নেপাল কারও খেলার তাস হবে না by সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো :
২০১৭ সালজুড়ে নেপালে আঞ্চলিক, প্রাদেশিক ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন গোলযোগ
ছাড়াই অনুষ্ঠিত হলো। সব নির্বাচনেই আপনাদের দল নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি
(ইউএমএল) জয়ী হয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে সব সম্পন্ন করার চাবিকাঠি কী ছিল?
মাধব কুমার নেপাল : নেপালের রাজনৈতিক সংস্কৃতি খুব ভালো। আমরা সবাই সামাজিক সম্পর্ক রেখে চলি। গণতন্ত্রের কিছু মূল্যবোধ ও নীতি মেনে চলি। সময়ে সময়ে যে সমস্যা আসে, কমবেশি তার সবই দেখভাল করা হয়। আমাদের রাষ্ট্র নিয়ে আমরা গর্বিত এবং প্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ।
প্রথম আলো : সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ, প্রাসাদ হত্যাকাণ্ড এবং দীর্ঘ অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও এই শান্তি ও সহযোগিতা কীভাবে অর্জিত হলো?
মাধব কুমার নেপাল : আমাদের শরিক সিপিএন (মাওবাদী) সশস্ত্র পথ নিয়েছিল। একাই জয়ী হওয়ার জন্যই তারা যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতি তাদের পক্ষে ছিল না। একই পরিস্থিতির কারণে তাদের বলপূর্বক নির্মূল করাও ছিল অসম্ভব। পরিস্থিতির চাপেই দুই চরমপন্থার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হয়েছিল। কোনো পক্ষই একে অন্যকে মুছে ফেলতে পারছিল না। মাওবাদীদের একদলীয় শাসন কায়েমের লক্ষ্য সঠিক না হলেও গণক্ষমতার জন্য তাদের সংগ্রাম সঠিক ছিল। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি ছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার যাত্রায় আমরা একই তরণির যাত্রী ছিলাম। গণতন্ত্রের স্বার্থেই বাস্তবতা উপলব্ধি করে তারা তাদের পথ ও চিন্তা বদলেছিল। আমরা দেখিয়েছিলাম, অতীতে অনেক রক্ত ঝরেছে, আর রক্তপাতের দরকার নেই। বিভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে যারা লড়াই করেছিল, গণতন্ত্রের সত্যিকার শক্তি যারা, তাদের মধ্যে সমঝোতা জরুরি। ভুল সংশোধন এবং সত্যকে রক্ষা করেই আমরা এত দূর এসেছি।
প্রথম আলো : গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় নেপালে দুই কর্তৃপক্ষ ছিল: বিদ্যমান সরকার ও নির্বাচন কমিশন। দুই কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হয়নি?
মাধব কুমার নেপাল : কিছু সমস্যা হয়েছে, কিন্তু তা শুধরে নেওয়া হয়েছে। সরকার কিছু অপচেষ্টা করলেও যথাসময়ে তা এড়ানো গেছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন সত্যিকারভাবেই স্বাধীন। আমরা কিছু পদ্ধতি, নীতি, দৃষ্টান্ত ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, যার কারণে ১৯৯০ সালের পর থেকে নেপালের নির্বাচন কমিশন মোটামুটি কর্মক্ষম এবং সঠিক পথেই থেকেছে।
প্রথম আলো : নির্বাচনকালীন সরকারে আপনাদের শরিক দল মাওবাদীরাসহ আরও কয়েকটি দল ছিল। ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধ হয়নি তাদের?
মাধব কুমার নেপাল : নির্বাচনের সময় আসলে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। নির্বাচন কমিশন যে তহবিল ও কর্মী চেয়েছে, সরকার তা সরবরাহ করেছে। ইসিও সরকারি লোকজনকে আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য করেছে। অনিয়ম হলে শাস্তি দিয়েছে।
প্রথম আলো : আপনি মাওবাদী বিদ্রোহের সামরিক সমাধানের বিপক্ষে ছিলেন। এখন সেই মাওবাদীদের সঙ্গে বাম জোট গঠনের পর এক পার্টি গড়তেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কোন পরিস্থিতি আপনাদের এক করল?
