বনানীতে দুই ছাত্রীর ধর্ষক নাঈমই সিরাজগঞ্জের হালিম
ঢাকার বনানীর হোটেলে দুই ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত নাঈম আশরাফ হলেন সিরাজগঞ্জের এইচএম হালিম। প্রকৃতপক্ষে সে একজন প্রতারক। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্দাইল গ্রামের সাধারণ ফেরিওয়ালার ঘরে জন্ম হালিম নাম পরিবর্তন করে ঢাকায় বসবাস করছে। স্কুলজীবন থেকেই প্রতারণার কাজে তার হাতে খড়ি। এইচএম হালিম ওরফে নাঈম আশরাফের বাবা আমজাদ হোসেন একজন দিনমজুর। ফেরি করে থালা-বাটি বিক্রি করতেন। করেছেন কৃষি কাজও। বাবার নাম বদল করে হালিম বিয়ে করেছে ৩টি।
আগের ২ স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার কালশি এলাকায় ভাড়াবাড়িতে বর্তমানে চলছে তার সংসার। কাজিপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিতে না থেকেও ব্যবহার করছে দলীয় পদ। দলের শীর্ষ নেতাদের ছবি দিয়ে লাগিয়েছে ব্যানার-ফেস্টুন। বনানীর হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় মিডিয়ায় ছবি প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বুধবার বিকালে কথিত নাঈম আশরাফের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্দাইল গ্রামে গেলে এমন চিত্রই উঠে আসে। প্রতিবেশী সিএনজিচালক শামীম হোসেন জানান, ২০০৪ সালে গান্দাইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এইচএম হালিম (হাসান মোহাম্মদ হালিম)। এই স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পরিচয় ব্যবহার করে রাজশাহী বোর্ড থেকে প্রশ্ন এনে ফেঁসে যায় সে।
এরপর ভর্তি হয় বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে। সেখানে পড়াশুনা করা অবস্থায় সিরাজগঞ্জ শহরের এক প্রভাবশালী ঠিকাদারকে নিজের বাবা পরিচয় দিয়ে বিত্তশালী পরিবারের এক নারীকে বিয়ে করে। পরিচয় জানার পর মেয়ে পক্ষ হালিমকে মারপিট করে মেয়েকে ছাড়িয়ে নেয়। আর বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষ তাকে কলেজ থেকে বের করে দেয়। এরপর সে ঢাকা তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়ে ডিপ্লোমা পাস করে। হালিমের এক ঘনিষ্ঠজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ইলেক্ট্রিক্যাল বিষয়ে ডিপ্লোমা পাস করার পর হালিম একুশে টিভিতে যায় ইন্টর্নি করতে। এরপর সেখানেই ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে তার চাকরি হয়।’ চেক জালিযাতি করার কারণে তার চাকরি চলে যায়। পরে মোহনা টিভিতে একই পদে চাকরি নেয় সে। সেখানেও একই কারণে চাকরিচ্যুত হয় তার। বর্তমানে সে গান বাংলা টিভির ইলেক্ট্রিক্যাল বিভাগে কর্মরত বলে জানা গেছে। ঢাকার কালশি এলাকার সাংবাদিক কলোনীর পশ্চিম অংশে অবস্থিত এক্সটেনশন রূপপুরের ৪নং গলির ৫তলা ভবনের তৃতীয় তলার পেছনের অংশের একটি ফ্ল্যাটে নাঈম ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছে। প্রতিবেশী ও স্থানীয় সীমান্ত বাজারের পান দোকানী আবু সাঈদ বলেন, ‘ও (হালিম) জীবনে বহু মানুষকে নিজের বাবা বানিয়ে ‘অকাম-কুকাম’ করেছে। মিডিয়ায় তার বিষয়টি উঠে এসেছে এবার হযতো আর পার পাবে না।’ কাজিপুর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোজাহারুল ইসলাম জানান,
হালিম ছোট থেকেই এলাকায় থাকেনি। দলের মিছিল মিটিংও করেনি। উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি পদ ব্যবহার করে এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুন লাগানোর পর যুবলীগের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগও করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই ব্যানার-ফেস্টুনগুলো এখনও অপসারণ করা হয়নি। কাজিপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হুদা মিষ্টি বলেন, ‘নাঈম আশরাফই আসলে হাসান মোহাম্মদ হালিম। দলের কমিটিতে আবদুল হালিম নামে যার নাম রয়েছে, সে আসলে এই হালিম নয়। কমিটিতে এই হালিমের কোনো নাম নেই। প্রতারণা করে ব্যানারে সে নিজের নাম ও পদবি ব্যবহার করছে।’ কাজিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল আমিন বলেন, ‘ছোট থেকেই হালিম প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। বাবা-মা এবং নিজের নাম বদল করে এর আগেও সে বেশ কয়েকটি অপকর্ম করেছিল, যার দেনদরবার আমাদের করতে হয়েছে।’ হালিমের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তালাবন্ধ টিনসেট বসতঘর পাওয়া গেলেও তার বাবা-মাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। কথা হয় তার দিনমজুর ছোট চাচা আবু বক্কার সিদ্দিক ও চাচী মাহমুদা খাতুনের সঙ্গে। পত্রিকায় ছাপানো ছবি দেখে তারা নিশ্চিত করেন এটাই হালিম।
তবে নাঈম আশরাফ প্রসঙ্গে তারা কিছু জানেন না। চাচী মাহমুদা খাতুন জানান, বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হালিম দীর্ঘ ৫ বছর যাবৎ বাড়িতে আসে না। কিছুদিন হল সে তার বাবা-মাকে ঢাকায় নিয়ে গেছে। বাড়ির সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি জানান, বসতবাড়ি ও আবাদি জমি মিলে ১৭ শতক জায়গা আছে হালিমদের। আগে হালিমের বাবা ফেরি করে থালা-বাটি বিক্রি করতো। কৃষি শ্রমিক হিসেবেও মাঠে কাজও করেছে। মাহমুদা খাতুন আরও জানান, মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর আমরা জানতে পেরেছি ঢাকায় হালিমের ঝামেলা হয়েছে। এর আগে সে ধানমণ্ডিতে বিয়ে করেছিল। সে বউ চলে যাবার পর বরিশালের এক মেয়েকে বিয়ে করে এখন সংসার করছে। ধর্ষণের ঘটনা সত্য হলে ভাতিজার শাস্তি দাবি করেন হালিমের চাচা-চাচী। স্থানীয় গান্দাইল ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আশরাফুল আলম বলেন, ‘হালিম নাম পরিচয় গোপন করে ছাত্র অবস্থায় সে ঢাকার মোহাম্মদপুরে এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল। ওই দরবার আমি নিজেও করেছি। সে বছরে ২/১ বার এলাকায় আসে। প্রতারণাই তার পেশা। ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত থাকলে আমরা তার শাস্তি দাবি করছি।’
No comments