বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় আমাদের সকলের by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কথা আমাদের সকলের মনে থাকবে। সেদিন আমরা কে কোথায় ছিলাম এবং কখন এবং কী অবস্থায় আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের করুণ মৃত্যুর সংবাদটি শুনেছিলাম এইসব চিত্র, এইসব কথা আমাদের মনে গেঁথে আছে এবং যত দিন আমরা যারা আজ ৫০ পেরিয়ে এসেছি, বেচেঁ থাকলে আমাদের স্মরণে থাকবে। বঙ্গবন্ধুকে সব সময়ই আমাদের মনে পড়ে এবং এর প্রধান কারণ তিনি ইতিহাস তৈরি করে গেছেন। আজ এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর যে তাঁর হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন হলো এই বাস্তবতাটি আমাদের মনে নতুন আশার সূচনা করে। এবং সেই আশাটি খুবই সামান্য ও পরিস্কার—এই বাংলাদেশে তথা পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো স্থানে যেন এই রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ড না ঘটে এবং কোনো নেতা ও তাঁর পরিবার যেন এইভাবে এই অস্বাভাবিক উপায়ে মৃত্যুবরণ না করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় হয়েছে। আমাদের সন্তুষ্টির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা এবং তারা যে দেশেরই হোক না কেন, কোনো দিন সফল হয় না। হ্যাঁ, তারা বড় মাপের মানুষদের মেরে ফেলতে পারে। রাষ্ট্রকে বিকল করে দিতে পারে কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু তারা ইতিহাসে কখনো কোনো শীর্ষস্থান পায় না। জাতির জনকের হত্যাকারীরা আজ ঘৃণিত নামমাত্র। খন্দকার মোশতাকের কথা মানুষ মনে করে একজন হত্যাকারীর রূপে। যারা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করল তারা ওই খুনি হিসেবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই জগতের ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবে। এবং যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার ফায়দাটা লুটেছেন, তাঁরাও ধিকৃত মানুষ বলে গণ্য হবেন।
এই সবই সত্য। সবই বাস্তব। কিন্তু আরও বাস্তবতা রয়েছে। একটি হলো অতি সহজ একটা সত্য। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতি হিসেবে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করেছিলাম? আজ আমরা হরহামেশাই বঙ্গবন্ধুর কথা বলি। এমন ব্যক্তিও আছেন যাঁদের কথা শুনলে মনে হয় তাঁরা কোনো একসময় বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন। কে কত গভীরভাবে বঙ্গবন্ধুকে চিনেছে, কত গভীরভাবে তাঁর রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে, এই কথা প্রায়ই আমরা শুনে থাকি। বিশেষ করে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ওই সকল সাবেক কূটনীতিকের কথা, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বছরের পর বছর দেশের বিভিন্ন বঙ্গবন্ধুবিরোধী সরকারের চাকরি করেছেন এবং কতভাবে নিজেদের উন্নতি সাধন করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অথচ তাঁদেরই কয়েকজন সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু শুনেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে তাঁদের কেউ কেউ ওই সকল কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয়েছেন, যাঁদের কাছে কখনো বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি পাওয়া গেছে। এমন রাষ্ট্রদূতও ছিলেন যাঁরা বিদেশে সফররত দেশি সামরিক শাসককে খুশি করার জন্য সেই শাসকের হোটেলের কক্ষের সম্মুখে সুইমিং পুলে সাঁতার কেটেছেন এবং সেই শাসকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আবার কোনো এক প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে বিদেশে তাঁর অবস্থানকালে তাঁর হোটেলকক্ষে জুতার দোকান সাজিয়ে বসেছেন। কেননা সেই প্রধানমন্ত্রী একজোড়া বিদেশি জুতা ক্রয় করার খায়েশ ব্যক্ত করেছিলেন।
এই ধরনের অনেক কথা, অনেক গল্প আপনি শুনতে পাবেন। যে সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারেননি, তিনিই আবার পরপর দুই সামরিক শাসকের আমলে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা সব সময়ই বলে থাকেন। জেনারেল ওসমানী, যিনি চতুর্থ সংশোধনীর প্রতিবাদ করে জাতীয় সংসদ ত্যাগ করেন এই বলে যে তিনি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মেনে নিতে পারেন না, সেই জেনারেল ওসমানিই খন্দকার মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হয়ে প্রায় তিন মাস বঙ্গভবনে কর্মরত ছিলেন। আমাদের কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যাতে আমরা ধরে নিতে পারি, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কী কারণ ছিল ওসমানীর ওই খুনিদের সঙ্গে যাওয়ার? যে মোশতাকের আমন্ত্রন সরকারে যোগ দেয়ার জন্য ঘৃণা ভরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই মোশতাকের সঙ্গে জেনারেল ওসমানী কেন যোগদান করলেন? দেশে তো সেই ১৫ আগস্টের পরও সাহসী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের চার নেতা খুনিদের সামনে মাথা নত করেননি। তাঁদের কারাগারে নেওয়া হয়। কখনো কি ওসমানী মোশতাকের কাছে দাবি করেছিলেন, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হোক? ওই চারজন কারাগারে নিহত হলেন। কেউই তাঁদের রক্ষা করতে পারলেন না। সবচেয়ে অনুতাপের বিষয় হলো, এই জেনারেল ওসমানীই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক দলের পক্ষে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করেন। মাজার জিয়ারতটি কি ১৫ আগস্টের অব্যবহিত পরপরই করা যেত না?
