যে বিশ্বকাপের পর নিঃস্ব হবে বিশ্ব by রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
ঈষৎ
পক্বকেশ, কাঁচাপাকা দাড়ির ভদ্রলোককে আর বোধহয় দেখা যাবে না। বিলেতে আসন্ন
বিশ্বকাপই খুব সম্ভবত শেষ। অলস অবসর যাপনে হয়তো তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়বেন
তিনি, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট মস্তিষ্ক। হয়তো হাতে তখন ব্যাটের
বদলে থাকবে রং-তুলি। বাইশ গজের সবুজ গালিচার জায়গা নেবে সাদা ক্যানভাস।
শৈশবে তার যা প্রথম প্রেম ছিল। বছরে একবার খেলবেন আইপিএল, বিশ্ব ওই একবারই
তখন দেখবে তার অসাধারণ ক্রিকেট প্রজ্ঞার ঝলক। কিন্তু নীল জার্সির পৃথিবীতে
আর নয়।
ছ’ফুট তিন ইঞ্চির দৈত্যাকার জামাইকান তিনিও তো আর থাকছেন না। জীবনের ৩৯ বসন্ত পেরিয়ে আজও তিনি ক্ষুরধার, ধুঁয়াধার। কিন্তু সেই দীর্ঘদেহীরও এই শেষ, এই বিশ্বকাপই শেষ। তাকে এরপর হয়তো আবিষ্কার করা যাবে জামাইকার মাঠে, গ্যালারিতে বিয়ার হাতে। যেখানে বসে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন, তার বোলার শাসনের রাজধর্মের সঠিক পালন ক্রিকেট উত্তরাধিকাররা করছেন কি না। কে জানে হয়তো বা অস্ফুটে বলেও ফেলবেন, নাহ্, ইউনিভার্স বস হওয়া তোদের কম্ম নয়! কিন্তু ক্রিকেট? বিশ্বকাপ উত্তর ক্রিকেট কফিনের ডালা খোলা? নাহ্, আর না।
কিংবা ধরা যাক ভারতীয় উপমহাদেশেরই দুই ক্রিকেট বীরকে। সিংহল প্রদেশ জাত যে পেসার বিশ্ব ক্রিকেটে স্লিং আর্ম বোলিং অ্যাকশনের প্রকৃত জন্মদাতা- তিনিও বা আর আগামী ১৪ই জুলাইয়ের পর থাকছেন কোথায়? ঝাঁকরা চুলের সদা হাস্যময় শ্রীলঙ্কা পেসারের মুখটা মনে পড়লে, চাপা দীর্ঘশ্বাস মিশবে না ভারত মহাসাগরের জলে? আবার চোখের কোনে জমা হবে না জলীয় বাষ্প পদ্মাপারের ক্রিকেট যোদ্ধার কথা ভাবলে? অনুভব হবে না বিশ্বকাপের পর তার ক্রিকেট মহাপ্রস্থানের অনুরণন? বাংলাদেশ ক্রিকেটের শেখ মুজিবর রহমান যে তিনি, ক্রিকেটীয় রেকর্ড-পারফরমেন্সের শুষ্কং কাষ্ঠং সংখ্যা ছাড়িয়ে বহু দিন কালোত্তীর্ণ। দেশের ক্রিকেট টিম নয়। পদ্মাপারের বঙ্গজাতির হৃদয়ের এগারোর অধিনায়ক। কিন্তু হায়, বিশ্বকাপ শেষে তিনিও আর নেই।
ভৌগলিক সীমায় বিভাজিত এই গ্রহে উপরের চরিত্রদের নাম আলাদা। প্রথম জনকে লোকে চেনে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামে। দ্বিতীয় জনের নাম ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল। তৃতীয় ও চতুর্থ চরিত্রের নাম সহজেই অনুমেয়- লাসিথ মালিঙ্গা এবং মাশরাফি বিন মোর্তাজা। কিন্তু এদের মধ্যে অদ্ভুত দু’টো মিল আছে। এরা প্রত্যেকেই ক্রিকেট নামক খেলাটার বিশ্বনাগরিক এবং প্রত্যেকেই বিশ্বকাপ শেষে প্রস্থানমুখী। ভুল হলো একটু। আরো গোটা কয়েক প্রবাদপ্রতিম নাম এদের সঙ্গে জুড়তে হবে। ধোনি-গেইল-মাশরাফিদের মতো যাদেরও এটা জীবনের শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে। কেউ কেউ আর এরপর খেলবেনও না। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইন। স্টেইন গানে মরচে না ধরলেও তার বয়স বেড়েছে। তিনি এখন ৩৫। নিউজিলান্ডের রস টেলরও আর খেলবেন না। ‘পুর্নজন্ম’ ঘটানো ডেভিড ওয়ার্নার- তিনিও কি আর খেলবেন পরের বিশ্বকাপ? অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের কঠোর শাসনবর্তিতার নিয়ম বলে না। খেলবেন না। ৩৬ কেউ বিশ্বকাপ খেলছে, সে দেশে কেউ বিশ্বাস করে না!
