি নতুন জ্ঞানকাণ্ডের সূচনা ঘটে। বস্তুত, ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই কলেরার প্রেক্ষাপটেই ইউরোপ তাঁর শহরগুলোর পানি এবং পয়ঃপ্রণালি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। লন্ডন, প্যারিসের মতো বহু শহরে তখন ঘরে ঘরে খাটা পায়খানার ব্যবস্থা ছিল। ভোরবেলা নগরের পরিচ্ছন্নকর্মী এসে মলের বালতি পরিষ্কার করে যেত। কলেরা মহামারি তাদের বাধ্য করে পয়োনিষ্কাশন নিয়ে নতুন করে ভাবতে। ইউরোপের শহরে শহরে শুরু হয় স্যানিটেশন নিয়ে উপর্যুপরি কনফারেন্স। নগরপরিকল্পনাবিদেরা পুরো শহরের পানিবিতরণ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। রাস্তা, দালানকোঠা নির্মাণে তৈরি হয় নতুন নীতিমালা।
বলাবাহুল্য, ইউরোপীয় সেই কলেরা মহামারির প্রধান শিকার হয় শহরের দরিদ্র মানুষ। কর্তৃপক্ষ কলেরা ছড়ানোর জন্য দরিদ্র মানুষকে অভিযুক্ত করতে থাকে। তাদের শহরের কেন্দ্র থেকে ঝেঁটিয়ে বের করে দেওয়া হয় বাইরে। শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে গরিবদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবে কলেরাকে কেন্দ্র করে ধনী ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে সামাজিক ও ভৌগোলিক দূরত্ব বাড়তে থাকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এমন গুজবও ছড়ায় যে ধনবানেরা ষড়যন্ত্র করে কলেরার মাধ্যমে গরিবদের মেরে ফেলার ব্যবস্থা করছে। ইউরোপের সেই ঐতিহাসিক কলেরা মহামারির সময় একাধিক বিক্ষোভ, সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কলেরাকে কেন্দ্র করে কয়েকজন অভিজাত ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনাও ঘটে। কলেরাজাত ওই আন্দোলনের কারণে সরকারকে অনেক দরিদ্রবান্ধব আইন পাস করতে হয়।
এভাবেই কলেরা নানাভাবে বদলে দেয় ইউরোপকে। সেই সূত্রে বলা যায়, আধুনিক ইউরোপ গড়ার এবং তার নয়নাভিরাম শহরগুলো তৈরির পেছনে এক অর্থে বাংলার ঐতিহাসিক সেই কলেরা জীবাণুরও একটি ভূমিকা আছে। সেই সঙ্গে এও প্রতিষ্ঠিত যে বিধ্বংসী এই কলেরার সমাধান যে রয়েছে সামান্য এক প্যাকেট স্যালাইনে, সে সত্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে এই বাংলাদেশেরই কলেরা হাসপাতালের গবেষণাগারে। তবে আপসোস এই, কলেরাকে ইউরোপ ইতিহাসের পাতায় পাঠিয়ে দিলেও আমাদের সেই পর্যটক জীবাণু এখনো আস্তানা গেড়ে আছে এই মাটিতে। আমাদের জীবাণু ওদের বদলে ফেললেও আমরা বদলাই না।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com
No comments