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। যে নেতার কথায় আমরা যুদ্ধে গিয়েছি, যাঁর প্রাণ রক্ষার জন্য আমরা কোটি কোটি বাঙালি ১৯৭১-এ নামাজ পড়েছি, প্রার্থনা করেছি, সেই নেতা যখন নিহত হন, আমরা কেউ প্রতিবাদ করিনি, বাইরে এসে বিক্ষোভ করিনি। আমাদের মাঝে অনেকে আছেন যাঁরা বঙ্গবন্ধুর গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। অথচ পরবর্তীকালে এই ব্যক্তিরাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরোধিতা করেছেন এবং তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের শুনতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কু-রটনা। তিনি নাকি ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যারা এই সব কথা বলে বেড়ায় তাদের অতীত পর্যবেক্ষণ করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তারা পাকিস্তানকে ভুলতে পারেনি। যেমন, ওই বিএনপিভুক্ত প্রাগুক্ত সামরিক কর্মকর্তার কথাই ধরা যাক। তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মানতে রাজি নন। তাতে আপনার-আমার কিছু যায়-আসে না। তবে ওই ব্যক্তির মনমানসিকতাটা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। এবং এই শ্রেণীর মানুষই ১৯৭৫-এর পরবর্তী সময়ে এই বাংলাদেশে লাভবান হয়েছেন। যেমন লাভবান হয়েছেন ওই সকল বাঙালি, যাঁরা ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনে চাকরি করেছেন এবং পরে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু ভক্ত হয়েছেন এবং আরও পরে শেখ হাসিনার কাছে ভিড়েছেন অনায়াসে।
কিন্তু তাঁদেরই বা আমরা দোষারোপ করব কেন? আমি, আপনি, আমরা সবাই তো একই অপরাধে অপরাধী। আমরা সবাই তো বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখেছি, তাঁর কথা শুনেছি, তাঁকে শ্রদ্ধা করেছি। সেই আমরাই কী করে ওই সব মানুষের পক্ষে কথা বলেছি, যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে? জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া—তাঁদের তো বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে রাজনীতি করার কথা। সেটা তাঁরা করেননি। তাঁরা জাতির পিতার হত্যাকারীদের সব সময় সর্বোতভাবে রক্ষা করেছেন। আজ যখন মওদুদ আহমদ পুলকিত হয়ে প্রশ্ন করেন যে ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর পরিণতি কী হয়েছিল, তখন তাঁকে কেউ পাল্টা প্রশ্ন করে না কেন যে সেই সংশোধনী তো আপনাদেরই মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল? আর সেই হত্যাযজ্ঞ তো আমাদের গোটা জীবনকে তছনছ করে রেখে দিল।
কথা শেষ হওয়ার নয়। আমরা কি ওই সাংবাদিকদের কথা বলি যারা আজ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে যান যত্রতত্র? একদা তো ওরাই বাকশালে যোগদান করার জন্য বঙ্গবন্ধুর সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন। এমনও সাংবাদিক আছেন যাঁরা গভীর রাতে রাজধানীর বাইরে থেকে মুরগি বোঝাই ট্রাকে চেপে ঢাকায় এসেছেন বঙ্গবন্ধুকে দেখাতে যে তাঁরা তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের অনুসারী। তাঁরা আমাদের মাঝেই রয়েছেন। আমরা তাঁদের সঙ্গে ওঠা-বসা করি, এক টেবিলে বসে খাই। এই লজ্জা তো আমাদেরই। আর ওই যে সাংবাদিক, যিনি ১৯৭৫-এর নভেম্বরে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তিনি তো পরবর্তীকালে অনেক উন্নতি করেছেন, তাঁকে কি আমরা কখনো প্রশ্ন করেছি তাঁর সেই ভূমিকার বিষয়ে?
