আশরাফ পারবেন? রাজনীতিমুক্ত প্রশাসন বড় চ্যালেঞ্জ by শরিফুজ্জামান
জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম |
নবনিযুক্ত
জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গতকাল সোমবার প্রথম কর্মদিবসে
বলেছেন, যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হবে এবং প্রশাসনে দলীয়করণ হবে না। তবে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনপ্রশাসনে দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্যের বিষয়টি এমন এক
অভূতপূর্ব জটিলতা সৃষ্টি করেছে যে কাজটি মোটেও সহজ হবে না। প্রশাসনের
পেশাদার কর্মকর্তাদের অনেকেও মনে করছেন, এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে
পড়েছে।
২০০৯ সাল থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছেই ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এই প্রথম সেখানে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেলেন একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক, যিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত ঈদের ছুটি থাকায় গতকাল সচিবালয়ে নিজের মন্ত্রণালয়ে প্রথম যান তিনি। মন্ত্রণালয়ে ঢোকার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশাসন নিয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন। এ সময় তাঁকে স্বাগত জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীসহ মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা।
নবনিযুক্ত জনপ্রশাসনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা প্রশাসনে দলীয়করণে বিশ্বাস করি না। যাঁরা দক্ষ, তাঁরাই এখানে কাজ করবেন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে যাঁর যে যোগ্যতা আছে, সেখানে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।’
বর্তমান সরকারের গত সাড়ে ছয় বছরে কয়েক দফায় প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফলে উপসচিব থেকে ওপরের পদগুলোতে আর শূন্য পদ নেই। পদের চেয়ে কর্মকর্তা অনেক বেশি হওয়ায় পদায়ন, বসার জায়গা ও দায়িত্ব নিয়ে অনেকটা কাড়াকাড়ি অবস্থা চলছে।
সর্বশেষ গত এপ্রিলে সরকার ৮৭৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে আরও কয়েক শ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি‘বঞ্চিত’ করে বলেও অভিযোগ ওঠে। এই ‘গণপদোন্নতি’ নিয়ে জনপ্রশাসনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। এক পক্ষের অভিযোগ, যোগ্যতা থাকার পরও রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে অনেককে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলে আসছে, পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত রাখার যে অঙ্গীকার সৈয়দ আশরাফ প্রথম কর্মদিবসে করলেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত এককভাবে তিনি নিতে পারবেন না। কিন্তু যথেষ্ট অবদান রাখতে পারেন। এই মিশন নিয়ে যদি উনি এগিয়ে যান, লেগে থাকেন, তাহলে প্রশাসনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
সাবেক ওই সচিব মনে করেন, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার অনুভূতিটাই নেই। তারা যদি এটা করত, তাহলে সরকার ও জনগণ উপকৃত হতো।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা সম্ভব। তবে ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এটা করা আর সম্ভব নয়। যে মাত্রায় দলীয়করণ প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে হয়েছে, তাতে এর লাগাম টেনে ধরাটা কঠিন।’
প্রশাসনে দলীয়করণ: বর্তমান ও সাবেক একাধিক সরকারি কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নব্বইয়ের পর থেকে প্রশাসনে দলীয়করণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রকাশ্যে দলীয়করণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে জনতা মঞ্চের মাধ্যমে। তখন সাবেক সচিব মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই মঞ্চে যোগ দিয়ে আলোচনায় আসেন। পরে মহীউদ্দীন খান আলমগীর মন্ত্রী হন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রশাসনের ওই সব কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ পদ পান।
ওই সময় থেকে পদোন্নতি ও ভালো পদ দেওয়া শুরু হয় মুখ দেখে, দলীয় বিবেচনায় বলে অভিযোগ আছে। আবার তদবিরেও অনেকের পদোন্নতি হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এসব কর্মকর্তাকে ‘শাস্তিমূলক ওএসডি’ (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো বা পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়। বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও ভালো পদ দেওয়া শুরু করে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় এক সরকারের আমলে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করলে আরেক সরকারের সময়ে এসে তিনি ‘বঞ্চিত’ হন। এরপর এটি নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে।
