ব্যাংকিং খাতের লুটপাট বন্ধে পদক্ষেপ নেই
ব্যাংকিং খাতে লুটপাট বন্ধে প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। উল্টো আবগারি শুল্ক আরোপ করে ব্যাংক আমানতকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে ও পুঁজিবাজার গতিশীল করতেও কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সোমবার রাজধানীর নীলক্ষেতে আইসিএমএবির বাজেটোত্তর আলোচনা সভায় অর্থনীতিবিদ, পেশাজীবীরা এসব কথা বলেন। আইসিএমএবির সভাপতি জামাল আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসিএমএবি’র মহাসচিব আবদুর রহমান। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ, সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব ড. মোস্তাফিজুর রহমান, ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রূপালি চৌধুরী, আইসিএমএবির সাবেক সভাপতি আরিফ খান প্রমুখ। ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘ব্যাংক থেকে টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ৬০ শতাংশ, সোনালী ব্যাংকের ৪০ শতাংশ ঋণই খেলাপি। এত খেলাপি ঋণ নিয়ে পৃথিবীর কোথাও ব্যাংক টিকতে পারে না। বেসিক ব্যাংক লুটপাটের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ও মানুষের চিৎকার তাদের (সরকার) কানে যায়নি। তাহলে কি সরকার নিজেই লুটপাট করতে চায়? সরকারই যদি ব্যাংক লুট করে তাহলে যাব কোথায়?’ ব্যাংকের দুর্নীতি বন্ধে কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ লুটপাট বন্ধে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ কমিশনের পর আর কোনো কমিশন হয়নি। এভাবে ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে না। ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের টাকা লুটপাট করে আবার জনগণের করের টাকা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি মেটানো হচ্ছে- এটা জোচ্চুরি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অর্থমন্ত্রী বাজেটে একটি কথাও বলেননি।’ আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ প্রসঙ্গে ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘বাজেট দেয়া হয় জনগণের জন্য। ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করার পর দেশের ১৬ কোটি মানুষ বিরোধিতা করল। এমনকি সংসদ সদস্যরাও বিরোধিতা করল, কিন্তু অর্থমন্ত্রী পাত্তাই দিলেন না। যখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, তখন অর্থমন্ত্রীর সুর পাল্টে গেল। এটা হতে পারে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর আরও বলেন, ‘যখন আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয় তখন ব্যাংক ঋণের সুদ ছিল ১২ শতাংশ। সুদ আয় থেকে ১৫০ টাকা কাটলে গ্রাহক তা বুঝত না। এখন ঋণের সুদ ৪-৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশ। অর্থাৎ কেউ ব্যাংকে টাকা রাখলে তার প্রকৃত মূল্য কমে যাচ্ছে। তাছাড়া মানুষ তো আয়ের ওপর ট্যাক্স দিয়ে তার অর্থ নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকে জমা রাখছে। এক্ষেত্রে আবগারি শুল্কের ফলে তা করের ওপর কর (ডাবল ট্যাক্স) আরোপ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হবে।’ ব্যাংকের লুটপাট প্রসঙ্গে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘লুটপাট বন্ধে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কার দরকার। এজন্য কমিশন গঠন করে ব্যাংকিং খাতের দুর্বৃত্তদের শাস্তি দেয়া উচিত। তা না করে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করা হয়েছে। যারা ব্যাংকগুলোর শৃঙ্খলা নষ্ট করছেন, লুটপাট করছেন তাদের বিচার না করে এসব করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘বাজেটে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের কোনো উপাদান নেই।’ আবগারি শুল্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাজেটের লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদ পুনর্বণ্টন। আবগারি শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হয়নি। এখানে ধনী-গরিব বৈষম্য করা হয়েছে।
একজন মধ্যবিত্ত ১ লাখ টাকা রাখতে তাকে দশমিক ৮ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। আর যে ৫ কোটি টাকার বেশি রাখছে তাকে দশমিক ০৫ শতাংশ আবগারি শুল্ক দিতে হচ্ছে। সম্পদ পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে শুল্ক আরোপ করা হলে ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বের আমানতকারীকে ৪ লাখ টাকা ট্যাক্স দিতে হতো।’ ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘বাজেটে বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনা নেই। কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হয়নি। এখনও অনেক বিনিয়োগকারী মুনাফার অংশ আবার দেশেই বিনিয়োগ করছে। কর্পোরেট ট্যাক্স না কমানোয় সেটির পথ রুদ্ধ হয়েছে। এমনিতে কয়েক বছর দেশে বিনিয়োগ হয়নি। তাই কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো উচিত ছিল। এছাড়া সব স্তরে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের প্রভাব বড় বড় কোম্পানির ওপর বেশি না হলেও ছোটদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর রাজস্ব বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু সে অনুপাতে করদাতার সংখ্যা বাড়ছে না। এর ফলে যারা কর দিচ্ছেন তাদের কাছ থেকে বর্ধিত রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। নতুন করদাতারা কী পরিমাণ রাজস্ব দিচ্ছেন তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। তাই বাজেটকে শুধু ট্যাক্স আদায়ের টুল (হাতিয়ার) হিসেবে বিবেচনা না করে ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতি সহায়তার দিক থেকে দেখতে হবে।’ এনবিআরের সমালোচনা করে রূপালী চৌধুরী বলেন, ‘উৎসে কর আদায়ের মাধ্যমে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কর আদায়কারী কর্তৃপক্ষ (ট্যাক্স কালেকটর) হিসেবে কাজ করছে। এনবিআরের সক্ষমতা নেই বলেই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে এ কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু যারা ট্যাক্স দিচ্ছে না তাদের ট্যাক্স আদায়ে ব্যর্থ হলে এনবিআর সেই কর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করে। এখন সময় এসেছে এনবিআরকে প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাক্স আদায় করে দেবে কিনা তা নিয়ে ভাববার।’ আইসিএমএবির সাবেক সভাপতি আরিফ খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য নতুন কিছু নেই। এটা সম্ভবত নীতিনির্ধারকদের পুঁজিবাজার সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে হয়েছে। পুঁজিবাজারের স্বার্থে কর্পোরেট ট্যাক্স কমাতে নীতিনির্ধারকরা সম্মত হলেও পরে পিছিয়ে যান। এবারে বাজেটে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অথচ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে কর্পোরেট ট্যাক্স বেশি। এমনকি করমুক্ত লভ্যাংশের সীমাও বাড়ানো হয়নি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে লভ্যাংশের ওপর কর নেই।
No comments