ঈদ সেলামির নামে চাঁদাবাজির মচ্ছব by শুভ্র দেব
ঈদ
সেলামির নামে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। বেপরোয়া
চাঁদাবাজিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চাঁদা দিতে চাইছেন না এমন
ব্যবসায়ীদের দেয়া হয় নানা হুমকি-ধমকি। কোথাও কোথাও দেখানো হচ্ছে অস্ত্রের
ভয়ভীতি। তাই বাধ্য হয়ে অনেক ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যান্য
বছরের মত এবারও ঈদকে ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজদের বিভিন্ন গ্রুপ।
রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের নামে উঠানো হচ্ছে চাঁদা। এছাড়া
দণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি ও পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙ্গিয়ে হচ্ছে
চাঁদাবাজি।
নিয়মিত চাঁদাবাজদের পাশাপাশি সক্রিয় হয়েছেন মৌসুমি চাঁদাবাজরা।
ইফতার মাহফিল, জাকাতের কাপড় কেনা, ঈদ সেলামি, ঈদ বকশিস, সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে কোথাও কোথাও।
গত কয়েকদিন সরজমিন রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেইট বাজার, মালিবাগ সুপার মার্কেট, মালিবাগ বাজার, মৌচাক, ফরচুন সুপার মার্কেট, আনারকলি মার্কেট, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চাঁদনীচক, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইসলামপুর কাপড় বাজার, কেরানীগঞ্জ কাপড় বাজার, এছাড়া মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, টঙ্গী, পুরাণ ঢাকার একাধিক মার্কেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ আরো একাধিক এলাকার মার্কেটের ব্যবসায়ী ও মতিঝিল, গুলিস্তান, হলিডে মার্কেট, ফার্মগেট, উত্তরা, বিমানবন্দর, মিরপুর, শেরেবাংলানগর, নিউমার্কেটসহ আরো কিছু এলাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে চাঁদাবাজির তথ্য।
মালিবাগ এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন বলেন, বলার কিছুই নাই। বিভিন্ন সংগঠনকে চাঁদা দেয়ার বাজেট আলাদাভাবে রাখতে হয়। কাউকে না বলার উপায় নাই। বিক্রি সব সময় ভাল হয় না। কিন্তু তাদের দাবিকৃত টাকা দিতে হয়। না হলে হেনস্থার শিকার হতে হয়। দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের হাট ইসলামপুর। প্রতি বছর সেখান থেকে কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু ইসলামপুরের যেসকল ব্যবসায়ীকে চাঁদা দিতে হয় তাদের কেউই মিডিয়ায় কথা বলতে রাজি হন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন ব্যবসায়ী বলেন, বাপ দাদার ব্যবসা।
এই ব্যবসা দিয়েই পরিবারের রুটি-রুজি চলে। এ ব্যবসা ছাড়ারও উপায় নাই। তাই তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এবছরও অনেক টাকা চাঁদা দিয়েছি। চকবাজারের এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের চেয়ে এবছর দ্বিগুণ চাঁদা দিয়েছি। গুলিস্তানের ব্যবসায়ী মুরাদ আলী বলেন, ব্যবসা করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বড় অংকের পুঁজি বিনিয়োগ করে কত টাকাই বা লাভ হয়। একদিকে কর্মচারির খরচ, দোকান ভাড়া, বিভিন্ন বিল তারপর এই লাভ থেকে পরিবারের খরচ চালাতে হয়। এর ওপর যদি চাঁদা দিতে হয় তো ব্যবসা করার কোন মানে হয়না। গাউছিয়া মার্কেটের ব্যবসীয় জুয়েল বলেন, এখন পর্যন্ত কত সংগঠন কত অজুহাতে যে আসছে তার ঠিক নাই। আরও অনেক আসবে। একেক সংগঠনের চাঁদার রেট একেক রকম।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারি হিসাবে রাজধানীতে প্রায় ১৪৭টি শপিংমল রয়েছে। বাস্তবে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। আর এসব শপিংমলে অন্তত লাখ খানেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। অভিজাত এলাকার ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় আরো বেশি টাকা।