ইংল্যান্ডে বিশ্বযুদ্ধের ঢক্কানিনাদ শুরু হওয়ার বহু বহু আগে একটা তীব্র আলোচনা ক্রিকেট দুনিয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছিল যে, বিলেত বিশ্বকাপ ব্যতিক্রমের বিশ্বকাপ হতে চলেছে। ’৯২-র পর আবার প্রত্যাবর্তন ঘটাতে চলেছে রাউন্ড রবিন ফরম্যাট, যা শেষ পর্যন্ত খোঁজ দিয়ে যাবে প্রকৃত বিশ্বজয়ীর। গ্রুপ লিগ ফরম্যাটে ক’টা ম্যাচ আর খেলে টিম। যুদ্ধ তো এবার। চ্যালেঞ্জ তো এবার। যেখানে প্রতিটা টিম মহড়া নেবে প্রতিটার, যাচাই হবে ক্রিকেট পৌরুষের। কিন্তু আরো একটা দিক থেকে তো ব্যতিক্রমী হতে চলেছে আসন্ন বিলেত বিশ্বকাপ। একটা বিশ্বকাপ শেষে একযোগে এত ক্রিকেট মহানায়কের পূর্ণগ্রাস শেষ কবে হয়েছে? শেষ মনে পড়ে, ২০১১ বিশ্বকাপ। শচীন টেন্ডুলকর, বীরেন্দ্র শেহবাগ, রিকি পন্টিংদের শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু তার পরও বিশ্ব ক্রিকেটে একটা ধোনি, একটা কোহলি, একটা এবি ডি’ভিলিয়ার্স, একটা কুমার সঙ্গকারা, মাহেলা জয়বর্ধনে ছিল। কিন্তু এবার? এরপর ক্রিকেটের জননেতা?
কোহলি এবং শুধুই হয়তো বিরাট কোহলি।
ক্রিকেটীয় বিচার-বিশ্লেষণে এবার ঢোকা যাক। কে জিতবে এবারের কাপ? উপরের মহাপ্রস্থানকারীদের মধ্যে কে পারবেন শেষবারের মতো বিশ্বজয়ীর শৃঙ্গ আরোহন করতে? ধোনি পারবেন রাঙিয়ে দিতে যাওয়ার আগে? আবারও এক সুবিশাল ছক্কায় ফিরিয়ে আনবেন ওয়াংখেড়ে ফাইনালের মায়াবী রাত? ক্রিস্টোফার গেইল পারবেন ব্যাটিং নামক এক বন্যসুখের অমৃতপাত্রে বিশ্বকে ডুবিয়ে দিতে? স্টেইন পারবেন ক্রিকেট প্রৌঢ়ত্বে বেঁচে থাকা স্ফুলিঙ্গগুলো একত্রিত করে শেষবারের মতো যৌবনের মশাল জ্বালতে? মাশরাফি পারবেন বাঙালির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটা তুলে দিতে? প্রমাণ করতে পারবেন তিনি যে, এগারো বাঙালি আর আদুরে বেড়াল নয়, বিশ্ব দরবারে তারা এখন বাঘ বটে? বাইশ গজে ব্যাঘ্রগর্জন তুলে তিনি দেখিয়ে দেবেন যে, তার দেশ এখন প্রকৃত শের-ই-বাংলা?
কুলকুলে আবেগস্রোত যদি শুধুমাত্র বিচার্য হতো, এত ঝামেলাই থাকতো না। ক্রিকেটের এহেন বিশ্ব নাগরিকদের সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে ট্রফিটা হাতে তুলে দিলেই চলত। কিন্তু ক্রিকেট চিরকাল যে চলেছে যুক্তির নিয়মে। আপনখেয়ালে বারবার রক্তাক্ত করেছে আবেগের তুলতুলে শরীরকে।
কিছু দিন আগে আইপিএল চলাকালীন বাংলাদেশের আর এক প্রিয় সন্তান সাকিব-আল-হাসান ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের কাজটা এবার খুব কঠিন। রাউন্ড রবিন ফরম্যাটের জন্যই কঠিন। ছোট-বড়-মাঝারি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ৯ ম্যাচের বেশ কয়েকটা জিততে হবে সেমিফাইনাল যেতে হলে। অন্যবার সেমিফাইনাল যাওয়ার সুযোগটা বেশি থাকে। শুনে প্রথমে সাকিবের কথাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, ঠিকই তো বলেছেন তিনি। ভারত যে ভারত, যাদের যুগ্ম ফেভারিট ধরে এত আগাম আলাপ-আলোচনা, প্রথম চারটে প্রচণ্ড কঠিন ম্যাচের (দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান) মধ্যে দু’টো বার না করতে পারলে, সেমিফাইনাল স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটে যেতে পারে। তা ছাড়া ভারতীয় টিমে ফুটোফাটাও বিস্তর, যা ছিদ্র থেকে ফাটলে পরিণত হলে দুঃখ আছে। যেমন, এখনও নিশ্চিত কোনো নাম্বার ফোর ব্যাটসম্যান নেই। যেমন, টিমের দুই রিস্টস্পিনার কুলদীপ যাদব এবং যুজবেন্দ্র চাহাল কী করবেন, বোঝা যাচ্ছে না। যেমন টিমের নড়বড়ে মিডল অর্ডার। সমালোচকদের কথা ধরলে, এত দুর্বল মিডল অর্ডার নিয়ে এর আগে ভারত বিশ্বকাপ খেলতে যায়নি কখনও।
অতএব ভারতের সম্ভাবনা খাতায়-কলমে যতটা, বাস্তবে ততটা নয়। বাংলাদেশেরও তাই। সমপ্রতি মোহিনী পারফরমেন্স বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে। ঐতিহাসিক ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে। কিন্তু ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ফরম্যাট সত্যিই গোলযোগ বাঁধিয়ে দিতে পারে। সত্যিকারের ফেভারিট বরং ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড সব দিক থেকেই তুখোড় টিম। স্বপ্নের ফর্মে থাকা ডেভিড ওয়ার্নার-স্টিভ স্মিথ জুড়ে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়া বর্তমান প্রেক্ষিতে ভয়াবহ ক্রিকেট শক্তি। ভারত আসবে এর পরে। পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ পুরোটাই অনিশ্চয়তার কুয়াশায় মোড়া দু’টো টিম। চললে যারা ফাইনালও খেলতে পারে, না চললে যারা গ্রুপ থেকেই বিদায় নিতে পারে। বাংলাদেশ অবশ্যই থাকবে টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স হিসেবে। যেমন থাকবে কেন উইলিয়ামসন-রস টেলর-ট্রেন্ট বোল্টের নিউজিল্যান্ড। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কথায় কথায় একবার বলেওছিলেন যে, অদ্ভুত একটা বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। যেখানে শ্রীলঙ্কা বাদ দিলে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটা দেশ বিশ্বজয়ের ক্ষমতা রাখে। এবার ফেভারিট ফিরতে পারে পরাজিতের গ্লানি নিয়ে, আর টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স শেষে ছুটিয়ে দিতে পারে অশ্বমেধের ঘোড়া! বাংলাদেশের তাই আশাহত হওয়ার কারণ নেই। এটা তো অনস্বীকার্য যে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান, সৌম্য সরকার সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইন আপ সামলানো খুব সহজ হবে না। তেমনই কঠিন হবে মোস্তাফিজুর রহমান, রুবেল-তাসকিনকে সামলানো। আর বাংলাদেশ তো অনেক দূরের গ্রহ। সে দিনের পুঁচকে আফগানিস্তান- তাকেও কিন্তু আর হালকা নেয়ার জায়গা নেই। শেষ এশিয়া কাপে তারা ভারতের বিরুদ্ধ ম্যাচ ‘টাই’ করেছে, পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে হারিয়েছে।
কিন্তু শুধু ট্রফিই কি সব? ধরা যাক, ধোনি-ম্যাশ-গেইল-স্টেইন কেউ ট্রফি পেলেন না। বিশ্বকাপ না জিতেও যদি ধোনি দিয়ে যান ভয়ডরহীন পুরুষালি পারফরমেন্স, মাশরাফির অলরাউন্ড পারফরমেন্স থেকে যদি নিঃসৃত হয় সততার সোঁদা গন্ধ, পরের পর যদি ওঠে গেইল স্টর্ম, স্টেইন গান যদি শেষবারের মতো সশব্দে গর্জে ওঠে- প্রাপ্তি কি কিছু কম হবে? বলবেন না তখন, ক্রিকেটের চিরশ্রেষ্ঠ স্মারক পাইনি তো কী, মাশরাফির অমরত্ব লাভ আমরা ইংল্যান্ডে দেখেছিলাম। বলবেন না তখন, ধোনি দেখিয়ে দিলেন তিনি ‘শেষ হইয়াও হন নাই শেষ।’
আর তাই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্রিকেট রোমান্টিকদের শুধু খেলাটা থেকে রোমান্স উপভোগের লক্ষ্য নিয়ে এবারের বিশ্বকাপটা দেখতে বসা ভালো। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দাঁড়ি পাল্লাটা দেরাজে তুলে রেখে। ম্যাশ-ধোনি-গেইলদের তো এটাই শেষ, এই আগামী দেড় মাস। যার পর ক্রিকেট থাকবে। কিন্তু তারা আর থাকবেন না। বিশ্বকাপের পর নিঃস্ব হবে বিশ্ব, ক্রিকেটের নিঠুর ছলনায় যার পর আমি-আপনি-আমরা হব একাকী অসহায়।
এবং ‘আমার হারানো প্রেম ফিরিয়ে দাও’ বলেও আর লাভ হবে না!
(পরিচিতি: লেখক কলকাতার ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সহ ক্রীড়াসম্পাদক)
ছ’ফুট তিন ইঞ্চির দৈত্যাকার জামাইকান তিনিও তো আর থাকছেন না। জীবনের ৩৯ বসন্ত পেরিয়ে আজও তিনি ক্ষুরধার, ধুঁয়াধার। কিন্তু সেই দীর্ঘদেহীরও এই শেষ, এই বিশ্বকাপই শেষ। তাকে এরপর হয়তো আবিষ্কার করা যাবে জামাইকার মাঠে, গ্যালারিতে বিয়ার হাতে। যেখানে বসে চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন, তার বোলার শাসনের রাজধর্মের সঠিক পালন ক্রিকেট উত্তরাধিকাররা করছেন কি না। কে জানে হয়তো বা অস্ফুটে বলেও ফেলবেন, নাহ্, ইউনিভার্স বস হওয়া তোদের কম্ম নয়! কিন্তু ক্রিকেট? বিশ্বকাপ উত্তর ক্রিকেট কফিনের ডালা খোলা? নাহ্, আর না।
