কিশোর হত্যা এবং দল বড় করার রাজনীতি by অনুপম দেবাশীষ রায়
চট্টগ্রাম
কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসফারকে দিনেদুপুরে রাজপথে কুপিয়ে হত্যা করা
হয়েছে। যে স্কুলে আদনান পড়ত, সেই স্কুলে আমিও পড়েছি। যে রাস্তায় আদনান
হাঁটত, সেসব রাস্তা দিয়ে আমিও হেঁটেছি। আর যে মোড়ে আদনান খুন হয়েছে, সেই
মোড় থেকে আমি বেঁচে ফিরেছি। তবে তখনো আমি দেখেছি, আমাদের স্কুলের কিছু
ছেলের হাতে হকিস্টিক, শার্টের পেছনে কোমরে রড। এটা কেবল সরকারি স্কুল বলে
কলেজিয়েটেই দেখেছি তা-ই নয়, রাজধানীর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজেও আমি চায়ের
দোকানে ছেলেদের শোডাউনের পরে চাপাতি লুকাতে দেখেছি আর শার্ট তুলে চাপাতির
কোপের দাগ দেখাতে দেখেছি। এই বিবর্ণ আক্রমণাত্মক কৈশোর নিয়ে আমি বড় হয়েছি
এবং রাজনীতিমুক্ত কোনো কৈশোর আমি চিনি না। কাজেই যখন আমার জ্যেষ্ঠরা আমাকে
মারামারি আর কোন্দলের বাইরে অন্য কোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা শোনান,
সেটিকে আমার রূপকথা বলেই মনে হয়।
আমার বেড়ে ওঠবার সময়ে রাজনীতি মানেই ছিল
ছাত্ররাজনীতি আর ছাত্ররাজনীতি মানেই ছিল হকিস্টিক, রড আর চাপাতির ছড়াছড়ি।
সুশীল ছাত্র হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ছিল মাথা এতখানি নিচু করে রাখা, যাতে
চাপাতি আর রডওয়ালারা আমাদের দেখতে না পায়, আমরা যাতে পিছলে বের হয়ে যেতে
পারি। আমি পিছলে বের হয়ে যেতে পেরেছিলাম। আদনান পারেনি। আরও অনেকে পারবে
না। চাপাতি, হকিস্টিক আর রডের ব্যবহারের পরিধি বাড়ছে, চাপাতি হকিস্টিক আর
রডের উপযোগ আরও বাড়ছে এবং সে জন্য চাপাতি, হকিস্টিক আর রড ব্যবহারের জন্য
আরও বেশি বেশি করে ছেলেদের দলে টানা লাগছে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যাল, কলেজ
পেরিয়ে এখন স্কুলের আঙিনায় আরও বেশি করে হাত ডুবোতে হচ্ছে আমাদের
রাজনীতিবিদদের। শিশুদের ব্যবহার করতে হচ্ছে আর শিশুরা নিজেদের কোন্দলে
ব্যবহার করতে পারছে মারণাস্ত্র। সেসব মারণাস্ত্রের আক্রমণে কয়েকজন মারা
পড়ছে। পত্রপত্রিকায় খবর ছাপা হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতা দিচ্ছেন সামাজিক
অবক্ষয় নিয়ে। আমাদের সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে শিশুরা শিশুদের হত্যা
করছে? শিক্ষকেরা কী শেখাচ্ছেন? অভিভাবকেরা করছেন কী? ঠিক এভাবে প্রতিটি
সমস্যার মতন সমাজের চুনোপুঁটিদের ওপর দায় তুলে দিয়ে রাজনৈতিক কাঠামোর বিশাল
সমস্যাটি এড়িয়ে যাচ্ছি আমরা প্রতিদিন। আমরা বুঝতে চাইছি না যে কেন আমাদের
রাজনীতিবিদদের শিশুদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হচ্ছে। এত বিশাল একটি
পেটোয়া বাহিনী আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কেন পুষতে হচ্ছে? দল বড় রাখা, দলের
প্রভাব অটুট রাখার জন্য। সেই বিষয়ে যাওয়ার আগে আরেকটি গল্প বলে নিই।
আমি
আমেরিকার যে স্টেটে থাকি, সেখানে তখন নির্বাচন হচ্ছে। আমি রিপাবলিকান
পার্টির কিছু রাজনীতিবিদের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ করছি। আমার প্রধান কাজ
হলো ভিক্ষা চেয়ে চিঠি লেখা। নানান সাহিত্য, ভঙ্গিমা করে আমি সাধারণ মানুষের
কাছে ভিক্ষা চাই। কেননা, তারা যদি ভিক্ষা না দেয়, তাহলে আমরা প্রচারণা
করতে পারব না আর প্রচারণা না করতে পারলে আমরা নির্বাচনে জিততে পারব না।
আমার মনে পড়ে যে প্রতিবার ট্রাম্প একটি করে পাগলামি করলে কেমন করে আমরা
সবাই মিলে কপাল চাপড়াতাম, কারণ এবার আমরা আর ভিক্ষা তুলতে পারব না। যারা এত
দিন আমাদের সাহায্য করছিল, তারা আর সাহায্য করবে না। ফলে নির্বাচনের আগেই
নির্বাচন হেরে যাব আমরা। ঠিক সেই উত্তপ্ত দিনগুলোয় আমার মনে হয়েছিল যে এমন
কোনো ভিক্ষার চিঠি আমি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কাছ থেকে পাইনি। শুধু যে আমি
পাইনি তা নয়, আমার পরিচিত কাউকেও আমি কোনো দিন পেতে শুনিনি। যদি সাধারণ
সমর্থকদের থেকে তারা গণতান্ত্রিকভাবে চাঁদা না তুলে থাকে, তাহলে প্রতিবছর
যে হাজার কোটি টাকা খরচ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দেখায়, সেই পয়সা তারা কোথা
থেকে পায়? একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা গেল যে চাঁদা আপসে তোলার রাস্তায় না
গিয়ে বরং আরও বেশি নিশ্চিত একটি উপায় বেছে নেয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। ভয়
দেখিয়ে চাঁদা তুলে নেওয়া, যেটিকে কথ্য ভাষায় আমরা চাঁদাবাজিও বলি। এই
চাঁদাবাজির ব্যাপারটি আমাদের রাজনীতিতে এমনভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে
স্বেচ্ছায় চাঁদা তোলার বুদ্ধিও এখন বুঝি কারও মাথায় আসে না। আর এই
চাঁদাবাজি করে দল টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রয়োজন হয় ভয়ভীতি দেখাতে পারে এমন
কিছু লোকজন।
ভয়ভীতি দেখাতে গেলে প্রয়োজন হয় চাপাতি, হকিস্টিক আর রড। সঙ্গে
সঙ্গে প্রয়োজন হয় তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের থেকে রেহাই পাওয়ার মতন
নিরাপত্তা। কাজেই সেটির সংস্থান করে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এই
ছাত্রদের রাজনৈতিক সহিংসতার ট্রেনিং দিতে হচ্ছে এবং তাদের মিলিশিয়ার মতন
করে রাস্তায় নামিয়ে দিতে হচ্ছে। আর এই চাঁদাবাজির বাইরে দলগুলোর
অর্থসংস্থানের দ্বিতীয় উপায়টি হলো মনোনয়ন বাণিজ্য। উচ্চ দামে মনোনয়নপত্র
বিক্রি করা হবে, এমন ধনী ব্যবসায়ীদের যাঁরা অতীতে দলে অনুদান দিয়েছেন মোটা
অঙ্কের, তাঁরা ভবিষ্যতে আরও মোটা অঙ্কের অনুদান দেবেন। আর রাজনীতিকে
ভালোমানের বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীরাও রাজনীতিতে আসতে থাকেন দলে দলে এবং
রাজনীতিতে এসেই তাঁদের সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে দুই দলের মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীদের দিকে
