পাঁচ দশকের দীর্ঘ লড়াই by বিল্লাল হোসেন রবিন
দুই
পরিবারের লড়াইয়ের শুরু প্রায় পাঁচ দশক আগে। দুটি পরিবারই আওয়ামী লীগের
রাজনীতির পরীক্ষিত পক্ষ। খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবার আর আলী আহমেদ চুনকার
পরিবার প্রথম মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় দলীয় প্রার্থী
হওয়াকে ঘিরে দুই পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। সে সময় আলী আহমেদ
চুনকা আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র লড়ে বিপুল ভোটে হারিয়েছিলেন
খোকা মহিউদ্দিনকে। খোকা আওয়ামী লীগ ও ওসমান আলীর পুত্র শামসুজ্জোহা
পরিবারের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন।
এই দ্বন্দ্বের জেরটা আরো জোরালো হয় ১৯৮০ সালে। এবার বিরোধের বিষয় জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। প্রতিযোগী সেই শামসুজ্জোহা ও চুনকা। এবার সরাসরি শামসুজ্জোহাকে হারিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন চুনকা। মাঝে কয়েক বছর বিরতি দিয়ে দুই পরিবারের বিরোধ সামনে আসে নারায়ণগঞ্জ নগর পিতার আসনটি নিয়ে। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েছিলেন চুনকা কন্যা আইভী। কিন্তু সেই সমর্থন পেয়েছিলেন শামসুজ্জোহা পুত্র শামীম ওসমান। ফল সেই আগের মতোই। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে নগরভবনে যান আইভী। মাঝে মিইয়ে থাকা দুই পরিবারের বিরোধটা এবার তুঙ্গে ওঠে। নানা ঘটনা আর শামীম-আইভীর বাকযুদ্ধ উত্তপ্ত রাখে জেলা রাজনীতিকে। আইভী দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হওয়ার ক্ষেত্রে দৃশ্যত বাধা ছিল না ওসমান পরিবার। কিন্তু জেলার লোকজন বলছেন, আদতে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে লড়েই দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হন আইভী। দীর্ঘ পাঁচ দশকে দুই পরিবারের রাজনৈতিক বিরোধ এতদিন বাকযুদ্ধ আর আলোচনার মধ্যেই ছিল। দলের নেতারা কাছে ডেকে বিরোধ মিটিয়ে দিয়েছেন দফায় দফায়।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার তা রাজপথে গড়ায়। শামীম-আইভীর সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা উত্তাপ ছড়ায় রাজনীতির ময়দানে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিব্রত দলের নেতারা। বিরোধ মেটাতে বরাবরের মতোই নেতারা উদ্যোগ নিচ্ছেন এমন আলোচনা হচ্ছে।
যেখান থেকে দ্বন্দ্বের শুরু: শুরুটা স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে। সে সময় পৌর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার জন্য আলী আহাম্মদ চুনকা নিজের দল আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েও পাননি, সমর্থন পান মহিউদ্দিন আহম্মেদ খোকা ওরফে খোকা মহিউদ্দিন। খোকার এই সমর্থন পাওয়ার পেছনে প্রত্যক্ষ শক্তি ছিলেন ওসমান পরিবারের একেএম শামসুজ্জোহা। চুনকা মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হওয়ার পরও সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হন। এর পর থেকে চুনকা পরিবার ও ওসমান পরিবারের মধ্যে শীতল দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৮০ সালে জেলা আওয়ামী লীগ সম্মেলনে শামসুজ্জোহা ও চুনকা সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চুনকা জয়ী হন। ১৯৮৪ সালে আলী আহাম্মদ চুনকার মৃত্যুর পর ৮৫ সালে তার মেয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী বিদেশে পড়তে গেলে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির মাঠে একক কর্তৃত্বের দাবিদার হয়ে উঠে ওসমান পরিবার। তবে ওই সময়ে শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপিকা নাজমা রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত থাকে চুনকার নেতাকর্মীরা। ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে নৌকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাচন করেন নাজমা রহমান। কিন্তু শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম ওসমান ও তার ভাই জাতীয় পার্টির মনোনীত নাসিম ওসমানের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে শামীম ওসমানের সঙ্গে দূরুত্ব তৈরি হয় নাজমা রহমানের। শহরের উত্তর-দক্ষিণের রাজনীতি নাজমা রহমানের মাধ্যমে জিইয়ে থাকে অনেক দিন। ১৯৯২ সালে চুনকা কন্যা আইভী দেশে ফিরে শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক হন। অল্প সময়ে ব্যবধানে তিনি আবার বিদেশে ফিরে যান। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচনের কয়েকদিন আগে দেশে ফিরে নির্বাচন করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায় ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ৩৭ বছর আগের ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেইবার প্রতিদ্বন্দ্বী চুনকা কন্যা আইভী ও জোহা পুত্র শামীম ওসমান। তখনও আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন মেলেনি চুনকা পরিবারের, তবে জয় ছিনিয়ে নেন চুনকা কন্যা আইভী। শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে পরাজিত করেন আইভী। জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের হোঁচট খান শামীম ওসমান। ওই নির্বাচন ঘিরে শামীম-আইভি একে অপরকে দোষারোপ ও বাক বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। এরপর থেকে আরো নানান ঘটনায় দুই পরিবারের দু’জনেই পরস্পরকে দোষাদোষী করতে দেখেছে দেশের মানুষ। এমনকি আলোচিত ত্বকী হত্যা ও সাত খুনের ঘটনায়ও দোষাদোষী চলে সমান তালে। একে অপরকে খুন, গুম, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। টেলিভিশনে সরাসরি সমপ্রচারিত টক-শোতেও শামীম ওসমান ও আইভীর মারমুখী বাক্য বিনিময় ও শক্তি প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ করতে দেখা গেছে। এমনকি সিটি করপোরেশনের ময়লা নিয়ে নোংরা রাজনীতি করা হয়েছে। আইভীকে কোণঠাসা করতে শামীম ওসমানের লোকজন অশ্লীল লেখা ও আইভীর বিকৃতি ছবি দিয়ে ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড বানিয়ে সারা শহর ছেয়ে দিয়েছেন। মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে বিষোদগার করেছেন। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকে বিগত ৫ বছর।
এবারের সিটি নির্বাচনেও প্রথম থেকেই ওসমান পরিবার চুনকা কন্যা আইভীর বিপক্ষে অবস্থান নেন। এমনকি তৃণমূল থেকে প্রার্থী হিসাবে যে তিন জনের নাম কেন্দ্রের কাছে মনোনয়নের জন্য পাঠানো হয়েছিল সেখানেও ছিল না আইভীর নাম। এর পেছনেও ওসমান পরিবার কলকাঠি নেড়েছিল বলে মনে করেন আইভীর ঘনিষ্ঠজনরা। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ আইভীকেই চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়। কেন্দ্রের নেতারা আইভী-শামীমের বিরোধ নিরসনে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মধ্যস্থতা করেন। তারপর চলে নানা নাটকীয়তা। আইভীর সমর্থনে সংবাদ সম্মেলন করেন ও আইভিকে উপহার পাঠান শামীম ওসমান। এমনকি নৌকায় ভোট দিয়েছেন তা প্রমাণ করতে তিনি মিডিয়ার সামনে ব্যালট পেপার প্রদর্শন করেন নির্বাচনী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। নির্বাচনে বিজয়ী হন আইভী। প্রথম বাজেটের দিন ওসমান পরিবারের মেজ ছেলে সেলিম ওসমান ঘোষণা দিয়ে আইভীর পাশে বসেন। বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে নেন উপস্থিত সবাই। সেখানে সেলিম ওসমান মেয়রকে নগরের উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। মেয়রও তার কাছে সহযোগিতা চান। এবং যৌথ উদ্যোগে নিতাইগঞ্জ থেকে দীর্ঘদিনের অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ হয়। কিছু দিন ভালোই চলছিল সব কিছু। কিন্তু নগরবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ফুটপাথ হকার মুক্ত করতে বার বার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছেন মেয়র। কিন্তু সকালে উচ্ছেদ হলে বিকালেই অদৃশ্য ইশারায় হকাররা যে যার মত বসে পড়ে। মোট কথা ইঁদুর বিড়াল খেলা চলতে থাকে হকার উচ্ছেদ নিয়ে। এজন্য মেয়র প্রশাসনের অসহযোগিতাকে দায়ী করেন। একপর্যায়ে ২৫শে ডিসেম্বর থেকে প্রশাসন শহরের ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ শুরু করে। ২৯শে ডিসেম্বর হকাররা ছুটে যান এমপি শামীম ওসমানের কাছে। তিনি হকারদের উদ্দেশে