আজ আমাদের সকলের জন্য অনুতাপের দিন, প্রায়শ্চিত্ত করার দিন। পিতাকে হত্যা করে কোনো পরিবার প্রশান্তি লাভ করে না, জাতির মুক্তিদাতাকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করলে জাতির জীবনে আঁধার কেবল ঘনীভূত হতে থাকে, এই সত্য মেনে নেওয়ার দিন আজ। আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার সময় এসেছে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় হয়েছে। আমাদের সন্তুষ্টির যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা এবং তারা যে দেশেরই হোক না কেন, কোনো দিন সফল হয় না। হ্যাঁ, তারা বড় মাপের মানুষদের মেরে ফেলতে পারে। রাষ্ট্রকে বিকল করে দিতে পারে কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু তারা ইতিহাসে কখনো কোনো শীর্ষস্থান পায় না। জাতির জনকের হত্যাকারীরা আজ ঘৃণিত নামমাত্র। খন্দকার মোশতাকের কথা মানুষ মনে করে একজন হত্যাকারীর রূপে। যারা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করল তারা ওই খুনি হিসেবেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই জগতের ইতিহাসে চিহ্নিত থাকবে। এবং যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার ফায়দাটা লুটেছেন, তাঁরাও ধিকৃত মানুষ বলে গণ্য হবেন।
এই সবই সত্য। সবই বাস্তব। কিন্তু আরও বাস্তবতা রয়েছে। একটি হলো অতি সহজ একটা সত্য। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতি হিসেবে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করেছিলাম? আজ আমরা হরহামেশাই বঙ্গবন্ধুর কথা বলি। এমন ব্যক্তিও আছেন যাঁদের কথা শুনলে মনে হয় তাঁরা কোনো একসময় বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন। কে কত গভীরভাবে বঙ্গবন্ধুকে চিনেছে, কত গভীরভাবে তাঁর রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে, এই কথা প্রায়ই আমরা শুনে থাকি। বিশেষ করে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ওই সকল সাবেক কূটনীতিকের কথা, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বছরের পর বছর দেশের বিভিন্ন বঙ্গবন্ধুবিরোধী সরকারের চাকরি করেছেন এবং কতভাবে নিজেদের উন্নতি সাধন করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। অথচ তাঁদেরই কয়েকজন সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু শুনেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে তাঁদের কেউ কেউ ওই সকল কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয়েছেন, যাঁদের কাছে কখনো বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি পাওয়া গেছে। এমন রাষ্ট্রদূতও ছিলেন যাঁরা বিদেশে সফররত দেশি সামরিক শাসককে খুশি করার জন্য সেই শাসকের হোটেলের কক্ষের সম্মুখে সুইমিং পুলে সাঁতার কেটেছেন এবং সেই শাসকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। আবার কোনো এক প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে বিদেশে তাঁর অবস্থানকালে তাঁর হোটেলকক্ষে জুতার দোকান সাজিয়ে বসেছেন। কেননা সেই প্রধানমন্ত্রী একজোড়া বিদেশি জুতা ক্রয় করার খায়েশ ব্যক্ত করেছিলেন।
এই ধরনের অনেক কথা, অনেক গল্প আপনি শুনতে পাবেন। যে সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে পারেননি, তিনিই আবার পরপর দুই সামরিক শাসকের আমলে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা সব সময়ই বলে থাকেন। জেনারেল ওসমানী, যিনি চতুর্থ সংশোধনীর প্রতিবাদ করে জাতীয় সংসদ ত্যাগ করেন এই বলে যে তিনি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মেনে নিতে পারেন না, সেই জেনারেল ওসমানিই খন্দকার মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হয়ে প্রায় তিন মাস বঙ্গভবনে কর্মরত ছিলেন। আমাদের কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যাতে আমরা ধরে নিতে পারি, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কী কারণ ছিল ওসমানীর ওই খুনিদের সঙ্গে যাওয়ার? যে মোশতাকের আমন্ত্রন সরকারে যোগ দেয়ার জন্য ঘৃণা ভরে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই মোশতাকের সঙ্গে জেনারেল ওসমানী কেন যোগদান করলেন? দেশে তো সেই ১৫ আগস্টের পরও সাহসী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের চার নেতা খুনিদের সামনে মাথা নত করেননি। তাঁদের কারাগারে নেওয়া হয়। কখনো কি ওসমানী মোশতাকের কাছে দাবি করেছিলেন, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হোক? ওই চারজন কারাগারে নিহত হলেন। কেউই তাঁদের রক্ষা করতে পারলেন না। সবচেয়ে অনুতাপের বিষয় হলো, এই জেনারেল ওসমানীই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক দলের পক্ষে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করেন। মাজার জিয়ারতটি কি ১৫ আগস্টের অব্যবহিত পরপরই করা যেত না?