সুত্র জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা তোলায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক একটু বেশি। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ আছেন কারাগারে। দেশ পলাতকের পাশাপাশি আবার অনেকেই গাঁ ডাকা দিয়ে আছেন। কিন্তু আড়ালে থেকেও তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভুমিকা পালন করছেন। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তোলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
শপিংমলের মত বাদ যায়নি ফুটপাতে চাঁদাবাজি। নামে বেনামে সংগঠনের নামে নিয়মিত চাঁদার পাশাপাশি তোলা হচ্ছে ইফতার ও ঈদ কেন্দ্রিক। চাঁদা না দিলেও ফুটপাতে বসে ব্যবসা করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনও অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সারাদেশের সিটি করপোরেশন, বন্দর, হাটবাজার ও জেলা-উপজেলার নিবন্ধনকৃত হকার আড়াই লাখ। এরমধ্যে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাতেই আছে প্রায় এক লাখের উপরে হকার। এর বাইরে অনিবন্ধিত ও মৌসুমী হকার আরো কয়েক লাখ। ঈদকে সামনে রেখে এসব হকারের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে শত কোটি টাকা। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রমজানের শুরু থেকেই ইফতার মাহফিলের নামে চাঁদাবাজি চলছে। আর ঈদ যত ঘনিয়ে চাঁদাবাজির রেটও বাড়ছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে বসেন হকার হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, ফুটপাতে বসে ব্যবসা করার জন্য প্রতিদিন একবার চাঁদা দিতে হয়। কিন্তু প্রতি বছর রমজান মাস আসলে নানা কিসিমের চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন সংগঠনকে।
যারা চাঁদা নিতে আসে তারা বিভিন্ন নেতাদের নাম বললে আর কিছু করার থাকে না। চাঁদা না দিলে ভয়ভীতিসহ খারাপ আচরণ করা হয়। করা হয় নানা হয়রানি। গুলিস্তানের সাইফুল বলেন, ব্যবসা হোক আর না হোক চাঁদার টাকা ঠিকই দিতে হয়। ছোট ব্যবসার জন্য সর্বনিম্ন ২০০ টাকা আর একটু ভাল ব্যবসা হলে কমপক্ষে ৫০০ টাকা নেয়া হয়। বায়তুল মোকারমের ফুটব্যবসায়ী সায়েম বলেন, চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করার উপায় নাই। মিরপুরের হকার আমিন বলেন, রমজান মাসে আলাদা বাজেট করে রাখতে হয়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারা যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ফুটপাত থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য প্রায় ৫ শতাধিক চাঁদাবাজ রয়েছেন। তারা লাইনম্যান নামে পরিচিত। নির্দিষ্ট পরিমান টাকার বিনিময়ে তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা উঠানোর কাজ করেন। তাদেরকে সহযোগীতা করেন স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি ও অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা। অনুসন্ধান ও সূত্রে জানা গেছে, নিউমার্কেট ও আশেপাশের এলাকায় চাঁদা তুলেন সাত্তার মোল্লা, ইব্রাহিম ইবু, নুর ইসলাম, বাচ্চু, রফিক, আমিনুল ইসলাম, মোর্শেদ, ইসমাঈল, সাইফুল ইসলাম। শেরেবাংলা নগর ও ফার্মগেট এলাকায় শাহআলম, জুতা মোবারক, শামসু, চুন্নু। জুরাইন ও পোস্তগোলায় চাঁদা তুলে হানিফ, সিরাজ ও খায়রুল। লালবাগে চান মিয়া, ফিরোজ ও আব্দুস সামাদ। যাত্রাবাড়িতে মান্নান, তোরাব আলী ও সোনা মিয়া। মিরপুরে-১ এ মিজান, বাদশা, জুয়েল ও আলী। ওসমানি উদ্যানে লম্বা শাহজাহান। শাহবাগে নুর ইসলাম, কালাম, ফজর আলী, আকাশ। গুলশানে হাকিম, কুড়িলে নুরুল আমিন, আব্দুর রহিম। মিরপুর-১১ শফিক, হানিফ, আব্দুল ওয়াদুদ। গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনে বাবুলসহ অন্যান্যরা। সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পাশের রাস্তায় জজ মিয়া। পুর্ব পাশের রাস্তায় সেলিম মিয়া। বায়তুল মোকাররমে কাদের, পটল, মুজিবুর, আবুুল হাসেম, সেকান্দার হায়াত, হারুন, খোকন, নসু ও তার সহযোগীরা।
গুলিস্তান খদ্দের মার্কেটের পুর্বে ভাগ্নে কাদের, আকতার, জাহাঙ্গীর, সালাম। একই মার্কেটের পশ্চিমে কাদের উত্তরে হান্নান। বিমান বন্দর এলাকায় বাবুল, জামাল, আকতার, ইব্রাহিম, মনির, উত্তরায় টিপু, নাসির হামিদ। মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে বাবুল ভুঁইয়া, মো. আলী, আবদুল গফুর। গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের রাস্তায় লম্বা হারুন, সহিদ, আমিন মিয়া। পশ্চিম পাশে কানা সিরাজ, ঢাকা ট্রেড সেন্টারের সামনে বিমল বাবু। জুতা পট্টিতে সালেক, জয়, বাবুল। গোলাপশাহ মাজারের দুই পাশে শাহীন ও বাবুল। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এলাকায় রতন, শিবলু, সাইফুল ও তার আরো কয়েকজন সহযোগী। মতিঝির আলিকোর সামনে সাদেক, সোনালি ব্যাংকের সামনে মকবুল, বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষিণ পাশে আজাদ, উত্তরপাশে হারুন, শাহীন। বক চত্বরে নুর ইসলাম, রুপালী ব্যাংক হেড অফিসের সামনে রাজু, বাবলু, অগ্রনি ব্যাংক হেড অফিসের সামনে মান্নান, জীবন বীমার সামনে কালা কাশেম, জাসদ অফিসের নিচে রনি।
বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য প্রতিটি ফুটপাতে আলাদা আলাদা লাইনম্যান আছে। তাদের চাঁদাবাজি ফরজ করতে তারা হকার ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠন করেছে। লাইনম্যানদের মধ্যে থেকে একজনকে সভাপতি ও আরেকজনকে সম্পাদক করা হয়েছে। তিনি বলেন, রমজানের শুরু থেকে চাঁদাবাজি চলছে। ঈদ যত সামনে আসবে ততই চাঁদার রেট বেড়ে যাবে। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে প্রতিদিন ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। চাঁদ রাত পর্যন্ত এই চাঁদাবাজি চলবে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা অনেক আন্দোলন করছি। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে একাধিক মামলা। কিন্তু তাদেরকে কখনই গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ তারা প্রত্যেকেই পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই কাজ করে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার পাশাপাশি পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিছু অসাধু চক্র। এই চক্রগুলো প্রতি বছর ঈদ কেন্দ্রিক দুর পাল্লার বিভিন্ন বাস থেকে চাঁদা উঠায়। ঈদ যাত্রা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু চাঁদাবাজরা রাজধানীতে প্রবেশ ও বাহির পথে চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ও ঢাকার টার্মিনাল গুলোতে প্রবেশকালে চাঁদা তোলা হয়। এর বাইরে খোদ ট্রাফিক পুলিশও কাগজপত্র চেক করার নামে চালকদের হয়রানী করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেক চালক। আবার দুর পাল্লার অনেক যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, এখনই চালকরা বাড়তি ভাড়া নেয়া শুরু করে দিয়েছে। বাড়তি ভাড়া নেয়ার কারণ জানতে চাইলেও তারা কোন সদুত্তর দিচ্ছেন না। তবে চালকরা জানিয়েছেন, তাদের খরচ বেড়েছে। ইঞ্জিন চালু করলেই একাধিক ঘাটে তাদেরকে টাকা দিতে হচ্ছে।
এদিকে, গত ২৬শে মে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মহাসড়কে চাঁদাবাজি রোধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি সড়ক ও মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের জন্য সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টসমূহে সিসিটিভি স্থাপন, ট্রাক, পিকআপ এবং পণ্যবাহী ট্রাকে যাত্রী পরিবহণ রোধ এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া মহাসড়কে যানবাহন না থামানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা বলেন, ঈদকে সামনে রেখে এক শ্রেণির অসাধু চক্র নানাভাবে চাঁদাবাজি করে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী এসময়টা একটু বেশি তৎপর থাকে। চাঁদাবাজির ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পুলিশ সদরদপ্তর থেকে সারা দেশের পুলিশবাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে তবে আমরা ব্যবস্থা নেব।
নিয়মিত চাঁদাবাজদের পাশাপাশি সক্রিয় হয়েছেন মৌসুমি চাঁদাবাজরা।
ইফতার মাহফিল, জাকাতের কাপড় কেনা, ঈদ সেলামি, ঈদ বকশিস, সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে কোথাও কোথাও।
গত কয়েকদিন সরজমিন রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেইট বাজার, মালিবাগ সুপার মার্কেট, মালিবাগ বাজার, মৌচাক, ফরচুন সুপার মার্কেট, আনারকলি মার্কেট, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চাঁদনীচক, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইসলামপুর কাপড় বাজার, কেরানীগঞ্জ কাপড় বাজার, এছাড়া মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, টঙ্গী, পুরাণ ঢাকার একাধিক মার্কেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ আরো একাধিক এলাকার মার্কেটের ব্যবসায়ী ও মতিঝিল, গুলিস্তান, হলিডে মার্কেট, ফার্মগেট, উত্তরা, বিমানবন্দর, মিরপুর, শেরেবাংলানগর, নিউমার্কেটসহ আরো কিছু এলাকার ফুটপাত ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে চাঁদাবাজির তথ্য।
মালিবাগ এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন বলেন, বলার কিছুই নাই। বিভিন্ন সংগঠনকে চাঁদা দেয়ার বাজেট আলাদাভাবে রাখতে হয়। কাউকে না বলার উপায় নাই। বিক্রি সব সময় ভাল হয় না। কিন্তু তাদের দাবিকৃত টাকা দিতে হয়। না হলে হেনস্থার শিকার হতে হয়। দেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের হাট ইসলামপুর। প্রতি বছর সেখান থেকে কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু ইসলামপুরের যেসকল ব্যবসায়ীকে চাঁদা দিতে হয় তাদের কেউই মিডিয়ায় কথা বলতে রাজি হন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন ব্যবসায়ী বলেন, বাপ দাদার ব্যবসা।
এই ব্যবসা দিয়েই পরিবারের রুটি-রুজি চলে। এ ব্যবসা ছাড়ারও উপায় নাই। তাই তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এবছরও অনেক টাকা চাঁদা দিয়েছি। চকবাজারের এক পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের চেয়ে এবছর দ্বিগুণ চাঁদা দিয়েছি। গুলিস্তানের ব্যবসায়ী মুরাদ আলী বলেন, ব্যবসা করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বড় অংকের পুঁজি বিনিয়োগ করে কত টাকাই বা লাভ হয়। একদিকে কর্মচারির খরচ, দোকান ভাড়া, বিভিন্ন বিল তারপর এই লাভ থেকে পরিবারের খরচ চালাতে হয়। এর ওপর যদি চাঁদা দিতে হয় তো ব্যবসা করার কোন মানে হয়না। গাউছিয়া মার্কেটের ব্যবসীয় জুয়েল বলেন, এখন পর্যন্ত কত সংগঠন কত অজুহাতে যে আসছে তার ঠিক নাই। আরও অনেক আসবে। একেক সংগঠনের চাঁদার রেট একেক রকম।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারি হিসাবে রাজধানীতে প্রায় ১৪৭টি শপিংমল রয়েছে। বাস্তবে এর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। আর এসব শপিংমলে অন্তত লাখ খানেক ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। এসব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। অভিজাত এলাকার ব্যবসায়ীদের গুনতে হয় আরো বেশি টাকা।
সুত্র জানিয়েছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা তোলায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক একটু বেশি। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ আছেন কারাগারে। দেশ পলাতকের পাশাপাশি আবার অনেকেই গাঁ ডাকা দিয়ে আছেন। কিন্তু আড়ালে থেকেও তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভুমিকা পালন করছেন। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তোলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
শপিংমলের মত বাদ যায়নি ফুটপাতে চাঁদাবাজি। নামে বেনামে সংগঠনের নামে নিয়মিত চাঁদার পাশাপাশি তোলা হচ্ছে ইফতার ও ঈদ কেন্দ্রিক। চাঁদা না দিলেও ফুটপাতে বসে ব্যবসা করতে দেয়া হচ্ছে না। এমনও অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সারাদেশের সিটি করপোরেশন, বন্দর, হাটবাজার ও জেলা-উপজেলার নিবন্ধনকৃত হকার আড়াই লাখ। এরমধ্যে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাতেই আছে প্রায় এক লাখের উপরে হকার। এর বাইরে অনিবন্ধিত ও মৌসুমী হকার আরো কয়েক লাখ। ঈদকে সামনে রেখে এসব হকারের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে শত কোটি টাকা। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রমজানের শুরু থেকেই ইফতার মাহফিলের নামে চাঁদাবাজি চলছে। আর ঈদ যত ঘনিয়ে চাঁদাবাজির রেটও বাড়ছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে বসেন হকার হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, ফুটপাতে বসে ব্যবসা করার জন্য প্রতিদিন একবার চাঁদা দিতে হয়। কিন্তু প্রতি বছর রমজান মাস আসলে নানা কিসিমের চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন সংগঠনকে।
যারা চাঁদা নিতে আসে তারা বিভিন্ন নেতাদের নাম বললে আর কিছু করার থাকে না। চাঁদা না দিলে ভয়ভীতিসহ খারাপ আচরণ করা হয়। করা হয় নানা হয়রানি। গুলিস্তানের সাইফুল বলেন, ব্যবসা হোক আর না হোক চাঁদার টাকা ঠিকই দিতে হয়। ছোট ব্যবসার জন্য সর্বনিম্ন ২০০ টাকা আর একটু ভাল ব্যবসা হলে কমপক্ষে ৫০০ টাকা নেয়া হয়। বায়তুল মোকারমের ফুটব্যবসায়ী সায়েম বলেন, চাঁদা না দিয়ে ব্যবসা করার উপায় নাই। মিরপুরের হকার আমিন বলেন, রমজান মাসে আলাদা বাজেট করে রাখতে হয়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পারা যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ফুটপাত থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য প্রায় ৫ শতাধিক চাঁদাবাজ রয়েছেন। তারা লাইনম্যান নামে পরিচিত। নির্দিষ্ট পরিমান টাকার বিনিময়ে তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা উঠানোর কাজ করেন। তাদেরকে সহযোগীতা করেন স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি ও অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা। অনুসন্ধান ও সূত্রে জানা গেছে, নিউমার্কেট ও আশেপাশের এলাকায় চাঁদা তুলেন সাত্তার মোল্লা, ইব্রাহিম ইবু, নুর ইসলাম, বাচ্চু, রফিক, আমিনুল ইসলাম, মোর্শেদ, ইসমাঈল, সাইফুল ইসলাম। শেরেবাংলা নগর ও ফার্মগেট এলাকায় শাহআলম, জুতা মোবারক, শামসু, চুন্নু। জুরাইন ও পোস্তগোলায় চাঁদা তুলে হানিফ, সিরাজ ও খায়রুল। লালবাগে চান মিয়া, ফিরোজ ও আব্দুস সামাদ। যাত্রাবাড়িতে মান্নান, তোরাব আলী ও সোনা মিয়া। মিরপুরে-১ এ মিজান, বাদশা, জুয়েল ও আলী। ওসমানি উদ্যানে লম্বা শাহজাহান। শাহবাগে নুর ইসলাম, কালাম, ফজর আলী, আকাশ। গুলশানে হাকিম, কুড়িলে নুরুল আমিন, আব্দুর রহিম। মিরপুর-১১ শফিক, হানিফ, আব্দুল ওয়াদুদ। গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনে বাবুলসহ অন্যান্যরা। সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পাশের রাস্তায় জজ মিয়া। পুর্ব পাশের রাস্তায় সেলিম মিয়া। বায়তুল মোকাররমে কাদের, পটল, মুজিবুর, আবুুল হাসেম, সেকান্দার হায়াত, হারুন, খোকন, নসু ও তার সহযোগীরা।