বলেন, মেয়র আইভীর নির্দেশে হকার উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান আমার জানা নাই। আপনারা তার কাছে যান। তিনি আপনাদের ব্যবস্থা করবেন। না করলে আমি দেখবো। এরপর ৩১শে ডিসেম্বর হকাররা স্মারকরিপি নিয়ে মেয়র আইভীর কাছে যান। মেয়র তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ৫ লাখ নগরবাসীর ভোগান্তি সৃষ্টি করে ফুটপাথে হকার বসতে দিতে পারি না। আমি হকার্স মার্কেট করে দিয়েছি সেখানে বসেন। প্রয়োজনে শুক্রবার, শনিবার শহরের ৪টি পয়েন্টে বসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সড়কে হকার বসতে দেয়া হবে না। ৩রা জানুয়ারি হকাররা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনিও মেয়রের ভাষায় কথা বলেন এবং বৈধ হকারদের তালিকা তার কাছে জমা দিতে বলেন। পরে ১৩ই জানুয়ারি হকাররা যান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমানের কাছে। তিনিও আইভীর প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে হকারদের বিকল্প ৪টি জায়গায় বসার পরামর্শ দেন। হকাররা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে ১৩ই জানুয়ারি রাতে সেলিম ওসমান হকারদের পক্ষে সুপারিশ করে মেয়রকে চিঠি দেন। ১৪ই জানুয়ারি বিকালে মেয়র চিঠির জবাব দেন। জবাবে মেয়র সেলিম ওসমানের কিছু প্রস্তাব নাকচ করে বাকিগুলোর সঙ্গে আরো যুক্ত করেন। সেলিম ওসমান মেয়রকে চিঠির জবাব দেয়ায় ধন্যবাদ দেন। এবং প্রস্তাবিত জায়গায় হকার বসা নিয়ে তিনি বিদেশ থেকে এসে আলোচনা করবেন বলে জানান প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে ১৪ই জানুয়ারি হকাররা নিয়মিত সমাবেশের একপর্যায়ে বলেন, এবার আমরা গরিবের বন্ধু এমপি শামীম ওসমানের কাছে যাবো। তিনি আমাদের গরিবের নেতা। তিনিই সব সমাধান করবেন। ১৫ই জানুয়ারি বিকালে চাষাড়া পৌর মার্কেটের সামনে সমাবেশে করেন হকাররা। সেখানে শামীম ওসমান উপস্থিত হয়ে বলেন, আগামীকাল (মঙ্গলবার) বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে হকার বসবে। এটা আমার অনুরোধ নয়, নির্দেশ। আমি শহীদ মিনারে উপস্থিত থাকবো, আপনাদের কেউ মারলে আপনারা মার খাবেন। কিভাবে পাল্টা মাইর দিতে হয় আমার জানা আছে। শামীম ওসমানের এই বক্তব্যে অবাক হন সিটি মেয়র। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু সড়কে হকার বসবে না। হকারদের জন্য প্রয়োজনে আরো বিকল্প জায়গা করে সেখানে পুনর্বাসন করবেন। একথাগুলো ১৬ই জানুয়ারি মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে মিডিয়ার সামনে বলবেন। সেই মতে তিনি নগরভবন থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হন। এদিকে পূর্ব ঘোষণা মতে দুপুরের পর থেকে হকাররা ফুটপাথে বসার জন্য শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন। শামীম ওসমানের লোকজন শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়। যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়। রাজপথে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয় সন্ত্রাসীরা। ওই সংঘর্ষে আইভী নিজেও আহত হন। ঘটনার আগে ও পরে শামীম-আইভী অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন একে অন্যের বিরুদ্ধে।
ওসমান পরিবার: বিভিন্ন সময়ে চমকপ্রদ অনেক খবরের শিরোনাম হওয়া শামীম ওসমানের পূর্ববর্তী তিন পুরুষের রাজনৈতিক ইতিহাস অনেক বৈচিত্র্যময়। ওসমান পরিবারের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিষ্ঠাতা খান সাহেব ওসমান আলী ১৯০০ সালে তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। ত্রিশের দশকে তিনি নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জেই স্থায়ী হন। খান সাহেব ওসমান আলীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৪৬ সালে তৎকালীন ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহর জামানত বাজেয়াপ্ত করে এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৩৫ সালে খান সাহেব ওসমান আলী নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া রেললাইন সংলগ্ন স্থানে গড়ে তোলেন ঐতিহাসিক বায়তুল আমান। বিভিন্ন সময়ে ওসমান পরিবার দাবি করে যে বঙ্গবন্ধুর