আরও ভালো নির্বাচন চাই
গত
৩০ মার্চ নতুন নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতার ‘অ্যাসিড টেস্ট’ হিসেবে
বিবেচিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনটির
ওপর নাগরিক সমাজের ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল। নির্বাচনে কে জিতবে বা কে
হারবে তা দেখতে নাগরিক সমাজের যতটা আগ্রহ ছিল, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল
নির্বাচনটি কেমন হয় সে বিষয়টি দেখার প্রতি। কারণ, দশম সংসদ নির্বাচন থেকে
নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়ে। ওই সংসদ
নির্বাচনে সংঘটিত ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি ও নৈরাজ্য নির্বাচনটিকে
কালিমালিপ্ত করে। পরবর্তীকালে পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ
নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং ৬ পর্বে
অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ব্যাপক
দুর্নীতি-কারচুপি, ভোট কাটাকাটি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, সন্ত্রাস-সহিংসতা,
বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ভোটের আগের
রাতেই ব্যালটে সিল মেরে কিছু ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা
বাহিনীর সদস্যদের সরকারদলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করাসহ বিভিন্ন প্রকার
দুর্নীতিতে নাগরিক সমাজ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এসব
নির্বাচনে সংঘটিত অনিয়ম দৃশ্যমান হলেও নির্বাচন কমিশন অনিয়মকারীদের আইনের
আওতায় এনে শাস্তি দিতে চেষ্টা করেনি। এ অবস্থায় রকিব কমিশনের মেয়াদ শেষ হলে
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ায় এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়কাল এগিয়ে
আসায় আগামী সংসদ নির্বাচন কীভাবে এবং কেমন সরকারের অধীনে হবে সে বিষয়ে
নাগরিক সমাজে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। অবশ্য স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানে
চরমভাবে ব্যর্থ কাজী রকিব কমিশন মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে নারায়ণগঞ্জ
সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন ভালোভাবে সম্পন্ন করে কমিশনের ভাবমূর্তি
মেরামতের ব্যর্থ চেষ্টা করে। তবে নাসিক নির্বাচন মোটামুটি স্বচ্ছভাবে
অনুষ্ঠিত হয়।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর এর অধীনে কুমিল্লা সিটি
কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় নাগরিক সমাজ নির্বাচনটিকে
একদিকে কমিশনের পারফরম্যান্স পরীক্ষা এবং অন্যদিকে দুই বড় দলের জনপ্রিয়তা
যাচাইয়ের ব্যারোমিটার হিসেবে গণ্য করেছে। এ কারণে এ নির্বাচনের প্রচারণায়
উভয় দলের প্রার্থীর পক্ষে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন।
নির্বাচনী প্রচারণাকালে এ নির্বাচনে বড় রকমের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বা
সন্ত্রাস-সহিংসতা হয়নি। ছোটখাটো ত্রুটি বাদ দিয়ে বলা যায়, নির্বাচনী
প্রচারণায় প্রার্থী ও তাদের নেতাকর্মী-সমর্থকরা নির্বাচনী আচরণবিধি মেনেই
প্রচারণা চালান। নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন-পূর্ব প্রস্তুতিও দৃশ্যত ভালো
ছিল। তবে নির্বাচনের দিন কমিশনের কর্মকাণ্ড ভালো ছিল না। কমিশনের
প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগে এবং তাদের প্রশিক্ষণে আরও সতর্ক
হওয়া দরকার ছিল। এদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণে গোপনে ইসির পর্যবেক্ষক নিয়োগ
করা দরকার ছিল। এরা যদি সঠিকভাবে কাজ করতে পারত, তাহলে সকালের দিকে
ভোটকেন্দ গুলোতে উল্লেখযোগ্য অনিয়ম না হলেও দুপুরের পর প্রায় শতকরা ১৫ থেকে
২০ ভাগ ভোট কেন্দ্রে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে ব্যালট পেপরে সিল মারাসহ
বিভিন্ন রকম অনিয়ম ছড়িয়ে পড়বে কেন? ২৯টি ওয়ার্ডের ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে
৮টি ওয়ার্ডের ২১টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণকারী ব্রতীর প্রতিবেদন অনুযায়ী
উল্লিখিত ২১টি কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ৬টিতে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে
বেআইনিভাবে সিল মারতে দেখা গেছে। এ ৬টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র দুটি
ভোট কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। নাগরিক সমাজ জানতে চায়, যারা ভোট
কেন্দ্রে ঢুকে একটি দলের প্রার্থীর পক্ষে সিল মেরেছে তাদের শাস্তি হয়েছে
কিনা। নির্বাচন কমিশন এত আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ দেয়ার পরও যদি
ভোটদস্যুরা ভোট কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপারে সিল মারতে পারে, তাহলে সে
নির্বাচনকে ভালো নির্বাচন বলার সুযোগ নেই। ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের
সর্বপ্রথম শর্ত হল নির্বাচনে ভয়-ভীতিহীন পরিবেশ সৃষ্টি করা। কুসিক
নির্বাচনে বাহ্যিকভাবে পরিবেশ ভালো মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে সেখানে পরিবেশ
ভয়-ভীতিহীন ছিল না। নির্বাচনে ভোটের হার দেখে সে বিষয়টি অনুধাবন করা যায়।
কারণ এ কথা সবাই জানে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে
ভোট বেশি পড়ে। সে কারণে কুসিক নির্বাচনে শতকরা ৬৩ ভাগের মতো যে ভোট পড়েছে
তা অনেক কম মনে করা যায়। কারণ, গত ৮ম সংসদ নির্বাচনে যেখানে শতকরা ৭৫.৫৯
এবং নবম সংসদ নির্বাচনে যেখানে শতকরা ৮৭.৬০ ভাগ ভোট পড়েছিল সেখানে ব্যাপক
প্রচারণার পর একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মাত্র শতকরা ৬৩ ভাগ ভোট পড়াকে
স্বাভাবিক বলা যায় না।
কিছু কিছু কেন্দ্রে বেশি এবং কিছু কিছু কেন্দ্রে কম
ভোট পড়ার হার দেখে ওই সব কেন্দ্রে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে বলে প্রতীয়মান
হয়। যেমন শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত হলেও নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি উচ্চ
বিদ্যালয়ের দুটি কেন্দ্রে, ভিক্টোরিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয় বিজ্ঞান ভবন
কেন্দ্রে এবং বাগিচাগাঁও ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কেন্দ্রে সবকিছু স্বাভাবিক
থাকলে শতকরা ৫০ ভাগেরও কম ভোট পড়বে কেন? আবার কোনোরকম ম্যানিপুলেশন বা
ইঞ্জিনিয়ারিং না হলে ইছহাক সরকারি প্রাথমিক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে শতকরা
৯০.৭১, মডার্ন স্কুল প্রাইমারি শাখা কেন্দ্রে ৮৯.৬০, দিশাবন্দ সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৮২.১ ভাগ ভোট পড়ে কীভাবে? এসব তথ্য থেকে
কোনোরকম গবেষণা না করেই অনুধাবন করা যায়, যেসব কেন্দ্রে অনেক কম ভোট পড়েছে
সেখানে হয়তো ভোটারদের মধ্যে ভয়-ভীতি কাজ করেছে এবং যেখানে খুব বেশি ভোট
পড়েছে সেখানে হয়তো ভোট কেন্দ্রে কোনো বিশেষ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী
ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। এ নির্বাচনে আরেকটি বিষয় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
নির্বাচনের দিন বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট ও কর্মীদের অনেক
কেন্দ্রে দেখাই যায়নি। পরে জানা যায়, তারা ছিলেন তবে তারা নৌকা মার্কার
ব্যাজ বুকে লাগিয়ে ভোট কেন্দ্রে এবং ভোট কেন্দ্রের বাইরে চলাফেরা করেছেন।
কাজেই পরিবেশ যদি স্বাভাবিকই হয়ে থাকে, তাহলে একটি দলের প্রার্থীর
নেতাকর্মীদের বুকে প্রতিপক্ষের নির্বাচনী প্রতীকের ব্যাজ লাগিয়ে ঘুরতে হবে
কেন? যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের মতামতেও কুসিক নির্বাচন
পরিচালনায় নতুন ইসির ভূমিকার মিশ্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। যেমন, ইলেকশন
ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) পর্যবেক্ষণে যেখানে এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে
নতুন ইসির শুভ সূচনা হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে, সেখানে আরেক নির্বাচন
পর্যবেক্ষক ব্রতীর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে ‘কুসিক নির্বাচন ইতিপূর্বে
অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের অর্জিত মান ধরে
রাখতে ব্যর্থ হয়েছে’ উল্লেখ করে এ নির্বাচনের কিছুসংখ্যক ভোট কেন্দ্রে
ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পক্ষে বেআইনিভাবে সিল মারা, ব্যালট ছিনতাই, ককটেল
বিস্ফোরণ ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচনের পর সরকারদলীয়
নেতাকর্মীদের ব্যাখ্যায় কুসিক নির্বাচন পরিচালনায় নতুন ইসির ব্যাপক প্রশংসা
করে আগামীতে এ কমিশনের অধীনেই সব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে বলে
আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও নেতা-কর্মী-সমর্থকরা
অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে ভোট অনেক
বেশি কাস্ট হতো এবং বিজয়ী প্রার্থী আরও অনেক বেশি ভোটের ব্যবধানে সরকারদলীয়
প্রার্থীকে পরাজিত করতে পারতেন। কুসিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারদলীয়
নেতা-কর্মী-সমর্থক এবং নাগরিক সমাজের অসচেতন অংশের মধ্যে একটি ভুল ধারণা
লক্ষ করা গেছে। তাদের অনেকেই মনে করেন, যেহেতু এ নির্বাচনে বিরোধীদলীয়
প্রার্থী জিতেছেন এবং সরকারদলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, কাজেই নির্বাচন
হয়তো ভালোই হয়েছে। এ ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী
জিতল বা হারল, তার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনের স্বচ্ছতা বা দুর্নীতি-কারচুপি
পরিমাপ করলে ভুল হবে। নির্বাচনী মাঠের বাস্তবতা দেখে এবং নির্বাচন-পূর্ব,
নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের পরিবেশ, ঘটনাবলী, তথ্য-উপাত্ত
বিবেচনা করেই নির্বাচনের স্বচ্ছতার মাত্রা অনুধাবন করতে হয়। সেক্ষেত্রে
কুসিক নির্বাচনের পরিবেশ, প্রচারণা, ভোট পড়ার হার, অদৃশ্য আতংক, নির্বাচনের
দিনের ঘটনাবলী ও পরিবেশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের
আচরণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিলে এ নির্বাচনকে একটি প্রশংসনীয় নির্বাচন
বলে বিবেচনা করা যায় না। এ কথা স্বীকার্য, ইতিপূর্বে রকিব কমিশনের অধীনে
অনুষ্ঠিত উপজেলা, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন এবং ইউপি নির্বাচনগুলোতে
সন্ত্রাস-সহিংসতা ও দুর্নীতি-কারচুপি যেভাবে ব্যাপকতা পেয়েছিল, কুসিক
নির্বাচনে এমন নেতিবাচকতার মাত্রা ছিল তুলনামূলক কম। তারপরও নির্বাচনটিকে
স্বচ্ছ নির্বাচনের তালিকাভুক্ত করা যায় না। নতুন নির্বাচন কমিশন তার
ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবটুকু মনোযোগ দেয়ার পরও একটিমাত্র স্থানীয়
সরকার নির্বাচন করতে গিয়েই যদি নির্বাচনের এ অবস্থা হয়, তাহলে তারা এর চেয়ে
অধিক গুরুত্বপূর্ণ ৩০০ আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে
স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে পারবেন এমনটি বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, ওই নির্বাচনে
হেরে গেলে যেহেতু আর সরকারে থাকা যাবে না সেজন্য সংসদ নির্বাচনে
প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী লড়াই হবে আরও অনেক তীব্র। সে কারণে
কুসিক নির্বাচনে নতুন ইসির পারফরম্যান্স দেখে মনে হয়, দলীয় সরকারের অধীনে
অনুষ্ঠিত হলে এ কমিশনের পক্ষে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতা
প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। সাধারণ মানুষ স্বচ্ছ নির্বাচন চান। কোনো বিশেষ
দল নির্বাচনে জয়ী বা পরাজিত হলেই নির্বাচন ভালো হবে এমনটি তারা মনে করেন
না। তারা একাদশ সংসদ নির্বাচনে শতভাগ স্বচ্ছতা দেখতে চান। তারা কুসিক
নির্বাচনের চেয়ে ভালো নির্বাচন চান। তারা এমন একটি ত্রুটিমুক্ত সংসদ
নির্বাচন চান, যে নির্বাচন দেশে ও বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক
ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
akhtermy@gmail.com
No comments