সাংবিধানিক সংস্কারের শক্তি ও বিপদ by আসমা জাহাঙ্গীর
বহুপ্রতীক্ষিত সাংবিধানিক সংস্কার জাতীয় পরিষদ ও সিনেটের গণ্ডি হয়তো পার হয়েছে, কিন্তু এটি বিচারের কাজ সামনে পড়ে আছে। সিনেটর রাজা রাব্বানিসহ সংস্কারের বিষয়ে কাজ করার জন্য গঠিত কমিটির সব সদস্যরই প্রশংসা প্রাপ্য। প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো নিখুঁত নয়, কিন্তু এগুলো ভবিষ্যতের স্পষ্টতর দিশার ভিত্তিভূমি তৈরি করেছে।
তবে সংশোধনীগুলো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে পারে—দুর্বলতার জন্য নয়, বরং এদের শক্তিমত্তার কারণে। তিনটি মৌলিক প্যারামিটারের ওপর এগুলো আলোকপাত করেছে: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণ, প্রাদেশিক অধিকারের স্বীকৃতি এবং তথ্য ও প্রাথমিক শিক্ষার অধিকারের মতো নতুন দুটি মৌলিক অধিকারের সম্প্রসারণ।
কোনো কোনো জায়গায় সংস্কার অযৌক্তিক হয়েছে; অধিকারের মৌলিক প্রত্যয়কে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের কাছে ধর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে কমিটি অবজেকটিভস রেজুলিউশনে ‘স্বাধীনভাবে’ শব্দটি ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু অন্যত্র সহিষ্ণুতা উৎসাহিত করার এই চেতনার বিরোধিতা আছে। ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ফলে এখন কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে হলে তাঁকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। তবে কোনো অমুসলমান ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন।
বাস্তবে পাকিস্তানের ক্ষমতাহীন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্ষমতার এমন সীমায় পৌঁছার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সংবিধানে নির্লজ্জ বৈষম্যের সুযোগ রাখা অসমর্থনযোগ্য। কোনো অমুসলমান ব্যক্তি জাতীয় পরিষদের সদস্যপদে নির্বাচন করতে পারেন এবং পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন না। ফলে কেবল মুসলমানেরাই সংসদীয় নেতা হতে পারবেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মনস্থির করতে হবে, তাঁরা সংখ্যালঘুদের প্রতি অবৈষম্যমূলক নীতির অঙ্গীকার করবেন, নাকি গোঁড়ামিতেই আস্থা রাখবেন। কেন্দ্রশাসিত উপজাতীয় অঞ্চলের (এফএটিএ) জন্য সংসদে অন্য সময়ের মতোই প্রচুর আসনের কোটা বরাদ্দ আছে, কিন্তু অঞ্চলটিতে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নেই। এ অঞ্চলে কি কোনো নারী বাস করেন না বা তাঁদের কি কোনো দুঃখ-বেদনা নেই? অন্য সব জায়গার মতো এখানকার নারীরাও বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দাবি করার মতো ততটাই অরক্ষিত নন কি?
সংবিধানের ৬২ ও ৬৩ অনুচ্ছেদ দুটি রেখে দিয়েছে কমিটি। এখানে সাংসদদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে। কমিটি অল্প কয়েকটি চাতুর্যপূর্ণ পরিবর্তন করেছে, কিন্তু তাতে কোনো উপকার হলো না। আদালতের ভিন্ন রায় না থাকলে ধরে নেওয়া হয়, সাংসদেরা এবং সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিরা ‘সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, নীতিবান, সচ্চরিত্র, সত্ ও নিয়মের প্রতি অনুগত’। অর্থাৎ সংসদের সব সদস্যকে সত্ বলে গণ্য করা হবে, যদি না মানবিক দুর্বলতার ফলে তাঁর চরিত্রে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ মেলে। অপরাধ করার অভিযোগে দণ্ডিত বা মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তি অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার যে বিধি ছিল, তা এই কমিটি বাদ দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোতে সামন্ততান্ত্রিকতার বিস্তার ঘটেছে এবং যেকোনো প্রকারের ঘৃণার অবাধ বিস্তার ঘটানোর স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়েছে। দলত্যাগবিষয়ক বিধানটি নিবর্তনমূলক; এটি সাংসদকে দলের মুষ্টিমেয় কর্তাব্যক্তির সিদ্ধান্তে বন্দী করে ফেলে। দলীয় কর্তাব্যক্তিরা ৭০ জন নারী ও সংখ্যালঘু সদস্য ঠিক করেন, যাঁদের কোনোরূপ মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে যেতে হয় না, শুধু কর্তাব্যক্তিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই চলে। দলের অভ্যন্তরে নির্বাচন এখন ঐচ্ছিক বিষয়। সাম্প্রদায়িক, জাতিগত বা আঞ্চলিক ঘৃণার বিস্তার ঘটানো রোধে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে লস্কররা ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিগুলো বৈধভাবে ঘৃণা ছড়াতে পারবে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।
কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও এই কমিটি বেশ কিছু ইতিবাচক সংস্কার শুরু করেছে। সবচেয়ে সজীব যে সংস্কার তা হলো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক ঋণ সংগ্রহ করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সংস্থাগুলোকে প্রদান এবং ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের (এনইসি) তত্ত্বাবধানে প্রাদেশিক সামষ্টিক তহবিলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া। তদুপরি খনিজ, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোনো প্রদেশ বা এর কাছাকাছি জলসীমার মধ্যে মিললে, এর অধিকার এখন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার যৌথভাবে সমপরিমাণে পাবে। এটির বাস্তবায়ন হবে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ যেসব প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় সরকারের উদার দানের ওপর ভর করে চলে, তাদের হূদয়ে আঘাত লাগবে। এস্টাবলিশমেন্টের তরফ থেকে অষ্টাদশ সংশোধনীর ওপর প্রকৃত হুমকিটা আসে এসব পরিবর্তন থেকে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত প্রদেশের (এনডব্লিউএফপি) নতুন নামকরণ বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ-পদ্ধতির পরিবর্তন থেকে নয়।
কাউন্সিল অব কমন ইন্টারেস্ট (সিসিআই) এবং এনইসিকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এদের প্রতিবেদনগুলো এখন সংসদের উভয় কক্ষে পেশ করতে হবে। কোনো প্রদেশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার প্রথম প্রচেষ্টা নিতে হবে সিসিআই পর্যায়ে। নির্বাচন কমিশনকে স্থায়ী কাঠামো দান করা হয়েছে। প্রাদেশিক নির্বাচন কমিশনাররা আর কর্মরত বিচারপতি হবেন না। কোনো ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক কেবিনেটে স্থান পাবেন না যদি তাঁর সন্তান বা স্বামী-স্ত্রী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জরুরি আইন জারি করার ক্ষমতা দেওয়া হলো আইন প্রণয়নকারী সংস্থাকে; গভর্নরকে নয়। সংশোধনী অনুযায়ী গণভোট দেওয়ার কোনো ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে থাকবে না। এ ক্ষমতা দেওয়া হলো সংসদকে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী, একমাত্র সংসদই গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। স্বৈরাচারী অধ্যাদেশ ঘোষণার ওপরও কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ভার সামগ্রিকভাবে বর্তাবে চলতি বা সাবেক বিচারপতি ও আইনজীবীদের প্রতিনিধির ওপর। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নাম পাঠাবে সংসদীয় কমিটিতে। সংসদীয় কমিটি কেবল এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে পারে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে।
গভর্নরের অনুপস্থিতিতে বিচারপতি হিসেবে কর্মরত কেউ আর ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অন্য কোনো সরকারি পদ গ্রহণ করলে, হয় তাঁর পেনশন পাবেন না অথবা নতুন পদের জন্য পারিশ্রমিক নেবেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল ও অ্যাডভোকেট জেনারেলরা দায়িত্বে থাকাকালে তাঁদের ব্যক্তিগত আইন ব্যবসা চালাতে পারবেন না। অতীতে কেন্দ্রীয় শরিয়া আদালতের বিচারপতিদের তিনজন ছিলেন ‘ইসলামি আইনে প্রাজ্ঞ’ ব্যক্তি। এই যোগ্যতার বদলে ইসলামি আইনে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, গবেষক বা শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।
দুর্বলতা প্রসঙ্গে আবারও ফিরে আসি। মৌলিক অধিকারগুলো দুর্বল রয়ে গেছে। এমনকি নির্যাতনও পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চলাচল ও ধর্মচর্চার অধিকার সীমিত রয়ে গেছে। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের পদ্ধতি সবচেয়ে অসন্তোষজনক। গণতন্ত্রের সনদে যে সাংবিধানিক আদালতের প্রতিশ্রুতির কথা আছে, তাতে ছদ্মাবরণ দেওয়া হয়েছে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিকে জবাবদিহি করার বিধানটি স্পষ্ট করা হয়নি। কেন্দ্র ও প্রদেশশাসিত উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদা কী হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া থেমে না গিয়ে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি। যদি শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত অসংগতিগুলোর দিকে আগে দৃষ্টি দেওয়া হয়, তবেই পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে যেতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সুষ্ঠু শাসনের জন্য একটি আইনি কাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অর্জনগুলো ধরে রাখতে প্রয়োজন দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উচ্চপর্যায়ের নিষ্ঠা।
