ভোলা নিয়ে জল ঘোলা by সোহরাব হাসান
ভোলা মাগুরা হয়নি। আবার বগুড়া হতেও বেশ দূরে।
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘ভোলা মাগুরা হবে না, বগুড়ার মতো অবাধ, সুষ্ঠু ও শতভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে।’ সম্ভবত তিনি বগুড়ায় খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া দুটি আসনের উপনির্বাচন বুঝিয়েছিলেন। সেখানে বিএনপির প্রার্থী মওদুদ আহমদ ও জমির উদ্দিন সরকার জয়ী হয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদ তাঁর কথা পুরোপুরি রাখতে পারেননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনকে আদর্শ ধরলেও ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনটি ভালো হয়েছে বলা যাবে না।
তা হলে কি বিএনপির প্রার্থী জিতলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতো? মোটেই না, ভোটাররা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে এবং যাঁকে ভোট দেবেন, তাঁর জয় নিশ্চিত হলেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, বিজয়ী প্রার্থী কোন দলের সেটি বিবেচ্য নয়। ভোলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিশাল ব্যবধানে জিতেছেন। কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে কি না, সেটি কোটি টাকার প্রশ্ন বটে।
ভোলা সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণ সরকারি দলের বাড়াবাড়ি, বিরোধী দলের পরাজয়-আতঙ্ক এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ। প্রচারণার শুরু থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল অযথা উত্তেজনা করেছে, বাগিবতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছে। এর ‘ঐতিহাসিক’ কারণও আছে। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই আসনটি পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। অতএব উপনির্বাচনে তারা বিজয়ী আসনটি ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের যে কটি আসনে বিএনপির ক্যাডাররা প্রতিপক্ষের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি লুট করেছিল, মেয়েদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, ভোলা-৩ ছিল সেসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ফলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভয় ছিল, এবার নির্বাচনে হারলে আওয়ামী লীগ তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে।
তা ছাড়া উপনির্বাচনটি আওয়ামী লীগ-বিএনপির জন্য যতটা না মর্যাদার লড়াই ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ভোলার দুই জাতীয় নেতা তোফায়েল আহমেদ ও হাফিজউদ্দিন আহমেদের। দুজনই ‘সংস্কারপন্থী’ নেতা। ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেও তাঁরা বেশি মাত্রায় সক্রিয় ছিলেন। হাফিজ বিএনপির প্রার্থী, আওয়ামী লীগের নূরনবী চৌধুরী। ২০০১ সালে এই আসনে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ। হতে পারে এবার তিনি সেই পরাজয়ের ‘মধুর’ শোধটি নিলেন এলাকায় প্রায় অপরিচিত প্রার্থী নূরনবী চৌধুরীকে জিতিয়ে। গোটা নির্বাচনী প্রচারে, বিতর্কে মুখোমুখি হয়েছেন ‘দুই জাতীয় নেতা’। তাঁরা নির্বাচনকে ভোলায় সীমিত না রেখে জাতীয় রাজনীতিকে সরগরম করেছেন।
এ নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা যায়। দলটি প্রথম থেকেই এক ধরনের অস্থিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে জনমনে সন্দেহ জেগেছে, তারা আদৌ নির্বাচন করবে কি না। আদালত বিজয়ী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার পর বিএনপি প্রথমে বলল, নিকটতম প্রার্থী হিসেবে হাফিজউদ্দিন আহমেদকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হবে। তাদের দাবি মেনে নিলে কোনো আসনেই উপনির্বাচন করতে হয় না। বিজয়ী প্রার্থী মারা গেলে বা আসন ছেড়ে দিলে নিকটতম প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হয়। তাদের দাবি মেনে নিলে বগুড়ার উপনির্বাচনে তাদের আসন দুটিও ছেড়ে দিতে হয়। খালেদা জিয়ার নিকটতম প্রার্থীদ্বয় ছিলেন আওয়ামী লীগেরই।
বিএনপির দ্বিতীয় দাবি ছিল সেনা মোতায়েনের। এ দাবিতে তারা এতটাই অনড় ছিল যে, মনে হয়েছে, সেনা মোতায়েন না করলে তারা নির্বাচনেই যাবে না। সবশেষে ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন সাত দিন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও ভোলাকে ইস্যু করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা একদিকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ষড়যন্ত্রকারী, সরকারের পুতুল; অন্যদিকে তাঁদের কাছেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। কোনটি তাঁদের আসল বক্তব্য? অভিযোগের নিনাদে প্রতিকারের আওয়াজ হারিয়ে গেছে। ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে ছিল, এবারে তারা চুপচাপ। ভোটের আগমুহূর্তে কয়েকজন নেতা-কর্মীর দলত্যাগও হাফিজের ভরাডুবিকে ত্বরান্বিত করেছে।
অন্যদিকে প্রচারের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ খানিকটা এগিয়ে ছিল। তারা বলেছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চান না হাফিজ জয়ী হোন। বরং তিনি পরাজিত হলে আন্দোলনের ইস্যু তৈরিতে সুবিধা হবে। এ প্রচারের বিরুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে বিএনপি বারবার নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছে। তাতেও দলীয় সমর্থকেরা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘মাগুরার চেয়েও ভোলায় বেশি কারচুপি হয়েছে।’ তাঁকে ধন্যবাদ। এই প্রথম বিএনপির কোনো নেতা স্বীকার করলেন, ‘মাগুরায় বড় ধরনের কারচুপি হয়েছিল।’ আব্বাস সাহেবরা কারচুপির কথাটি তখন স্বীকার করলে দেশ ও জনগণকে এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। এখন যাঁরা ‘সব পেয়েছি’ বলে উল্লাস প্রকাশ করছেন, তাঁদেরও অতীতের কথা স্মরণ করতে বলব।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভুল ছিল যেকোনো মূল্যে আসনটি পাওয়ার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা এবং তার বাস্তবায়নে একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর বাড়াবাড়ি। তাঁরা চেয়েছেন, নির্বাচনের পরিবেশটি পুরো তাঁদের অনুকূলে থাকুক এবং ভোটাররা শুধু নৌকায় সিল মারুক। ভোটের আগেই বহু কেন্দ্রে তাঁরা বিজয়ের আবহ তৈরি করেছিলেন, ভয়ে বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা সেখানে যেতে সাহস পাননি। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অতিউৎসাহের সঙ্গে তাঁদের সহায়তা করেছে। আবার পরাজয় নিশ্চিত জেনে কোনো কোনো কেন্দ্রে বিএনপিও প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও। একটি নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যা যা করা প্রয়োজন তার সবটাই কি তারা করেছে? বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বলেছিল সেনাবাহিনী ছাড়াই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে। নির্বাচন কমিশন যেসব আচরণবিধি দিয়েছে তা অমান্য করেছেন দুই প্রার্থীই। কিন্তু কমিশন কারও বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি সিইসি এলাকায় গিয়ে দুই প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করে যে সমঝোতা করিয়ে এসেছিলেন, তাও তাঁরা মানেননি। নির্বাচন কমিশন নয়টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত রাখলেও তার প্রভাব অন্যান্য কেন্দ্রে পড়েনি।
বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায়, ৭৭টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন ৯৩ হাজার ৮৭৩ ভোট আর বিএনপির প্রার্থী পেয়েছেন ৪২ হাজার ৫২৮ ভোট। ভোটের ব্যবধান প্রমাণ করে, এ নির্বাচনে সরকারি দল জবরদস্তি না করলেও নূরনবী চৌধুরীই জয়ী হতেন। হয়তো ভোটের ব্যবধানটা কম হতো। ভোটের দিন ও তার আগে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের আচরণ ছিল বেপরোয়া। তাঁদের ভাবটা ছিল, নির্বাচনের আগেই তাঁরা জিতে গেছেন। এটি গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। বিএনপি এ উপনির্বাচনকে ইস্যু করে আন্দোলন করতে পারবে কি পারবে না তার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, সরকারি দল খামোখা ভোলায় জল ঘোলা করেছে। আমরা অতীতেও দেখেছি, সরকারি দল উপনির্বাচনের ফল পক্ষে নিতে নানা কৌশল আঁটে। তার ফল কখনো ভালো হয় না। তবে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিএনপি কি সে দায়িত্ব পালন করেছে?
নির্বাচনের আগে যেমন দিয়েছে, তেমনি পরেও দলটি নানা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা নির্বাচন বাতিলের পাশাপাশি তিন নির্বাচন কমিশনারেরও পদত্যাগ দাবি করেছে। কোথাও নির্বাচনে কারচুপি হলে বাতিল করার দাবি অন্যায় নয়। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন বাতিলের দাবিটি তারা কার কাছে করেছে? নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনারের কাছে। আবার তাদেরই পদত্যাগ চাইছে। এটি কি স্ববিরোধী নয়? কোনো আসনে নির্বাচনে কারচুপি হলে তথ্য-প্রমাণসহ ফল বাতিলের দাবি তারা করতেই পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের দাবির কী যুক্তি থাকতে পারে? তারা তো জাতীয় নির্বাচনের পরও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চেয়েছিল, আবার তাদের অধীনে উপনির্বাচন করে জিতেও এসেছে। এখন জেতেনি বলেই কি নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগ করতে হবে?
আরেকটি কথা, ভোলায় বিএনপির পরাজয়ের আরও একটি কারণ আছে। মানুষ এত সহজে ২০০১ সালের বীভৎসতা ভোলেনি। এবার সরকারি দল জবরদস্তি না করলেও তাদের প্রার্থী জয়ী হতো। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন সেখানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে তা কিছুই নয়। এখানে প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
‘নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর রাতে সন্ত্রাসীরা বেন্টর বাড়িসহ গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে নারকীয় হামলা চালায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্পদ লুট আর নারীদের সম্ভ্রমহানি। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের ৪০০ হিন্দুবাড়ির কোনোটিই রেহাই পায়নি তাদের হাত থেকে। রাতের বেলা ৮-১০টি দলে বিভক্ত হয়ে শত শত সন্ত্রাসী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায় গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। বেন্টর বাড়িতে আশ্রিত অর্ধশতাধিক নারীর কেউই নিজেকে বাঁচাতে পারেনি সন্ত্রাসীদের কবল থেকে। এখানে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০ বছরের শিশু, লাঞ্ছিত হয়েছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা।’
আরও কতজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সে সময়ের শাসক দল কত শেফালি রানির নাকফুল কেড়ে নিয়েছে, কত প্রাণকৃষ্ণকে ঘরছাড়া করেছে, তার হিসাব-নিকাশ ক্ষমতার রাজনীতি রাখে না। সে কারণেই বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের উপনির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সাদরে বরণ করে নেয়।
একটি অন্যায়কে আরেকটি অন্যায় দিয়ে আড়াল করা যায় না। ২০০১ সালে যারা এসব সন্ত্রাস-নির্যাতন চালিয়েছিল, তারও আগে একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তাদের কেউ কেউ এবার আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নূরনবী চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ হয়তো বিষয়টি নির্বাচনে জয়ের কৌশল হিসেবে নিয়েছে, কিন্তু যাঁরা সেদিন নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছিলেন, তাঁরা বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন?
