মায়ের পিঠে স্নেহের শয্যা
সন্তান দেখাশোনা করার কেউ নেই। অগত্যা কী আর করা। তিন বছরের ছেলে প্রান্তকে কোলে নিয়েই ললিতাকে ছুটতে হয় কাজে। কাজের মধ্যেও ছেলেকে সামলাতে হয় তাঁকেই। অনেক সময় কাজের চাপে ছেলেকে চোখে চোখে রাখা সম্ভব হয় না। কখনো কখনো ক্লান্ত শিশু ঘুমিয়ে পড়ে পথের ধারে। তাই ছেলের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রান্তকে অনেক সময় পিঠে তুলে কাপড় দিয়ে বেঁধে নেন ললিতা। মায়ের পিঠেই লেগে থেকে কখনো দুনিয়া দেখে প্রান্ত। কখনো মায়ের পিঠেই ঘুমিয়ে থাকে ক্লান্ত শিশু। এভাবেই দিনের পর দিন সন্তান আগলে নিজের জীবন ও জীবিকা বহাল রেখেছেন ললিতা। এই মায়ের পুরো নাম ললিতা রানী রায় (৩২)। তাঁর বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রায়পুর গ্রামে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আওতায় ঠাকুরগাঁও সদরের ভাউলারহাট থেকে শিবগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের নির্মাণকাজ চলছে। ওই রাস্তার কাজ দেখতে গিয়েই ১ এপ্রিল দুপুরে পিঠে শিশুসন্তানকে বেঁধে সড়কে ব্রাশ ঘষে ময়লার আস্তরণ পরিষ্কার করতে দেখা যায় ললিতাকে। তখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ললিতার। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী আনন্দ রায় অনেকটাই ভবঘুরে। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁদের সংসার। মেয়ে বিথি রানী একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। সকাল হতেই বিথিকে বাড়িতে রেখে কাজে বের হন ললিতা। এরপর বিথিও চলে যায় বিদ্যালয়ে। তখন বাড়ি একেবারেই ফাঁকা হয়ে যায়। উপায় না থাকায় ছেলে প্রান্তকে (৩) সঙ্গে নিয়েই কাজে বের হতে হয় তাঁকে। কাজে আসার পর শুরুর সময়টা হইহুল্লোড় আর খেলার মধ্যে কেটে যায় প্রান্তর। এরপর বিরক্ত করতে শুরু করে। কিছুতেই মায়ের পিছু ছাড়তে চায় না ও। ঠিকাদারের লোকজনের বকুনি থেকে বাঁচতে একসময় ছেলেকে পিঠে বেঁধে নেন তিনি। তারপর সবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে করে চলেন কাজ। ললিতা বলেন, পিঠে তুলে নিতেই ছেলের বিরক্ত করা নিমেষে থেমে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মায়ের পিঠে থেকেই দেখতে থাকে দুনিয়া। তারপর একসময় মায়ের স্পর্ষের উষ্ণতায় পিঠেই ঘুমিয়ে পড়ে ছোট্ট প্রান্ত। এই মা আরও বলেন, ছেলেকে পিঠে নিয়ে কাজ করতে প্রথম দিকে কিছুটা কষ্ট হলেও এখন সব সয়ে গেছে। সকাল আটটায় কাজে এসে বিকেল পাঁচটায় ফেরেন তিনি। দিন শেষে ১৭০ টাকা মজুরি পান। কোনো কোনো দিন কাজ পাওয়াও যায় না। তখন ছেলেমেয়ে নিয়ে আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়।
তাই রোজগারের তাগিদেই একদিন ছেলের কোলে ওঠার আবদার বন্ধ করতে ওকে পিঠে তুলে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ললিতা বলেন, ‘ছুয়াক পিঠত রাখিয়া কাজ করিতে হামরা কুনো কষ্ট লাগে না। সারা বছরই থাকে। এনং কাজ পাইলেই হামরা খুশি।’ ললিতার গ্রামের আরেক নারী শ্রমিক প্রবিতা রানী (৪৫) বলেন, ললিতাকে ছাড়া প্রান্ত কিছুই বুঝতে চায় না। আর ললিতাও ওকে সব সময় আগলে রাখেন। ছেলেটার জন্মের পর একটু ঝরঝরা হলে ওকে নিয়ে কাজে আসতে শুরু করেন ললিতা। প্রায় তিন বছর ধরে এই মাকে এভাবেই কাজ করতে দেখছেন তাঁরা। এখন প্রান্তর প্রতি তাঁদেরও মায়া জন্মে গেছে। ললিতার সঙ্গে কাজ করা শ্রমিকদের মধে৵ অনেকেই ছেলেটির জন্য বাড়ি থেকে কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসেন। কাজের ফাঁকে মিনতি রানী নামে আরেক শ্রমিক এই প্রতিবেদককে অনুরোধ করে বলেন, ‘হামার কথা বাদ দেন। ললিতাক একখান ভিজিডি কার্ড করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কার্ডখান পাইলে ওর কষ্ট কুনিক কমিবা পারে।’ সড়ক নির্মাণের কাজ দেখভালের দায়িত্বে থাকা আল সাব্বির বলেন, ছেলে পিঠে নিয়ে ললিতা অন্য শ্রমিকদের চেয়ে কোনো অংশে কম কাজ যে করেন তা না। রায়পুর গ্রামের জীতেন্দ্রনাথ রায় (৫৫) বলেন, ললিতার কাজেই চলে তাঁর সংসার। বছরের অনেক সময় গ্রামে কাজ থাকে না। তখন তাঁর কষ্টটা আরও বাড়ে। সরকারি সাহায্যও তাঁর ভাগ্যে জোটে না। সংশ্লিষ্ট রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নের বাসিন্দারা অধিকাংশই অসচ্ছল। এসব দরিদ্র মানুষের তুলনায় ভিজিডি কার্ডের সংখ্যা অনেক কম। তবে ললিতার বিষয়টি আলাদা করে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
No comments