পদচারণায় এই বায়তুল আমানে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এরপর রাজনীতির মাঠে আসেন ওসমান পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম খান সাহেব ওসমান আলীর ছেলে একেএম শামছুজ্জোহা। ৭০-এর প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচনে তিনি পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে খান সাহেব ওসমান আলী মৃত্যুবরণ করেন। এই পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৭৩ সালে শামছুজ্জোহা জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১২ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়। একেএম শামছুজ্জোহার তিন ছেলে- নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। তিনিও তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তার মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত সেলিম ওসমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৯৬ সালের নির্বাচনে জ্জোহা পুত্র শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমান সংসদেও তিনি এই আসনের এমপি।
চুনকা পরিবার: ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আলী আহম্মদ চুনকা। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগের পাশাপাশি শ্রমিক রাজনীতি করতেন। দিন দিন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চুনকা। তিনি নারায়ণগঞ্জের প্রথম নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান। দুবার নারায়ণগঞ্জের পৌর চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রতিদ্বন্দ্বী ওসমান পরিবারের একেএম শামছুজ্জোহাকে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আলী আহম্মদ চুনকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তান সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি পেশায় চিকিৎসক। ১৯৮৪ সালে চুনকার মৃত্যুর পর ১৯৮৬ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওদেসা নগরের পিরাগভ মেডিকেল ইন্সটিটিউটে পড়তে যান। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আইভী রাজনীতির মাঠে যোগ দেন ১৯৯২ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে। ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ শহরের পৌর মেয়রের পদে ছিলেন আইভী। এরপর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই দেশের প্রথম নারী সিটি মেয়র।
এই দ্বন্দ্বের জেরটা আরো জোরালো হয় ১৯৮০ সালে। এবার বিরোধের বিষয় জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। প্রতিযোগী সেই শামসুজ্জোহা ও চুনকা। এবার সরাসরি শামসুজ্জোহাকে হারিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন চুনকা। মাঝে কয়েক বছর বিরতি দিয়ে দুই পরিবারের বিরোধ সামনে আসে নারায়ণগঞ্জ নগর পিতার আসনটি নিয়ে। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েছিলেন চুনকা কন্যা আইভী। কিন্তু সেই সমর্থন পেয়েছিলেন শামসুজ্জোহা পুত্র শামীম ওসমান। ফল সেই আগের মতোই। আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটে হারিয়ে নগরভবনে যান আইভী। মাঝে মিইয়ে থাকা দুই পরিবারের বিরোধটা এবার তুঙ্গে ওঠে। নানা ঘটনা আর শামীম-আইভীর বাকযুদ্ধ উত্তপ্ত রাখে জেলা রাজনীতিকে। আইভী দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হওয়ার ক্ষেত্রে দৃশ্যত বাধা ছিল না ওসমান পরিবার। কিন্তু জেলার লোকজন বলছেন, আদতে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে লড়েই দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হন আইভী। দীর্ঘ পাঁচ দশকে দুই পরিবারের রাজনৈতিক বিরোধ এতদিন বাকযুদ্ধ আর আলোচনার মধ্যেই ছিল। দলের নেতারা কাছে ডেকে বিরোধ মিটিয়ে দিয়েছেন দফায় দফায়।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার তা রাজপথে গড়ায়। শামীম-আইভীর সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা উত্তাপ ছড়ায় রাজনীতির ময়দানে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিব্রত দলের নেতারা। বিরোধ মেটাতে বরাবরের মতোই নেতারা উদ্যোগ নিচ্ছেন এমন আলোচনা হচ্ছে।