পাকিস্তানের ডন পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আসমা জাহাঙ্গীর: পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন।
তবে সংশোধনীগুলো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে পারে—দুর্বলতার জন্য নয়, বরং এদের শক্তিমত্তার কারণে। তিনটি মৌলিক প্যারামিটারের ওপর এগুলো আলোকপাত করেছে: গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালীকরণ, প্রাদেশিক অধিকারের স্বীকৃতি এবং তথ্য ও প্রাথমিক শিক্ষার অধিকারের মতো নতুন দুটি মৌলিক অধিকারের সম্প্রসারণ।
কোনো কোনো জায়গায় সংস্কার অযৌক্তিক হয়েছে; অধিকারের মৌলিক প্রত্যয়কে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের কাছে ধর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে কমিটি অবজেকটিভস রেজুলিউশনে ‘স্বাধীনভাবে’ শব্দটি ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু অন্যত্র সহিষ্ণুতা উৎসাহিত করার এই চেতনার বিরোধিতা আছে। ১৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ফলে এখন কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে হলে তাঁকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। তবে কোনো অমুসলমান ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন।
বাস্তবে পাকিস্তানের ক্ষমতাহীন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্ষমতার এমন সীমায় পৌঁছার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সংবিধানে নির্লজ্জ বৈষম্যের সুযোগ রাখা অসমর্থনযোগ্য। কোনো অমুসলমান ব্যক্তি জাতীয় পরিষদের সদস্যপদে নির্বাচন করতে পারেন এবং পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন না। ফলে কেবল মুসলমানেরাই সংসদীয় নেতা হতে পারবেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মনস্থির করতে হবে, তাঁরা সংখ্যালঘুদের প্রতি অবৈষম্যমূলক নীতির অঙ্গীকার করবেন, নাকি গোঁড়ামিতেই আস্থা রাখবেন। কেন্দ্রশাসিত উপজাতীয় অঞ্চলের (এফএটিএ) জন্য সংসদে অন্য সময়ের মতোই প্রচুর আসনের কোটা বরাদ্দ আছে, কিন্তু অঞ্চলটিতে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন নেই। এ অঞ্চলে কি কোনো নারী বাস করেন না বা তাঁদের কি কোনো দুঃখ-বেদনা নেই? অন্য সব জায়গার মতো এখানকার নারীরাও বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দাবি করার মতো ততটাই অরক্ষিত নন কি?
সংবিধানের ৬২ ও ৬৩ অনুচ্ছেদ দুটি রেখে দিয়েছে কমিটি। এখানে সাংসদদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে। কমিটি অল্প কয়েকটি চাতুর্যপূর্ণ পরিবর্তন করেছে, কিন্তু তাতে কোনো উপকার হলো না। আদালতের ভিন্ন রায় না থাকলে ধরে নেওয়া হয়, সাংসদেরা এবং সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিরা ‘সুস্থ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন, নীতিবান, সচ্চরিত্র, সত্ ও নিয়মের প্রতি অনুগত’। অর্থাৎ সংসদের সব সদস্যকে সত্ বলে গণ্য করা হবে, যদি না মানবিক দুর্বলতার ফলে তাঁর চরিত্রে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ মেলে। অপরাধ করার অভিযোগে দণ্ডিত বা মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তি অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার যে বিধি ছিল, তা এই কমিটি বাদ দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোতে সামন্ততান্ত্রিকতার বিস্তার ঘটেছে এবং যেকোনো প্রকারের ঘৃণার অবাধ বিস্তার ঘটানোর স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়েছে। দলত্যাগবিষয়ক বিধানটি নিবর্তনমূলক; এটি সাংসদকে দলের মুষ্টিমেয় কর্তাব্যক্তির সিদ্ধান্তে বন্দী করে ফেলে। দলীয় কর্তাব্যক্তিরা ৭০ জন নারী ও সংখ্যালঘু সদস্য ঠিক করেন, যাঁদের কোনোরূপ মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে যেতে হয় না, শুধু কর্তাব্যক্তিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেই চলে। দলের অভ্যন্তরে নির্বাচন এখন ঐচ্ছিক বিষয়। সাম্প্রদায়িক, জাতিগত বা আঞ্চলিক ঘৃণার বিস্তার ঘটানো রোধে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে লস্কররা ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠিগুলো বৈধভাবে ঘৃণা ছড়াতে পারবে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে।
কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও এই কমিটি বেশ কিছু ইতিবাচক সংস্কার শুরু করেছে। সবচেয়ে সজীব যে সংস্কার তা হলো দেশীয় বা আন্তর্জাতিক ঋণ সংগ্রহ করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সংস্থাগুলোকে প্রদান এবং ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের (এনইসি) তত্ত্বাবধানে প্রাদেশিক সামষ্টিক তহবিলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া। তদুপরি খনিজ, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোনো প্রদেশ বা এর কাছাকাছি জলসীমার মধ্যে মিললে, এর অধিকার এখন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার যৌথভাবে সমপরিমাণে পাবে। এটির বাস্তবায়ন হবে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ যেসব প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় সরকারের উদার দানের ওপর ভর করে চলে, তাদের হূদয়ে আঘাত লাগবে। এস্টাবলিশমেন্টের তরফ থেকে অষ্টাদশ সংশোধনীর ওপর প্রকৃত হুমকিটা আসে এসব পরিবর্তন থেকে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত প্রদেশের (এনডব্লিউএফপি) নতুন নামকরণ বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ-পদ্ধতির পরিবর্তন থেকে নয়।
কাউন্সিল অব কমন ইন্টারেস্ট (সিসিআই) এবং এনইসিকে শক্তিশালী করা হয়েছে। এদের প্রতিবেদনগুলো এখন সংসদের উভয় কক্ষে পেশ করতে হবে। কোনো প্রদেশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার প্রথম প্রচেষ্টা নিতে হবে সিসিআই পর্যায়ে। নির্বাচন কমিশনকে স্থায়ী কাঠামো দান করা হয়েছে। প্রাদেশিক নির্বাচন কমিশনাররা আর কর্মরত বিচারপতি হবেন না। কোনো ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক কেবিনেটে স্থান পাবেন না যদি তাঁর সন্তান বা স্বামী-স্ত্রী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জরুরি আইন জারি করার ক্ষমতা দেওয়া হলো আইন প্রণয়নকারী সংস্থাকে; গভর্নরকে নয়। সংশোধনী অনুযায়ী গণভোট দেওয়ার কোনো ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে থাকবে না। এ ক্ষমতা দেওয়া হলো সংসদকে। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ী, একমাত্র সংসদই গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত দিতে পারবে। স্বৈরাচারী অধ্যাদেশ ঘোষণার ওপরও কিছু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ভার সামগ্রিকভাবে বর্তাবে চলতি বা সাবেক বিচারপতি ও আইনজীবীদের প্রতিনিধির ওপর। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের নাম পাঠাবে সংসদীয় কমিটিতে। সংসদীয় কমিটি কেবল এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে পারে তিন-চতুর্থাংশ ভোটে।
গভর্নরের অনুপস্থিতিতে বিচারপতি হিসেবে কর্মরত কেউ আর ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অন্য কোনো সরকারি পদ গ্রহণ করলে, হয় তাঁর পেনশন পাবেন না অথবা নতুন পদের জন্য পারিশ্রমিক নেবেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল ও অ্যাডভোকেট জেনারেলরা দায়িত্বে থাকাকালে তাঁদের ব্যক্তিগত আইন ব্যবসা চালাতে পারবেন না। অতীতে কেন্দ্রীয় শরিয়া আদালতের বিচারপতিদের তিনজন ছিলেন ‘ইসলামি আইনে প্রাজ্ঞ’ ব্যক্তি। এই যোগ্যতার বদলে ইসলামি আইনে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, গবেষক বা শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার বিধান করা হয়েছে।
দুর্বলতা প্রসঙ্গে আবারও ফিরে আসি। মৌলিক অধিকারগুলো দুর্বল রয়ে গেছে। এমনকি নির্যাতনও পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চলাচল ও ধর্মচর্চার অধিকার সীমিত রয়ে গেছে। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের পদ্ধতি সবচেয়ে অসন্তোষজনক। গণতন্ত্রের সনদে যে সাংবিধানিক আদালতের প্রতিশ্রুতির কথা আছে, তাতে ছদ্মাবরণ দেওয়া হয়েছে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতিকে জবাবদিহি করার বিধানটি স্পষ্ট করা হয়নি। কেন্দ্র ও প্রদেশশাসিত উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদা কী হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া থেমে না গিয়ে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করি। যদি শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত অসংগতিগুলোর দিকে আগে দৃষ্টি দেওয়া হয়, তবেই পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে যেতে পারে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সুষ্ঠু শাসনের জন্য একটি আইনি কাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অর্জনগুলো ধরে রাখতে প্রয়োজন দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উচ্চপর্যায়ের নিষ্ঠা।
পাকিস্তানের ডন পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আসমা জাহাঙ্গীর: পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন।
No comments