মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনী
বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পেছনে তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা-নৌ-বিমানবাহিনীর অবদান অতুলনীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সামরিক সদস্যদের নিয়ে গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ খবর ফাঁস হয়ে গেলে রাষ্ট্রদ্রোহ তথা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হিসেবে বন্দী হয়ে কারাবরণ করেন। আসামিদের মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক অন্যতম। তাকে সেনাবাহিনী হত্যা করে। তবে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পণ্ড হয়ে যায় এবং সবাই খালাস পান। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সামরিক বাহিনীর বাঙালি সৈনিক, নাবিক, বৈমানিক, পুলিশ ও আনসার মুক্তিযুুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। রণপ্রস্তুতির জন্য গোপন বৈঠক ও শলাপরামর্শ করতে থাকেন। চূড়ান্তক্ষণ উপস্থিত হলো ২৫ মার্চ, যখন পাকিস্তানিবাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করে। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরপর মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এর সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। সব পেশাজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, জনগণের সাথে, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী।
তখন আমি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সমরাস্ত্র মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং পদে কর্মরত। ’৭১ সালের ২৮ মে পাকিস্তানের সারগোধা বিমানঘাঁটি থেকে পালিয়ে বিমানে ঢাকায় অবতরণ করি। কয়েক দিন কক্সবাজার সদরের মুকতারকুল নিজ গ্রামে অবস্থান করার পর মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টরের সদর দফতর, ভারতের হরিয়ানা ক্যাম্পে যোগদান করলাম। যুদ্ধকে বেগবান করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বৈমানিকদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয় ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে। স্থান নির্ধারিত হয়েছিল ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমানঘাঁটি, যা দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপানিরা দখল করেছিল। চতুর্দিকে জঙ্গল আর পাহাড়বেষ্টিত এই ঘাঁটি। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনের পাঁচজন পাইলটসহ আমরা ছিলাম ৬৮ জন। বিমানবাহিনী অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন গ্রুপ ক্যাপটেন এ কে খোন্দকার (পরে বিমানবাহিনী প্রধান ও মন্ত্রী)। ভারত সরকার দিয়েছিল তিনটি বিমান। একটি অটার, একটি হেলিকপ্টার ও একটি ডাকোটা। মূলত এগুলো যুদ্ধের নয়, যাত্রীবাহী বিমান। আমরা বৈমানিক ইঞ্জিনিয়াররা অটার ও হেলিকপ্টারকে রকেট, মেশিনগান ও বোমা দিয়ে যুদ্ধবিমানে রূপান্তরিত করি। বিমান তিনটির গায়ে লাল-সবুজে বাংলাদেশের পতাকা অঙ্কন করা হয়েছিল যেন সাংবাদিকেরা ভারতের বিমান মনে না করেন। ডাকোটা বিমানটিকে ব্যবহার করা হলো মুক্তিযোদ্ধা আর মালামাল পরিবহনের জন্য। পিআইএ-এর বেসামরিক পাইলটদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জঙ্গি বিমানের পাইলটে পরিণত করা হয়েছিল। অটার বিমান চালনা করতেন গ্রুপ ক্যাপটেন শামসুল আলম এবং পিআইএ-এর ক্যাপ্টেন আকরাম।
আমি বোমা নিক্ষেপের দায়িত্বে ছিলাম। লিডিং এয়ার ক্র্যাফটম্যান রুস্তম আলী মেশিনগান ফায়ার করতেন। হেলিকপ্টারটি চালাতেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ (পরে বিমানবাহিনী প্রধান) এবং ফাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম ও ক্যাপটেন শাহাবুদ্দিন। পরিবহন ডাকোটা বিমানটির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেক, শরফুদ্দিন ও মুকিত। প্রশিক্ষণ চলত দিবা-নিশি, তবে বেশির ভাগ সময় অন্ধকার রাতে। রাত ১০টায় অন্ধকার রাতে অভিযানে আমরা বের হলাম অটার বিমান নিয়ে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারি স্টেশনে হামলা আমাদের উদ্দেশ্য। হেলিকপ্টারটি উড়াল দিলো নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা তেলডিপো অভিমুখে। আমাদের প্রত্যেকের সাথে ছিল একটি স্টেনগান আর ৫০০ টাকা। আমরা চারজন খুব নিচু দিয়ে এবং পাহাড়, সমতল, গাছ ও সাগরের ওপর দিয়ে উড়লাম, যাতে পাকিস্তানের রাডারে ধরা না পড়তে হয়। রাত ২টায় পৌঁছলাম আমাদের লক্ষ্যে, অর্থাৎ পতেঙ্গার তেল শোধনাগার ও ডিপোতে। হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করে কর্ণফুলী নদীর মোহনা দিয়ে উড়ে পৌঁছলাম লক্ষ্যবস্তুর পূর্ব পাশে। পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে রকেট, মেশিনগান ও বোমা নিক্ষেপ করে আক্রমণ শুরু করা হলো। এর পরপরই তেল ট্যাংকার বিস্ফোরিত হলো এবং দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। এত উঁচুতে আগুন উঠে গেল যেন বিমান ছুঁই ছুঁই। তখনই পাকিস্তানি স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট মেশিনগান একসঙ্গে ফায়ার করতে লাগল। আমরা পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে সন্দ্বীপের দিকে চলে গেলাম। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আমাদের বিমানে একটি গুলিও লাগেনি। আমরা ফেনীর ওপর দিয়ে উড়ে আসামের কুম্ভিগ্রাম বিমানঘাঁটিতে ভোর ৫টায় অবতরণ করলাম। সেখানে উপস্থিত হন আমাদের অধিনায়ক এবং ভারতের বিমানবাহিনী পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান। তারা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং সফল অভিযানের কথা শুনে আনন্দ ও গর্ববোধ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাভারিং সাপোর্ট দেয়ার জন্য উল্লিখিত বিমান দু’টি খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। ১২ ডিসেম্বর ঢাকার পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বার আখাউড়ায় ভীষণ যুদ্ধে আমরা চতুর্দিকে আক্রমণ চালিয়ে ঘায়েল করে দেয়াতে পাকবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা অভিমুখে অনায়াসে অগ্রসর হয়ে ঢাকা দখল করে নেয়। আমরা আরো অনেক ফলপ্রসূ হামলা চালিয়ে হানাদারদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। দেরিতে হলেও সরকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব:) শামসুল আলমকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছেন। ১৯৭১ সালে বিমানযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে গর্ববোধ করছি এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীও এ জন্য স্মরণীয় বরণীয়।
লেখক : বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য
লেখক : বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য
No comments