যেখান থেকে দ্বন্দ্বের শুরু: শুরুটা স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে। সে সময় পৌর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার জন্য আলী আহাম্মদ চুনকা নিজের দল আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েও পাননি, সমর্থন পান মহিউদ্দিন আহম্মেদ খোকা ওরফে খোকা মহিউদ্দিন। খোকার এই সমর্থন পাওয়ার পেছনে প্রত্যক্ষ শক্তি ছিলেন ওসমান পরিবারের একেএম শামসুজ্জোহা। চুনকা মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হওয়ার পরও সমর্থন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হন। এর পর থেকে চুনকা পরিবার ও ওসমান পরিবারের মধ্যে শীতল দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৮০ সালে জেলা আওয়ামী লীগ সম্মেলনে শামসুজ্জোহা ও চুনকা সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চুনকা জয়ী হন। ১৯৮৪ সালে আলী আহাম্মদ চুনকার মৃত্যুর পর ৮৫ সালে তার মেয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী বিদেশে পড়তে গেলে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির মাঠে একক কর্তৃত্বের দাবিদার হয়ে উঠে ওসমান পরিবার। তবে ওই সময়ে শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপিকা নাজমা রহমানের নেতৃত্বে সংগঠিত থাকে চুনকার নেতাকর্মীরা। ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে নৌকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাচন করেন নাজমা রহমান। কিন্তু শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম ওসমান ও তার ভাই জাতীয় পার্টির মনোনীত নাসিম ওসমানের পক্ষে কাজ করার অভিযোগে শামীম ওসমানের সঙ্গে দূরুত্ব তৈরি হয় নাজমা রহমানের। শহরের উত্তর-দক্ষিণের রাজনীতি নাজমা রহমানের মাধ্যমে জিইয়ে থাকে অনেক দিন। ১৯৯২ সালে চুনকা কন্যা আইভী দেশে ফিরে শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক হন। অল্প সময়ে ব্যবধানে তিনি আবার বিদেশে ফিরে যান। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচনের কয়েকদিন আগে দেশে ফিরে নির্বাচন করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায় ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ৩৭ বছর আগের ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেইবার প্রতিদ্বন্দ্বী চুনকা কন্যা আইভী ও জোহা পুত্র শামীম ওসমান। তখনও আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন মেলেনি চুনকা পরিবারের, তবে জয় ছিনিয়ে নেন চুনকা কন্যা আইভী। শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে পরাজিত করেন আইভী। জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের হোঁচট খান শামীম ওসমান। ওই নির্বাচন ঘিরে শামীম-আইভি একে অপরকে দোষারোপ ও বাক বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন প্রকাশ্যেই। এরপর থেকে আরো নানান ঘটনায় দুই পরিবারের দু’জনেই পরস্পরকে দোষাদোষী করতে দেখেছে দেশের মানুষ। এমনকি আলোচিত ত্বকী হত্যা ও সাত খুনের ঘটনায়ও দোষাদোষী চলে সমান তালে। একে অপরকে খুন, গুম, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। টেলিভিশনে সরাসরি সমপ্রচারিত টক-শোতেও শামীম ওসমান ও আইভীর মারমুখী বাক্য বিনিময় ও শক্তি প্রদর্শনের চ্যালেঞ্জ করতে দেখা গেছে। এমনকি সিটি করপোরেশনের ময়লা নিয়ে নোংরা রাজনীতি করা হয়েছে। আইভীকে কোণঠাসা করতে শামীম ওসমানের লোকজন অশ্লীল লেখা ও আইভীর বিকৃতি ছবি দিয়ে ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ড বানিয়ে সারা শহর ছেয়ে দিয়েছেন। মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করে বিষোদগার করেছেন। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকে বিগত ৫ বছর।