মাধব কুমার নেপাল : আমরা আমাদের ৩০ বছর ধরে চিনি এবং একসঙ্গে কাজও করেছি। মাঝপথে মাওবাদীরা পথ বদলে সশস্ত্র পথে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। তাদের জন্য সেটা ছিল কঠিন সময়। সরকারও তাদের প্রতি খুব কঠোর ছিল। তারপর নতুন পরিস্থিতির উদয় হলো, রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটল। রাজনৈতিক দল ও রাজতন্ত্র মুখোমুখি হয়ে গেল। সে সময় আমরা কাছাকাছি আসি। আমরা তখন থেকে টানা যোগাযোগে আছি। তাদের বুঝিয়েছি, শান্তিপূর্ণভাবে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। এ জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে হবে। আমি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তারা আমার সরকারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল, আমাকে সরাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি টিকে গেছি এবং তারাও পরে নীতি বদলেছে।
প্রথম আলো : বাম জোট সরকারে কীভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি হবে?
মাধব কুমার নেপাল : ঐক্যবদ্ধভাবেই আমরা বেশি লাভবান হব, এটাই অতীতের শিক্ষা। নেপালে আপনি দুটি রাজনৈতিক প্রবণতা দেখবেন। একটি হলো বাম, অন্যটি ডান। লিবারেল বনাম র্যাডিকাল। কখনো র্যাডিকালরা টিকেছে, কখনো মধ্য বামরা জিতেছে। জনগণ শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থী বামদেরই সমর্থন করেছে। মাওবাদীরাও সেটা বুঝেছে। এভাবে দুই দলই বুঝতে পারল, ঐক্যের মাধ্যমেই আমরা এগোতে পারব। তা ছাড়া নেপালে কমিউনিস্ট আন্দোলন খুবই জনপ্রিয়।
প্রথম আলো : কেন?
মাধব কুমার নেপাল : গত কয়েক দশকে কমিউনিস্ট পার্টি নেপালের রাজনৈতিক বাঁকবদলের প্রতিটি ঘটনার মূল ভূমিকায় ছিল। জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে এবং বাইরের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি অটল ছিল। মানুষ মনে করে, কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের অধিকারের পক্ষে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর চেয়েও গণতান্ত্রিক। জনগণ দেখেছে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নত করার সবচেয়ে সোচ্চার পক্ষ কমিউনিস্টরা। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পক্ষ আমরা। অন্যদিকে কংগ্রেসের আমলে তারা দেখেছে সর্বাত্মক দুর্নীতি এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিসর্জন।
প্রথম আলো : দেখতে পাচ্ছি, নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরও নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হতে দেরি হচ্ছে। ক্ষমতা হস্তান্তর-প্রক্রিয়া কি অচলাবস্থায় পড়েছে?
মাধব কুমার নেপাল : নেপালি কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত হয়ে খুব আহত ও হতাশ। তারা নিজেদের সব সময়ই ক্ষমতাসীন দেখতে চায়। কিন্তু জনগণ তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় নির্বাচনের ফল অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এক মাসের মধ্যেই বাম জোটের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে কে পি অলিই হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম আলো : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আপনার সরকারের নীতি কী হবে?
