শিশুটিকে দত্তক পেতে চতুর্মুখী লড়াই by মরিয়ম চম্পা
ফুটফুটে।
চোখে দুনিয়ার মায়া। চেহারায় ঐশ্বর্য। প্রথম দেখাতেই মনে হবে, বাহ! কী
সুন্দর। টিভিতে বার কয়েক দেখা গেছে। যদিও জন্মের পরই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়
নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়েছে সে। কে তার বাবা-মা কেউ জানে না।
শিশু হাসপাতালের শৌচাগারে কে বা কারা তাকে ফেলে যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। এখন তার ঠাঁই হয়েছে ছোটমণি নিবাসে। কিন্তু ছোট্ট এই শিশুকে নিয়ে শুরু হয়েছে রীতিমতো লড়াই। তাকে দত্তক পেতে চান অনেকে। প্রভাবশালী থেকে সাধারণ এ লাইন দীর্ঘ। তারা এরই মধ্যে আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। হাসপাতালে থাকতেই শিশুটিকে নেয়ার জন্য আসে শ’ শ’ ফোন। বড় অঙ্কের টাকা দিতে চেয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার নিজের ফ্ল্যাটও লিখে দিতে চেয়েছেন তার নামে। ছোট্ট শিশুটির নাম রাখা হয়েছে ‘গহীন’। রোববার দুপুরে রাজধানীর আজিমপুরের ছোটমনি নিবাসে গিয়ে দেখা যায়, মিডিয়াকর্মী এবং অভিভাবকদের ভিড়। শিশুটির নিরাপত্তার স্বার্থে একপর্যায়ে সকল মিডিয়া এবং দর্শনার্থীদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ করে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। এসময় শিশুটিকে দত্তক নিতে আসা সিলেটের প্রবাসী মো. সাইফুল আলম বলেন, আমরা বিয়ে করেছি প্রায় ১৪ বছর। আমাদের কোনো ছেলে মেয়ে নেই। আমরা ইতোমধ্যে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছি। তাকে সন্তান হিসেবে পাওয়ার জন্য যা কিছু করতে হয় করবো। আমেরিকাতে আমার নিজের ব্যবসা আছে। পাশাপাশি আমি চাকরি করি। আমরা তাকে পেলে সরাসরি আমেরিকাতে নিয়ে যাবো।
তাকে পেতে আদালতের যে কোনো শর্ত মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত। ঢাকা শিশু হাসপাতালের ওয়ার্ডমাস্টার রাসেল মাহমুদ বলেন, বাচ্চা কি আছে? বাচ্চা নাই। বাচ্চা নিয়ে গেছে। ছোটমনিতে যারা নেয়ার তারা নিয়ে গেছে। একটি বাচ্চার প্রতি যদি প্রভাবশালী মহল যুক্ত হয় সে বাচ্চা কি ছোটমনিতে রাখা সম্ভব। আমার স্ত্রী পলি আক্তার শিশুটিকে ছোটমনি নিবাসের কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শিশুটির দুঃশ্চিন্তায় তার রক্তের উচ্চচাপ অধিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। সে শিশুটিকে নেয়ার জন্য পাগল। পলি সুস্থ্য হলেই শিশুটিকে পেতে আমরা আইনি লড়াইয়ে যাবো। শিশুটিকে পেলে আমার পেনশন পুরোটাই ওর নামে লিখে দিবো। ছোটমনির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আপনাদের থেকে অনেক হাই প্রোফাইলের লোকজনের আবেদন এসেছে। এতো বড় লেভেলের মানুষ যেহেতু বাচ্চাটিকে চাইছে তাই আমরা সাধারণ আবেদনকারীরা হয়তো বাচ্চাটিকে পাবো না। শিশুটির চেহারার মাঝে এমন মায়া ও আকর্ষণ রয়েছে যেটা দেখে প্রথম থেকেই আমি আকর্ষিত হয়ে গেছি। দ্বিতীয়ত ৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে আমাদের কোনো ছেলে মেয়ে হয়নি। আগে পরে এরকম আরো বাচ্চা পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই বাচ্চাটির ভেতরে আলাদা একটি টান রয়েছে।
শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হামিদা আক্তার মিতা বলেন, আমার দুই ছেলে মেয়ে আছে। ওরা বড় হয়ে গেছে। ছেলে বিকেএসপিতে পড়ে। মেয়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসইতে পড়ে। অনেক আগে থেকেই শখ যে আমার দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে থাকবে। কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আমরা আর বাচ্চা নিতে পারবো না। ফলে অনেক আগে থেকেই আমার ভাবনা ছিল আমি যেহেতু বাচ্চা নিতে পারবো না তাই একটি কন্যা শিশু দত্তক নিবো। আমার খুব ইচ্ছা এই বাচ্চাটিকে যদি পাই তাহলে ওকে আমি মানুষের মতো মানুষ করবো। একটাই শঙ্কা শিশুটিকে পেতে এতো এতো প্রতিযোগীতা ‘যদি আমি না পাই’। রীতিমত আমার বুকের মাঝে ব্যথা শুরু হয়েছে। যদি আমি না পাই তাহলে নিজেকে কি সামলাতে পারবো? ওকে পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে আমি আমার আইনজীবী নিয়োগ করেছি। আমার তরফ থেকে শিশুটিকে পেতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। নামাজ পড়েও আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন বাচ্চাটিকে আমি পাই। মনে হয় যেন ও আমার নিজেরই সন্তান। ওর নামও আমি ঠিক করে ফেলছি। এই মেয়েকে রোজার মধ্যে পেলে আমি ওর নাম রাখবো ‘রোজা’। এবং অনেক বড় করে আকিকা দিয়ে ওর নাম রাখবো। এবং আমার যা কিছু সহায় সম্পত্তি আছে সব তিন সন্তানের নামে সমান সমান থাকবে।
সিলেটের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট হবিগঞ্জের অফিস কোর্ডিনেটর বোরহান উদ্দিন বলেন, ৭ বছর আগে আমি বিয়ে করেছি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমি নি:স্বন্তান। ফেসবুকে শিশুটির ছবি দেখে আমি খুবই ইমোশনাল হয়ে গিয়েছি। তৎক্ষণাত আমি ফেসবুকে কমেন্ট করেছি, ‘এই মেয়েটি যদি আমাকে দেওয়া হতো, তাহলে আমি ওকে আমার রাজকন্যা বানিয়ে রাখতাম’। তখন আমি বুঝতে পারিনি যে এই মেয়েটার জন্য সারা বাংলাদেশ এরকম পাগল হয়ে যাবে। আমি মনেকরি এই মেয়েটি খুব ভাগ্য নিয়ে দুনিয়াতে এসেছে। এতো মানুষের আগ্রহ দেখে আমি অনেকটা আশাহত হয়ে গেছি। সত্যিই আমি ওকে পাবো তো? চাকরির সুবাদে সিলেট থেকে আমি হয়তো ওভাবে আইনি লড়াই চালাতে পারবো না।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এমপি মানবজমিনকে বলেন, একটি শিশুর প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কৌতূহল থাকবে এটাই সহজাত এবং স্বাভাবিক। আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিশুটির সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। ওর খাওয়া, ঘুম, স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সর্বোচ্চ সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শিশুটির সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখছেন। এবং আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তার বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সবার কাছে দোয়া প্রত্যাশা করছি শিশুটি যেখানেই থাকুক না কেন যেন ভালো থাকে।
শিশু হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালের কমন শৌচাগারের ভেতর থেকে সাত থেকে আট দিন বয়সী জীবিত এই নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির দায়িত্ব নিতে সমাজের অনেকেই ছুটে এসেছেন। এ ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনে হস্তান্তরকৃত শিশুটিকে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথ আইন মেনেই দত্তক নিতে পারবেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির বলেন, ও (শিশুটি) ভালো