১৯৮৪ সালের বিসিএস কর্মকর্তাদের কয়েকজন সচিব বা ভারপ্রাপ্ত পদমর্যাদায় রয়েছেন। কিন্তু এই ব্যাচের অনেক কর্মকর্তাই এখনো উপসচিব রয়ে গেছেন। তাঁদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার। জনপ্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তার মতে, এমন ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্যে কেউবা সামনে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন, আবার কারও কারও পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকার উপক্রম হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জনপ্রশাসনে এখন ভিন্নমতের কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরকারি দলের সমর্থকেরাই প্রশাসনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন।
গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা, এইচ টি ইমাম, যিনি সরকারের আগের মেয়াদে জনপ্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তার পরে আমরা দেখব।’ ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন সম্পর্কে তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রশাসনের যে ভূমিকা, নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’ এই মন্তব্যের পর সরকার বিব্রত হয় এবং তাঁকে অপসারণ করা না হলেও তাঁর কাজের পরিধি কমিয়ে দেওয়া হয় বলে দলীয় নেতারা জানান। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সাবেক আমলা এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা হিসেবে সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। প্রশাসনে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা আছে।
সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী এবং সাবেক সচিব এম কে আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন যে অবস্থায় গেছে সেখান থেকে বের করা সম্ভব, কিন্তু সেই ইচ্ছা সরকারের নেই। তবে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন দলীয়করণের অভিযোগ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির সময় দলীয়করণ কিছুটা হলেও সহনশীল পর্যায়ে ছিল। এখন প্রশাসনে দলীয়করণ যে পর্যায়ে হয়েছে, তা অতীতে কখনই হয়নি। তাই আমি মনে করি, এটা দলীয়করণ নয়, লাইসেন্স দেওয়া।’
জনপ্রশাসনে ভারসাম্যহীনতা: অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের পদ ১০৭। কর্মরত আছেন ২৬৬ জন। এক মন্ত্রণালয়ে সাধারণত একজন অতিরিক্ত সচিব থাকার কথা, কিন্তু আছেন একাধিক। অতএব, একজনের দায়িত্ব বা কাজই তাঁরা ভাগাভাগি করে করছেন, এ নিয়ে বিরোধও তৈরি হচ্ছে।
প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের ৪৩০টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন দ্বিগুণের বেশি, ৮৯৩ জন। এসব কর্মকর্তার অনেকেই বসার জায়গা পান না। একটি কক্ষে ভাগাভাগি করে বসছেন একাধিক কর্মকর্তা। পদ না থাকলেও পদোন্নতি পাওয়া এসব কর্মকর্তাকে কাজ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শাখা, অধিশাখা, বিভাগ ও অনুবিভাগ খোলা হয়েছে। তবে এ অবস্থার মধ্যেও সুষ্ঠু ও নিয়মিত পদোন্নতি চান ভুক্তভোগীরা। পদ না থাকলেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সেই নিশ্চয়তা অনেকের ভাগ্যে জোটেনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদোন্নতি পাওয়া যেসব কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন, তাঁরা বেশি খুশি হয়েছেন। কারণ, এ পদগুলোকে প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বেশি।
সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করছেন, যে বৈষম্য ও বঞ্চনা জনপ্রশাসনে তৈরি হয়ে আছে, তা ঘোচানোর উদ্যোগ নেওয়া দূরে থাক, আরও পেঁচিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ অনেক কর্মকর্তাই এখন কনিষ্ঠের অধীনে কাজ করছেন। ফলে প্রশাসনে তাঁদের কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।
সংস্কার কেবল আলোচনায়: প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার পর জনপ্রশাসনে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১৮টি কমিশন বা কমিটি গঠন করে সংস্কারের নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি কখনো। বরং অপরিকল্পিত কয়েকটি বিসিএস ব্যাচের কারণে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও ভালো পদ পেতে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজেছেন বারবার।
সর্বশেষ মন্ত্রিসভা যে ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ অনুমোদন করেছে, তাতে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে অভিযোগপত্র দাখিলের আগে গ্রেপ্তারের জন্য সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই আইন প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। প্রশাসনে দীর্ঘ সময় ধরে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে দূর করার চেষ্টা চলছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, ৮৭৩ জন কর্মকর্তার পদোন্নতির পর তাঁদের পদায়নগুলো দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছে মন্ত্রণালয়।