ভোলার উপনির্বাচনের ঘোলা জল দেশটিকেই ফের গভীর অনিশ্চয়তায় ফেলে দেবে কি না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। প্রত্যাশা ছিল, ভোলার নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, হয়নি। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হলেও পরাজিত হয়েছে নীতি ও আদর্শ। বিএনপির দলছুটদের দলে টানতে হয়েছে, জায়গা দিতে হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদেরও। অতএব বিজয়ী দলকে ধন্যবাদ দিতে পারলাম না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘ভোলা মাগুরা হবে না, বগুড়ার মতো অবাধ, সুষ্ঠু ও শতভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে।’ সম্ভবত তিনি বগুড়ায় খালেদা জিয়ার ছেড়ে দেওয়া দুটি আসনের উপনির্বাচন বুঝিয়েছিলেন। সেখানে বিএনপির প্রার্থী মওদুদ আহমদ ও জমির উদ্দিন সরকার জয়ী হয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদ তাঁর কথা পুরোপুরি রাখতে পারেননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনকে আদর্শ ধরলেও ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনটি ভালো হয়েছে বলা যাবে না।
তা হলে কি বিএনপির প্রার্থী জিতলে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতো? মোটেই না, ভোটাররা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে এবং যাঁকে ভোট দেবেন, তাঁর জয় নিশ্চিত হলেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, বিজয়ী প্রার্থী কোন দলের সেটি বিবেচ্য নয়। ভোলায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিশাল ব্যবধানে জিতেছেন। কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে কি না, সেটি কোটি টাকার প্রশ্ন বটে।
ভোলা সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার কারণ সরকারি দলের বাড়াবাড়ি, বিরোধী দলের পরাজয়-আতঙ্ক এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ। প্রচারণার শুরু থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল অযথা উত্তেজনা করেছে, বাগিবতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছে। এর ‘ঐতিহাসিক’ কারণও আছে। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই আসনটি পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। অতএব উপনির্বাচনে তারা বিজয়ী আসনটি ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের যে কটি আসনে বিএনপির ক্যাডাররা প্রতিপক্ষের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি লুট করেছিল, মেয়েদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, ভোলা-৩ ছিল সেসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত। ফলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভয় ছিল, এবার নির্বাচনে হারলে আওয়ামী লীগ তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে।
তা ছাড়া উপনির্বাচনটি আওয়ামী লীগ-বিএনপির জন্য যতটা না মর্যাদার লড়াই ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ভোলার দুই জাতীয় নেতা তোফায়েল আহমেদ ও হাফিজউদ্দিন আহমেদের। দুজনই ‘সংস্কারপন্থী’ নেতা। ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেও তাঁরা বেশি মাত্রায় সক্রিয় ছিলেন। হাফিজ বিএনপির প্রার্থী, আওয়ামী লীগের নূরনবী চৌধুরী। ২০০১ সালে এই আসনে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ। হতে পারে এবার তিনি সেই পরাজয়ের ‘মধুর’ শোধটি নিলেন এলাকায় প্রায় অপরিচিত প্রার্থী নূরনবী চৌধুরীকে জিতিয়ে। গোটা নির্বাচনী প্রচারে, বিতর্কে মুখোমুখি হয়েছেন ‘দুই জাতীয় নেতা’। তাঁরা নির্বাচনকে ভোলায় সীমিত না রেখে জাতীয় রাজনীতিকে সরগরম করেছেন।
এ নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা যায়। দলটি প্রথম থেকেই এক ধরনের অস্থিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে জনমনে সন্দেহ জেগেছে, তারা আদৌ নির্বাচন করবে কি না। আদালত বিজয়ী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার পর বিএনপি প্রথমে বলল, নিকটতম প্রার্থী হিসেবে হাফিজউদ্দিন আহমেদকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হবে। তাদের দাবি মেনে নিলে কোনো আসনেই উপনির্বাচন করতে হয় না। বিজয়ী প্রার্থী মারা গেলে বা আসন ছেড়ে দিলে নিকটতম প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে হয়। তাদের দাবি মেনে নিলে বগুড়ার উপনির্বাচনে তাদের আসন দুটিও ছেড়ে দিতে হয়। খালেদা জিয়ার নিকটতম প্রার্থীদ্বয় ছিলেন আওয়ামী লীগেরই।
