সফরের আগেই চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশের দাবি
প্রধানমন্ত্রীর
সফরের আগে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি স্বাক্ষর হবে তার বিষয়বস্তু প্রকাশের
দাবি জানিয়েছে বিএনপি। বিকালে দলের নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ দাবি জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে-
প্রধানমন্ত্রী আগামী ৭ই এপ্রিল চারদিনের সরকারি সফরে ভারত যাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এ সফরের সময় দুই
দেশের মধ্যে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে
পত্র-পত্রিকায় জল্পনা-কল্পনা চলছে। বলা হচ্ছে, এ সফরে নিরাপত্তা,
প্রতিরক্ষা, পারমাণবিক সহযোগিতাসহ জ্বালানি, মহাকাশ, রেল তথ্যপ্রযুক্তি,
অবকাঠামো ও অন্যান্য বিষয়ে দুই ডজনের মতো চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক সই হতে
পারে। আমরা আশাকরি- সরকার প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের আগেই তার
সফরকালে যেসকল চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে
তার সব ক’টি জনগণের উদ্দেশে প্রকাশ করবে। জনগণই এ দেশের মালিক। দেশ এবং
জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এসব চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকের বিষয়বস্তু
সম্পর্কে জানার ও মতামত প্রকাশ করার অধিকার তাদের রয়েছে। জনগণকে পাশ কাটিয়ে
দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো চুক্তি বা
সমঝোতা স্মারক জনগণ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, বিএনপি বাংলাদেশ ও ভারতের
বিদ্যমান সম্পর্ককে আরো দৃঢ়, বন্ধুত্বপূর্ণ ও পারস্পরিক আস্থাশীল দেখতে
চায়। দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, দুই দেশের
জনগণের সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্কে আরো সুসংহত করাই এই দুই দেশের
সম্পর্কের মূলভিত্তি হওয়া উচিত। পারস্পরিক সমতা, মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াই আমাদের নীতি। আমরা কখনই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে
ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ডকে জায়গা দেবো না। আমরা একই সঙ্গে প্রত্যাশা করি ভারতও
আমাদের অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল থাকবে।
উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সবধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে
অবস্থান গ্রহণ করাই বিএনপির ঘোষিত নীতি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, দুইটি
রাষ্ট্রের সুন্দর, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তখনই আশা করা যায় যখন সম্পর্কটা
হয় দুই দেশ ও জনগণের মধ্যে। সরকার বদলায় কিন্তু জনগণ থাকে এবং একটি
রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তিই হচ্ছে এর জনগণ। তাই দুটি দেশের সম্পর্ক এমন
হওয়া উচিত যাতে সরকার পরিবর্তন হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটি একই রকম মজবুত
থাকে। বাংলাদেশ-ভারত রাষ্ট্রদ্বয় ও দুদেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক চাই, আর
সেটাই হবে টেকসই সম্পর্ক। মির্জা আলমগীর বলেন, ভারতীয় প্রেস সূত্রে বিশেষ
করে নিরাপত্তা ও কূটনীতিক বিশ্লেষকদের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ভারত ও
বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক হতে
যাচ্ছে। ভারতের সদ্য সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকরের সাম্প্রতিক
বাংলাদেশ সফর, ভারতীয় সেনাপ্রধান ও ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের
কারণে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই এর ধারণাটি আরও ঘনীভূত হয়। ভারতের প্রভাবশালী
পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের
সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সর্বশেষ দুইটি সাবমেরিন
কেনার কারণে ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বিষয়ে দ্রুত সমঝোতা স্মারক
সইয়ে আগ্রহী হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা বিষয়ে বড় ধরনের একটা কিছু সই হতে
যাচ্ছে এমন একটা আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ভারতের সঙ্গে
প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে পারে বা হতে পারে প্রতিরক্ষা বিষয়ে এমওইউ। যদি
চুক্তি বা এমওইউ স্বাক্ষরিত হয় তবে এই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকে কী আছে বা
কী থাকছে- তা আদৌ স্বচ্ছ নয়। জনগণ এ চুক্তি বা সমঝোতা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত
একেবারেই অন্ধকারে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে কোনো আনুষ্ঠানিক
ব্রিফিং হয়নি। অনির্বাচিত জাতীয় সংসদেও এসব চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের
বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রতিরক্ষার মতো জাতীয়
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। প্রায় সকল গণতান্ত্রিক দেশে
এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি বা সমঝোতা স্বাক্ষরের আগে দেশের প্রধান
রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে পরামর্শের রেওয়াজ আছে। এমনকি ভারতেও
সেই রেওয়াজ প্রচলিত। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে জনগণকে
কিছুই জানায়নি। জনগণকে পাশ কাটিয়ে দেশের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোন
ধরনের চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক জনগণ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ
সরকার দাবি করে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বর্তমানে সর্বকালের উষ্ণতম পর্যায়ে
আছে। সে ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে কেন ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা
চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে তা বোধগম্য নয়। মির্জা আলমগীর বলেন, ভারতের সঙ্গে
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে। অভিন্ন নদীর
পানি বণ্টন, সীমান্ত ট্রানজিট ও বাণিজ্য অন্যতম। সীমান্তে বাংলাদেশি
নাগরিকদের ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বেআইনিভাবে গুলি করে হত্যা, ৫৪টি
অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, তিস্তার পানির ন্যায্যা হিস্যা এবং গঙ্গা চুক্তি
অনুযায়ী আমাদের ন্যায্য অধিকার আজও অর্জিত হয়নি। কয়েকবার তিস্তা চুক্তি
স্বাক্ষর হবে বলে ঘোষণা এলেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। তিস্তার পানি কৃষি প্রধান
বাংলাদেশের জনমানুষের জীবন-মরণ সমস্যা। অথচ এবারও তিস্তা চুক্তি সই হবে না
বলে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন। মির্জা আলমগীর
বলেন, সীমান্তে নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশিদের হত্যা দুদেশের
মানুষের মধ্যে কেবল সন্দেহ ও অবিশ্বাসই বাড়িয়ে তোলে। গত এক দশকে বিএসএফ
সীমান্তে ৫৫২জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। যার জন্য ভারত একবার দুঃখ প্রকাশ
পর্যন্ত করেনি। ফেলানী হত্যার বিচার আজও পায়নি বাংলাদেশ। কাঁটাতারের বেড়া
অবিশ্বাস, অসম্মান আর সন্দেহেরই ইঙ্গিত বহন করে। প্রধানমন্ত্রী যখন ভারত
সফরের কয়েকদিন আগেই লালমনিরহাট সীমান্ত থেকে একজন উঠিয়ে নিয়ে গেছে বিএসএফ।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মহল বহুদিন ধরে শুল্ক ও অশুল্ক
বিভিন্ন বাণিজ্য বাধার অভিযোগ করলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সন্তোষজনক সমাধান
হয়নি। ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক ইস্যুতে ইতিমধ্যে ইতিবাচক কার্যক্রম
নিয়েছে ভারত যার সুফল পাচ্ছে। তিনি বলেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
বিদ্রোহ দমন থেকে শুরু করে ভারতের পণ্য আনা-নেয়ার জন্য বন্দর ব্যবহারের
সুবিধা, নামমূল্য ট্রানজিট সুবিধা প্রধান এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক
ঐকমত্যে ভারতীয় স্বার্থে বাংলাদেশের অবদান অনন্য। যেখানে বাংলাদেশ নিজেই
প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, সেখানে বাংলাদেশ থেকে
ভারতীয় নাগরিকরা বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। যা রেমিট্যান্স
সূত্রে ভারতীয় আয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস বলে জানা যায়। তিনি বলেন, প্রায়
বিনামূল্যে টনে মাত্র ১৯২ টাকায় ট্রানজিট দিয়ে দেয়া হয়েছে ভারতকে। মংলা ও
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধার মাধ্যমে ভারত ১৫টি রুটে স্বল্প ব্যয়ে
মাল পরিবহনের সুযোগ নিচ্ছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের
বিষয়ে বাংলাদেশ ভারতকে দিয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। একজন ভারতীয় কূটনীতিক
বিশ্লেষকের মতো, ‘এখন ভারতের উদার হওয়া উচিত, এখন সময় দেনা পরিশোধের।’
মির্জা আলমগীর বলেন, ভারতীয় ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে-
প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় প্রতিরক্ষার নামে ভারতের সঙ্গে ৫০ কোটি ডলারের ঋণ
চুক্তি হবে। এই ঋণ দিয়ে বাংলাদেশকে ভারত থেকেই অস্ত্র কিনতে হবে। কিন্তু
১৯৫০ সালের পর যে ভারত নিজেই অস্ত্র আমদানিতে এক নম্বর সে দেশের কাছ থেকে
বাংলাদেশ কেন অস্ত্র কিনতে যাবে? সাশ্রয়ী এবং আধুনিক চীনা অস্ত্র ও
সরঞ্জামে সজ্জিত আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ভারতের প্রস্তুতকৃত অধিক
দামের অস্ত্র ক্রয় কতটুকু যৌক্তিক তা নিশ্চয়ই প্রশ্নের দাবি রাখে। অস্ত্র
প্রস্তুতকারী নতুন দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে সমরাস্ত্র বিক্রির নিশ্চিত
‘ক্যাপ্টিভ মার্কেট’ হিসেবে পেতে চায়। প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ বা তথ্য
বিনিময়ের কথা এই চুক্তি বা স্মারকে থাকবে বলে যে কথা হচ্ছে তা এদেশের
জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। আগেই বলেছি, এটি চুক্তি হবে না সমঝোতা স্মারক হবে
তা স্পষ্ট নয়। তবে চুক্তি বা এমওইউ যাই হোক এদেশের মানুষকেই সেই অসম
চুক্তির মূল্য দিতে হবে। মির্জা আলমগীর বলেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল।
বাংলাদেশ তাতে কী পেল বা কি দিল তা দেশবাসীর কাছে আজও স্পষ্ট নয়। ৪০ বছর
আগে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তি এতদিন ভারত বাস্তবায়ন করেনি। তিনি বলেন,
ভারত একটি বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্র। ভারত তার নিজস্ব স্বার্থ দেখবে এটাই
স্বাভাবিক। আমরা ভারতের সঙ্গে সব সময়ই সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক চাই।
কোনোভাবেই আমাদের সার্বভৌমত্বকে খাটো করে নয়। বাংলাদেশের অমীমাংসিত
ইস্যুগুলোতে যদি আন্তরিকভাবে সমাধানে ভারত এগিয়ে আসে তা হলে বাংলাদেশের
মানুষের মনে সৃষ্ট আস্থার ঘাটতি দূরীভূত হবে। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই
পারস্পরিকভাবে লাভজনক ও কল্যাণমূলক সম্পর্কে প্রাকৃতিকভাবেই আরো দৃঢ়ভাবে
আবদ্ধ হবে। এ জন্য আলাদা করে কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের
প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। লিখিত প্রতিরক্ষা চুক্তির বা সমঝোতার
প্রশ্ন তখনই ওঠে যখন পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থার ঘাটতি থাকে। সংবাদ
সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম,
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী
কামাল ইবনে ইউসুফ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান
ঢালী, নিতাই রায় চৌধুরী ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
No comments