যেভাবে বরগুনার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো এমপিপুত্র সুনাম
বরগুনার গডফাদার, তিনিই ছিলেন এখানকার অপরাধ জগতের আসল নায়ক। বরগুনা জেলা জুড়ে বিশাল ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীও ছিলেন সুনাম দেবনাথ। গত ১৫ বছরে বাবার ছত্রছায়া ও দাপটে সুনাম দেবনাথ হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজে গড়ে তুলেন বিশাল সাম্রাজ্য। তার এই সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন। মাদক বাণিজ্য করে অবৈধভাবে কামাই করে বনে যান শত শত কোটি টাকার মালিক। ক্ষমতার দাপট আর ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেতো না এলাকাবাসী।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও প্রতি বিপ্লবের ষড়যন্ত্রে শহরে বিশাল মিছিল ও সমাবেশের নেতৃত্বে ছিলেন এই সুনাম দেবনাথ। জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবিরের গ্রেপ্তারের পরই গাঢাকা দেন সুনাম। গোয়েন্দা বিভাগ ও দুদক থেকে শম্ভু এবং সুনামের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধানে নামলে বরগুনার এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পিতা-পুত্র আত্মগোপনে চলে যান। সম্প্রতি পিতা শম্ভু ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়। পুত্র সুনাম দেবনাথ এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এক যুগ সময় ধরে বরগুনার উপকূল ও নদীপথে মাদকসহ বিভিন্ন চোরাচালানের রুট হিসেবে গড়ে ওঠে। কক্সবাজার, টেকনাফ, চট্টগ্রাম রুটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি বেড়ে উঠলে নিরাপদ তালতলীর সমুদ্র সৈকত শুভ সন্ধ্যা, টেংরাগিরি সৈকত, মরানিদ্রা, নিদ্রা, ফকিরহাট মৎস্য বন্দর, বরগুনার সোনাতলা, বাবুগঞ্জ, নলী, পালের বালিয়াতলী, ছোনবুনিয়া, চালিতাতলী ও গোলবুনিয়াসহ নদী পাড়ের এলাকাগুলো রুট হিসেবে বেছে নেয় মাদক কারবারি ও চোরাকারবারিরা।
আর এ সুযোগে অপরাধ জগতের সব নিয়ন্ত্রণ নেয় সংসদ সদস্য শম্ভু ও তার পুত্র। মাদক ও চোরাকারবারিদের যুবরাজ সুনাম দেবনাথ কামিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করতেন তার বৌয়ের চাচাতো ভাই শাওন তালুকদার ও শীর্ষ সন্ত্রাসী অভিজিৎ তালুকদার এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সিন্ডিকেটের অন্যতম ডান হাত ছিল। ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে ছিল বৌয়ের আপন ভাই রনি তালুকদার। এ ছাড়া মাদক ব্যবসায় ও কিশোর গ্যাংয়ে ছিল সানি, ড্যাফোডিল প্রিন্স, কবি আসাদ, অয়ন মীর, তারাকান্দার রাজু, মাহাবুব, হিমেল, শিবা, প্রত্যয়, প্রান্ত, চোরা রাজীবের ভাই সোহেল, হাত কাটা জাহাঙ্গীর, শুভ খান, জিন্নাত খান, মনির, রাজা মেম্বার ও জাহিদুল ইসলাম সুমন।
বরগুনার মাদক ও চোরাচালানের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করতো সুনাম দেবনাথ। কিশোর গ্যাং ও ছাত্রলীগের একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো সে। ২০১৯ সালে চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড ও কিশোর গ্যাং লিডার নয়ন বন্ডের ক্রসফায়ার ঘটনা ছিল মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। নিহত রিফাত শরীফ ও নয়ন বন্ড মূলত ছিল তার সাম্রাজ্যের অনুসারী। ক্রসফায়ারে নিহত নয়ন বন্ড তার ছত্রছায়ায় থেকেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতো আর রিফাত শরীফ তার ডান হাত মঞ্জুরুল আলম জনের হয়ে কাজ করতো। এ নিয়ে তৎকালীন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রুবাইয়াত আদনান অনিক সুনাম দেবনাথের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে গণমাধ্যমের কাছে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বরগুনায় মাদকটা চালায় কে? মাদকের পেছনে কে জড়িত? নয়ন বন্ড কার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এতদূর এসেছে? বরগুনার রাজনীতিতে শম্ভু ও তার পুত্রের প্রভাবশালী হতে তাদের মতাদর্শের বাইরের নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে দলের বাইরে ও কর্মকাণ্ডে বিচ্ছিন্ন করে রাখতো।
ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার ছেলের এসব অপরাধের বিচার চেয়েছেন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌশিকুর রহমান ইমরান। ইমরান বলেন, বরগুনার সব অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সাবেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার ছেলে সুনাম জড়িত ছিল। তাদের কারণে আওয়ামী লীগ বরগুনায় কলঙ্কিত। বরগুনায় আওয়ামী লীগের দুর্গ হওয়া সত্ত্ব্বেও নৌকা পরাজিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধাচারণ। দুর্নীতি আর লুটপাট করে শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ায় আমাদের মতন সাধারণ নেতাকর্মীদের আড়ালে থাকতে হচ্ছে এদের কারণে।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা বিএনপি’র সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হুমায়ুন হাসান শাহীন বলেন, সুনাম দেবনাথ ছিল মাদকের গডফাদার। তার বাবার ক্ষমতায় বরগুনার যুবসমাজের মধ্যে মাদক ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করে হত্যাকাণ্ডের মতো অনেক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড এই মাদক নিয়েই সংঘটিত হয়েছে। আমরা এ ধরনের সব অপরাধের জন্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার ছেলে সুনাম দেবনাথসহ সব অপরাধীর বিচার দেখতে চাই।
No comments