এক মামলায় ৫৩ সাবেক সচিব আসামি: বাদী বললেন ক্ষোভ থেকে মামলা করেছি by শুভ্র দেব

সাবেক ৫৩ সচিবের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচনায় জামাল হোসেন খান রিপন (৫১)। এক সময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সরকারি তিতুমীর কলেজ ছাত্র সংসদের জিএসও ছিলেন। ’৯০-এর আন্দোলনে ছাত্র ঐক্যের নেতা ছিলেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তিনি। জিয়া ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পারিবারিক ফার্নিচার ব্যবসার ও ঠিকাদারি করেন। এ ছাড়াও তিনি সামাজিক ও সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল বলেও দাবি করেছেন। তার তিন মেয়েও আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামল নিয়ে তার অনেক ক্ষোভ রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাবেক সচিবদের প্রতি তিনি বেশি ক্ষিপ্ত। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তারা মেয়াদ বাড়িয়ে চাকরিতে অবস্থান, দুর্নীতি, বিভিন্ন দেশের এজেন্ট হিসাবে কাজ করাসহ নানা কারণেই এই ক্ষোভ। ক্ষোভ থেকেই মেয়েকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় মামলা করেছেন। বলেছেন, কে শাস্তি পাবে জানি না, ক্ষোভ থেকেই মামলা করেছি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন থানায় শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী,  পুলিশ সদস্য, আমলাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা  হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে সাবেক কয়েকজন সচিবকে আসামি করা হয়েছে। তবে এর আগে এক মামলায় ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করা হয়নি। মামলায় কেন তিনি এত সাবেক সচিবকে আসামি করেছেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গতকাল মানবজমিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জামাল হোসেন খান বলেন, এবারের আন্দোলনটি ছিল দীর্ঘ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বিগত তিনটি নির্বাচন চোখের পলকে হয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদের একটা শক্তি দেশে দাঁড়িয়েছিল। আমার তিন মেয়ে। সবাই আন্দোলনে ছিল। আমিও ছিলাম।  ছোট মেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ৫টি গুলি লেগেছে তার শরীরে। দুইটা গুলি বের করা হয়েছে। তিনটা এখনো আছে। ফ্যাসিবাদ শব্দের সঙ্গে আমরা সেভাবে পরিচিত ছিলাম না। ফ্যাসিবাদের কারণে প্রশাসন, পুলিশ, আইন আদালত, মিডিয়া, স্কুল-কলেজ কিংবা ব্যবসার জায়গাগুলোতে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি বিগত দিনে। আমলাদের চাকরি শেষ তবুও ২/৪ বছর এক্সটেনশন করে চাকরি করেছে। অনেক ক্ষমতাবান তারা। আমলাতান্ত্রিকতার দিকে সরকার ঝুঁকেছে ২০১৪ সাল থেকে। আমরা দেখেছি আমলারা কীভাবে ক্ষমতাবান হয়ে যাচ্ছে। এমপি নির্বাচন করে মন্ত্রী হয়ে যায়। এরকম একটা ট্রেডিশন তৈরি হয়েছিল। এসব থেকে আমার মাঝে ক্ষোভ জন্মায়। তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নাই। আদালত যদি এগুলো আমলে আনে তবে পরবর্তী প্রজন্ম উপকৃত হবে। আর কোনো আমলা যেন দলীয়ভাবে এগ্রেসিভ না হয়। তারা যেন তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজটাই করে।

জামাল বলেন, আমার মেয়ে সামিয়া খান হৃদি। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মেজো মেয়ে একই স্কুলের এইচএসসি’র শিক্ষার্থী। আর বড় মেয়ে নাফিসা খান মুন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ তৃতীয় বর্ষে পড়ে। ১৮ তারিখে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের বের করে দেয় তখন সন্তানদের আর ঘরে রাখতে পারিনি। তাদের বড় ভাই, আপুরা বা সমবয়সীরা যখন আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তখন তারা আর ঘরে থাকেনি। একসময় তো আন্দোলন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা যখন ছাত্রলীগের হামলার কারণে আহত হয় তখনই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জোড়ালো ভূমিকা নেয়। আমরা অভিভাবক অথচ তারা আমাদের যেসব কথাবার্তা বলেছে সেসব শুনে আমরাও আন্দোলনে না গিয়ে থাকতে পারিনি। বনশ্রী এলাকায় অনেক টর্চার হয়েছে। না দেখলে বুঝানো যাবে না। এলোপাতাড়ি গুলি করেছে। এসব গুলিতে আমার মেয়ে আহত হয়েছে।  

যেখানে গণহত্যা মামলায় আসামিরা যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য প্রমাণ ও আলামতের অভাবে শাস্তির আওতায় আসবে কিনা এ নিয়ে সংশয় রয়েছে, এক্ষেত্রে হত্যাচেষ্টা মামলায় সাবেক সচিবদের আসামি করা হয়েছে। এই মামলার ভবিষ্যত ও আসামিদের শাস্তির বিষয়ে তিনি বলেন, মামলা টিকবে কিনা এটা আদালতের বিষয় এবং দীর্ঘসূত্রিতা আছে। বিচারের প্রত্যাশা আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আমরা জানি এদেশে বিচারের সংস্কৃতিটা এখনো গড়ে উঠে নাই। তবে যদি হয়! আমরা যেরকমটা স্বপ্ন দেখছি। আমাদের দেশটা ঘুরে দাঁড়াবে। সত্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে। স্বাধীনতার এত বছরে আমরা কিছুই পাইনি। প্রশাসনের লোকজন যদি ভালো হয়। রায় কি হবে আর কে শাস্তি পাবে তার চিন্তা করিনি। ডকুমেন্টারি থাকলো যাতে শাস্তির আওতায় আসতে পারে।

মামলায় সাবেক আমলাদের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট কেন বলা হলো এ নিয়ে তিনি বলেন, এটা বলার কারণ হলো সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেগুলো দ্রুত পাসিং হয়ে যায়। রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে আমলারা শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সরকারের আচরণেও এসব বোঝা যেত। আমাদের সচিবরা পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিং নিচ্ছে। একদিনে হয়নি জুলাই বিপ্লবটা। এটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন অনিয়ম থেকে জন্ম নেয়।

মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হয়েছে কিনা এ নিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি এরকম না। যারা ফ্যাসিবাদের দোসর হয়ে কাজ করেছে তাদেরকেই আসামি করা হয়েছে। আরও কয়েকজন ছিল তারা বাদ পড়ে গেছে। মিডিয়া সেক্টরের কিছু ব্যক্তির নাম বাদ পড়ে গেছে। তারাও ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে।  মেয়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বলেন, আমার মেয়ের পায়ের হাড়ের সঙ্গে গুলি লেগে আছে।  মেয়েটা পা ভাঁজ করতে পারে না। দেশের বাইরে কোথাও নিয়ে চিকিৎসা করানোর ইচ্ছা আছে। সিএমএইচ বলেছে, তিন মাস পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে অপারেশনের অবস্থায় আছে কিনা। মামলার তদন্ত নিয়ে জামান বলেন, ঘটনার প্রায় তিন মাস পর তিনি প্রথমে বাড্ডা থানায় মামলা করতে যান। থানা থেকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর তিনি সিএমএম আদালতে মামলা করেছেন। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) এ মামলা তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। এখনো তদন্ত শুরু হয়নি। এসপিকে ফোন দিয়েছিলাম। বললেন, তদন্ত কর্মকর্তা কিছুদিন পর যোগাযোগ করবে।

এর আগে ২৯শে অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা করেন জামান হোসেন খান। মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৯৬ জনকে। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যসহ আরও ২০০/৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় তিনি সাবেক সচিবদের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট, দুর্নীতিবাজ, ফ্যাসিস্টের সহযোগী, রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, আব্দুস সোবহান সিকদার, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। সাবেক অন্য সচিবদের মধ্যে রয়েছেন মোজাম্মেল হক খান, জুয়েনা আজিজ, ফরিদ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, হেলালুদ্দীন আহমেদ, ফয়েজ আহমেদ, সাজ্জাদুল হাসান, সালাহ উদ্দিন, লোকমান হোসেন মিয়া, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মান্নান হাওলাদার, আবু হেনা মোরশেদ জামান, ওয়াহিদা আক্তার, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী, মহিবুল হক, উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত, জাহাংগীর আলম, এম এ এন সিদ্দিক, শাহজাহান আলী মোল্লা, শ্যামল কান্তি ঘোষ, ইকবাল খান চৌধুরী, মরতুজা আহমেদ, খন্দকার শওকত হোসেন, নিয়াজ উদ্দিন মিয়া, জাফর আহম্মদ খান, বরুণ দেব মিত্র, এম আসলাম আলম, রফিকুল ইসলাম, চৌধুরী মো. বাবুল হাসান, সুরাইয়া বেগম, নজরুল ইসলাম খান, শহীদউল্লা খন্দকার, আব্দুল মালেক, জিল্লার রহমান, ইবরাহীম হোসেইন খান, সম্পদ বড়ুয়া, পবন চৌধুরী, অপরূপ চৌধুরী, সামছুদ্দিন আজাদ চৌধুরী, আক্তারী মমতাজ, শাহ কামাল ও প্রশান্ত কুমার রায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন আহম্মেদ। মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম, সাবেক সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, পিএসসি’র সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। ইসি সচিবালয়ের বর্তমান অতিরিক্ত সচিব ফরহাদ আহম্মদ খান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি, সাবেক যুগ্ম সচিব আবুল কাশেম ও মোহাম্মদ আবদুল বাতেন এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের এনআইডি শাখার সাবেক পরিচালক ফরহাদ হোসেন। মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক একজন প্রধান বিচারপতি, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যান, পুলিশের সাবেক আইজিপি, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক তথ্য ও সমপ্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহ্‌মেদ, যুবলীগের সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক দুই মেয়র আতিকুল ইসলাম ও শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব বিপ্লব বড়ুয়া, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনসহ কয়েকজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে তিনজন সাংবাদিক নেতাও রয়েছেন। তারা হলেন- ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মোজাম্মেল বাবু ও নঈম নিজাম।

মামলার এজাহারে বাদী জামাল হোসেন খান উল্লেখ করেছেন, তার মেয়ে সামিয়া খান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ৫ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যোগ দিতে সামিয়া আফতাবনগরে ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যায়। সেখানে ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল। ছাত্র-জনতার মিছিল চলার সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে থাকে। এ সময় সামিয়া গুলিবিদ্ধ হয়। তার পায়ে এখনো তিনটি গুলি রয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.