তাকালে আমরা সেই চিত্রই দেখতে পাব। সংসদের অবস্থাও ঠিক একই। সুজনের
তথ্যমতে, বর্তমান সংসদের ৫০ শতাংশই ব্যবসায়ী এবং ৩৫০ জন সাংসদের মধ্যে ২২৬
জনই কোটিপতি। বাকি সাংসদদের মধ্যে অনেকেই চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং গডফাদার।
তাদের নেতৃত্বেই এলাকাগুলোতেই সৃষ্টি হয় আঞ্চলিক ছাত্রনেতা, যাদের টিকে
থাকার উদ্দেশ্যই হলো দলকে, নেতাকে চাঁদা তুলে দেওয়া, তাদের আধিপত্য বজায়ে
রাখা। এবং নেতার ছত্রচ্ছায়ায় নিজের আর্থিক এবং সামাজিক প্রভাব বজায় রাখার
জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্কুলছাত্রদের। তা ছাড়া বিরোধী দল তো
বটেই, নিজের দলের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকিয়ে রাখতেও যার যার নিজস্ব মাস্তান
বাহিনীর প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতি এখন হয়ে উঠেছে অপরাধী,
ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ীদের আখড়া, রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পদসৈনিক হিসেবে
ব্যবহার করা হচ্ছে নওল কিশোরদের। চট্টগ্রামের সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বকোণের
প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে। চট্টগ্রামের প্রভাবশালী জাতীয় রাজনৈতিক নেতার
ছত্রচ্ছায়ায় ঘুরে বেড়ায় আরেক পাতিনেতা এবং তার দায়ভারেই স্কুলছাত্রদের
রাজনীতির চাপাতিবাহক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
আর যত দিন আমাদের রাজনৈতিক
সংস্কৃতি চাঁদাবাজি আর মনোনয়ন-বাণিজ্য তথা আধিপত্যনির্ভর থাকবে, তত দিন এমন
নিয়োগ চলতেই থাকবে। কখনো আদনানের মতন কেউ মারা পড়বে বলে সেটি খবরের কাগজে
আসবে, না হয় আমার বন্ধুদের মতন পিঠে চাপাতির কোপ নিয়ে বেঁচে থাকবে হাজারো
কিশোর—যাদের গল্প আমরা কেউ জানব না। কাজেই যদি আমরা আমাদের সংসদে বা
রাজনীতিতে কেবল একটি শ্রেণির বা পেশার মানুষের আধিপত্য নিয়ে অথবা অপরাপর
নিম্নশ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে চিন্তিত হতে না পারি, তাহলে
কমপক্ষে আমদের শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাদের রাজনৈতিক
সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের জন্য কথা বলতে হবে। নতুন প্রজন্মের রাজনীতি যদি
গণমুখী হতে চায়, তাহলে তার গণতহবিলমুখী হতে হবে। জনতার কাছে হাত পাততে হবে
আর সেই হাত পেতে পাওয়া পয়সার মান রাখার চেষ্টা করতে হবে নিরন্তর। তাহলেই আর
ছেঁকে ছেঁকে কোটিপতিদের দলে টানতে হবে না অথবা দলীয় আধিপত্য আর নেতাদের
স্বার্থ রক্ষার জন্য ছোট ছেলেদের জীবন বলি দিতে হবে না। সে রকম একটি
পরিবর্তন যদি আমরা শুরু করতে না পারি, তাহলে আদনানদের মৃত্যুগুলো ঘুরে ঘুরে
আমাদের পৃথিবীতে হানা দেবেই।
অনুপম দেবাশীষ রায়: গবেষণা সহযোগী, কেটো ইনস্টিটিউট, ওয়াশিংটন ডিসি।
অনুপম দেবাশীষ রায়: গবেষণা সহযোগী, কেটো ইনস্টিটিউট, ওয়াশিংটন ডিসি।
No comments