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। যে নেতার কথায় আমরা যুদ্ধে গিয়েছি, যাঁর প্রাণ রক্ষার জন্য আমরা কোটি কোটি বাঙালি ১৯৭১-এ নামাজ পড়েছি, প্রার্থনা করেছি, সেই নেতা যখন নিহত হন, আমরা কেউ প্রতিবাদ করিনি, বাইরে এসে বিক্ষোভ করিনি। আমাদের মাঝে অনেকে আছেন যাঁরা বঙ্গবন্ধুর গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। অথচ পরবর্তীকালে এই ব্যক্তিরাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরোধিতা করেছেন এবং তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের শুনতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কু-রটনা। তিনি নাকি ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যারা এই সব কথা বলে বেড়ায় তাদের অতীত পর্যবেক্ষণ করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তারা পাকিস্তানকে ভুলতে পারেনি। যেমন, ওই বিএনপিভুক্ত প্রাগুক্ত সামরিক কর্মকর্তার কথাই ধরা যাক। তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক মানতে রাজি নন। তাতে আপনার-আমার কিছু যায়-আসে না। তবে ওই ব্যক্তির মনমানসিকতাটা আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। এবং এই শ্রেণীর মানুষই ১৯৭৫-এর পরবর্তী সময়ে এই বাংলাদেশে লাভবান হয়েছেন। যেমন লাভবান হয়েছেন ওই সকল বাঙালি, যাঁরা ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনে চাকরি করেছেন এবং পরে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু ভক্ত হয়েছেন এবং আরও পরে শেখ হাসিনার কাছে ভিড়েছেন অনায়াসে।
কিন্তু তাঁদেরই বা আমরা দোষারোপ করব কেন? আমি, আপনি, আমরা সবাই তো একই অপরাধে অপরাধী। আমরা সবাই তো বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখেছি, তাঁর কথা শুনেছি, তাঁকে শ্রদ্ধা করেছি। সেই আমরাই কী করে ওই সব মানুষের পক্ষে কথা বলেছি, যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে? জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া—তাঁদের তো বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে রাজনীতি করার কথা। সেটা তাঁরা করেননি। তাঁরা জাতির পিতার হত্যাকারীদের সব সময় সর্বোতভাবে রক্ষা করেছেন। আজ যখন মওদুদ আহমদ পুলকিত হয়ে প্রশ্ন করেন যে ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর পরিণতি কী হয়েছিল, তখন তাঁকে কেউ পাল্টা প্রশ্ন করে না কেন যে সেই সংশোধনী তো আপনাদেরই মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল? আর সেই হত্যাযজ্ঞ তো আমাদের গোটা জীবনকে তছনছ করে রেখে দিল।
কথা শেষ হওয়ার নয়। আমরা কি ওই সাংবাদিকদের কথা বলি যারা আজ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে যান যত্রতত্র? একদা তো ওরাই বাকশালে যোগদান করার জন্য বঙ্গবন্ধুর সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন। এমনও সাংবাদিক আছেন যাঁরা গভীর রাতে রাজধানীর বাইরে থেকে মুরগি বোঝাই ট্রাকে চেপে ঢাকায় এসেছেন বঙ্গবন্ধুকে দেখাতে যে তাঁরা তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের অনুসারী। তাঁরা আমাদের মাঝেই রয়েছেন। আমরা তাঁদের সঙ্গে ওঠা-বসা করি, এক টেবিলে বসে খাই। এই লজ্জা তো আমাদেরই। আর ওই যে সাংবাদিক, যিনি ১৯৭৫-এর নভেম্বরে তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তিনি তো পরবর্তীকালে অনেক উন্নতি করেছেন, তাঁকে কি আমরা কখনো প্রশ্ন করেছি তাঁর সেই ভূমিকার বিষয়ে?
আজ আমাদের সকলের জন্য অনুতাপের দিন, প্রায়শ্চিত্ত করার দিন। পিতাকে হত্যা করে কোনো পরিবার প্রশান্তি লাভ করে না, জাতির মুক্তিদাতাকে সপরিবারে নিশ্চিহ্ন করলে জাতির জীবনে আঁধার কেবল ঘনীভূত হতে থাকে, এই সত্য মেনে নেওয়ার দিন আজ। আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করার সময় এসেছে।
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments