বিশ্ব যখন কর কমানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে...
কেউ কি কখনও চিন্তা করতে পেরেছিলেন, হোয়াইট হাউসে মার্কিনিরা এমন একজন প্রেসিডেন্ট পাবেন যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ধনী লোকদের পক্ষে এত দৃঢ় অবস্থান নেবেন? ধনী লোকেরা যেটা চায় সেটা হল আরও ব্যবসা, আরও অর্থ। তারা সব সময়ই নাখোশ ছিল তাদের ব্যবসার আয়ের ৩৫ শতাংশ সরকার কর আরোপ করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে। তাদের অসন্তুষ্টির শেষ এখানেই নয়। তারা যখন বিভিন্ন সূত্র থেকে আয় পায়, সেই আয়ের ওপরও আবার ৪৫ শতাংশ কর দিতে হয়। অর্থাৎ একজন মার্কিন ধনী যদি বাড়তি ১০০ ডলার আয় করে, তাকে সেই অর্থের ৪৫ শতাংশ আয়কর হিসাবে সরকারকে দিয়ে দিতে হয়। অবশ্য মার্কিন গরিবেরা অত ট্যাক্স দেয় না, আয় ভেদে তাদের ট্যাক্স হারের ভিন্নতা আছে। তবে ধনীদের ওপর বেশি করারোপের পক্ষে অর্থনীতি শাস্ত্রে কিছু যুক্তি আছে। যুক্তিটি হল, ধনীরা বেশি ট্যাক্স দেবে এ কারণে যে, বাড়তি আয় তাদের কম উপযোগ দেয়। এবং বাড়তি আয়ের ওপর বর্ধিত হারে কর বসালে তারা করের ভারটা কম অনুভব করবে। ছাত্রদের ক্লাসরুমে পাবলিক ফাইনেন্স এবং ট্যাক্স পলিসি নামের একটি বিষয় পড়ানো হয়। পাবলিক ফাইনেন্স মূলত বলতে চায় সরকার কীভাবে আয় পাবে এবং কোথায় কী পরিমাণ ট্যাক্স ও ফি ধার্য করবে। সেই সঙ্গে এক্সপেনডিচার পলিসি নিয়েও অনেক কিছু পড়ানো হয়। সরকার কোথায় ব্যয় করবে এবং কোন ব্যয়ের সামাজিক উপকারিতা কতটুকু ইত্যাদি।
একটা কথা ব্যয় বিষয়ে পড়ানো হয়, সেটা হল সরকার কোনো অর্থ ব্যক্তির জন্য ব্যয় করবে না, করবে ব্যক্তি সমষ্টির জন্য। ব্যক্তির জন্য ব্যয় করলেও সেটা শুধু এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ব্যয় করবে না, সেই ব্যয় হতে হবে ব্যক্তি শ্রেণীর জন্য। ট্যাক্সের ক্ষেত্রে একটা নীতিকে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়, সেটা হল সমতার নীতি (Principle of Equity), যে নীতি বলে- যে যত বেশি ধনী সে তত বেশি হারে ট্যাক্স দেবে। ট্যাক্স ও ফি-এর অর্থ দিয়ে সরকার চলবে। সরকার আহরিত অর্থ থেকে দেশরক্ষা, প্রশাসনের লোকদের জন্য বেতন-ভাতা, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, শিক্ষা-স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামো খাতে ব্যয় করবে। অবশ্য ট্যাক্স ও ফি-এর বাইরেও সরকারের দুটো আয়ের উৎস আছে। একটি হল বিনিয়োগকৃত অর্থের বিপরীতে সুদ ও ডিভিডেন্ড আয়। অন্যটি হল ঋণ। ঋণকে অবশ্য আয় বলা যাবে না। তবে অর্থ সংগ্রহের অন্যতম উৎস বলা যাবে। যেমন, আমাদের দেশে সরকার শত শত কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করছে। সরকারের ব্যালেন্সশিটের একদিকে এই অর্থ আয় হিসাবে অন্যদিকে দায় হিসাবে দেখা দেবে। অপরদিকে বন্ড বিক্রি করে সরকার সরাসরি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি থেকে ঋণও নিতে পারে। সামগ্রিক ঋণের পরিমাণকে একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখা হয়। অনেক দেশে সরকারি আয় যদি ব্যয়ের তুলনায় পিছিয়ে থাকে, তাহলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলে, যা মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) একটা পার্সেন্টের মধ্যে রাখা হয়। যেমন, বাংলাদেশে ঘাটতি বাজেটের আকার জিডিপি’র ৪-৪.৫ শতাংশ। শুনছি আসছে বাজেটে এই ঘাটতি একটু বাড়তে পারে। তবে সত্য হল, আমরা এবং অন্যরাও ট্যাক্স নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা করি, সরকার কর্তৃক অর্থের ব্যয় নিয়ে তার চেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়। আর এজন্যই আমরা দেখি প্রকল্প অর্থায়নের নামে অর্থকে জলে ফেলা হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হয় না, শেষ করা হয় না। শেষ না করলে বাড়তি অর্থ পাওয়া যায়। এই যে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ট্যাক্স হারগুলো কল্পনার বাইরে গিয়ে কমানোর প্রস্তাব করল, তাতে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে মার্কিন প্রশাসনকে। করের হার কমে গেলে তো সরকারি রাজস্ব আয়ও কমে যাবে, অন্তত ওই দেশে। তাহলে সেই সরকার কি বড় রকমের ঘাটতি বাজেটের দিকে যাবে, না অন্যত্র ব্যয় অনেক কমিয়ে ফেলবে? মার্কিন সরকারের জন্য ব্যয় কমানো অত সহজ নয়। অনেক ব্যয় আছে যেগুলো কমাতে গেলে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামবে।
তবে ট্রাম্পপন্থীদের একটা যুক্তি আছে এভাবে যে, ট্যাক্স কমালে ব্যবসাগুলো বেশি লাভ করবে। বেশি লাভ করলে অর্থনীতিতে বেশি বিনিয়োগ হবে, বেশি বিনিয়োগ হলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। তখন অনেক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প ছোট করে ফেললে কোনো অসুবিধা হবে না। ট্রাম্প প্রস্তাব রেখেছেন, ব্যবসার মুনাফার ওপর কর হার ৩৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। সেই অনুসারে ব্যক্তির আয়ের ওপরও ট্যাক্স কমানো হবে। ট্রাম্পের যুক্তি হল, ব্যক্তির আয়ের ওপর ট্যাক্স কমালে ব্যক্তি-ভোগ বাড়বে। অর্থনীতিতে ভোগ বাড়লে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। তখন বেশি লোক করদাতার দলে শামিল হবে। তবে কর কমিয়ে মার্কিন সরকারের ব্যয় কীভাবে নির্বাহ করা হবে সেটা দেখার বিষয়। অনেক রিপাবলিকান যারা কর কমানোর পক্ষে ছিলেন, তারাও বিশ্বাস করতে পারছেন না এত বড় কর হ্রাসের প্রস্তাব কীভাবে করা হল! যদি ট্রাম্প তার প্রস্তাবিত কর হ্রাসকে মার্কিন কংগ্রেসে পাস করাতে পারেন, তাহলে কর হ্রাসের ক্ষেত্রে সেটা হবে এক বড় বিপ্লব। আমাদের মনে আছে, প্রয়াত হেভিওয়েট মুষ্টিযুদ্ধ চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী অতিরিক্ত রাউন্ড খেলতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন শুধু খেলা থেকে প্রাপ্য অর্থের বেশিরভাগ কর হিসাবে সরকারকে দিয়ে দিতে হবে বলে। কত কর হার হলে লোকে বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবেন না, তা নিয়ে অনেক প্রবন্ধ ও বই লেখা হয়েছে। তবে Optimum Tax Rate বা আদর্শ ট্যাক্স হার বলতে কিছু নেই। এটা হল ওই ট্যাক্স, যে ট্যাক্স হার মানুষকে বাড়তি আয় অর্জনে নিরুৎসাহিত করবে না। এই ট্যাক্স হার এক অর্থনীতিতে এক রকম, আরেক অর্থনীতিতে আরেক রকম। সারা বিশ্বের জন্য কোনো আদর্শ ট্যাক্স হার নেই। অনেক বাজারপন্থী অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকারকে দিয়ে বেশি কাজ করাতে নেই। সরকার বেশি কাজ করলে জনগণকেই বেশি ট্যাক্স দিতে হবে। তারা একটা মৌলিক প্রশ্ন করেন যা হল, অর্থ ব্যক্তির পকেটে থাকলে সেই অর্থের উত্তম ব্যয় হবে, নাকি ওই অর্থ ট্যাক্স হিসাবে সরকারকে দিয়ে দিলে উত্তম ব্যয় হবে? তারা বলতে চান, ব্যক্তিই ভালো জানেন তার অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার কোথায় কীভাবে হবে। সুতরাং ওদের দৃষ্টিতে সেই সরকারই ভালো যেটা আয়তনে ছোট, ব্যয় কম করে এবং জনগণকে অল্প ট্যাক্স দিতে বলে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এটুকু বলা যায়, আমরা যে পরিমাণ অর্থ সরকারি খাতে ব্যয় করছি, সেই পরিমাণ সামাজিক উপকার পাচ্ছি না। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা ধরুন। যে অর্থ সরকার শিক্ষকদের জন্য এবং অবকাঠামোয় ব্যয় করছে, ঠিক সেই অর্থটা যদি বেসরকারিভাবে ব্যয় হতো, তাহলে অনেক বেশি ভালো শিক্ষা পাওয়া যেত। অনেক দেশে স্বাস্থ্য খাতকেও ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দিয়ে সরকার শুধু রেগুলেটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের জন্য অর্থের বড় খাত হতে পারত বিনিয়োগ থেকে মুনাফা, যা ডিভিডেন্ড আয় নামেও পরিচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যেসব কোম্পানি থেকে সরকার আংশিক ইকুইটি ক্যাপিটাল সরবরাহ করে ওই আয় পেতে পারত, সেটা সময়মতো সরকার করেনি বলে পায়নি।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগের অনেকগুণ বেশি লাভ করছে। কিন্তু ওগুলোর অধিকাংশে সরকারের কোনো মালিকানা নেই। কারণ সরকার সেই মালিকানা চায়নি। আরও সত্য হল, সেগুলো শেয়ারবাজারেও নেই। ফলে ওইসব বড় ব্যবসায় জনগণের কোনো অংশ নেই। তারাও কাঙ্ক্ষিত মুনাফার অংশ থেকে বঞ্চিত। এ ক্ষেত্রে একটা কাজ সরকার করতে পারে। তা হল তাদেরকে ডেকে বলা, তোমরা শেয়ারবাজারে এসো, না এলে সরকার ট্যাক্স বাড়িয়ে দেবে। উল্টোভাবে তাদেরকে বলা যায়, তোমরা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তোমাদের জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স আরও হ্রাস করে দেয়া হবে। ইকুইটি ক্যাপিটালে অংশ নেয়া বিশ্বব্যাপী একটা স্বীকৃত প্রথা। বাংলাদেশ নেয়নি বলে ওই আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেনও তাদের কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর পক্ষে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা এই হারকে ২০ শতাংশ নিচে নিয়ে আসবে। ইউরোপের অন্য দেশ আয়ারল্যান্ডে এই কর হার হল মাত্র ১৫ শতাংশ। ভারত গত বাজেটে বলে দিয়েছে, তারা পর্যায়ক্রমে তাদের কর্পোরেট আয়কর ২৩ শতাংশে নিয়ে আসবে। আমাদের কাছের দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে এই ট্যাক্স অনেক কম।
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
No comments