বিএনপির দ্বিতীয় দাবি ছিল সেনা মোতায়েনের। এ দাবিতে তারা এতটাই অনড় ছিল যে, মনে হয়েছে, সেনা মোতায়েন না করলে তারা নির্বাচনেই যাবে না। সবশেষে ভোট গ্রহণের দুই দিন আগে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচন সাত দিন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও ভোলাকে ইস্যু করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা একদিকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ষড়যন্ত্রকারী, সরকারের পুতুল; অন্যদিকে তাঁদের কাছেই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। কোনটি তাঁদের আসল বক্তব্য? অভিযোগের নিনাদে প্রতিকারের আওয়াজ হারিয়ে গেছে। ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচনে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে ছিল, এবারে তারা চুপচাপ। ভোটের আগমুহূর্তে কয়েকজন নেতা-কর্মীর দলত্যাগও হাফিজের ভরাডুবিকে ত্বরান্বিত করেছে।
অন্যদিকে প্রচারের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ খানিকটা এগিয়ে ছিল। তারা বলেছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব চান না হাফিজ জয়ী হোন। বরং তিনি পরাজিত হলে আন্দোলনের ইস্যু তৈরিতে সুবিধা হবে। এ প্রচারের বিরুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে বিএনপি বারবার নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছে। তাতেও দলীয় সমর্থকেরা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘মাগুরার চেয়েও ভোলায় বেশি কারচুপি হয়েছে।’ তাঁকে ধন্যবাদ। এই প্রথম বিএনপির কোনো নেতা স্বীকার করলেন, ‘মাগুরায় বড় ধরনের কারচুপি হয়েছিল।’ আব্বাস সাহেবরা কারচুপির কথাটি তখন স্বীকার করলে দেশ ও জনগণকে এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। এখন যাঁরা ‘সব পেয়েছি’ বলে উল্লাস প্রকাশ করছেন, তাঁদেরও অতীতের কথা স্মরণ করতে বলব।
এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভুল ছিল যেকোনো মূল্যে আসনটি পাওয়ার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা এবং তার বাস্তবায়নে একশ্রেণীর নেতা-কর্মীর বাড়াবাড়ি। তাঁরা চেয়েছেন, নির্বাচনের পরিবেশটি পুরো তাঁদের অনুকূলে থাকুক এবং ভোটাররা শুধু নৌকায় সিল মারুক। ভোটের আগেই বহু কেন্দ্রে তাঁরা বিজয়ের আবহ তৈরি করেছিলেন, ভয়ে বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা সেখানে যেতে সাহস পাননি। স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও অতিউৎসাহের সঙ্গে তাঁদের সহায়তা করেছে। আবার পরাজয় নিশ্চিত জেনে কোনো কোনো কেন্দ্রে বিএনপিও প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও। একটি নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যা যা করা প্রয়োজন তার সবটাই কি তারা করেছে? বিএনপির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন বলেছিল সেনাবাহিনী ছাড়াই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যাবে। নির্বাচন কমিশন যেসব আচরণবিধি দিয়েছে তা অমান্য করেছেন দুই প্রার্থীই। কিন্তু কমিশন কারও বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি সিইসি এলাকায় গিয়ে দুই প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করে যে সমঝোতা করিয়ে এসেছিলেন, তাও তাঁরা মানেননি। নির্বাচন কমিশন নয়টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত রাখলেও তার প্রভাব অন্যান্য কেন্দ্রে পড়েনি।
বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায়, ৭৭টি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছেন ৯৩ হাজার ৮৭৩ ভোট আর বিএনপির প্রার্থী পেয়েছেন ৪২ হাজার ৫২৮ ভোট। ভোটের ব্যবধান প্রমাণ করে, এ নির্বাচনে সরকারি দল জবরদস্তি না করলেও নূরনবী চৌধুরীই জয়ী হতেন। হয়তো ভোটের ব্যবধানটা কম হতো। ভোটের দিন ও তার আগে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের আচরণ ছিল বেপরোয়া। তাঁদের ভাবটা ছিল, নির্বাচনের আগেই তাঁরা জিতে গেছেন। এটি গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। বিএনপি এ উপনির্বাচনকে ইস্যু করে আন্দোলন করতে পারবে কি পারবে না তার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো, সরকারি দল খামোখা ভোলায় জল ঘোলা করেছে। আমরা অতীতেও দেখেছি, সরকারি দল উপনির্বাচনের ফল পক্ষে নিতে নানা কৌশল আঁটে। তার ফল কখনো ভালো হয় না। তবে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে বিরোধী দলেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিএনপি কি সে দায়িত্ব পালন করেছে?