২০০৯ সাল থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছেই ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এই প্রথম সেখানে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেলেন একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক, যিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত ঈদের ছুটি থাকায় গতকাল সচিবালয়ে নিজের মন্ত্রণালয়ে প্রথম যান তিনি। মন্ত্রণালয়ে ঢোকার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশাসন নিয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন। এ সময় তাঁকে স্বাগত জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীসহ মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা।
নবনিযুক্ত জনপ্রশাসনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা প্রশাসনে দলীয়করণে বিশ্বাস করি না। যাঁরা দক্ষ, তাঁরাই এখানে কাজ করবেন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে যাঁর যে যোগ্যতা আছে, সেখানে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।’
বর্তমান সরকারের গত সাড়ে ছয় বছরে কয়েক দফায় প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফলে উপসচিব থেকে ওপরের পদগুলোতে আর শূন্য পদ নেই। পদের চেয়ে কর্মকর্তা অনেক বেশি হওয়ায় পদায়ন, বসার জায়গা ও দায়িত্ব নিয়ে অনেকটা কাড়াকাড়ি অবস্থা চলছে।
সর্বশেষ গত এপ্রিলে সরকার ৮৭৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে গিয়ে আরও কয়েক শ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি‘বঞ্চিত’ করে বলেও অভিযোগ ওঠে। এই ‘গণপদোন্নতি’ নিয়ে জনপ্রশাসনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। এক পক্ষের অভিযোগ, যোগ্যতা থাকার পরও রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে অনেককে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলে আসছে, পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাই প্রাধান্য পাচ্ছে।
প্রশাসন দলীয়করণমুক্ত রাখার যে অঙ্গীকার সৈয়দ আশরাফ প্রথম কর্মদিবসে করলেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত এককভাবে তিনি নিতে পারবেন না। কিন্তু যথেষ্ট অবদান রাখতে পারেন। এই মিশন নিয়ে যদি উনি এগিয়ে যান, লেগে থাকেন, তাহলে প্রশাসনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
সাবেক ওই সচিব মনে করেন, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার অনুভূতিটাই নেই। তারা যদি এটা করত, তাহলে সরকার ও জনগণ উপকৃত হতো।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকলে প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করা সম্ভব। তবে ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে এটা করা আর সম্ভব নয়। যে মাত্রায় দলীয়করণ প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে হয়েছে, তাতে এর লাগাম টেনে ধরাটা কঠিন।’
প্রশাসনে দলীয়করণ: বর্তমান ও সাবেক একাধিক সরকারি কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নব্বইয়ের পর থেকে প্রশাসনে দলীয়করণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রকাশ্যে দলীয়করণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে জনতা মঞ্চের মাধ্যমে। তখন সাবেক সচিব মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই মঞ্চে যোগ দিয়ে আলোচনায় আসেন। পরে মহীউদ্দীন খান আলমগীর মন্ত্রী হন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রশাসনের ওই সব কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ পদ পান।
ওই সময় থেকে পদোন্নতি ও ভালো পদ দেওয়া শুরু হয় মুখ দেখে, দলীয় বিবেচনায় বলে অভিযোগ আছে। আবার তদবিরেও অনেকের পদোন্নতি হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এসব কর্মকর্তাকে ‘শাস্তিমূলক ওএসডি’ (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো বা পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়। বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও ভালো পদ দেওয়া শুরু করে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় এক সরকারের আমলে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করলে আরেক সরকারের সময়ে এসে তিনি ‘বঞ্চিত’ হন। এরপর এটি নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে।