মাধব কুমার নেপাল : ১৯৯৪-৯৫ সালে সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলাম আমি। আমিই তখন ভারতের সঙ্গে ১৯৫০ সালের চুক্তি সংস্কারের কথা বলি। এই চুক্তি বৈষম্যমূলক। কারণ, একদিকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করেছেন, অন্যদিকের স্বাক্ষর নেপালে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের? দুজন কি সমান? দ্বিতীয়ত, এই চুক্তির কারণে সব সময়ই আমরা কী করতে পারব কী পারব না, তা ভারতকে জিজ্ঞাসা করতে হতো। তিন কোটি জনসংখ্যার নেপাল দেড় শ কোটি জনসংখ্যার ভারতকে কীভাবে সমান সুযোগ দিতে পারবে? তৃতীয়ত, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ৭০ বছর আগে। এর মধ্যে দুনিয়ায় অনেক কিছু ঘটে গেছে। এটা শীতলযুদ্ধের যুগ নয়, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সময় নয়। দক্ষিণ এশিয়ায়ও অনেক ঘটনা ঘটেছে। তাই এই চুক্তিতে নেপালি জনগণের নতুন আকাঙ্ক্ষাকে জায়গা দিতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশকে সব সময় স্বাধীন রেখে গেছেন, তার জন্য লড়াই করে গেছেন। আপনি যদি আপনার ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করতে পারেন, তাহলে কেন আমরা আমাদের ইতিহাস নিয়ে গৌরব করতে পারব না? আমাদের কী অপরাধ? বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ চাই। আমরা বলি, আমাদের হুকুম দিয়ো না। আন্তর্জাতিক চুক্তির সময় দেখি, আমাদের ওপর অন্যায্য চাপ থাকে। আমরা তা পছন্দ করি না। মুক্তবাণিজ্য ও বিশ্বায়নের এই যুগে কেন আমরা ক্ষতিকর শর্ত মেনে নেব? আমাদের তো পথ খোলা আছে। এটা তো ঔপনিবেশিক যুগ নয়। নেপাল আর ভারতকে আলোচনা করে বের করতে হবে, কোথায় কোথায় অভিন্ন স্বার্থ আছে। নেপাল স্বাধীন দেশ, একে শ্রদ্ধা করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনারা কি আপনাদের এই অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন?
মাধব কুমার নেপাল : আমরা যদি দুর্নীতিমুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ না থাকি এবং জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দেশের উন্নতি করতে না পারি, তাহলে আমাদের মাথা নত করতে হবে। আমাদের বিচক্ষণতা দেখাতে হবে। নিজের ঘর ঠিক রাখতে পারলে সব সামলানো সম্ভব। আমার অভিজ্ঞতা বলে, যেসব বিষয় অনেক বছর ধরে ঝুলে আছে, তা মাত্র একটি বৈঠকেই মীমাংসা করা যায়। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আমি সমস্যা দেখি না। সমস্যা হলো আমলাতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায়। নেতারা যখন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার খপ্পরে পড়েন, তখনই সমস্যা হয়। সংকীর্ণ দৃষ্টির ওপরে উঠতে পারলে কিছুই সমস্যা নয়। নেপাল কারও বিরুদ্ধে কারও কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে চায় না। আমরা সবার নাজুক জায়গা মেনে চলি। অন্যদেরও আমাদের স্পর্শকাতরতা আমলে নিতে হবে। নেপালের ভূমি কারও বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। নেপাল সবার সঙ্গে সমদূরত্ব ও সমবন্ধুত্ব রাখবে।
প্রথম আলো : নেপাল আর বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখেন? বিশেষ করে, যোগাযোগ ও পানিবিদ্যুতের বেলায়?
মাধব কুমার নেপাল : যাদের একই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, একই রকম অনুভূতি যাদের, তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়। তাই নেপাল ও বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। আমরা আমাদের বাজার বহুমুখী করতে পারি। নেপালে বাংলাদেশের বাজার আছে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে একটি বিকল্প নিয়ে বসে থাকা উচিত নয়। এটাই বাজারের নিয়ম। বাংলাদেশের বিদ্যুতের খুব দরকার। নেপালেরও এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা। আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম, নেপালে আসুন, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করুন, বিদ্যুৎ বানান, নিজ দেশে নিয়ে যান। এ জন্য নেপালের সঙ্গে চুক্তি করুন। ভারতের সঙ্গেও চুক্তি করুন। নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী ভারতের ১৬ কিলোমিটার করিডর দিয়ে ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের চুক্তি করুন। নেপালে কৃষির আধুনিকায়ন ও বাণিজ্যিকায়নে, অবকাঠামো খাতে, সিমেন্টশিল্পে, পর্যটনের বিস্তারে বাংলাদেশ বিনিয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশিরা নেপালে যৌথ বিনিয়োগে আসতে পারে। বাংলাদেশ ভারতকে রাজি করিয়ে নেপালের সঙ্গে রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ কানেকটিভিটি স্থাপন করতে পারে। ভারত বিশাল দেশ, আমাদের মতো দেশের জন্য তার হৃদয় বড় করা উচিত।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
মাধব কুমার নেপাল : আপনাকেও ধন্যবাদ।
মাধব কুমার নেপাল : নেপালের রাজনৈতিক সংস্কৃতি খুব ভালো। আমরা সবাই সামাজিক সম্পর্ক রেখে চলি। গণতন্ত্রের কিছু মূল্যবোধ ও নীতি মেনে চলি। সময়ে সময়ে যে সমস্যা আসে, কমবেশি তার সবই দেখভাল করা হয়। আমাদের রাষ্ট্র নিয়ে আমরা গর্বিত এবং প্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ।
প্রথম আলো : সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ, প্রাসাদ হত্যাকাণ্ড এবং দীর্ঘ অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও এই শান্তি ও সহযোগিতা কীভাবে অর্জিত হলো?
