ফেঁসে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫৮ সদস্য
নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, জোরপূর্বক জাল ভোট প্রদান ও অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। খতিয়ে দেখা হচ্ছে বর্তমান কমিশনের আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনা। ইতোমধ্যে মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচনে দুটি কেন্দ্র দখল ও জোরপূর্বক জাল ভোট দেয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫৮ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়ে এসব সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে ইসি। এ ছাড়া কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন ও সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌরসভার একটি ওয়ার্ডে উপনির্বাচনে সহিংসতার ঘটনাও তদন্ত করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ছোট-বড় সব নির্বাচনে ভোটার ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের স্বার্থে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যেও যেসব স্থানে সহিংসতা ও জোরপূর্বক ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটছে সেগুলোর বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। অভিযোগ পেলেই তদন্ত করছি। মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। আইন অনুযায়ী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেসব নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সময় প্রকাশ্য সহিংসতা, মারামারি, কেন্দ্র দখলসহ নির্বাচনী অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর বিষয়ে কমিশন তদন্ত করছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ীও বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় যারা দায়ী হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কমিশন চায়, এখনই দায়ীদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে না গেলে নির্বাচনী সহিংসতার কালচার থেকে বের হওয়া কঠিন হবে। তারা আরও বলেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরও মেহেরপুর পৌরসভা নির্বাচনের আগের রাতে দুটি কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটে। মেহেরপুর জেলার মেহেরপুর পৌরসভায় গত ২৫ এপ্রিল ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মাহফুজুর রহমান (রিটন)। কেন্দ্র দখল ও জোর করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেয়ার অভিযোগ এনে ওই নির্বাচন বয়কট করেন বিএনপির প্রার্থী জাহাঙ্গীর বিশ্বাস। নির্বাচনের দিন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের মেহেরপুর-১ (পুরুষ কেন্দ্র) এবং একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থিত মেহেরপুর-২ (মহিলা) কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বাতিল করা হয়। অর্থাৎ ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অভিযোগ ছিল, ভোটের আগের রাতে ওই কেন্দ্র দুটিতে ব্যালটে সিল মেরে বক্সে ঢুকিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় কমিশনের তদন্তে ওই দুই কেন্দ্রের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘কর্তব্য পালনে চরমতম অবহেলা প্রদর্শনের’ প্রমাণ মিলেছে। মেহেরপুর জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেহেরপুর-১ কেন্দ্রে এসআই কার্তিক চন্দ্র পাল, তিনজন এএসআই ও ১৪ জন অস্ত্রধারী পুলিশ সদস্য দায়িত্বে ছিলেন।
এর বাইরে লাঠিসহ আনসার ছিলেন আরও ১৫ জন। সবমিলিয়ে ওই কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন ২৯ জন। একই হারে মেহেরপুর-২ কেন্দ্রে এসআই ফকরুল ইসলামের নেতৃত্বে ১৪ জন অস্ত্রধারীসহ ২৯ জন দায়িত্বে ছিলেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই ব্যালটে সিল মেরে বক্সে ঢুকিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনায় দায়িত্ব পালনকালী ৫৮ জন (২৯+২৯) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ এর ৫ ধারা অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা কমিশনকে দ্রুততম সময়ে অবহিত করতে বলা হয়েছে। ইসির নির্বাচন পরিচালনা-২ শাখার উপসচিব মো. নুরুজ্জামান তালুকদার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, দুই কেন্দ্রে এত বিপুল সংখ্যক ফোর্সের উপস্থিতিতে বহিরাগতরা ভোটকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে ব্যালট পেপার ছিনতাই এবং জোরপূর্বক সিল মারার ঘটনায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যরা কর্তব্যে চরমতম অবহেলা প্রদর্শন করেছেন। ইসির কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নির্বাচন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টকে চাকরি থেকে অপসারণ, বরখাস্ত বা বাধ্যতামূলক অবসর বা পদানবতি বা তার বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবে। আরও জানা গেছে, গত ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্র দখল ও জাল ভোটের ঘটনায় দুটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় কমিশন তদন্ত করছে যাতে নির্বাচন কর্মকর্তা এবং কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা হচ্ছে। এছাড়া ২৫ এপ্রিল সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌরসভা নির্বাচনে কসবা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যাপক সংঘর্ষ, জাল ভোট ও কারচুপির ঘটনা ঘটে। এতে ওই কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে কমিটি ঘটনাটি তদন্ত করছে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, আরও কয়েকটি ঘটনায় তদন্ত করা হয়েছে। কয়েকটি তদন্তাধীন রয়েছে।
No comments