কিংবা ধরা যাক ভারতীয় উপমহাদেশেরই দুই ক্রিকেট বীরকে। সিংহল প্রদেশ জাত যে পেসার বিশ্ব ক্রিকেটে স্লিং আর্ম বোলিং অ্যাকশনের প্রকৃত জন্মদাতা- তিনিও বা আর আগামী ১৪ই জুলাইয়ের পর থাকছেন কোথায়? ঝাঁকরা চুলের সদা হাস্যময় শ্রীলঙ্কা পেসারের মুখটা মনে পড়লে, চাপা দীর্ঘশ্বাস মিশবে না ভারত মহাসাগরের জলে? আবার চোখের কোনে জমা হবে না জলীয় বাষ্প পদ্মাপারের ক্রিকেট যোদ্ধার কথা ভাবলে? অনুভব হবে না বিশ্বকাপের পর তার ক্রিকেট মহাপ্রস্থানের অনুরণন? বাংলাদেশ ক্রিকেটের শেখ মুজিবর রহমান যে তিনি, ক্রিকেটীয় রেকর্ড-পারফরমেন্সের শুষ্কং কাষ্ঠং সংখ্যা ছাড়িয়ে বহু দিন কালোত্তীর্ণ। দেশের ক্রিকেট টিম নয়। পদ্মাপারের বঙ্গজাতির হৃদয়ের এগারোর অধিনায়ক। কিন্তু হায়, বিশ্বকাপ শেষে তিনিও আর নেই।
ভৌগলিক সীমায় বিভাজিত এই গ্রহে উপরের চরিত্রদের নাম আলাদা। প্রথম জনকে লোকে চেনে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামে। দ্বিতীয় জনের নাম ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল। তৃতীয় ও চতুর্থ চরিত্রের নাম সহজেই অনুমেয়- লাসিথ মালিঙ্গা এবং মাশরাফি বিন মোর্তাজা। কিন্তু এদের মধ্যে অদ্ভুত দু’টো মিল আছে। এরা প্রত্যেকেই ক্রিকেট নামক খেলাটার বিশ্বনাগরিক এবং প্রত্যেকেই বিশ্বকাপ শেষে প্রস্থানমুখী। ভুল হলো একটু। আরো গোটা কয়েক প্রবাদপ্রতিম নাম এদের সঙ্গে জুড়তে হবে। ধোনি-গেইল-মাশরাফিদের মতো যাদেরও এটা জীবনের শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে। কেউ কেউ আর এরপর খেলবেনও না। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার ডেল স্টেইন। স্টেইন গানে মরচে না ধরলেও তার বয়স বেড়েছে। তিনি এখন ৩৫। নিউজিলান্ডের রস টেলরও আর খেলবেন না। ‘পুর্নজন্ম’ ঘটানো ডেভিড ওয়ার্নার- তিনিও কি আর খেলবেন পরের বিশ্বকাপ? অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের কঠোর শাসনবর্তিতার নিয়ম বলে না। খেলবেন না। ৩৬ কেউ বিশ্বকাপ খেলছে, সে দেশে কেউ বিশ্বাস করে না!
ইংল্যান্ডে বিশ্বযুদ্ধের ঢক্কানিনাদ শুরু হওয়ার বহু বহু আগে একটা তীব্র আলোচনা ক্রিকেট দুনিয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছিল যে, বিলেত বিশ্বকাপ ব্যতিক্রমের বিশ্বকাপ হতে চলেছে। ’৯২-র পর আবার প্রত্যাবর্তন ঘটাতে চলেছে রাউন্ড রবিন ফরম্যাট, যা শেষ পর্যন্ত খোঁজ দিয়ে যাবে প্রকৃত বিশ্বজয়ীর। গ্রুপ লিগ ফরম্যাটে ক’টা ম্যাচ আর খেলে টিম। যুদ্ধ তো এবার। চ্যালেঞ্জ তো এবার। যেখানে প্রতিটা টিম মহড়া নেবে প্রতিটার, যাচাই হবে ক্রিকেট পৌরুষের। কিন্তু আরো একটা দিক থেকে তো ব্যতিক্রমী হতে চলেছে আসন্ন বিলেত বিশ্বকাপ। একটা বিশ্বকাপ শেষে একযোগে এত ক্রিকেট মহানায়কের পূর্ণগ্রাস শেষ কবে হয়েছে? শেষ মনে পড়ে, ২০১১ বিশ্বকাপ। শচীন টেন্ডুলকর, বীরেন্দ্র শেহবাগ, রিকি পন্টিংদের শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু তার পরও বিশ্ব ক্রিকেটে একটা ধোনি, একটা কোহলি, একটা এবি ডি’ভিলিয়ার্স, একটা কুমার সঙ্গকারা, মাহেলা জয়বর্ধনে ছিল। কিন্তু এবার? এরপর ক্রিকেটের জননেতা?
কোহলি এবং শুধুই হয়তো বিরাট কোহলি।
ক্রিকেটীয় বিচার-বিশ্লেষণে এবার ঢোকা যাক। কে জিতবে এবারের কাপ? উপরের মহাপ্রস্থানকারীদের মধ্যে কে পারবেন শেষবারের মতো বিশ্বজয়ীর শৃঙ্গ আরোহন করতে? ধোনি পারবেন রাঙিয়ে দিতে যাওয়ার আগে? আবারও এক সুবিশাল ছক্কায় ফিরিয়ে আনবেন ওয়াংখেড়ে ফাইনালের মায়াবী রাত? ক্রিস্টোফার গেইল পারবেন ব্যাটিং নামক এক বন্যসুখের অমৃতপাত্রে বিশ্বকে ডুবিয়ে দিতে? স্টেইন পারবেন ক্রিকেট প্রৌঢ়ত্বে বেঁচে থাকা স্ফুলিঙ্গগুলো একত্রিত করে শেষবারের মতো যৌবনের মশাল জ্বালতে? মাশরাফি পারবেন বাঙালির হাতে বিশ্বকাপ ট্রফিটা তুলে দিতে? প্রমাণ করতে পারবেন তিনি যে, এগারো বাঙালি আর আদুরে বেড়াল নয়, বিশ্ব দরবারে তারা এখন বাঘ বটে? বাইশ গজে ব্যাঘ্রগর্জন তুলে তিনি দেখিয়ে দেবেন যে, তার দেশ এখন প্রকৃত শের-ই-বাংলা?
কুলকুলে আবেগস্রোত যদি শুধুমাত্র বিচার্য হতো, এত ঝামেলাই থাকতো না। ক্রিকেটের এহেন বিশ্ব নাগরিকদের সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে ট্রফিটা হাতে তুলে দিলেই চলত। কিন্তু ক্রিকেট চিরকাল যে চলেছে যুক্তির নিয়মে। আপনখেয়ালে বারবার রক্তাক্ত করেছে আবেগের তুলতুলে শরীরকে।
কিছু দিন আগে আইপিএল চলাকালীন বাংলাদেশের আর এক প্রিয় সন্তান সাকিব-আল-হাসান ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের কাজটা এবার খুব কঠিন। রাউন্ড রবিন ফরম্যাটের জন্যই কঠিন। ছোট-বড়-মাঝারি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ৯ ম্যাচের বেশ কয়েকটা জিততে হবে সেমিফাইনাল যেতে হলে। অন্যবার সেমিফাইনাল যাওয়ার সুযোগটা বেশি থাকে। শুনে প্রথমে সাকিবের কথাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, ঠিকই তো বলেছেন তিনি। ভারত যে ভারত, যাদের যুগ্ম ফেভারিট ধরে এত আগাম আলাপ-আলোচনা, প্রথম চারটে প্রচণ্ড কঠিন ম্যাচের (দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান) মধ্যে দু’টো বার না করতে পারলে, সেমিফাইনাল স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটে যেতে পারে। তা ছাড়া ভারতীয় টিমে ফুটোফাটাও বিস্তর, যা ছিদ্র থেকে ফাটলে পরিণত হলে দুঃখ আছে। যেমন, এখনও নিশ্চিত কোনো নাম্বার ফোর ব্যাটসম্যান নেই। যেমন, টিমের দুই রিস্টস্পিনার কুলদীপ যাদব এবং যুজবেন্দ্র চাহাল কী করবেন, বোঝা যাচ্ছে না। যেমন টিমের নড়বড়ে মিডল অর্ডার। সমালোচকদের কথা ধরলে, এত দুর্বল মিডল অর্ডার নিয়ে এর আগে ভারত বিশ্বকাপ খেলতে যায়নি কখনও।
অতএব ভারতের সম্ভাবনা খাতায়-কলমে যতটা, বাস্তবে ততটা নয়। বাংলাদেশেরও তাই। সমপ্রতি মোহিনী পারফরমেন্স বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে। ঐতিহাসিক ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে। কিন্তু ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ফরম্যাট সত্যিই গোলযোগ বাঁধিয়ে দিতে পারে। সত্যিকারের ফেভারিট বরং ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড সব দিক থেকেই তুখোড় টিম। স্বপ্নের ফর্মে থাকা ডেভিড ওয়ার্নার-স্টিভ স্মিথ জুড়ে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়া বর্তমান প্রেক্ষিতে ভয়াবহ ক্রিকেট শক্তি। ভারত আসবে এর পরে। পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ পুরোটাই অনিশ্চয়তার কুয়াশায় মোড়া দু’টো টিম। চললে যারা ফাইনালও খেলতে পারে, না চললে যারা গ্রুপ থেকেই বিদায় নিতে পারে। বাংলাদেশ অবশ্যই থাকবে টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স হিসেবে। যেমন থাকবে কেন উইলিয়ামসন-রস টেলর-ট্রেন্ট বোল্টের নিউজিল্যান্ড। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কথায় কথায় একবার বলেওছিলেন যে, অদ্ভুত একটা বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। যেখানে শ্রীলঙ্কা বাদ দিলে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটা দেশ বিশ্বজয়ের ক্ষমতা রাখে। এবার ফেভারিট ফিরতে পারে পরাজিতের গ্লানি নিয়ে, আর টুর্নামেন্টের ডার্ক হর্স শেষে ছুটিয়ে দিতে পারে অশ্বমেধের ঘোড়া! বাংলাদেশের তাই আশাহত হওয়ার কারণ নেই। এটা তো অনস্বীকার্য যে তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, সাকিব আল হাসান, সৌম্য সরকার সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইন আপ সামলানো খুব সহজ হবে না। তেমনই কঠিন হবে মোস্তাফিজুর রহমান, রুবেল-তাসকিনকে সামলানো। আর বাংলাদেশ তো অনেক দূরের গ্রহ। সে দিনের পুঁচকে আফগানিস্তান- তাকেও কিন্তু আর হালকা নেয়ার জায়গা নেই। শেষ এশিয়া কাপে তারা ভারতের বিরুদ্ধ ম্যাচ ‘টাই’ করেছে, পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে হারিয়েছে।
কিন্তু শুধু ট্রফিই কি সব? ধরা যাক, ধোনি-ম্যাশ-গেইল-স্টেইন কেউ ট্রফি পেলেন না। বিশ্বকাপ না জিতেও যদি ধোনি দিয়ে যান ভয়ডরহীন পুরুষালি পারফরমেন্স, মাশরাফির অলরাউন্ড পারফরমেন্স থেকে যদি নিঃসৃত হয় সততার সোঁদা গন্ধ, পরের পর যদি ওঠে গেইল স্টর্ম, স্টেইন গান যদি শেষবারের মতো সশব্দে গর্জে ওঠে- প্রাপ্তি কি কিছু কম হবে? বলবেন না তখন, ক্রিকেটের চিরশ্রেষ্ঠ স্মারক পাইনি তো কী, মাশরাফির অমরত্ব লাভ আমরা ইংল্যান্ডে দেখেছিলাম। বলবেন না তখন, ধোনি দেখিয়ে দিলেন তিনি ‘শেষ হইয়াও হন নাই শেষ।’
আর তাই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্রিকেট রোমান্টিকদের শুধু খেলাটা থেকে রোমান্স উপভোগের লক্ষ্য নিয়ে এবারের বিশ্বকাপটা দেখতে বসা ভালো। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দাঁড়ি পাল্লাটা দেরাজে তুলে রেখে। ম্যাশ-ধোনি-গেইলদের তো এটাই শেষ, এই আগামী দেড় মাস। যার পর ক্রিকেট থাকবে। কিন্তু তারা আর থাকবেন না। বিশ্বকাপের পর নিঃস্ব হবে বিশ্ব, ক্রিকেটের নিঠুর ছলনায় যার পর আমি-আপনি-আমরা হব একাকী অসহায়।
এবং ‘আমার হারানো প্রেম ফিরিয়ে দাও’ বলেও আর লাভ হবে না!
(পরিচিতি: লেখক কলকাতার ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সহ ক্রীড়াসম্পাদক)
No comments