মাধব কুমার নেপাল : আমাদের শরিক সিপিএন (মাওবাদী) সশস্ত্র পথ নিয়েছিল। একাই জয়ী হওয়ার জন্যই তারা যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতি তাদের পক্ষে ছিল না। একই পরিস্থিতির কারণে তাদের বলপূর্বক নির্মূল করাও ছিল অসম্ভব। পরিস্থিতির চাপেই দুই চরমপন্থার মধ্যে ভারসাম্য আনতে হয়েছিল। কোনো পক্ষই একে অন্যকে মুছে ফেলতে পারছিল না। মাওবাদীদের একদলীয় শাসন কায়েমের লক্ষ্য সঠিক না হলেও গণক্ষমতার জন্য তাদের সংগ্রাম সঠিক ছিল। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি ছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার যাত্রায় আমরা একই তরণির যাত্রী ছিলাম। গণতন্ত্রের স্বার্থেই বাস্তবতা উপলব্ধি করে তারা তাদের পথ ও চিন্তা বদলেছিল। আমরা দেখিয়েছিলাম, অতীতে অনেক রক্ত ঝরেছে, আর রক্তপাতের দরকার নেই। বিভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে যারা লড়াই করেছিল, গণতন্ত্রের সত্যিকার শক্তি যারা, তাদের মধ্যে সমঝোতা জরুরি। ভুল সংশোধন এবং সত্যকে রক্ষা করেই আমরা এত দূর এসেছি।
প্রথম আলো : গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় নেপালে দুই কর্তৃপক্ষ ছিল: বিদ্যমান সরকার ও নির্বাচন কমিশন। দুই কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হয়নি?
মাধব কুমার নেপাল : কিছু সমস্যা হয়েছে, কিন্তু তা শুধরে নেওয়া হয়েছে। সরকার কিছু অপচেষ্টা করলেও যথাসময়ে তা এড়ানো গেছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন সত্যিকারভাবেই স্বাধীন। আমরা কিছু পদ্ধতি, নীতি, দৃষ্টান্ত ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, যার কারণে ১৯৯০ সালের পর থেকে নেপালের নির্বাচন কমিশন মোটামুটি কর্মক্ষম এবং সঠিক পথেই থেকেছে।
প্রথম আলো : নির্বাচনকালীন সরকারে আপনাদের শরিক দল মাওবাদীরাসহ আরও কয়েকটি দল ছিল। ক্ষমতাসীন নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধ হয়নি তাদের?
মাধব কুমার নেপাল : নির্বাচনের সময় আসলে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। নির্বাচন কমিশন যে তহবিল ও কর্মী চেয়েছে, সরকার তা সরবরাহ করেছে। ইসিও সরকারি লোকজনকে আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য করেছে। অনিয়ম হলে শাস্তি দিয়েছে।
প্রথম আলো : আপনি মাওবাদী বিদ্রোহের সামরিক সমাধানের বিপক্ষে ছিলেন। এখন সেই মাওবাদীদের সঙ্গে বাম জোট গঠনের পর এক পার্টি গড়তেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কোন পরিস্থিতি আপনাদের এক করল?
