সুইডিশ রেডিওতে র্যাবের নির্যাতনের বর্ণনা
সুইডেনের
সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত 'স্ভারিজেস রেডিও' গোপনে ধারণকৃত একটি অডিও
প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশ পুলিশের এলিট বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন
ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কিভাবে মানুষ হত্যা এবং অপহরণ করে তার বর্ণনা উঠে
এসেছে। ওই অডিওতে একজন উচ্চপদস্থ র্যাব কর্মকর্তা বাহিনীটির অপহরণ, হত্যা
এবং লাশ গুমের বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দেন। স্পর্শকাতর রেকর্ডটি প্রায় দুই ঘণ্টা
দীর্ঘ। তবে ওই কর্মকর্তা জানতেন না যে, তার কথাবার্তা রেকর্ড করা হচ্ছে।
'যদি তুমি তাকে (টার্গেটকৃত ব্যক্তি) খুঁজে পাও তাহলে সে যাই হোক না তাকে
গুলি এবং হত্যা করো। এরপর তার পাশে একটি অস্ত্র রেখো দাও'। প্রায় সময়েই এমন
নির্দেশ দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ওই প্রতিবেদনে
উল্লেখ করা হয়, র্যাব বাংলাদেশের পুলিশের একটি বিশেষ বাহিনী। এটি সামরিক
বাহিনী ও পুলিশের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৪ সালে এই
বাহিনীটিকে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ বাংলাদেশে মাদক ও চোরাচালানোর মতো
বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উদ্দেশ্য সামনে রেখে গঠন করা হয়।
অডিওতে র্যাব কর্মকর্তার কথোপকথন ছিল বাংলায়। সুইডেনের রেডিওটি জানিয়েছে,
তারা নিজেদের সূত্রগুলোর সুরক্ষার জন্য এটি অন্য দেশে অনুবাদ করেছে। ওই
র্যাব কর্মকর্তা তার ভাষ্যে তুলে ধরেছেন, বাহিনীটি বাছাইকৃত মানুষকে
কিভাবে কোনো ঘটনার সময়ে হত্যা করে। এক্ষেত্রে চায়ের দোকানে বসে থাকার সময়ে
বা অন্যান্য দৈনন্দিন কাজ করার সময় টার্গেটদের ধরা হয়। তিনি বলেন, শুরুর
দিকে ক্রসফায়ারের ঘটনায় লোকজনের সঙ্গে অস্ত্র থাকতো না। এ কারণে তখন হত্যার
কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই এলিট পুলিশ বাহিনী আত্মরক্ষার জন্য গুলি
চালানোর কথা বলতো। অডিওতে র্যাবের ওই কর্মকর্তা জানান, র্যাবের হাতে নিহত
ব্যক্তিদের প্রত্যেকের ঘটনা ক্ষেত্রে কিভাবে গুলি ছোড়া হয়েছিল তা সহ
বিভিন্ন তদন্ত হয়। কোনো ঘটনা ঘটলে সব কর্তৃপক্ষ তা কিভাবে সম্মিলিতভাবে
বাংলাদেশের সাংবাদিক ও জনগণের কাছে তুলে ধরে তার চমকপ্রদ বর্ণনা তুলে
ধরেছেন তিনি। তারা 'ক্রসফায়ারের' মতো শব্দ ব্যবহার করেন এবং দাবি করেন যে
র্যাবের ওপর গুলি বর্ষণ করা হলে তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল। ওই
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কাউকে জোর করে গুম করার তিনটি কৌশলের কথা বর্ণনা
করেছেন। তা হলো-টার্গেটকে ধরা, তাকে হত্যা করা এবং তৃতীয়ত মরদেহ লুকিয়ে
ফেলা। নিহতদের মরদেহ নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার আগে তার সঙ্গে কিভাবে
কংক্রিটের ব্লক বেঁধে দেয়া হয় অডিও কথোপকথনে তার সম্পর্কেও বলা হয়েছে।
এই
কথোপকথনে এমন সব ভয়ংকর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা সাধারণত হরর ছবিতে
ব্যবহার হয়। ওই কর্মকর্তা তুলে ধরেছেন পুলিশ কিভাবে ধরে নেয়া লোকজনদের
সঙ্গে মিথ্যা বলে। তারা আটকদের বলেন, তাদের নিরাপদে রেখে আসার জন্য তাদের
কোনো বন্ধুর কাছে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এমনটি না করে পুলিশ তাদের হত্যা করে।
ওই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, সবাই গুম করার দক্ষতা সম্পন্ন হয় না। আমাদেরকে
নিশ্চিত করতে হয় যেন ঘটনার কোনো ক্লু (প্রমাণ) না থাকে। যারা এসব করে তাদের
সবার পরিচয়পত্র খুলে ফেলা হয়। আমাদেরকে হাতমোজা পরতে হয় যাতে আমাদের হাতের
ছাপ ধরা না পড়ে এবং আমাদের জুতার ওপর কাপড় মোড়ানো থাকে যাতে তার দাগ বুঝা
না যায়। আর আমরা অভিযানের সময় ধুমপান করতে পারি না। ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা
বলেন, প্রতিদিনই লোকজন নিখোঁজ হয়। এছাড়া এভাবে নিরাপরাধ মানুষ বা যে কেউ
নিহত হতে পারে। তার মতে, এটিই রাজনৈতিক বিরোধীদের থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার
উপায় হতে পারে এবং এখানে এমন শক্তি রয়েছে যারা ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে মুছে
ফেলতে চায়। তিনি এমন মতও দেন যে, এটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেরও একটি উপায় হতে
পারে। ওই কর্মকর্তার কথোপকথনের রেকর্ডে এত বেশি ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা রয়েছে
যে সুইডিশ রেডিওর অনুবাদককে বেশ কয়েকবার বাইরে গিয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস
নিতে হয়েছে। র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, এই বাহিনী যাদের তুলে নিয়ে যায়
তাদের পরিণতির বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ে নির্ধারিত হয়। এই স্পর্শকাতর রেকর্ডে
তিনি বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কিভাবে লোকজনকে নির্যাতন করা
হয়। তিনি একটি অন্ধকার কক্ষের বর্ণনা দেন, যার মধ্যে একটি বাতি ছিল এবং
সেখানে গ্রেফতার করা একজন ব্যক্তিকে নগ্ন করে রাখা হয়েছিল। তাকে হাতকড়া
পরিয়ে ঝুলিয়ে রাখার পর তার অণ্ডকোষে ইট বেঁধে দেয়া হয়েছিল। ওজনের কারণে তার
অণ্ডকোষ মোটামুটি ছিড়ে গিয়েছিল। এরপর নির্যাতিত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, তখন তিনি জানতেন না যে ওই ব্যক্তি মারা গিয়েছিল কী
না।
No comments