এবারের সিটি নির্বাচনেও প্রথম থেকেই ওসমান পরিবার চুনকা কন্যা আইভীর বিপক্ষে অবস্থান নেন। এমনকি তৃণমূল থেকে প্রার্থী হিসাবে যে তিন জনের নাম কেন্দ্রের কাছে মনোনয়নের জন্য পাঠানো হয়েছিল সেখানেও ছিল না আইভীর নাম। এর পেছনেও ওসমান পরিবার কলকাঠি নেড়েছিল বলে মনে করেন আইভীর ঘনিষ্ঠজনরা। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ আইভীকেই চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়। কেন্দ্রের নেতারা আইভী-শামীমের বিরোধ নিরসনে ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মধ্যস্থতা করেন। তারপর চলে নানা নাটকীয়তা। আইভীর সমর্থনে সংবাদ সম্মেলন করেন ও আইভিকে উপহার পাঠান শামীম ওসমান। এমনকি নৌকায় ভোট দিয়েছেন তা প্রমাণ করতে তিনি মিডিয়ার সামনে ব্যালট পেপার প্রদর্শন করেন নির্বাচনী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। নির্বাচনে বিজয়ী হন আইভী। প্রথম বাজেটের দিন ওসমান পরিবারের মেজ ছেলে সেলিম ওসমান ঘোষণা দিয়ে আইভীর পাশে বসেন। বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে নেন উপস্থিত সবাই। সেখানে সেলিম ওসমান মেয়রকে নগরের উন্নয়নে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। মেয়রও তার কাছে সহযোগিতা চান। এবং যৌথ উদ্যোগে নিতাইগঞ্জ থেকে দীর্ঘদিনের অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ হয়। কিছু দিন ভালোই চলছিল সব কিছু। কিন্তু নগরবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ফুটপাথ হকার মুক্ত করতে বার বার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছেন মেয়র। কিন্তু সকালে উচ্ছেদ হলে বিকালেই অদৃশ্য ইশারায় হকাররা যে যার মত বসে পড়ে। মোট কথা ইঁদুর বিড়াল খেলা চলতে থাকে হকার উচ্ছেদ নিয়ে। এজন্য মেয়র প্রশাসনের অসহযোগিতাকে দায়ী করেন। একপর্যায়ে ২৫শে ডিসেম্বর থেকে প্রশাসন শহরের ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ শুরু করে। ২৯শে ডিসেম্বর হকাররা ছুটে যান এমপি শামীম ওসমানের কাছে। তিনি হকারদের উদ্দেশে বলেন, মেয়র আইভীর নির্দেশে হকার উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান আমার জানা নাই। আপনারা তার কাছে যান। তিনি আপনাদের ব্যবস্থা করবেন। না করলে আমি দেখবো। এরপর ৩১শে ডিসেম্বর হকাররা স্মারকরিপি নিয়ে মেয়র আইভীর কাছে যান। মেয়র তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ৫ লাখ নগরবাসীর ভোগান্তি সৃষ্টি করে ফুটপাথে হকার বসতে দিতে পারি না। আমি হকার্স মার্কেট করে দিয়েছি সেখানে বসেন। প্রয়োজনে শুক্রবার, শনিবার শহরের ৪টি পয়েন্টে বসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সড়কে হকার বসতে দেয়া হবে না। ৩রা জানুয়ারি হকাররা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনিও মেয়রের ভাষায় কথা বলেন এবং বৈধ হকারদের তালিকা তার কাছে জমা দিতে বলেন। পরে ১৩ই জানুয়ারি হকাররা যান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমানের কাছে। তিনিও আইভীর প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে হকারদের বিকল্প ৪টি জায়গায় বসার পরামর্শ দেন। হকাররা তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে ১৩ই জানুয়ারি রাতে সেলিম ওসমান হকারদের পক্ষে সুপারিশ করে মেয়রকে চিঠি দেন। ১৪ই জানুয়ারি বিকালে মেয়র চিঠির জবাব দেন। জবাবে মেয়র সেলিম ওসমানের কিছু প্রস্তাব নাকচ করে বাকিগুলোর সঙ্গে আরো যুক্ত করেন। সেলিম ওসমান মেয়রকে চিঠির জবাব দেয়ায় ধন্যবাদ দেন। এবং প্রস্তাবিত জায়গায় হকার বসা নিয়ে তিনি বিদেশ থেকে এসে আলোচনা করবেন বলে জানান প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে ১৪ই জানুয়ারি হকাররা নিয়মিত সমাবেশের একপর্যায়ে বলেন, এবার আমরা গরিবের বন্ধু এমপি শামীম ওসমানের কাছে যাবো। তিনি আমাদের গরিবের নেতা। তিনিই সব সমাধান করবেন। ১৫ই জানুয়ারি বিকালে চাষাড়া পৌর মার্কেটের সামনে সমাবেশে করেন হকাররা। সেখানে শামীম ওসমান উপস্থিত হয়ে বলেন, আগামীকাল (মঙ্গলবার) বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে হকার বসবে। এটা আমার অনুরোধ নয়, নির্দেশ। আমি শহীদ মিনারে উপস্থিত থাকবো, আপনাদের কেউ মারলে আপনারা মার খাবেন। কিভাবে পাল্টা মাইর দিতে হয় আমার জানা আছে। শামীম ওসমানের এই বক্তব্যে অবাক হন সিটি মেয়র। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু সড়কে হকার বসবে না। হকারদের জন্য প্রয়োজনে আরো বিকল্প জায়গা করে সেখানে পুনর্বাসন করবেন। একথাগুলো ১৬ই জানুয়ারি মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে মিডিয়ার সামনে বলবেন। সেই মতে তিনি নগরভবন থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হন। এদিকে পূর্ব ঘোষণা মতে দুপুরের পর থেকে হকাররা ফুটপাথে বসার জন্য শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন। শামীম ওসমানের লোকজন শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়। যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়। রাজপথে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয় সন্ত্রাসীরা। ওই সংঘর্ষে আইভী নিজেও আহত হন। ঘটনার আগে ও পরে শামীম-আইভী অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন একে অন্যের বিরুদ্ধে।
ওসমান পরিবার: বিভিন্ন সময়ে চমকপ্রদ অনেক খবরের শিরোনাম হওয়া শামীম ওসমানের পূর্ববর্তী তিন পুরুষের রাজনৈতিক ইতিহাস অনেক বৈচিত্র্যময়। ওসমান পরিবারের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিষ্ঠাতা খান সাহেব ওসমান আলী ১৯০০ সালে তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। ত্রিশের দশকে তিনি নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জেই স্থায়ী হন। খান সাহেব ওসমান আলীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ১৯৪৬ সালে তৎকালীন ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহর জামানত বাজেয়াপ্ত করে এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৩৫ সালে খান সাহেব ওসমান আলী নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া রেললাইন সংলগ্ন স্থানে গড়ে তোলেন ঐতিহাসিক বায়তুল আমান। বিভিন্ন সময়ে ওসমান পরিবার দাবি করে যে বঙ্গবন্ধুর পদচারণায় এই বায়তুল আমানে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এরপর রাজনীতির মাঠে আসেন ওসমান পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম খান সাহেব ওসমান আলীর ছেলে একেএম শামছুজ্জোহা। ৭০-এর প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচনে তিনি পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে খান সাহেব ওসমান আলী মৃত্যুবরণ করেন। এই পরিবারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৭৩ সালে শামছুজ্জোহা জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১২ সালে তাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়। একেএম শামছুজ্জোহার তিন ছেলে- নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। তিনিও তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য। তার মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত সেলিম ওসমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৯৬ সালের নির্বাচনে জ্জোহা পুত্র শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বর্তমান সংসদেও তিনি এই আসনের এমপি।
চুনকা পরিবার: ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আলী আহম্মদ চুনকা। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগের পাশাপাশি শ্রমিক রাজনীতি করতেন। দিন দিন নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চুনকা। তিনি নারায়ণগঞ্জের প্রথম নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান। দুবার নারায়ণগঞ্জের পৌর চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রতিদ্বন্দ্বী ওসমান পরিবারের একেএম শামছুজ্জোহাকে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আলী আহম্মদ চুনকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তান সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি পেশায় চিকিৎসক। ১৯৮৪ সালে চুনকার মৃত্যুর পর ১৯৮৬ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ওদেসা নগরের পিরাগভ মেডিকেল ইন্সটিটিউটে পড়তে যান। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আইভী রাজনীতির মাঠে যোগ দেন ১৯৯২ সালে নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে। ২০০৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ শহরের পৌর মেয়রের পদে ছিলেন আইভী। এরপর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই দেশের প্রথম নারী সিটি মেয়র।
No comments