জনগণকে বিভ্রান্ত করছে নির্বাচন কমিশন by বদিউল আলম মজুমদার
ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে দুই দফায় ১ হাজার ৩৬৪টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। গণমাধ্যমে এ বিষয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন বেরিয়েছে এবং টক শোতে হয়েছে বহু আলোচনা। সব মত-পথের ব্যক্তিরাই এই সমালোচনায় অংশ নিয়েছেন। এমনকি মহাজোটের শরিকেরাও সমালোচনায় শরিক হয়েছেন। এসব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ৪ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান। বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয় যে কিছু পত্র–পত্রিকায় ও টেলিভিশনের টক শোতে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক আলোচনা হচ্ছে। গত দুই ধাপের নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়েছে, তা প্রমাণ করার জন্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়: ‘প্রথম পর্যায়ে ৬ হাজার ৮৭০টি কেন্দ্রের মধ্যে প্রিসাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত হওয়ার কারণে ৬৫টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে, যা মোট কেন্দ্রের মাত্র শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬ হাজার ৮৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে বন্ধ হয়েছে ৩৭টি, যা মোট কেন্দ্রের মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। এতে দেখা যায় যে দ্বিতীয় পর্যায়ে কেন্দ্র স্থগিতের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কমে গেছে। দুই পর্যায়ে কেন্দ্র বন্ধের হার খুবই নগণ্য—১ শতাংশেরও কম, যা এ ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই দৃশ্যমান করে।’ উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের হয় কোনো ধারণাই নেই, না হয় কমিশন জেনেশুনেই জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। কমিশনের জানার কথা যে নির্বাচন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনের দিনে কী ঘটে না–ঘটে শুধু তার ওপর সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নির্ভর করে না। কমিশনের সদস্যরা যদি তা না জানেন, তা হবে তাঁদের অযোগ্যতার নগ্নতম প্রতিফলন। আর জেনেশুনে তাঁরা যদি এমন বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তা হবে জাতির সঙ্গে অমার্জনীয় প্রতারণা। এ ছাড়া দুই ধাপের নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি সত্ত্বেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কমিশন জনগণের চোখে ধুলা দেওয়ার অপচেষ্টাতেই যেন লিপ্ত হয়েছে।
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কতগুলো মানদণ্ড রয়েছে, যেগুলো হলো: (১) সর্বজনীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নির্ভুল ভোটার তালিকা, যে তালিকায় যাঁরা ভোটার হওয়ার যোগ্য, তাঁরা সবাই অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছেন; (২) যাঁরা প্রার্থী হতে চেয়েছেন তাঁরা সবাই প্রার্থী হতে পেরেছেন; (৩) ভোটারদের সামনে পর্যাপ্ত বিকল্প ছিল, যার ফলে নির্বাচনটি ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক; (৪) যাঁরা ভোট দিতে চেয়েছেন, তাঁরা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে ও ভোট দিতে পেরেছেন এবং (৫) নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য। উপরিউক্ত মানদণ্ডগুলোর আলোকে আমাদের গত দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। অনেক ইউনিয়নেই বিরোধী দলের, এমনকি মহাজোটের অংশীদারদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত প্রার্থীরা ক্ষমতাসীনদের বাধার মুখে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। মামলা, হামলা ও বিভিন্ন ধরনের হুমকির কারণে যাঁরা প্রার্থী হতে পেরেছেন, তাঁদের অনেকেই নির্বাচনী মাঠে থাকতে এবং প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেননি। ফলে গত দুই ধাপে বিএনপি ১৬২ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিতে পারেনি এবং ৮৭ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, যা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের উদাহরণ নয় (ইত্তেফাক, ৮ এপ্রিল ২০১৬)। জাল ভোট প্রদান, সহিংসতা ও নানা হুমকির কারণে অনেক ভোটারই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার পরও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, অনিয়মের দায় না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া এবং ব্যাপক কারচুপি সত্ত্বেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে সাফাই গাওয়াসহ কমিশনের বিভিন্ন বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকাণ্ড পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমনকি আমাদের অতি গর্বের ধন ভোটার তালিকাটিকেও, যে তালিকা নিয়ে বর্তমানে নির্বাচন হচ্ছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০০৭-০৮ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ছবিযুক্ত যে ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়, তা ছিল সর্বাধিক নির্ভুল তালিকা। সেই তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা ছিল ১৪ লাখের কিছু বেশি। আমাদের জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান হলেও আমাদের প্রায় এক কোটি জনগোষ্ঠী বিদেশে কর্মরত, যার অধিকাংশই পুরুষ এবং যাদের একটি বিরাট অংশই ভোটার নন। তাই আমাদের ভোটার তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় যে প্রায় ৪৭ লাখ ব্যক্তি ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, তাতে ‘জেন্ডার-গ্যাপ’ বা পুরুষ-নারীর অনুপাত ছিল ৫৬: ৪৪ বা ১২ শতাংশ, যা ফেনী জেলায় ছিল সর্বাধিক ৩২ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৫ সালের হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় যে প্রায় ৪৪ লাখ ভোটার যুক্ত হয়েছিলেন, তাতে জেন্ডার-গ্যাপ প্রায় ৬ শতাংশ। অর্থাৎ হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় নারীরা ভোটার তালিকা থেকে ক্রমাগতভাবে বাদ পড়েছেন। ভোটার তালিকায় এমন ত্রুটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে পারে না। এটি সুস্পষ্ট যে বর্তমান কমিশনের অপারগতার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনের মানে যে নিম্নগামিতা সৃষ্টি হয়েছে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সেই ধারাই অব্যাহত রয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটেনি। বরং বর্তমান নির্বাচনগুলোতে কতগুলো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা অতীতে ঘটেনি। যেমন এবার ‘মনোনয়ন-বাণিজ্য’ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, যা আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং ইউনিয়ন পরিষদকেই শুধু কলুষিত করেনি, এর মাধ্যমে তৃণমূলেও বিরাজনীতিকরণ ছড়িয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান নির্বাচনগুলোতে যে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটছে, তা ঘটছে দীর্ঘমেয়াদিভাবে এবং মূলত ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে, যা অতীতে দেখা যায়নি। উপরন্তু, এবারই প্রথম নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের অনেক এলাকায়ই মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং যাঁরা প্রার্থী হতে পেরেছেন, তাঁদেরও বহু ক্ষেত্রে নির্বাচনী মাঠে থাকতে দেওয়া হয়নি। আর ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকেরা এসব এবং অন্যান্য নির্বাচনী অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন প্রকাশ্যে, বেপরোয়াভাবে ও কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই। নির্বাচন কমিশন এসব অপকর্মের কোনোটিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে আজ অনেকের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে জনগণকে শুধু বিভ্রান্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান অমান্য করার এক মহোত্সবেও যেন লিপ্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯-এর ১১(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বর্তমান কমিশন ২০১৪ সালের মে মাসে এবং ২০১৫ সালের জুলাই মাসে হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করে। ভোটার তালিকা বিধিমালা, ২০১২ (ধারা ৩) এ হালনাগাদের জন্য ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কথা থাকলেও তথ্য সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে তা না করার অভিযোগ ওঠে (প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০১৫), যা কমিশনের ব্যর্থতারই প্রতিফলন। এ ছাড়া আইনানুযায়ী প্রতিবছর হালনাগাদের তথ্য সংগ্রহ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত বছর কমিশন ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়স্কদের অগ্রিম নিবন্ধন করেছে, যাতে প্রতিবছর ভোটারদের বাড়ি যেতে না হয়, যা বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়া আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী ভোটার তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশের কথা থাকলেও তা করা হয় না। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে প্রার্থীদের হলফনামা সন্দেহজনকভাবে উধাও হয়ে যায়, যা সুজনের পক্ষ থেকে আইনি নোটিশ প্রদানের পর আবার পাওয়া যায়। এ সবই বর্তমান কমিশনের পদে পদে আইন ও বিধিবিধান উপেক্ষা করার এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রবণতারই প্রতিফলন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কতগুলো মানদণ্ড রয়েছে, যেগুলো হলো: (১) সর্বজনীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নির্ভুল ভোটার তালিকা, যে তালিকায় যাঁরা ভোটার হওয়ার যোগ্য, তাঁরা সবাই অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছেন; (২) যাঁরা প্রার্থী হতে চেয়েছেন তাঁরা সবাই প্রার্থী হতে পেরেছেন; (৩) ভোটারদের সামনে পর্যাপ্ত বিকল্প ছিল, যার ফলে নির্বাচনটি ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক; (৪) যাঁরা ভোট দিতে চেয়েছেন, তাঁরা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে ও ভোট দিতে পেরেছেন এবং (৫) নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য। উপরিউক্ত মানদণ্ডগুলোর আলোকে আমাদের গত দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। অনেক ইউনিয়নেই বিরোধী দলের, এমনকি মহাজোটের অংশীদারদের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত প্রার্থীরা ক্ষমতাসীনদের বাধার মুখে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। মামলা, হামলা ও বিভিন্ন ধরনের হুমকির কারণে যাঁরা প্রার্থী হতে পেরেছেন, তাঁদের অনেকেই নির্বাচনী মাঠে থাকতে এবং প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেননি। ফলে গত দুই ধাপে বিএনপি ১৬২ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী দিতে পারেনি এবং ৮৭ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, যা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের উদাহরণ নয় (ইত্তেফাক, ৮ এপ্রিল ২০১৬)। জাল ভোট প্রদান, সহিংসতা ও নানা হুমকির কারণে অনেক ভোটারই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার পরও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, অনিয়মের দায় না নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া এবং ব্যাপক কারচুপি সত্ত্বেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে সাফাই গাওয়াসহ কমিশনের বিভিন্ন বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকাণ্ড পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমনকি আমাদের অতি গর্বের ধন ভোটার তালিকাটিকেও, যে তালিকা নিয়ে বর্তমানে নির্বাচন হচ্ছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০০৭-০৮ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ছবিযুক্ত যে ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়, তা ছিল সর্বাধিক নির্ভুল তালিকা। সেই তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারের সংখ্যা ছিল ১৪ লাখের কিছু বেশি। আমাদের জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান সমান হলেও আমাদের প্রায় এক কোটি জনগোষ্ঠী বিদেশে কর্মরত, যার অধিকাংশই পুরুষ এবং যাদের একটি বিরাট অংশই ভোটার নন। তাই আমাদের ভোটার তালিকায় পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় যে প্রায় ৪৭ লাখ ব্যক্তি ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, তাতে ‘জেন্ডার-গ্যাপ’ বা পুরুষ-নারীর অনুপাত ছিল ৫৬: ৪৪ বা ১২ শতাংশ, যা ফেনী জেলায় ছিল সর্বাধিক ৩২ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৫ সালের হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় যে প্রায় ৪৪ লাখ ভোটার যুক্ত হয়েছিলেন, তাতে জেন্ডার-গ্যাপ প্রায় ৬ শতাংশ। অর্থাৎ হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় নারীরা ভোটার তালিকা থেকে ক্রমাগতভাবে বাদ পড়েছেন। ভোটার তালিকায় এমন ত্রুটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে পারে না। এটি সুস্পষ্ট যে বর্তমান কমিশনের অপারগতার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচনের মানে যে নিম্নগামিতা সৃষ্টি হয়েছে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সেই ধারাই অব্যাহত রয়েছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটেনি। বরং বর্তমান নির্বাচনগুলোতে কতগুলো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা অতীতে ঘটেনি। যেমন এবার ‘মনোনয়ন-বাণিজ্য’ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে, যা আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং ইউনিয়ন পরিষদকেই শুধু কলুষিত করেনি, এর মাধ্যমে তৃণমূলেও বিরাজনীতিকরণ ছড়িয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান নির্বাচনগুলোতে যে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটছে, তা ঘটছে দীর্ঘমেয়াদিভাবে এবং মূলত ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে, যা অতীতে দেখা যায়নি। উপরন্তু, এবারই প্রথম নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের অনেক এলাকায়ই মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং যাঁরা প্রার্থী হতে পেরেছেন, তাঁদেরও বহু ক্ষেত্রে নির্বাচনী মাঠে থাকতে দেওয়া হয়নি। আর ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকেরা এসব এবং অন্যান্য নির্বাচনী অপরাধে লিপ্ত হয়েছেন প্রকাশ্যে, বেপরোয়াভাবে ও কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই। নির্বাচন কমিশন এসব অপকর্মের কোনোটিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলে আজ অনেকের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে জনগণকে শুধু বিভ্রান্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা নির্বাচনী আইন ও বিধিবিধান অমান্য করার এক মহোত্সবেও যেন লিপ্ত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯-এর ১১(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বর্তমান কমিশন ২০১৪ সালের মে মাসে এবং ২০১৫ সালের জুলাই মাসে হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু করে। ভোটার তালিকা বিধিমালা, ২০১২ (ধারা ৩) এ হালনাগাদের জন্য ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কথা থাকলেও তথ্য সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে তা না করার অভিযোগ ওঠে (প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০১৫), যা কমিশনের ব্যর্থতারই প্রতিফলন। এ ছাড়া আইনানুযায়ী প্রতিবছর হালনাগাদের তথ্য সংগ্রহ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও গত বছর কমিশন ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়স্কদের অগ্রিম নিবন্ধন করেছে, যাতে প্রতিবছর ভোটারদের বাড়ি যেতে না হয়, যা বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ছাড়া আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী ভোটার তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশের কথা থাকলেও তা করা হয় না। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে প্রার্থীদের হলফনামা সন্দেহজনকভাবে উধাও হয়ে যায়, যা সুজনের পক্ষ থেকে আইনি নোটিশ প্রদানের পর আবার পাওয়া যায়। এ সবই বর্তমান কমিশনের পদে পদে আইন ও বিধিবিধান উপেক্ষা করার এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রবণতারই প্রতিফলন।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments