পশ্চিম নিজের অঙ্গীকার ভুলে গেছে by জেফরি ডি স্যাক্স
গ্লোবাল
পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (জিপিই) ৬৫টি নিম্ন আয়ের দেশে শিক্ষা বিস্তারের এক
ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা আমাদের
উন্নয়নবিশারদদের ভাষায় ‘শূন্যস্থান পূরণ’ পর্ব, যার অর্থ হলো, শূন্য তহবিল
পূরণ করতে দাতাদেশগুলোকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই উদ্যোগের
জন্য বছরে যে মাত্র ১০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, সবার জন্য
শিক্ষা অ্যাজেন্ডার প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর অঙ্গীকার কতটা। মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কখনোই এ ব্যাপারে অতটা মাথা ঘামায়নি। রোগ বা
মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা গেলে তারা কখনো কখনো এইডস, ম্যালেরিয়া ও ইবোলার
মতো রোগের পেছনে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। মানুষের জীবন রক্ষার্থে এবং রোগটিকে
তাদের দেশে আসতে বাধা দিতে তারা সেটা করেছে। কিন্তু শিক্ষার প্রসঙ্গে দেখা
যায়, পশ্চিমের অনেক দেশ বিদ্যালয় নির্মাণের চেয়ে দেয়াল ও নির্যাতন শিবির
নির্মাণে বেশি আগ্রহী। সারা পৃথিবীতে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারে জিপিই
দারুণ কাজ করছে। দাতাদেশগুলো অনেক আগেই সবার জন্য শিক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ
করেছে, তাদের উচিত হলো, জিপিইর মতো বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলোর
একটিকে সাহায্য করার জন্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু উদার দাতারা
কালেভদ্রে সেটা করে থাকে। এই বাস্তবতার জন্ম সাম্রাজ্যিক যুগে। যখন আফ্রিকা
ও এশিয়ার সিংহভাগ ইউরোপীয় শাসনের অধীনে ছিল, তখন সেই ঔপনিবেশিক শাসকেরা
মৌলিক শিক্ষায় খুব সামান্যই বিনিয়োগ করতেন। ১৯৫০-এর দশকের শেষ ভাগে
জাতিসংঘের তথ্যানুসারে ইউরোপের আফ্রিকান ও এশীয় উপনিবেশগুলোতে সাক্ষরতার
হার ছিল খুবই কম। ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের সাক্ষরতার
হার ছিল ১৫-২০ শতাংশ। নেদারল্যান্ডসের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের সময়
ইন্দোনেশিয়ার সাক্ষরতার হারও ছিল একই রকম। ফরাসি উপনিবেশ পশ্চিম আফ্রিকায়
১৯৫০-এর দশকে সাক্ষরতার হার ছিল ১ থেকে ৫ শতাংশ।
স্বাধীনতার পর আফ্রিকান ও
এশীয় দেশগুলো মৌলিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার বিস্তারে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়। তা
সত্ত্বেও এই সুযোগে ক্ষতিপূরণ না করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিক ও
মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তারে যৎসামান্য টাকা দিয়েছে। যদিও তারা সবার জন্য
শিক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৪-এর বাস্তবায়নে গভীর অঙ্গীকার করেছে, যার
মাধ্যমে সবার জন্য প্রাক্প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ২০১০ থেকে ২০১৫
সালের মধ্যে শিক্ষায় অনুদান প্রকৃত অর্থে কমেছে। সর্বসাম্প্রতিক
তথ্যানুসারে আফ্রিকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় দাতাদের অনুদানের পরিমাণ
১৩০ কোটি ডলার। এর একটু তুলনা করলে দেখা যাবে, পেন্টাগনের দৈনিক বাজেট ২০০
কোটি ডলার। আফ্রিকায় স্কুলগামী শিশুদের সংখ্যা ৪২ কোটি, অর্থাৎ শিশুপ্রতি
বছরওয়ারি মোট অনুদানের পরিমাণ তিন ডলার। ব্যাপারটা এমন নয় যে পশ্চিমা
সরকারগুলো জানে না কত টাকা দরকার। একাধিক সাম্প্রতিক বড় হিসাবে জানা যায়,
এসডিজির চতুর্থ অভীষ্ট বাস্তবায়নে কী পরিমাণে বাহ্যিক অর্থায়ন দরকার।
ইউনেসকোর সমীক্ষায় দেখা যায়, এতে বছরে ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার লাগবে। সাবেক
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের নেতৃত্বাধীন ইন্টারন্যাশনাল কমিশন
অন ফাইন্যান্সিং এডুকেশন অপরচুনিটিও বলেছে, এই খাতে প্রতিবছর প্রায় এই
পরিমাণ টাকা লাগবে। আর সে কারণেই অনুদান জরুরি। আফ্রিকায় একজন ছাত্রের
শিক্ষা বাবদ বছরে অন্তত ৩০০ ডলার প্রয়োজন (খেয়াল করুন, ধনী দেশগুলো
প্রতিবছর মাথাপিছু কয়েক হাজার ডলার ব্যয় করে)। আফ্রিকার স্কুলগামী ছাত্রের
সংখ্যা তার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। সে কারণে তার মাথাপিছু ১০০ ডলার
প্রয়োজন। তারপরও এটা আফ্রিকার একটি দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ১০ শতাংশ। এই
শূন্যতা পূরণ করতে পারে বাহ্যিক অর্থায়ন। তবে সেটা হচ্ছে না। সাবসাহারা
আফ্রিকায় স্কুলগামী প্রতিটি শিশুর পেছনে বার্ষিক যে ব্যয় হয়, তা চাহিদার
মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। ফলে অধিকাংশ শিশু মাধ্যমিক স্কুল শেষ করার পর্যায়ে যেতে
পারে না। তারা অনেক আগেভাগে স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়। কারণ একদিকে সরকারি
স্কুলে তাদের জায়গা হয় না, অন্যদিকে বেসরকারি স্কুলের টিউশন ফি অনেক বেশি।
বিশেষ করে, মেয়েরা দ্রুত ঝরে পড়ে, যদিও অভিভাবকেরা জানেন, সব শিশুর
মানসম্পন্ন শিক্ষার চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা আছে। ফলে যেটা হয় তা হলো, দ্রুত
ঝরে পড়ার কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা যে দক্ষতা অর্জন করে
থাকে, সেটা তারা অর্জন করতে পারে না। অনেকেই তখন জীবিকার জন্য মরিয়া হয়ে
ইউরোপে পাড়ি জমায়। ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপে যেতে গিয়ে অনেকেই ডুবে মরে।
অনেকেই আবার সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে আফ্রিকায় ফেরত যায়। এবার জিপিইর
শূন্যস্থান পূরণের পর্বে আসি, যেটা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে সেনেগালে হতে
পারে। এদের অন্তত বছরে এক হাজার কোটি ডলার পাওয়া উচিত, যেটা ন্যাটোভুক্ত
দেশগুলোর চার দিনের সামরিক ব্যয়ের সমান। আফ্রিকায় সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা
নিশ্চিতকরণে এটি জরুরি। কিন্তু জিপিই সারা পৃথিবীর জন্য বছরে ১০০ কোটি
ডলার ভিক্ষা চাইছে। পশ্চিমা নেতারা প্রকৃত অর্থে শিক্ষার সংকট সমাধান না
করে একের পর এক বক্তৃতা দেন এবং এক বৈঠক থেকে আরেক বৈঠকে যান। তাঁরা সবার
জন্য শিক্ষার নীতির প্রতি ভালোবাসার কথা বলে বেড়ান। আফ্রিকাজুড়ে রাজনৈতিক,
ধর্মীয় ও নাগরিক সমাজের নেতারা যা পারেন, তা করে যাচ্ছেন। ঘানা সম্প্রতি
সবার জন্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ঘোষণা দিয়ে মহাদেশটির গতি ঠিক করে দিয়েছে।
আফ্রিকার দেশগুলো উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যপূরণে টাকার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
সে জন্য নতুন অংশীদার, বেসরকারি কোম্পানি ও উচ্চস্তরের ব্যক্তিদের এগিয়ে
আসা উচিত। মূলধারার দাতারা অনেক সময় নষ্ট করেছেন, যেটা এখন তাঁদের পূরণ
করতে হবে। শিক্ষার চাহিদা কখনো কমবে না। কিন্তু যাঁরা শিশুদের চাহিদার দিক
থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, ইতিহাস তাঁদের কঠিন বিচার করবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জেফরি ডি স্যাক্স: যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জেফরি ডি স্যাক্স: যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
No comments