গুলিস্তান খদ্দের মার্কেটের পুর্বে ভাগ্নে কাদের, আকতার, জাহাঙ্গীর, সালাম। একই মার্কেটের পশ্চিমে কাদের উত্তরে হান্নান। বিমান বন্দর এলাকায় বাবুল, জামাল, আকতার, ইব্রাহিম, মনির, উত্তরায় টিপু, নাসির হামিদ। মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে বাবুল ভুঁইয়া, মো. আলী, আবদুল গফুর। গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের রাস্তায় লম্বা হারুন, সহিদ, আমিন মিয়া। পশ্চিম পাশে কানা সিরাজ, ঢাকা ট্রেড সেন্টারের সামনে বিমল বাবু। জুতা পট্টিতে সালেক, জয়, বাবুল। গোলাপশাহ মাজারের দুই পাশে শাহীন ও বাবুল। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এলাকায় রতন, শিবলু, সাইফুল ও তার আরো কয়েকজন সহযোগী। মতিঝির আলিকোর সামনে সাদেক, সোনালি ব্যাংকের সামনে মকবুল, বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষিণ পাশে আজাদ, উত্তরপাশে হারুন, শাহীন। বক চত্বরে নুর ইসলাম, রুপালী ব্যাংক হেড অফিসের সামনে রাজু, বাবলু, অগ্রনি ব্যাংক হেড অফিসের সামনে মান্নান, জীবন বীমার সামনে কালা কাশেম, জাসদ অফিসের নিচে রনি।
বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার জন্য প্রতিটি ফুটপাতে আলাদা আলাদা লাইনম্যান আছে। তাদের চাঁদাবাজি ফরজ করতে তারা হকার ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠন করেছে। লাইনম্যানদের মধ্যে থেকে একজনকে সভাপতি ও আরেকজনকে সম্পাদক করা হয়েছে। তিনি বলেন, রমজানের শুরু থেকে চাঁদাবাজি চলছে। ঈদ যত সামনে আসবে ততই চাঁদার রেট বেড়ে যাবে। ১০০ টাকা থেকে শুরু করে প্রতিদিন ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেয়া হচ্ছে। চাঁদ রাত পর্যন্ত এই চাঁদাবাজি চলবে। তিনি বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধে আমরা অনেক আন্দোলন করছি। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে একাধিক মামলা। কিন্তু তাদেরকে কখনই গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ তারা প্রত্যেকেই পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই কাজ করে।
এদিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার পাশাপাশি পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদা উঠানোর জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে কিছু অসাধু চক্র। এই চক্রগুলো প্রতি বছর ঈদ কেন্দ্রিক দুর পাল্লার বিভিন্ন বাস থেকে চাঁদা উঠায়। ঈদ যাত্রা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু চাঁদাবাজরা রাজধানীতে প্রবেশ ও বাহির পথে চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ও ঢাকার টার্মিনাল গুলোতে প্রবেশকালে চাঁদা তোলা হয়। এর বাইরে খোদ ট্রাফিক পুলিশও কাগজপত্র চেক করার নামে চালকদের হয়রানী করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেক চালক। আবার দুর পাল্লার অনেক যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন, এখনই চালকরা বাড়তি ভাড়া নেয়া শুরু করে দিয়েছে। বাড়তি ভাড়া নেয়ার কারণ জানতে চাইলেও তারা কোন সদুত্তর দিচ্ছেন না। তবে চালকরা জানিয়েছেন, তাদের খরচ বেড়েছে। ইঞ্জিন চালু করলেই একাধিক ঘাটে তাদেরকে টাকা দিতে হচ্ছে।
এদিকে, গত ২৬শে মে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মহাসড়কে চাঁদাবাজি রোধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। তিনি সড়ক ও মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের জন্য সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টসমূহে সিসিটিভি স্থাপন, ট্রাক, পিকআপ এবং পণ্যবাহী ট্রাকে যাত্রী পরিবহণ রোধ এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া মহাসড়কে যানবাহন না থামানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি সোহেল রানা বলেন, ঈদকে সামনে রেখে এক শ্রেণির অসাধু চক্র নানাভাবে চাঁদাবাজি করে। আইন শৃঙ্খলাবাহিনী এসময়টা একটু বেশি তৎপর থাকে। চাঁদাবাজির ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পুলিশ সদরদপ্তর থেকে সারা দেশের পুলিশবাহিনীকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে তবে আমরা ব্যবস্থা নেব।
No comments