মাধব কুমার নেপাল : আমরা আমাদের ৩০ বছর ধরে চিনি এবং একসঙ্গে কাজও করেছি। মাঝপথে মাওবাদীরা পথ বদলে সশস্ত্র পথে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। তাদের জন্য সেটা ছিল কঠিন সময়। সরকারও তাদের প্রতি খুব কঠোর ছিল। তারপর নতুন পরিস্থিতির উদয় হলো, রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটল। রাজনৈতিক দল ও রাজতন্ত্র মুখোমুখি হয়ে গেল। সে সময় আমরা কাছাকাছি আসি। আমরা তখন থেকে টানা যোগাযোগে আছি। তাদের বুঝিয়েছি, শান্তিপূর্ণভাবে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। এ জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে হবে। আমি প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তারা আমার সরকারকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল, আমাকে সরাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি টিকে গেছি এবং তারাও পরে নীতি বদলেছে।
প্রথম আলো : বাম জোট সরকারে কীভাবে ক্ষমতা ভাগাভাগি হবে?
মাধব কুমার নেপাল : ঐক্যবদ্ধভাবেই আমরা বেশি লাভবান হব, এটাই অতীতের শিক্ষা। নেপালে আপনি দুটি রাজনৈতিক প্রবণতা দেখবেন। একটি হলো বাম, অন্যটি ডান। লিবারেল বনাম র্যাডিকাল। কখনো র্যাডিকালরা টিকেছে, কখনো মধ্য বামরা জিতেছে। জনগণ শেষ পর্যন্ত মধ্যপন্থী বামদেরই সমর্থন করেছে। মাওবাদীরাও সেটা বুঝেছে। এভাবে দুই দলই বুঝতে পারল, ঐক্যের মাধ্যমেই আমরা এগোতে পারব। তা ছাড়া নেপালে কমিউনিস্ট আন্দোলন খুবই জনপ্রিয়।
প্রথম আলো : কেন?
মাধব কুমার নেপাল : গত কয়েক দশকে কমিউনিস্ট পার্টি নেপালের রাজনৈতিক বাঁকবদলের প্রতিটি ঘটনার মূল ভূমিকায় ছিল। জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে এবং বাইরের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি অটল ছিল। মানুষ মনে করে, কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের অধিকারের পক্ষে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টি তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর চেয়েও গণতান্ত্রিক। জনগণ দেখেছে, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জীবনমান উন্নত করার সবচেয়ে সোচ্চার পক্ষ কমিউনিস্টরা। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পক্ষ আমরা। অন্যদিকে কংগ্রেসের আমলে তারা দেখেছে সর্বাত্মক দুর্নীতি এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিসর্জন।
প্রথম আলো : দেখতে পাচ্ছি, নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরও নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হতে দেরি হচ্ছে। ক্ষমতা হস্তান্তর-প্রক্রিয়া কি অচলাবস্থায় পড়েছে?
মাধব কুমার নেপাল : নেপালি কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত হয়ে খুব আহত ও হতাশ। তারা নিজেদের সব সময়ই ক্ষমতাসীন দেখতে চায়। কিন্তু জনগণ তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় নির্বাচনের ফল অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এক মাসের মধ্যেই বাম জোটের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে কে পি অলিই হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম আলো : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আপনার সরকারের নীতি কী হবে?