আছে। শিশু দত্তক নেয়ার একটি বিধি বিধান আছে। ছোটমনি নিবাস থেকে দত্তক নিতে হলে আদালতে পারিবারিক আইনে একটি মামলা করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে আদালত যিনি দত্তক নিবেন তার আর্র্থসামাজিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা কেমন সেটা যাচাই বাচাই করবে। এবং কতটুকু সামর্থ আছে বাচ্চাকে রাখতে বা মানুষ করতে পারবে কি না। তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা এই সকল বিষয় বিবেচনা করে আদালত একটি রায় দেবেন। সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে আমরা শিশু নিবাস থেকে বাচ্চাটিকে দত্তক দিবো। এবং নির্দিষ্ট পরিমানে অর্থ শিশুর নামে লিখে দিতে হবে। আইনের চোখে যিনি সবচেয়ে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন আদালত তাকেই শিশুটির দায়িত্ব দেবেন।
ছোটমনি নিবাসের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট জুবলি বেগম রানু বলেন, শিশুটি ভালো আছে। স্বাভাবিক নিয়মেই খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, কান্না করছে। ও আমাদের কাছে বিশেষ কেউ নয়। কারণ আমাদের ছোটমনি নিবাসে এমন অনেক শিশু আছে। তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। নিরাপত্তার স্বার্থে এখন কোনো গণমাধ্যম কিংবা দত্তক প্রার্থীকে শিশুটিকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। শিশুটির সাথে দেখা করতে হলে অবশ্যই সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর লিখিত আবেদন করে অনুমতি নিয়ে তারপর সংবাদ কাভার এবং প্রার্থীরা দেখতে পারবেন। শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুন্সি মানবজমিনকে বলেন, আগে পরে অনেক বাচ্চা পাওয়া গেছে কিন্তু দত্তক নেয়ার জন্য এতো প্রার্থী হয়নি। এই বাচ্চার দত্তক প্রার্থী খুব বেশি হয়েছে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দর। সে মায়াবি চোখে তাকিয়ে ছিল। এবং তার মায়াবী ভঙ্গি যেটা দেখে বেশি লোকজন আকৃষ্ট হয়েছে। এছাড়া আমরা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম তার সত্যিকার বাবা মাকে আকৃষ্ট করার জন্য। যার জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষের বিবেক নড়ে গেছে। কিন্তু ওর প্রকৃত মায়ের বিবেক এতোটুকুও নড়েনি।
তিনি বলেন, শিশুটির বাবা মাকে খুঁজে পেতে আমরা বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে তদন্ত করছি। অনুসন্ধান করছি। এবং আমরা আশাবাদি যে কিছু একটা করতে পারবো। আমার মনে হয় এখানে ইনভেস্টিগেশন অফিসার শুধু আমরা না। সারা বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর মানুষ ভিডিওটা দেখছে। কেউ না কেউ শিশুর বাবা মাকে চেনে। বাচ্চাটিকে দেখে মনে হয়েছে, সে নরমাল ডেলিভারিয়ান নয়। সিজারিয়ান বেবি। এর সাথে যুক্ত বাবা-মা, পরিবারের সদস্য এবং ডাক্তার এরা কেউ না কেউ নিশ্চয় ভিডিও এবং শিশুটির খবর দেখেছে। আমরা আসলে এর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে প্রকৃত মায়ের কাছে তাকে ফেরত দিতে চাইছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, শিশুটির মায়ের নিশ্চয়ই কোনো ধরনের অসুবিধা ছিল। অন্যথায় কোনো মা তো তার সন্তানকে এভাবে ফেলে রেখে যায় না। বোধহয় সন্তানটিকে নিয়ে তার মা বিপদে পড়েছে। ভালো এবং ইতিবাচক দিক হচ্ছে এই যে, সমাজের উচুস্তর থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত সব শ্রেণীর মানুষ তাকে দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তার মানে আমাদের মধ্যে মানবতাবোধ এখনো জাগ্রত আছে। যে কারণে একটি শিশুকে সবাই দত্তক নিতে চাইছে।
শিশু হাসপাতালের শৌচাগারে কে বা কারা তাকে ফেলে যায়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তাকে। এখন তার ঠাঁই হয়েছে ছোটমণি নিবাসে। কিন্তু ছোট্ট এই শিশুকে নিয়ে শুরু হয়েছে রীতিমতো লড়াই। তাকে দত্তক পেতে চান অনেকে। প্রভাবশালী থেকে সাধারণ এ লাইন দীর্ঘ। তারা এরই মধ্যে আবেদন করেছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। হাসপাতালে থাকতেই শিশুটিকে নেয়ার জন্য আসে শ’ শ’ ফোন। বড় অঙ্কের টাকা দিতে চেয়েছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার নিজের ফ্ল্যাটও লিখে দিতে চেয়েছেন তার নামে। ছোট্ট শিশুটির নাম রাখা হয়েছে ‘গহীন’। রোববার দুপুরে রাজধানীর আজিমপুরের ছোটমনি নিবাসে গিয়ে দেখা যায়, মিডিয়াকর্মী এবং অভিভাবকদের ভিড়। শিশুটির নিরাপত্তার স্বার্থে একপর্যায়ে সকল মিডিয়া এবং দর্শনার্থীদের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ করে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। এসময় শিশুটিকে দত্তক নিতে আসা সিলেটের প্রবাসী মো. সাইফুল আলম বলেন, আমরা বিয়ে করেছি প্রায় ১৪ বছর। আমাদের কোনো ছেলে মেয়ে নেই। আমরা ইতোমধ্যে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছি। তাকে সন্তান হিসেবে পাওয়ার জন্য যা কিছু করতে হয় করবো। আমেরিকাতে আমার নিজের ব্যবসা আছে। পাশাপাশি আমি চাকরি করি। আমরা তাকে পেলে সরাসরি আমেরিকাতে নিয়ে যাবো।
তাকে পেতে আদালতের যে কোনো শর্ত মেনে নিতে আমরা প্রস্তুত। ঢাকা শিশু হাসপাতালের ওয়ার্ডমাস্টার রাসেল মাহমুদ বলেন, বাচ্চা কি আছে? বাচ্চা নাই। বাচ্চা নিয়ে গেছে। ছোটমনিতে যারা নেয়ার তারা নিয়ে গেছে। একটি বাচ্চার প্রতি যদি প্রভাবশালী মহল যুক্ত হয় সে বাচ্চা কি ছোটমনিতে রাখা সম্ভব। আমার স্ত্রী পলি আক্তার শিশুটিকে ছোটমনি নিবাসের কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শিশুটির দুঃশ্চিন্তায় তার রক্তের উচ্চচাপ অধিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। সে শিশুটিকে নেয়ার জন্য পাগল। পলি সুস্থ্য হলেই শিশুটিকে পেতে আমরা আইনি লড়াইয়ে যাবো। শিশুটিকে পেলে আমার পেনশন পুরোটাই ওর নামে লিখে দিবো। ছোটমনির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আপনাদের থেকে অনেক হাই প্রোফাইলের লোকজনের আবেদন এসেছে। এতো বড় লেভেলের মানুষ যেহেতু বাচ্চাটিকে চাইছে তাই আমরা সাধারণ আবেদনকারীরা হয়তো বাচ্চাটিকে পাবো না। শিশুটির চেহারার মাঝে এমন মায়া ও আকর্ষণ রয়েছে যেটা দেখে প্রথম থেকেই আমি আকর্ষিত হয়ে গেছি। দ্বিতীয়ত ৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে আমাদের কোনো ছেলে মেয়ে হয়নি। আগে পরে এরকম আরো বাচ্চা পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই বাচ্চাটির ভেতরে আলাদা একটি টান রয়েছে।
শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হামিদা আক্তার মিতা বলেন, আমার দুই ছেলে মেয়ে আছে। ওরা বড় হয়ে গেছে। ছেলে বিকেএসপিতে পড়ে। মেয়ে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসইতে পড়ে। অনেক আগে থেকেই শখ যে আমার দুটি ছেলে এবং দুটি মেয়ে থাকবে। কিন্তু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আমরা আর বাচ্চা নিতে পারবো না। ফলে অনেক আগে থেকেই আমার ভাবনা ছিল আমি যেহেতু বাচ্চা নিতে পারবো না তাই একটি কন্যা শিশু দত্তক নিবো। আমার খুব ইচ্ছা এই বাচ্চাটিকে যদি পাই তাহলে ওকে আমি মানুষের মতো মানুষ করবো। একটাই শঙ্কা শিশুটিকে পেতে এতো এতো প্রতিযোগীতা ‘যদি আমি না পাই’। রীতিমত আমার বুকের মাঝে ব্যথা শুরু হয়েছে। যদি আমি না পাই তাহলে নিজেকে কি সামলাতে পারবো? ওকে পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে আমি আমার আইনজীবী নিয়োগ করেছি। আমার তরফ থেকে শিশুটিকে পেতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। নামাজ পড়েও আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন বাচ্চাটিকে আমি পাই। মনে হয় যেন ও আমার নিজেরই সন্তান। ওর নামও আমি ঠিক করে ফেলছি। এই মেয়েকে রোজার মধ্যে পেলে আমি ওর নাম রাখবো ‘রোজা’। এবং অনেক বড় করে আকিকা দিয়ে ওর নাম রাখবো। এবং আমার যা কিছু সহায় সম্পত্তি আছে সব তিন সন্তানের নামে সমান সমান থাকবে।
সিলেটের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট হবিগঞ্জের অফিস কোর্ডিনেটর বোরহান উদ্দিন বলেন, ৭ বছর আগে আমি বিয়ে করেছি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমি নি:স্বন্তান। ফেসবুকে শিশুটির ছবি দেখে আমি খুবই ইমোশনাল হয়ে গিয়েছি। তৎক্ষণাত আমি ফেসবুকে কমেন্ট করেছি, ‘এই মেয়েটি যদি আমাকে দেওয়া হতো, তাহলে আমি ওকে আমার রাজকন্যা বানিয়ে রাখতাম’। তখন আমি বুঝতে পারিনি যে এই মেয়েটার জন্য সারা বাংলাদেশ এরকম পাগল হয়ে যাবে। আমি মনেকরি এই মেয়েটি খুব ভাগ্য নিয়ে দুনিয়াতে এসেছে। এতো মানুষের আগ্রহ দেখে আমি অনেকটা আশাহত হয়ে গেছি। সত্যিই আমি ওকে পাবো তো? চাকরির সুবাদে সিলেট থেকে আমি হয়তো ওভাবে আইনি লড়াই চালাতে পারবো না।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এমপি মানবজমিনকে বলেন, একটি শিশুর প্রতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কৌতূহল থাকবে এটাই সহজাত এবং স্বাভাবিক। আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিশুটির সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। ওর খাওয়া, ঘুম, স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সর্বোচ্চ সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শিশুটির সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখছেন। এবং আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তার বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সবার কাছে দোয়া প্রত্যাশা করছি শিশুটি যেখানেই থাকুক না কেন যেন ভালো থাকে।
শিশু হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালের কমন শৌচাগারের ভেতর থেকে সাত থেকে আট দিন বয়সী জীবিত এই নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির দায়িত্ব নিতে সমাজের অনেকেই ছুটে এসেছেন। এ ব্যাপারে আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অধীনে হস্তান্তরকৃত শিশুটিকে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথ আইন মেনেই দত্তক নিতে পারবেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির বলেন, ও (শিশুটি) ভালো আছে। শিশু দত্তক নেয়ার একটি বিধি বিধান আছে। ছোটমনি নিবাস থেকে দত্তক নিতে হলে আদালতে পারিবারিক আইনে একটি মামলা করতে হবে। এর প্রেক্ষিতে আদালত যিনি দত্তক নিবেন তার আর্র্থসামাজিক অবস্থা, পারিবারিক অবস্থা কেমন সেটা যাচাই বাচাই করবে। এবং কতটুকু সামর্থ আছে বাচ্চাকে রাখতে বা মানুষ করতে পারবে কি না। তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা এই সকল বিষয় বিবেচনা করে আদালত একটি রায় দেবেন। সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে আমরা শিশু নিবাস থেকে বাচ্চাটিকে দত্তক দিবো। এবং নির্দিষ্ট পরিমানে অর্থ শিশুর নামে লিখে দিতে হবে। আইনের চোখে যিনি সবচেয়ে যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন আদালত তাকেই শিশুটির দায়িত্ব দেবেন।
ছোটমনি নিবাসের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট জুবলি বেগম রানু বলেন, শিশুটি ভালো আছে। স্বাভাবিক নিয়মেই খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, কান্না করছে। ও আমাদের কাছে বিশেষ কেউ নয়। কারণ আমাদের ছোটমনি নিবাসে এমন অনেক শিশু আছে। তার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। নিরাপত্তার স্বার্থে এখন কোনো গণমাধ্যম কিংবা দত্তক প্রার্থীকে শিশুটিকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। শিশুটির সাথে দেখা করতে হলে অবশ্যই সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর লিখিত আবেদন করে অনুমতি নিয়ে তারপর সংবাদ কাভার এবং প্রার্থীরা দেখতে পারবেন। শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুন্সি মানবজমিনকে বলেন, আগে পরে অনেক বাচ্চা পাওয়া গেছে কিন্তু দত্তক নেয়ার জন্য এতো প্রার্থী হয়নি। এই বাচ্চার দত্তক প্রার্থী খুব বেশি হয়েছে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে মেয়েটি দেখতে খুবই সুন্দর। সে মায়াবি চোখে তাকিয়ে ছিল। এবং তার মায়াবী ভঙ্গি যেটা দেখে বেশি লোকজন আকৃষ্ট হয়েছে। এছাড়া আমরা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম তার সত্যিকার বাবা মাকে আকৃষ্ট করার জন্য। যার জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষের বিবেক নড়ে গেছে। কিন্তু ওর প্রকৃত মায়ের বিবেক এতোটুকুও নড়েনি।
তিনি বলেন, শিশুটির বাবা মাকে খুঁজে পেতে আমরা বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে তদন্ত করছি। অনুসন্ধান করছি। এবং আমরা আশাবাদি যে কিছু একটা করতে পারবো। আমার মনে হয় এখানে ইনভেস্টিগেশন অফিসার শুধু আমরা না। সারা বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর মানুষ ভিডিওটা দেখছে। কেউ না কেউ শিশুর বাবা মাকে চেনে। বাচ্চাটিকে দেখে মনে হয়েছে, সে নরমাল ডেলিভারিয়ান নয়। সিজারিয়ান বেবি। এর সাথে যুক্ত বাবা-মা, পরিবারের সদস্য এবং ডাক্তার এরা কেউ না কেউ নিশ্চয় ভিডিও এবং শিশুটির খবর দেখেছে। আমরা আসলে এর প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে প্রকৃত মায়ের কাছে তাকে ফেরত দিতে চাইছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, শিশুটির মায়ের নিশ্চয়ই কোনো ধরনের অসুবিধা ছিল। অন্যথায় কোনো মা তো তার সন্তানকে এভাবে ফেলে রেখে যায় না। বোধহয় সন্তানটিকে নিয়ে তার মা বিপদে পড়েছে। ভালো এবং ইতিবাচক দিক হচ্ছে এই যে, সমাজের উচুস্তর থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত সব শ্রেণীর মানুষ তাকে দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তার মানে আমাদের মধ্যে মানবতাবোধ এখনো জাগ্রত আছে। যে কারণে একটি শিশুকে সবাই দত্তক নিতে চাইছে।
No comments