১৯৮৪ সালের বিসিএস কর্মকর্তাদের কয়েকজন সচিব বা ভারপ্রাপ্ত পদমর্যাদায় রয়েছেন। কিন্তু এই ব্যাচের অনেক কর্মকর্তাই এখনো উপসচিব রয়ে গেছেন। তাঁদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার। জনপ্রশাসনের কোনো কোনো কর্মকর্তার মতে, এমন ভারসাম্যহীন অবস্থার মধ্যে কেউবা সামনে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন, আবার কারও কারও পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকার উপক্রম হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জনপ্রশাসনে এখন ভিন্নমতের কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরকারি দলের সমর্থকেরাই প্রশাসনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন।
গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা, এইচ টি ইমাম, যিনি সরকারের আগের মেয়াদে জনপ্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমাদের লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তার পরে আমরা দেখব।’ ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন সম্পর্কে তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রশাসনের যে ভূমিকা, নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’ এই মন্তব্যের পর সরকার বিব্রত হয় এবং তাঁকে অপসারণ করা না হলেও তাঁর কাজের পরিধি কমিয়ে দেওয়া হয় বলে দলীয় নেতারা জানান। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর সাবেক আমলা এইচ টি ইমাম প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা হিসেবে সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। প্রশাসনে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা আছে।
সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী এবং সাবেক সচিব এম কে আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন যে অবস্থায় গেছে সেখান থেকে বের করা সম্ভব, কিন্তু সেই ইচ্ছা সরকারের নেই। তবে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন দলীয়করণের অভিযোগ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির সময় দলীয়করণ কিছুটা হলেও সহনশীল পর্যায়ে ছিল। এখন প্রশাসনে দলীয়করণ যে পর্যায়ে হয়েছে, তা অতীতে কখনই হয়নি। তাই আমি মনে করি, এটা দলীয়করণ নয়, লাইসেন্স দেওয়া।’
জনপ্রশাসনে ভারসাম্যহীনতা: অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের পদ ১০৭। কর্মরত আছেন ২৬৬ জন। এক মন্ত্রণালয়ে সাধারণত একজন অতিরিক্ত সচিব থাকার কথা, কিন্তু আছেন একাধিক। অতএব, একজনের দায়িত্ব বা কাজই তাঁরা ভাগাভাগি করে করছেন, এ নিয়ে বিরোধও তৈরি হচ্ছে।
প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের ৪৩০টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন দ্বিগুণের বেশি, ৮৯৩ জন। এসব কর্মকর্তার অনেকেই বসার জায়গা পান না। একটি কক্ষে ভাগাভাগি করে বসছেন একাধিক কর্মকর্তা। পদ না থাকলেও পদোন্নতি পাওয়া এসব কর্মকর্তাকে কাজ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে শাখা, অধিশাখা, বিভাগ ও অনুবিভাগ খোলা হয়েছে। তবে এ অবস্থার মধ্যেও সুষ্ঠু ও নিয়মিত পদোন্নতি চান ভুক্তভোগীরা। পদ না থাকলেও পদোন্নতির ক্ষেত্রে সেই নিশ্চয়তা অনেকের ভাগ্যে জোটেনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদোন্নতি পাওয়া যেসব কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন, তাঁরা বেশি খুশি হয়েছেন। কারণ, এ পদগুলোকে প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও বেশি।
সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করছেন, যে বৈষম্য ও বঞ্চনা জনপ্রশাসনে তৈরি হয়ে আছে, তা ঘোচানোর উদ্যোগ নেওয়া দূরে থাক, আরও পেঁচিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জ্যেষ্ঠ অনেক কর্মকর্তাই এখন কনিষ্ঠের অধীনে কাজ করছেন। ফলে প্রশাসনে তাঁদের কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।
সংস্কার কেবল আলোচনায়: প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার পর জনপ্রশাসনে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১৮টি কমিশন বা কমিটি গঠন করে সংস্কারের নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি কখনো। বরং অপরিকল্পিত কয়েকটি বিসিএস ব্যাচের কারণে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও ভালো পদ পেতে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজেছেন বারবার।
সর্বশেষ মন্ত্রিসভা যে ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ অনুমোদন করেছে, তাতে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে অভিযোগপত্র দাখিলের আগে গ্রেপ্তারের জন্য সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই আইন প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। প্রশাসনে দীর্ঘ সময় ধরে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে দূর করার চেষ্টা চলছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, ৮৭৩ জন কর্মকর্তার পদোন্নতির পর তাঁদের পদায়নগুলো দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পেরেছে মন্ত্রণালয়।
No comments