নির্বাচনের আগে যেমন দিয়েছে, তেমনি পরেও দলটি নানা বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। তারা নির্বাচন বাতিলের পাশাপাশি তিন নির্বাচন কমিশনারেরও পদত্যাগ দাবি করেছে। কোথাও নির্বাচনে কারচুপি হলে বাতিল করার দাবি অন্যায় নয়। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন বাতিলের দাবিটি তারা কার কাছে করেছে? নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনারের কাছে। আবার তাদেরই পদত্যাগ চাইছে। এটি কি স্ববিরোধী নয়? কোনো আসনে নির্বাচনে কারচুপি হলে তথ্য-প্রমাণসহ ফল বাতিলের দাবি তারা করতেই পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের দাবির কী যুক্তি থাকতে পারে? তারা তো জাতীয় নির্বাচনের পরও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চেয়েছিল, আবার তাদের অধীনে উপনির্বাচন করে জিতেও এসেছে। এখন জেতেনি বলেই কি নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগ করতে হবে?
আরেকটি কথা, ভোলায় বিএনপির পরাজয়ের আরও একটি কারণ আছে। মানুষ এত সহজে ২০০১ সালের বীভৎসতা ভোলেনি। এবার সরকারি দল জবরদস্তি না করলেও তাদের প্রার্থী জয়ী হতো। নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন সেখানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে তা কিছুই নয়। এখানে প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
‘নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর রাতে সন্ত্রাসীরা বেন্টর বাড়িসহ গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে নারকীয় হামলা চালায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্পদ লুট আর নারীদের সম্ভ্রমহানি। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের ৪০০ হিন্দুবাড়ির কোনোটিই রেহাই পায়নি তাদের হাত থেকে। রাতের বেলা ৮-১০টি দলে বিভক্ত হয়ে শত শত সন্ত্রাসী অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায় গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। বেন্টর বাড়িতে আশ্রিত অর্ধশতাধিক নারীর কেউই নিজেকে বাঁচাতে পারেনি সন্ত্রাসীদের কবল থেকে। এখানে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০ বছরের শিশু, লাঞ্ছিত হয়েছে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা।’
আরও কতজন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সে সময়ের শাসক দল কত শেফালি রানির নাকফুল কেড়ে নিয়েছে, কত প্রাণকৃষ্ণকে ঘরছাড়া করেছে, তার হিসাব-নিকাশ ক্ষমতার রাজনীতি রাখে না। সে কারণেই বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের উপনির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সাদরে বরণ করে নেয়।
একটি অন্যায়কে আরেকটি অন্যায় দিয়ে আড়াল করা যায় না। ২০০১ সালে যারা এসব সন্ত্রাস-নির্যাতন চালিয়েছিল, তারও আগে একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তাদের কেউ কেউ এবার আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নূরনবী চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ হয়তো বিষয়টি নির্বাচনে জয়ের কৌশল হিসেবে নিয়েছে, কিন্তু যাঁরা সেদিন নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছিলেন, তাঁরা বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন?
ভোলার উপনির্বাচনের ঘোলা জল দেশটিকেই ফের গভীর অনিশ্চয়তায় ফেলে দেবে কি না, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। প্রত্যাশা ছিল, ভোলার নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে, হয়নি। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হলেও পরাজিত হয়েছে নীতি ও আদর্শ। বিএনপির দলছুটদের দলে টানতে হয়েছে, জায়গা দিতে হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীদেরও। অতএব বিজয়ী দলকে ধন্যবাদ দিতে পারলাম না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments