আশরাফ ও আতরাফ by মাহবুব তালুকদার
একজন
আশরাফ ও একজন আতরাফ! আশরাফ অর্থ উচ্চস্তরের মানুষ, মানে ভদ্রলোক। আর আতরাফ
অর্থ অনভিজাত। যিনি আশরাফ তিনি শুধু নামে আশরাফ নন, আসলেই আশরাফ বা সজ্জন
মানুষ। অন্যজনকে আতরাফ বলা হলেও তিনিও অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তিত্ব। তার নাম
অবশ্যই আতরাফ নয়, ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে তাকে রাষ্ট্রযন্ত্র আতরাফ হিসেবে
তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। যার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, আগুনে মানুষ পুুড়িয়ে
মারা ও বোমাবাজির মতো হীন কাজকর্মের অভিযোগ, তাকে আতরাফ ছাড়া আর কী বলা
যায়? তবে ব্যক্তিগত জীবনে এই আতরাফ মানুষটি আশরাফের মতোই ভদ্রলোক, একথা তার
শত্রু বা বিরুদ্ধবাদীরাও বলবেন। আশরাফ ও ফখরুল দু’জনকে নিয়েই এখন
রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে। একজন আওয়ামী লীগের মতো বিশাল দলের সাধারণ সম্পাদক।
অন্যদিকে অন্যজন বিএনপির মতো বড় মাপের দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। এই
ভারপ্রাপ্ত পদবিটি দীর্ঘকাল ধরে তিনি ললাটে ধারণ করে আছেন। কবে যে তিনি
ভারপ্রাপ্ত থেকে ভারমুক্ত হবেন, তা কেউ বলতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতারাও
অনেক সময় তার ভারপ্রাপ্তি নিয়ে কটাক্ষ করেন। তবে নেতা ও মানুষ হিসেবে ফখরুল
ইসলাম আলমগীরের গুণাবলীর প্রশংসা অবশ্যই করতে হবে।
চাচার বাসায় বসে দৈনিক পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে আশরাফ ও ফখরুলের গুরুত্বপূর্ণ খবর দুটি পড়ছিলাম। আশরাফকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ফখরুলকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে জেলখাটা থেকে। আশরাফের মতো সৎ ও অনুগত রাজনীতিবিদকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার কারণ কী হতে পারে? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তিনি মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম যথাযথভাবে দেখভাল করেন না, একনেকের গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত থাকেননি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকরূপে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব রয়েছে, ইত্যাদি। তবে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকই থাকলেন। আর ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাস্থ্যগত কারণে জামিনে মুক্তি লাভ করলেও চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যেতে হবে। তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের মতোই তার দলের স্বাস্থ্যও ভালো নয়। এই সময়ে অসংখ্য মামলার জালে জড়িয়ে আছে বিএনপির অগণিত নেতাকর্মী। হাজার হাজার নেতাকর্মী আন্দোলনের ফসল হিসেবে পলাতক এবং পারিবারিক ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত। এমতাবস্থায় ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে বিএনপি ও ফখরুল কবে কিভাবে রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরে আসবেন, তা এক জিজ্ঞাসা।
আমাকে পত্রিকার পাতায় নিবিষ্ট দেখে চাচা বললেন, কী ব্যাপার? এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছো?
আশরাফ ও আতরাফের ঘটনা।
আতরাফ কী? চাচা জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি বর্তমান রাজনীতিতে আতরাফ কথাটার তাৎপর্য তুলে ধরলাম।
চাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি আশরাফ ও ফখরুলকে এক পাল্লায় মাপছো? একজন পার্টির পূর্ণ সাধারণ সম্পাদক, আরেকজন দলের ভারপ্রাপ্ত। দু’জনের প্রটোকল আলাদা।
আমি বললাম, পাল্লা তো একটাই হতে হবে। আলাদা আলাদা পাল্লায় মেপে তুলনামূলক বিচার করা যাবে না।
চাচা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, আশরাফ সাহেবের সঙ্গে ফখরুলের তুলনা? তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?
চাচা! আমি আপনার দৃষ্টি দিয়ে দেখছি না। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখছি। তারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়ারও তুলনামূলক বিচার করতে পারে। কথার শেষে আমি চাচার প্রতি একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া আশরাফের পরিণতিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই দূরদর্শী। তিনি কেবল রাষ্ট্রনায়ক নন, রাষ্ট্রচিন্তকও বটে। তার ডিসিশন অবশ্যই কারেক্ট।
কিন্তু তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হলো কেন? এটা এইচ এম এরশাদের বিশেষ দূতের মতো অবস্থা হয়ে গেল না?
তুমি তো রাজনীতি বোঝো না। তাই এসব বিষয়ের মাজেজা বুঝতে পারো না। আশরাফ সাহেবকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী না করা হলে যারা তাকে ঘিরে আছে, তারা কোথায় যাবে? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই বা তাকে মানবে কেন? আর এরশাদ স্যারের কথা বলছো? তিনি যে নির্বাচন না করতে চেয়ে নিজের মাথায় পিস্তল ধরে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন, তাকেও তো কিছু একটা দিতে হবে?
চাচা! নির্বাচনের সময় এরশাদ সাহেব নমিনেশন পেপার লিখিতভাবে তুলে নিলেও তিনি বাধ্যতামূলকভাবে এমপি হয়ে যান। হতে না চেয়েও তিনি এমপি ও মন্ত্রীর পদমর্যাদায় আসীন হয়েছেন।
হ্যাঁ। এরই নাম রাজনীতি। চাচা বললেন, ভবিষ্যতে নমিনেশন পেপার সাবমিট না করেও কেউ কেউ এমপি হতে পারেন। প্রেমে, যুদ্ধে ও রাজনীতিতে সবই সম্ভব। এ বিষয়টা তুমি বুঝতে পারবে না।
রাজনীতি আমি ঠিকই ভালো বুঝতে পারি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম, পর্দার অন্তরালে আশরাফকে নিয়ে মান-অভিমানের খেলা চলছে। আশরাফ লন্ডনে চলে যাওয়ার ‘হুমকি’ দিচ্ছেন, ঘন ঘন শেখ রেহানার সঙ্গে তার ফোনালাপ হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কয়েকবার দেখাও হয়ে গেল। আমার কাছে মনে হলো, অন্তরালে কিছু একটা নাটক চলছে। এরপর জানা গেল, আশরাফ সাহেব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী হয়েছেন। খবরটি পেয়ে আমি চাচাকে ফোন করলাম। বললাম, আশরাফ সাহেব তো আবার মন্ত্রী হয়েছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই দূরদর্শী। তিনি কেবল রাষ্ট্রনায়ক নন, রাষ্ট্রচিন্তকও বটে। তার ডিসিশন অবশ্যই কারেক্ট।
বললাম, আগের ডিসিশন আর এখনকার ডিসিশন তো অনেকটা পরস্পরবিরোধী।
তুমি যদি এসব বিষয় বুঝতে পারতে, তাহলে তুমিই তো রাজনীতিবিদ হয়ে যেতে। আগের পরিস্থিতিতে মন্ত্রিত্ব থেকে তার অব্যাহতি দান ঠিকই ছিল। আবার এখনকার পরিস্থিতিতে নতুন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদের মন্ত্রিত্ব প্রদান ঠিকই আছে। আগেই বলেছি, এসব তুমি বুঝবে না।
আসলেই আমি এসব বুঝতে পারি না। আমার মনে হয়েছে, আশরাফের অভিমানের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে হার মেনেছেন। দু’জনেই পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগের বন্ধনে আবদ্ধ। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহযোগী ছিলেন। এ জন্যই তাকে জেল হত্যাকাণ্ডের সময় প্রাণ দিতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় এসব বিষয় নিশ্চয়ই কাজ করেছে।
বাংলাদেশ এক অদ্ভুত দেশ। বিশেষত্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা মন্ত্রিত্বের ইঁদুর দৌড়ে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব জোর করে চাপিয়ে দেয়ার পরও কেউ কেউ ক্ষমতা থেকে দূরে সরে থাকতে চান। সোহেল তাজের ঘটনাটা মনে পড়লো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে কেন মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে রহস্য আজও আমার কাছে অজ্ঞাত। সম্ভবত সেই ঘটনার প্রভাবেই সোহেল তাজকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। তবে তিনি এক পর্যায়ে একরকম জোর করেই মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি চান। অবশেষে তাজউদ্দীন কন্যা ও সোহেল তাজের বোন সিমিন হোসেন রিমিকে এমপি বানিয়ে, তাজউদ্দীন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়। রাজনীতির অন্তরালে কত কৌতূহলপূর্ণ ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে, যা আমরা জানি না।
আবার আতরাফের কথায় আসা যাক। এক্ষণে ফখরুল ব্যক্তিগতভাবে হয়তো আতরাফ নন, কিন্তু তার দলকে আতরাফ বললে অত্যুক্তি হয় না। জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়া সম্ভবত তার রাজনৈতিক জীবনের কঠিনতম সময় পার করছেন। সরকার তার দলকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা ঝুলছে। এর কোন একটিতে সাজা হলেও তাকে জেলে যেতে হবে এবং জেলে থাকতে হবে বলে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী আগাম বলে দিয়েছেন। আদালতের রায় কি হবে তা কেউ জানে না। কিন্তু আমাদের মন্ত্রীদের কেউ কেউ রাজনৈতিক জ্যোতিষীও বটে। তারা অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন।
আতরাফ বিএনপিকে নিয়ে নতুন একটি খেলা শুরু হয়েছে। এমনিতে বিএনপিকে টুকরো করার প্রচেষ্টা এক-এগারোর সময় থেকেই চলে আসছিল। আসল বিএনপি’র ব্যানারে দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করা হয়। এক কালের বিএনপি নেতা আবু হেনা ও সংস্কারপন্থি নেতা এখন আওয়ামী ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু বর্তমান খেলাটা বেশ চমকপ্রদ। বিএনপি’র অসংখ্য নেতাকর্মীকে আওয়ামী লীগ কোলে তুলে বরণ করে নেয়ার চমৎকার ছবি পত্রিকাতে দেখা যাচ্ছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিগত আন্দোলনকালে সহিংসতা, মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে, মামলাও রয়েছে। হামলা- মামলার ভয়ে বিপর্যস্ত বিএনপি’র অনেক আতরাফ নেতাকর্মী আত্মরক্ষার তাগিদে আওয়ামী লীগে যোগদানের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিচ্ছেন। জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু আখেরে এসব ঘটনা রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে!
আমি চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম, দেশের ভবিষ্যৎ কি?
দেশের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। রাজনীতির খেলায় আওয়ামী লীগ চ্যাম্পিয়ন। আগামীতে জাতীয় নির্বাচন কিভাবে হবে?
মানে? চাচা চোখ কপালে তুলে বললেন, সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত। জাতীয় নির্বাচনের জন্য এটা ছিল একটা মহড়া। এভাবে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং নির্বাচনের দিন দুপুর বেলা উইথড্র করে, তাহলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কি আছে?
কিন্তু বিএনপি, মানে আতরাফের দল যদি নির্বাচনে না আসে?
তাতে অসুবিধা কি? জাতীয় পার্টি আছে, ... পার্টি আছে। আর আগামীতে ইনশাআল্লাহ আওয়ামী লীগ থেকে মাত্র ১৫৩টি পদে নয়, সংসদের বিরোধী দলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে প্রায় পৌনে তিনশ’ পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হবে।
কিন্তু আতরাফকে বাদ দিয়ে আশরাফের নির্বাচন কি সম্ভব?
কেন? চাচা সবিস্ময়ে আমার দিকে তাকালেন।
বললাম, আতরাফ পাশাপাশি না থাকলে আশরাফ তার মর্যাদার স্বীকৃতি পাবে কিভাবে?
চাচার বাসায় বসে দৈনিক পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে আশরাফ ও ফখরুলের গুরুত্বপূর্ণ খবর দুটি পড়ছিলাম। আশরাফকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ফখরুলকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে জেলখাটা থেকে। আশরাফের মতো সৎ ও অনুগত রাজনীতিবিদকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার কারণ কী হতে পারে? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তিনি মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম যথাযথভাবে দেখভাল করেন না, একনেকের গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত থাকেননি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকরূপে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব রয়েছে, ইত্যাদি। তবে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলেও তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকই থাকলেন। আর ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাস্থ্যগত কারণে জামিনে মুক্তি লাভ করলেও চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যেতে হবে। তার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের মতোই তার দলের স্বাস্থ্যও ভালো নয়। এই সময়ে অসংখ্য মামলার জালে জড়িয়ে আছে বিএনপির অগণিত নেতাকর্মী। হাজার হাজার নেতাকর্মী আন্দোলনের ফসল হিসেবে পলাতক এবং পারিবারিক ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত। এমতাবস্থায় ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে বিএনপি ও ফখরুল কবে কিভাবে রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরে আসবেন, তা এক জিজ্ঞাসা।
আমাকে পত্রিকার পাতায় নিবিষ্ট দেখে চাচা বললেন, কী ব্যাপার? এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছো?
আশরাফ ও আতরাফের ঘটনা।
আতরাফ কী? চাচা জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি বর্তমান রাজনীতিতে আতরাফ কথাটার তাৎপর্য তুলে ধরলাম।
চাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি আশরাফ ও ফখরুলকে এক পাল্লায় মাপছো? একজন পার্টির পূর্ণ সাধারণ সম্পাদক, আরেকজন দলের ভারপ্রাপ্ত। দু’জনের প্রটোকল আলাদা।
আমি বললাম, পাল্লা তো একটাই হতে হবে। আলাদা আলাদা পাল্লায় মেপে তুলনামূলক বিচার করা যাবে না।
চাচা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন, আশরাফ সাহেবের সঙ্গে ফখরুলের তুলনা? তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?
চাচা! আমি আপনার দৃষ্টি দিয়ে দেখছি না। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখছি। তারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়ারও তুলনামূলক বিচার করতে পারে। কথার শেষে আমি চাচার প্রতি একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া আশরাফের পরিণতিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই দূরদর্শী। তিনি কেবল রাষ্ট্রনায়ক নন, রাষ্ট্রচিন্তকও বটে। তার ডিসিশন অবশ্যই কারেক্ট।
কিন্তু তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হলো কেন? এটা এইচ এম এরশাদের বিশেষ দূতের মতো অবস্থা হয়ে গেল না?
তুমি তো রাজনীতি বোঝো না। তাই এসব বিষয়ের মাজেজা বুঝতে পারো না। আশরাফ সাহেবকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী না করা হলে যারা তাকে ঘিরে আছে, তারা কোথায় যাবে? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই বা তাকে মানবে কেন? আর এরশাদ স্যারের কথা বলছো? তিনি যে নির্বাচন না করতে চেয়ে নিজের মাথায় পিস্তল ধরে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন, তাকেও তো কিছু একটা দিতে হবে?
চাচা! নির্বাচনের সময় এরশাদ সাহেব নমিনেশন পেপার লিখিতভাবে তুলে নিলেও তিনি বাধ্যতামূলকভাবে এমপি হয়ে যান। হতে না চেয়েও তিনি এমপি ও মন্ত্রীর পদমর্যাদায় আসীন হয়েছেন।
হ্যাঁ। এরই নাম রাজনীতি। চাচা বললেন, ভবিষ্যতে নমিনেশন পেপার সাবমিট না করেও কেউ কেউ এমপি হতে পারেন। প্রেমে, যুদ্ধে ও রাজনীতিতে সবই সম্ভব। এ বিষয়টা তুমি বুঝতে পারবে না।
রাজনীতি আমি ঠিকই ভালো বুঝতে পারি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম, পর্দার অন্তরালে আশরাফকে নিয়ে মান-অভিমানের খেলা চলছে। আশরাফ লন্ডনে চলে যাওয়ার ‘হুমকি’ দিচ্ছেন, ঘন ঘন শেখ রেহানার সঙ্গে তার ফোনালাপ হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কয়েকবার দেখাও হয়ে গেল। আমার কাছে মনে হলো, অন্তরালে কিছু একটা নাটক চলছে। এরপর জানা গেল, আশরাফ সাহেব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী হয়েছেন। খবরটি পেয়ে আমি চাচাকে ফোন করলাম। বললাম, আশরাফ সাহেব তো আবার মন্ত্রী হয়েছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া কি?
চাচা বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই দূরদর্শী। তিনি কেবল রাষ্ট্রনায়ক নন, রাষ্ট্রচিন্তকও বটে। তার ডিসিশন অবশ্যই কারেক্ট।
বললাম, আগের ডিসিশন আর এখনকার ডিসিশন তো অনেকটা পরস্পরবিরোধী।
তুমি যদি এসব বিষয় বুঝতে পারতে, তাহলে তুমিই তো রাজনীতিবিদ হয়ে যেতে। আগের পরিস্থিতিতে মন্ত্রিত্ব থেকে তার অব্যাহতি দান ঠিকই ছিল। আবার এখনকার পরিস্থিতিতে নতুন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদের মন্ত্রিত্ব প্রদান ঠিকই আছে। আগেই বলেছি, এসব তুমি বুঝবে না।
আসলেই আমি এসব বুঝতে পারি না। আমার মনে হয়েছে, আশরাফের অভিমানের কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে হার মেনেছেন। দু’জনেই পরস্পরের প্রতি গভীর অনুরাগের বন্ধনে আবদ্ধ। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহযোগী ছিলেন। এ জন্যই তাকে জেল হত্যাকাণ্ডের সময় প্রাণ দিতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় এসব বিষয় নিশ্চয়ই কাজ করেছে।
বাংলাদেশ এক অদ্ভুত দেশ। বিশেষত্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা মন্ত্রিত্বের ইঁদুর দৌড়ে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু মন্ত্রিত্ব জোর করে চাপিয়ে দেয়ার পরও কেউ কেউ ক্ষমতা থেকে দূরে সরে থাকতে চান। সোহেল তাজের ঘটনাটা মনে পড়লো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে কেন মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে রহস্য আজও আমার কাছে অজ্ঞাত। সম্ভবত সেই ঘটনার প্রভাবেই সোহেল তাজকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। তবে তিনি এক পর্যায়ে একরকম জোর করেই মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি চান। অবশেষে তাজউদ্দীন কন্যা ও সোহেল তাজের বোন সিমিন হোসেন রিমিকে এমপি বানিয়ে, তাজউদ্দীন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়। রাজনীতির অন্তরালে কত কৌতূহলপূর্ণ ঘটনা অনবরত ঘটে চলেছে, যা আমরা জানি না।
আবার আতরাফের কথায় আসা যাক। এক্ষণে ফখরুল ব্যক্তিগতভাবে হয়তো আতরাফ নন, কিন্তু তার দলকে আতরাফ বললে অত্যুক্তি হয় না। জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়া সম্ভবত তার রাজনৈতিক জীবনের কঠিনতম সময় পার করছেন। সরকার তার দলকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা ঝুলছে। এর কোন একটিতে সাজা হলেও তাকে জেলে যেতে হবে এবং জেলে থাকতে হবে বলে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী আগাম বলে দিয়েছেন। আদালতের রায় কি হবে তা কেউ জানে না। কিন্তু আমাদের মন্ত্রীদের কেউ কেউ রাজনৈতিক জ্যোতিষীও বটে। তারা অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকেন।
আতরাফ বিএনপিকে নিয়ে নতুন একটি খেলা শুরু হয়েছে। এমনিতে বিএনপিকে টুকরো করার প্রচেষ্টা এক-এগারোর সময় থেকেই চলে আসছিল। আসল বিএনপি’র ব্যানারে দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করা হয়। এক কালের বিএনপি নেতা আবু হেনা ও সংস্কারপন্থি নেতা এখন আওয়ামী ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু বর্তমান খেলাটা বেশ চমকপ্রদ। বিএনপি’র অসংখ্য নেতাকর্মীকে আওয়ামী লীগ কোলে তুলে বরণ করে নেয়ার চমৎকার ছবি পত্রিকাতে দেখা যাচ্ছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিগত আন্দোলনকালে সহিংসতা, মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে, মামলাও রয়েছে। হামলা- মামলার ভয়ে বিপর্যস্ত বিএনপি’র অনেক আতরাফ নেতাকর্মী আত্মরক্ষার তাগিদে আওয়ামী লীগে যোগদানের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিচ্ছেন। জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু আখেরে এসব ঘটনা রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে!
আমি চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম, দেশের ভবিষ্যৎ কি?
দেশের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। রাজনীতির খেলায় আওয়ামী লীগ চ্যাম্পিয়ন। আগামীতে জাতীয় নির্বাচন কিভাবে হবে?
মানে? চাচা চোখ কপালে তুলে বললেন, সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত। জাতীয় নির্বাচনের জন্য এটা ছিল একটা মহড়া। এভাবে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং নির্বাচনের দিন দুপুর বেলা উইথড্র করে, তাহলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কি আছে?
কিন্তু বিএনপি, মানে আতরাফের দল যদি নির্বাচনে না আসে?
তাতে অসুবিধা কি? জাতীয় পার্টি আছে, ... পার্টি আছে। আর আগামীতে ইনশাআল্লাহ আওয়ামী লীগ থেকে মাত্র ১৫৩টি পদে নয়, সংসদের বিরোধী দলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে প্রায় পৌনে তিনশ’ পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হবে।
কিন্তু আতরাফকে বাদ দিয়ে আশরাফের নির্বাচন কি সম্ভব?
কেন? চাচা সবিস্ময়ে আমার দিকে তাকালেন।
বললাম, আতরাফ পাশাপাশি না থাকলে আশরাফ তার মর্যাদার স্বীকৃতি পাবে কিভাবে?
No comments