কান্না থামছে না রাকিবের পরিবারে by ফাহিমা আক্তার সুমি

রাকিব হোসেন। তেইশ বছরের এই যুবক গত ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর রামপুরা ব্রিজের উপরে গুলিবিদ্ধ হন।  গুলিটি তার পেটে লাগে। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পরিবারের সঙ্গে ঢাকার আফতাব নগরে থাকতেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে রাকিব ছিলেন বড়। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন তিনি। রাকিব আফতাব নগরে পাওয়ার গ্রিডের আউটসোর্সিং-এ পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং। তার বাবা চান মিয়া বেশকিছু দিন আগে স্ট্রোক করেন। এরপর থেকে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছেন। তার মা হাসি আক্তার পাওয়ার গ্রিডের আউটসোর্সিং-এ অফিস অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত। যা আয় হতো সেটি দিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করতেন। রাকিব মারা যাওয়ার দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও পরিবারে এখনো থামছে না কান্না। সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে পরিবারটি।

রাকিবের মা হাসি আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে বলেন, সন্তান হারানোর কষ্ট তো একমাত্র মা-ই জানে। যার সন্তান যায় সেই বুঝে সন্তান কী। আমি মারা গেলে আমার কবরে কে মাটি দিবে? আমার রাকিব তো একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। এখন বাসা থেকে যখন কাজে বের হই তখন মনে হয় আমার পেছন থেকে মা বলে ডাকছে রাকিব। আমি আর রাকিব একসঙ্গে দু’জন একই অফিসে কাজ করতাম। অফিসে গিয়ে মা-ছেলে মিলে দুপুরে একসঙ্গে ভাত খেতাম। কতো স্মৃতি আছে আমার রাকিবের সঙ্গে। এখনো এক মুহূর্ত ঘুমাতে পারি না সব সময় রাকিবের মুখটি সামনে ভাসে। আমার কাছে এখনো মনে হয় না যে, রাকিব নেই। বাসায় এসে আমাকে না দেখলে ওর বোনকে বলতো, ‘আম্মু কইরে।’ যেদিন মারা যায় তার আগের রাতে একসঙ্গে খাবার খেয়েছিলাম। আমার বড় মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট মেয়েটার বয়স মাত্র ১৪ বছর। সারাক্ষণ ওর ভাইকে নিয়ে থাকতো। ভাই মারা যাওয়ার পর মেয়েটি কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে। প্রায়ই ভাইয়ের জন্য কাঁদতে থাকে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ঘটনার দিন সকালে ওর মধ্যে অনেক অস্থিরতা ছিল, কোনোমতে অল্প কিছু ভাত খেয়ে বাইরে দৌড়ে চলে যায়। ওইদিন খাওয়ার সময় আমি রাকিবের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। এখনো রাকিবের কথা মনে পড়লে, ওর জিনিসপত্র দেখলে বুকের মধ্যে ব্যথা হয়। কী করে ভুলে থাকবো আমার ছেলেটিকে।

তিনি বলেন, আমি আফতাব নগরে পাওয়ার গ্রিডের আউটসোর্সিং-এ অফিস অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করি। আমার রাকিবকেও সেখানে ক্লিনার হিসেবে কাজে দিয়েছিলাম। আমরা ছোটবেলা থেকেই ঢাকাতে থাকি। আমার বাবা ঢাকায় রিকশা চালাতেন। আমার স্বামী বাটা স্কয়ারের ব্যবসা করতো। সে হঠাৎ স্ট্রোক করার পর থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে, কাউকে চিনতে পারে না। আমার ছেলে আগে থেকেই আন্দোলনে গিয়েছিল সেটি আমি জানতাম না। বৃহস্পতিবার এদিকের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল। রাকিব আমাকে ফোন দিয়ে বলে মা আপনি বাইরে ও ছাদে যাবেন না- বাইরের অবস্থা খুবই খারাপ। আমিও তাকে অফিস থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম। রাকিব তো আর ফিরে আসবে না কিন্তু ওকে তো ভুলতে পারছি না। একমাত্র ছেলে সন্তানকে নিয়ে অনেক আশা ছিল। আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সংসারের অভাবের কারণে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেনি। অনেক ছোটবেলা থেকেই ও কাজে যোগ দেয়। ওর অনেক ইচ্ছা ছিল ছোট বোনটিকে লেখাপড়া করাবে। ছোট মেয়েটা মাদ্রাসায় পড়তো রাকিব মারা যাওয়ার পর আর যায় না। আমি আর রাকিব মিলে সংসারের খরচ চালাতাম। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় রাকিবের স্মৃতি।

রাকিবের বোনের স্বামী নূর আলম বলেন, ১৯শে জুলাই শুক্রবার রাকিব গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ১০-১৫ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। এর আগে আমি কাজ করে বাসায় ফেরার পথে বৃহস্পতিবার তাকে রামপুরা ব্রিজের উপর থেকে বাসায় নিয়ে আসি। শুক্রবার সকালের দিকে খবর আসে রামপুরা ব্রিজে থাকাকালীন তার গায়ে গুলি লেগেছে। গুলিটি তার পেটে লাগে। প্রথমে আহত অবস্থায় সেখানে থাকা লোকজন উদ্ধার করে তাকে আফতাব নগর নাগরিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে আমরা খবর পেয়ে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পরে ওইদিন তেমন কোনো চিকিৎসা হয়নি। পরের দিন মারা যায়। রাকিবের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় থাকে পরিবারের সঙ্গে। অভাবের কারণে বেশিদূর পড়াশোনা করাতে পারি নি। রাকিবরা তিন ভাই- বোন। ওর বাবা স্ট্রোকের পর দীর্ঘদিন ধরে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছেন। রাকিবকে হারিয়ে তার মা পাগলপ্রায়।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.