মাধব কুমার নেপাল : ১৯৯৪-৯৫ সালে সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলাম আমি। আমিই তখন ভারতের সঙ্গে ১৯৫০ সালের চুক্তি সংস্কারের কথা বলি। এই চুক্তি বৈষম্যমূলক। কারণ, একদিকে নেপালের প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করেছেন, অন্যদিকের স্বাক্ষর নেপালে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতের? দুজন কি সমান? দ্বিতীয়ত, এই চুক্তির কারণে সব সময়ই আমরা কী করতে পারব কী পারব না, তা ভারতকে জিজ্ঞাসা করতে হতো। তিন কোটি জনসংখ্যার নেপাল দেড় শ কোটি জনসংখ্যার ভারতকে কীভাবে সমান সুযোগ দিতে পারবে? তৃতীয়ত, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ৭০ বছর আগে। এর মধ্যে দুনিয়ায় অনেক কিছু ঘটে গেছে। এটা শীতলযুদ্ধের যুগ নয়, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সময় নয়। দক্ষিণ এশিয়ায়ও অনেক ঘটনা ঘটেছে। তাই এই চুক্তিতে নেপালি জনগণের নতুন আকাঙ্ক্ষাকে জায়গা দিতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশকে সব সময় স্বাধীন রেখে গেছেন, তার জন্য লড়াই করে গেছেন। আপনি যদি আপনার ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব করতে পারেন, তাহলে কেন আমরা আমাদের ইতিহাস নিয়ে গৌরব করতে পারব না? আমাদের কী অপরাধ? বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ চাই। আমরা বলি, আমাদের হুকুম দিয়ো না। আন্তর্জাতিক চুক্তির সময় দেখি, আমাদের ওপর অন্যায্য চাপ থাকে। আমরা তা পছন্দ করি না। মুক্তবাণিজ্য ও বিশ্বায়নের এই যুগে কেন আমরা ক্ষতিকর শর্ত মেনে নেব? আমাদের তো পথ খোলা আছে। এটা তো ঔপনিবেশিক যুগ নয়। নেপাল আর ভারতকে আলোচনা করে বের করতে হবে, কোথায় কোথায় অভিন্ন স্বার্থ আছে। নেপাল স্বাধীন দেশ, একে শ্রদ্ধা করতে হবে।
প্রথম আলো : আপনারা কি আপনাদের এই অবস্থান ধরে রাখতে পারবেন?
মাধব কুমার নেপাল : আমরা যদি দুর্নীতিমুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ না থাকি এবং জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে দেশের উন্নতি করতে না পারি, তাহলে আমাদের মাথা নত করতে হবে। আমাদের বিচক্ষণতা দেখাতে হবে। নিজের ঘর ঠিক রাখতে পারলে সব সামলানো সম্ভব। আমার অভিজ্ঞতা বলে, যেসব বিষয় অনেক বছর ধরে ঝুলে আছে, তা মাত্র একটি বৈঠকেই মীমাংসা করা যায়। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আমি সমস্যা দেখি না। সমস্যা হলো আমলাতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায়। নেতারা যখন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার খপ্পরে পড়েন, তখনই সমস্যা হয়। সংকীর্ণ দৃষ্টির ওপরে উঠতে পারলে কিছুই সমস্যা নয়। নেপাল কারও বিরুদ্ধে কারও কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে চায় না। আমরা সবার নাজুক জায়গা মেনে চলি। অন্যদেরও আমাদের স্পর্শকাতরতা আমলে নিতে হবে। নেপালের ভূমি কারও বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। নেপাল সবার সঙ্গে সমদূরত্ব ও সমবন্ধুত্ব রাখবে।
প্রথম আলো : নেপাল আর বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখেন? বিশেষ করে, যোগাযোগ ও পানিবিদ্যুতের বেলায়?
মাধব কুমার নেপাল : যাদের একই দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, একই রকম অনুভূতি যাদের, তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব হয়। তাই নেপাল ও বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। আমরা আমাদের বাজার বহুমুখী করতে পারি। নেপালে বাংলাদেশের বাজার আছে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে একটি বিকল্প নিয়ে বসে থাকা উচিত নয়। এটাই বাজারের নিয়ম। বাংলাদেশের বিদ্যুতের খুব দরকার। নেপালেরও এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা। আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম, নেপালে আসুন, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করুন, বিদ্যুৎ বানান, নিজ দেশে নিয়ে যান। এ জন্য নেপালের সঙ্গে চুক্তি করুন। ভারতের সঙ্গেও চুক্তি করুন। নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যবর্তী ভারতের ১৬ কিলোমিটার করিডর দিয়ে ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের চুক্তি করুন। নেপালে কৃষির আধুনিকায়ন ও বাণিজ্যিকায়নে, অবকাঠামো খাতে, সিমেন্টশিল্পে, পর্যটনের বিস্তারে বাংলাদেশ বিনিয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশিরা নেপালে যৌথ বিনিয়োগে আসতে পারে। বাংলাদেশ ভারতকে রাজি করিয়ে নেপালের সঙ্গে রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ কানেকটিভিটি স্থাপন করতে পারে। ভারত বিশাল দেশ, আমাদের মতো দেশের জন্য তার হৃদয় বড় করা উচিত।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
মাধব কুমার নেপাল : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments